ফেরা পর্ব-৫

0
549

#ফেরা

৫.

রাতে শাজুকে সামনে বসিয়ে খাতা চেক করছিলো। মাত্র ১০-১২ টা অংক করেছে সারাদিনে। বিস্মিত হয়ে মুক্তা জিজ্ঞেস করলো
– এতো কম অংক কেনো?
– নিধির গণিতে অনেক সমস্যা ছিলো। ওর খাতায় আমি বুঝানোর সময় করে দিয়েছিলাম। আবার ফিজিক্স টাও রিভিশন দিলাম।
– তোমার জন্য একজন টিউটর পেয়েছি।
– ম্যাডাম নাকি স্যার?
– ম্যাডাম। তার সাথে কোনোরকমে গল্প করবেনা। পড়ার সময় তুমি আগের ম্যাডামদের সাথে গল্প করতে। এবার যদি করো তাহলে তোমার পড়াশোনাই বন্ধ করে দিবো।
– ঠিক আছে মা।

অফ পিরিয়ডে শাজু, রত্নার গল্প শুনছিলো নিধির কাছে। রত্না নাকি ওর বয়ফ্রেন্ডের বাসায় যাওয়া আসাও করে। ওর বয়ফ্রেন্ডের মা নাকি ওকে খুব পছন্দ করে। শাজু অবাক হয়ে বললো
– রত্নার মা জানেনা?
নিধি ভ্রু কুঁচকে বলে
– মাথা নষ্ট নাকি? ও যে পরিমাণ চালাক ওর সাথে কেউই পারেনা।
আর জানিস ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে লিপ কিসও করেছে।
– কী বলিস??? প্রশ্নটা করে শাজু শুক্রবারের কথা মনে করলো। সঞ্চয় ওকে গালে চুমু দিয়েছে কিন্তু ঠোঁটে না। গালে দিয়েছে তাতেই লজ্জায় ওর অবস্থা খারাপ ঠোঁটে….. ভাবতেই কেমন লাগে!
– হ্যাঁ সত্যি।
– তুই কীভাবে জানলি?
– আমি সবার খোঁজ রাখি। তোমারও রাখি।
– আমি ওসব করিনি। আচ্ছা তোর সেই কাজিনের কী খবর রে? প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য শাজু এই প্রশ্নটা করলো।
নিধি মুচকি হেসে বললো
– ভাইয়া আমাকে বলেছে, তুই আগে আরেকটু বড় হ। এতো পিচ্চি মেয়ের সাথে আমি প্রেম করিনা।
– তারমানে সে প্রেম করে?
– করবেনা কেনো? অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়তেছে আর করবেনা প্রেম!
– তুই সত্যি করে একটা কথা বলবি?
– না মিথ্যা করে বলবো।
– সত্যিই দোস্ত।
– আচ্ছা যা বলবো।
– সঞ্চয় কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে?
– আমার তো তাই মনেহয়। তারপরও তুই একটু কথাবার্তা বলে দেখ। বুঝোস কিনা!
– আমি কীভাবে বুঝবো?
– সেটাও কথা। ফাহাদের কাছ থেকে শুনে জানাবো। ও তো এইচএসসি পরীক্ষার আগেই হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলবে শিওর।
– ফাহাদ কে?
– আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। সঞ্চয় তোর সেল নাম্বার চাচ্ছে।
দিয়ে দিবো?
– মা যদি বুঝতে পারে?
– আন্টি তো সারাদিন ধরা যায় থাকেনা। থাকে শুধু রাতে আর সকালে। আর আন্টি তোর কোনো কিছুই তো আমার মায়ের মতো চেক করেনা।
– মা আমাকে খুব বিশ্বাস করে। আমার মনে হয় সঞ্চয় এর সাথে জড়ানো ঠিক হচ্ছেনা। আম্মু খুব কষ্ট পাবে।
– সঞ্চয় তো আর বখাটে না। ভালো স্টুডেন্ট, ভদ্র ছেলে। ক্যারিয়ার ভালো হবে। এতে আন্টির কষ্ট পাওয়ার কিছুই নেই।
– তারপরও।
– তাহলে বাদ দে। আমি সঞ্চয়কে বলে দিবো তুই সম্পর্ক রাখতে চাস না।
শাজু একটা ধাক্কা খেলো। সঞ্চয়ের সাথে দুদিন যাবত তেমন কথা হচ্ছেনা তাতেই কেমন খারাপ লাগছে আর যদি একেবারেই কথা না হয় তখন? তখন সে থাকবে কীভাবে?
নিধি গম্ভীর স্বরে বললো
– এখনো সময় আছে দোস্ত। এখনো ১ সপ্তাহ হয়নি তোদের সম্পর্কের। ব্রেকাপ করে ফেললে তেমন একটা কষ্ট হবেনা। ভেবে দ্যাখ। শুধু শুধু সময় নষ্ট করা।

শাজু পুরো ক্লাস জুড়ে তেমন একটা কথা বললো না। নিধির কথায় যুক্তি আছে। এখন ব্রেকাপ করলে তেমন কোনো কষ্ট হবেনা কিন্তু পরে কষ্ট হবে।
সঞ্চয়ের হাসি মুখের ছবি চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। কতোটা অনাবিল সেই হাসি!
অনেক সুন্দর ছেলেটা। কথা যখন বলে তখন শাজুর মনে হয় একটা সুর বাজছে ধীরগতিতে!
যখন হাসে তখন ইচ্ছা করে হাসিটাকে বোতল বন্ধী করে রাখতে। অদ্ভুত অনুভূতি!
কী করবে ভেবে পাচ্ছে না শাজু!

রাতের খাবার শেষে মুক্তা ছোট্ট ব্যাগে কিছু একটা শাজুর হাতে দিয়ে বললো
– তোমার জন্য এনেছি। আগামীকাল সকালে তোমার ম্যাডাম আসবে।
– আচ্ছা।
মুক্তা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর শাজু ছাদে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। আকাশে আজকে একটাও তারা নেই। চাঁদটাও দেখা যাচ্ছেনা। অর্থাৎ আমাবস্যা চলছে! ঘন অন্ধকারের মধ্যে কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখলো শাজু। মানুষের অবয়বের মতো কালো রঙের অবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসছে।
শাজু চিৎকার দিতে গিয়ে বুঝতে পারলো কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। রাত ১২ টার মতোই বাজে। এইসময় এই ছাদে আসাটা ঠিক হয়নি তার। এদিকটা এমনিতেই নীরব লোকজন কম আসে।
একটু নড়তে পারছেনা। অবয়বটা কাছে আসার পর শাজু আরো বেশি চমকে উঠলো।
মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বের হয়ে আসলো
– সঞ্চয় আপনি?
সঞ্চয় দ্রুত শাজুর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো
– আস্তে কথা বলো। আন্টির ঘুম ভেঙে যাবে।
হাত সরিয়ে নিলো সঞ্চয়।
শাজু ফিসফিস করে বললো
– আপনি এখানে কেনো এসেছেন? কেউ দেখে ফেললে আমি বিপদে পড়বো।
– এসেছি কারণ তুমি বাধ্য করেছো।
– আমি কী করলাম? আমি বাধ্য করবো কেনো?
– নিধি বললো তুমি ব্রেকাপ করতে চাচ্ছো। শাহাজাদী আমি কী দোষ করেছি যে, তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছো?
– মা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে তাই।
– তাহলে হ্যাঁ বলার আগে কেনো ভাবোনি? আমি তখন ঠিকই মেনে নিতাম কিন্তু আমি এখন মানতে পারছিনা।
– মা কষ্ট পেতে পারে আজকেই বুঝতে পারলাম। আর ১ সপ্তাহও তো হয়নি। ব্রেকাপ করলে তেমন কষ্ট হবেনা।
– উঁহু শাহাজাদী। তুমি ব্রেকাপ করবা শুনেই আমার অবস্থা এতো খারাপ হয়েছে যে,আমি বিল্ডিংয়ের পাইপ, জানালা বেয়ে তোমাদের ছাদে চলে এসেছি এটা জেনে যে ধরা খেলে কপালে শনি আছে। আর ব্রেকাপ করলে আমি মরে যাবো।
অল্পবয়সী মেয়েদের কাছে এটুকুই কথা যথেষ্ট ব্রেকাপ না করার জন্য।
শাজুর চোখের কোণে ভিজে উঠেছে। সেও তো পাগলের মতোই হয়ে গেছে। কী করবে এখন?
– শাহাজাদী কিছু তো বলো।
– ব্রেকাপ করবো না। এখন আপনি যান।
সঞ্চয় হেসে বললো
– সত্যি?
– হ্যাঁ এক সত্যি, দুই সত্যি, তিন সত্যি!
– তাহলে আমাকে একটা চুমু দাও।
শাজু লজ্জা পেয়ে বললো
– কেনো?
– এইযে খুশির খবর দিলে।
– খুশির খবর দিয়েছি এটাই অনেক। ওসব দিতে হবেনা।
– না হবেনা। এখনই দিতে হবে।
সঞ্চয় ওর গাল এগিয়ে দিয়ে বললো
– তাড়াতাড়ি করো। আন্টি চলে আসবে।
শাজু দ্রুত চুমু দিয়ে বললো
– এখন যান।
– আবার আসতে বলবা না? বাসায় মেহমান আসলে সবাই তো বলে, ‘ আবার আসবেন! ‘
– না, আপনি আসবেন না। অন্য কোথাও দেখা করা যাবে,কিন্তু আপনি বাসায় আসবেন না প্লিজ।
– মাসে একবার তো আমি আসবোই যতই না করো।
সঞ্চয় যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই চলে গেলো। ঘন অন্ধকারের মধ্যে ধীরে ধীরে মিশে গেলো।
কীভাবে কী হলো শাজু বুঝতেই পারলো না। সময়টা খুব দ্রুত পার হয়ে গেলো কিন্তু একটু আগেও যেন সময় ফুরাচ্ছিলো না।
রাতের ঘুমটা বেশ ভালোই হলো। সকালে নতুন ম্যাডাম আসলেন।
শাজু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ম্যাডামের দিকে। তার মায়ের চেয়েও বয়স বেশি কিন্তু এতো বেশি মেকাপ করেছে যে দেখতে বিশ্রী লাগছে। সকালে কেউ এইভাবে মেকাপ করে বের হয় নাকি। ম্যাডামকে তার রুমে গিয়ে চেয়ার টেনে বসতে দিয়ে নিজে চেয়ার পেতে বসলো। ম্যাডাম বললেন
– আমার নাম সালমা সুলতানা। তোমার নাম কী?
– শাহাজাদী।
– অচেনা কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে পুরো নামটা বলতে হয়।
– সুমি মাহমুদ।
– তোমার ক্লাস রোল কতো?
– ১।
– শুনো আমি তোমাকে রসায়ন আর জীববিজ্ঞান পড়াবো।
– আচ্ছা।
সালমা ম্যাডাম পড়ানো শেষ হয়ে গেলে মুক্তা চা নাস্তা নিয়ে এলেন।
শাজু চেয়ার ছেড়ে উঠে মায়ের রুমে চলে গেলো।
সালমা চলে যাবার পর মুক্তা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন
– কেমন পড়ায়?
শাজু ভয়ে ভয়ে বললো
– ওনার পড়া আমি কিছুই বুঝি নাই মা।
– মানে?
– শুধু রিডিং পড়ে যায় কিন্তু বুঝায় না। না বুঝালে আমি বুঝবো কীভাবে?
– তুমি এটা তাকে বলতে পারলে না?
– বলেছিলাম কিন্তু সে কথাটাকে গুরুত্ব দেয়নি।
মুক্তা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন
– আর কয়টা দিন পড়ে দেখো। হতে পারে আজকে প্রথম দিন তাই বুঝোনি।
– আচ্ছা মা।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here