ফেরা পর্ব-৪

0
646

#ফেরা

৪.

– মন খারাপ বাবা। মন খারাপ থাকলে সেটা শরীরের উপরও প্রভাব ফেলে।
– আচ্ছা বাবা তুমি আমাকে ঢাকার বাইরে কোথাও নিয়ে যাবে? আমার কেমন যেন এই চার দেয়ালের মাঝে দম আটকে আসে। জানালা ফাঁকা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালেই ইচ্ছে করে উড়াল দেই।
– তোমার মা যেতে দিবেনা। রাজি করাতে গেলে দেখা গেলো আমার দেখতে আসাটাও বন্ধ করে দিলো।
– ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে যাবা তাহলেই তো হয়।
– মা শুধু নিধিদের বাসায় যেতে দেয়। আর ঢাকার মধ্যে তো অনেক ঘুরেছি।
– মন খারাপ করোনা মা। তোমার মাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করো।
– বাবা চা খেয়ে নাও ঠান্ডা হয়ে যাবে।
চায়ে চুমুক দিয়ে মাহমুদ সাহেব হেসে বললেন, চা অলরেডি ঠান্ডা হয়ে গেছে।
– তাহলে তুমি ৫ মিনিট বসো। আবার বানিয়ে নিয়ে আসি।
– না লাগবেনা। এটাই হবে। ওহ হ্যাঁ তোমার জন্য কিছু গিফট এনেছি। আমি যাবার পর খুলে দেখবে। ঠিক আছে?
– আচ্ছা বাবা। বাবা আমার তো অনেক আছে। তুমিই তো সেদিন এতো কসমেটিকস এনে দিলা। সেগুলোই তো শেষ হয়নি।
– রেখে দাও। আমি মরে গেলে তো আর দিতে পারবোনা।

রাত ২ টা বেজে ১৫ মিনিটে শাজুর ঘুম ভেঙে গেলো। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। স্বপ্নটা সঞ্চয়কে নিয়ে। সঞ্চয় তাকে নিধিদের বাসার ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। একসময় ফেলেও দিলো।নিচে পরতে পরতে শাজুর ঘুম ভেঙে গেলো।
বিছানার নিচে রাখা চিঠিটা হাতে নিয়ে ছিড়ে ফেলতে গিয়েও ছিড়তে পারলোনা শাজু। সামান্য একটা চিঠি ১ সপ্তাহ ধরে তার কাছে আছে। এই অল্প দিনের মায়ায় সে চিঠিটা ছিড়তে পারছেনা। যদি সঞ্চয় তার সাথে বিট্রে করে তাহলে কী করবে সে?
সঞ্চয় তার সাথে বিট্রে করবে কীভাবে ওরা তো রিলেশনশিপেই যায়নি।
চিঠিটা আগের স্থানে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো শাজু। এপাশ ওপাশ করেই বাকি রাত পার হলো। সম্পর্কে জড়ায়নি তাই এই অবস্থা আর যদি জড়িয়ে পড়ে তখন কী হবে?
সঞ্চয়কে তার খুব বেশি ভালোলাগে। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে সেই ভালোলাগাটা আরো বেড়েছে। মনে হয় ভালো বেসে ফেলেছে। রত্না সেই ক্লাস এইট থেকে প্রেম করছে। ওর বয়ফ্রেন্ডের গল্প প্রায়ই করে। নাম যেন কী? ফাহিম হাসান। বেশ স্মার্ট ছেলেটা। স্কুলের সামনে বাইক নিয়ে আসে প্রায়।
নিধি অবশ্য প্রেম করেনা কিন্তু ও ওর কাজিনকে বেশ পছন্দ করে। ক্লাসের বেশিরভাগ মেয়েরাই প্রেম করছে।
তাহলে সে করলে দোষ কই?
বাসার সারাদিন একা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে শাজু। একাকীত্ব কাটানোর জন্য হলেও কাউকে চাই তার।

শুক্রবার সকালে নিধি এসে হাজির। শাজু অবাক হয়ে বললো
– আমিই তো যাচ্ছিলাম। তুই এলি যে?
– আমি আসতে পারিনা বুঝি?
– আমার যাওয়ার কথা ছিলো যে?
– থাক যেতে হবেনা তোর।
শাজুর মন খারাপ হয়ে গেলো। একটা সুযোগ ছিলো সঞ্চয়ের সাথে দেখা করার কিন্তু সেটাও হারালো।

মুক্তাকে দেখে নিধি সালাম জানিয়ে বললো
– আন্টি আমার আব্বু আম্মু গাজীপুর গেছেন একটা জরুরি কাজে। সন্ধ্যার আগেই চলে আসবে। শাজুকে বাসায় নিয়ে যাই? বিকালে ওকে দিয়ে যাবো।
– সামনে তো পরীক্ষা। এখন এভাবে ঘোরাঘুরি না করাই ভালো।
– আমরা তো ঘোরাঘুরি করবো না। বই খাতা নিয়ে যাবে। দুজনে মিলে পড়াশোনা করবো।
– আমি কিন্তু খাতা চেক করবো।
– আচ্ছা আন্টি।

শাজু স্কুল ব্যাগে সাধারণ গণিত আর উচ্চতর গণিত বই, দুটো খাতা, ক্যালকুলেটর, বক্স নিয়ে নিলো। গোসল সেরে রেডি হয়ে নিধিকে বললো
– আমি রেডি চল।
– ম্যাডাম আজকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে আপনাকে।
– কই?
– এইযে আপনার চোখেমুখে লেপ্টে আছে।
– হয়েছে তোর সাহিত্যের কথা রাখ।
– তা না হয় রাখলাম কিন্তু…..
দুষ্টু হাসি চেপে রাখলো নিধি।
– ম্যাডাম বাক্যের আকাঙ্ক্ষা তো পূরণ করলেন না।
– ওটা তুই পূরণ করিস। এখন চল তাড়াতাড়ি।

নিধিদের ফ্ল্যাট শাজুর খুব পছন্দ। নিধির ছোট্ট বারান্দায় অনেক ফুল গাছ আছে। ছোট্ট বারান্দার অল্প একটু জায়গা শুধু খালি রাখা হয়েছে যেন একজন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এটা অবশ্য নিধির চালাকি। ও একা বারান্দায় থাকতে ভালোবাসে। দ্বিতীয় জনের উপস্থিতি ওর পছন্দ না।
নিধির রুমে ব্যাগ রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো শাজু। নিধিটা কই গেলো? দরজা আটকাতে গিয়ে কি দরজার সাথে আটকে গেলো নাকি?
নিধি মনে হয় ড্রয়িংরুমে বসে আরামে টিভি দেখছে। আংকেল আন্টি থাকলে ১ ঘণ্টার বেশি টিভি দেখার সুযোগ হয়না। ড্রয়িংরুমে নিধিকে টিভি দেখতে দেখে শাজু বিরক্ত হয়ে বললো
– তোর বলে গণিতে অনেক সমস্যা? চল আমরা গণিত নিয়ে বসি।
– ধুর অনেক সময় আছে। আপাতত একটু টিভি দেখে নেই।
– তোর ছোটো বোনটা কই?
– ওকে আম্মু আব্বুর সাথে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওর জন্য আমি নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারিনা। নালিশ করে দেয়।
কলিং বেল বেজে উঠায় নিধি লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলো।
কথাবার্তায় শাজুর মনে হলো সঞ্চয় এসেছে। সঞ্চয়কে ড্রয়িংরুমের দিকে আসতে দেখে শাজু দ্রুত নিধির রুমে চলে গেলো।
সঞ্চয়ের সামনে যেতেই লজ্জা লাগছে ওর।
শাজুকে এভাবে পালিয়ে যেতে দেখে সঞ্চয় মন খারাপ করে বললো
– নিধি ও আমাকে দেখে সরে পড়লো ক্যান রে?
– লাজুকলতা বুঝেছিস? আমার এই ফ্রেন্ড হচ্ছে লজ্জার ভাণ্ডার।
– এখন আমি কী করি?
– আচ্ছা ছেলে আমি না তুই?
– আমি।
– প্রেমটা কে করবে? তুই না আমি?
– আমি।
– তাহলে আমাকে কেনো বলে দিতে হবে?
– ও তো আমার সামনেই আসছেনা।
– একটা কাজ কর ও আমার রুমেই আছে। সোজা রুমে ঢুকে যা।
– রাগ করবে না তো?
– ধুর যা তো। আমাকে টিভি দেখতে দে।

সঞ্চয় কী করবে বুঝতে না পেরে নিধির রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। শাজু বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে গণিত করছিলো।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সঞ্চয় ভয়ে ভয়ে বললো
– চিঠির উত্তর যে দিলেনা!
শাজু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
– দিয়েছি তো।
– সরাসরি লিখলেই তো পারতে।
শাজু কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না।
শাজুর পাশে বসে সঞ্চয় বললো
– এই মেয়ে গণিত পরেও করা যাবে কিন্তু এই সময় আর পাবেনা।
– এজন্যই তো এখন করছি। সামনে এক্সাম, সময় তো আর বেশি নেই।
– তুমি এমনিতেই ফার্স্ট হবে। এখন এসব রাখো।
কথাটা বলে শাজুর বই আর খাতা কেড়ে নিয়ে বিছানার উপর রেখে দিলো সঞ্চয়।
– অনেক পড়া হয়েছে। এখন গল্প করার সময় বুঝতে পারছো?
– আপনি এখানে কেনো? কেউ দেখে ফেললে বিপদ হবে।
– দেখে ফেলার মতো যে আছে সেই এখানে আমাকে পাঠিয়েছে।
– মানে?
– নিধিই পাঠিয়েছে।
– ওহ।
শাজু চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।
সঞ্চয়ও উঠে দাঁড়িয়ে শাজুর হাত ধরলো।
প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শে শাজুর পুরো শরীরে বিদ্যুতের ঝটকা লাগলো।
– দেখো শাহাজাদী আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিন্তু নিরিবিলি গল্প করার সময় খুবই কম পাবো। তাই বলছি এখন আমরা গল্প করি।
– আমার হাত ছাড়ুন।
– আরে হাতটাই তো ধরেছি শুধু।
– আমার এসব ভালো লাগেনা।
সঞ্চয় ওর দুহাতের মাঝে শাজু মুখ তুলে নিলো। লজ্জায় শাজু লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো খোলা রাখতে না পেরে বন্ধ করে আছে। নিশ্বাস পড়ছে খুব ধীরে ধীরে পড়ছে।
সঞ্চয় মুচকি হেসে বললো
– কী ম্যাডাম এখন এতো লজ্জা পাচ্ছেন কেনো? কী যেন লিখেছিলেন আপনি – প্রেয়সীর চোখে চোখ রেখে ভালবাসি তোমায় বলার সাহস যার নেই, সে কি সত্যিই ভালোবাসতে জানে?”
আমি তো ঠিকই প্রেয়সীর চোখে চোখ রাখার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু প্রেয়সীই তো সেই সুযোগ দিচ্ছেনা।
শাজুর গলার কাছে কিছু একটা আটকে গেছে। কোনোভাবেই সরাতে পারছেনা। বুকের ভেতরটা হাসফাস করছে প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর তার আছে কিন্তু কী যে হলো হঠাৎ করে!
কোনো উত্তর না পেয়ে সঞ্চয় বললো
– থাক তোমাকে চোখ খুলতে হবেনা।
শাজুর চিবুকে চুমু দিয়ে সঞ্চয় মুচকি হেসে বললো
– ভালোবাসি।
সঞ্চয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে প্রায় দৌঁড়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসে পড়লো।
শাজুকে আচমকা এভাবে দৌঁড়ে আসতে দেখে নিধি চিন্তিত হয়ে বললো
– কিছু হয়েছে?
– না।
– তাহলে এভাবে আসলি কেনো?
– তুই ওনাকে পাঠিয়েছিলি কেনো?
– ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার। তাহলে আমি রুমে যাচ্ছি। সঞ্চয় এখানে আসুক। তোরা টিভি দেখতে দেখতে গল্প কর।
– না। তুই থাক।
– তাহলে এটা কোনো প্রেম হইলো?
সঞ্চয় ছোট্টো সোফায় বসে টিভি দেখায় মন দিলো।
– জানিনা।
নিধি হাসতে হাসতে বললো
– দেখা যাবে যে তোদের বাসর ঘরে আমাকে মাঝখানে বসায় রাখলি।
সঞ্চয় হো হো হো করে হাসতে শুরু করলো। শাজু দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।
নিধি হাসি থামিয়ে বললো
– নে ভাই তোর লজ্জাবতীকে নিয়ে গল্প কর। আমার ঘুম আসছে ঘুমাবো।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here