###বক্ররেখা(১ম পর্ব)
###লাকি রশীদ
নামাজ পড়ে সকালে অনেকক্ষণ হেঁটে ঘরে আসি আমি। আমার ছোট বোন বকুল আজ যায়নি বলে একা একা ছিলাম। ভয় ভয় লাগছিল যেন।
ঘরে ফেরার পথে মনে মনে হাসছি, বিগত ২ বছর ধরে একা থেকেও এখনো একা থাকার ভয় !!!!
আমার বড় নাতি রায়ান যে ক্লাশ থ্রীতে পড়ে সে মাঝে মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলবে, দাদী তুমি সবচেয়ে বেশি কাকে ভালবাসো সত্যি করে বলো তো? আমি রাজনীতিবিদদের মতো ঝামেলা না করে আপাতত যে সামনে আছে তার নামই বলি। তখন সে আমার কুঁচকানো চামড়ার হাত ধরে বলে, তুমি মিথ্যে বলছো না আমি জানি। তুমি তো মিথ্যে বলা পছন্দ করো না। আমি তখন মনে মনে হাসি, এই পৃথিবীতে শতভাগ শুদ্ধ কিছু আছে নাকি? ষাটোর্ধ্ব এই জীবনে সেকেন্ডে সেকেন্ডে, পলে পলে যা খোঁচা দিয়ে স্মরণ করায় আমাকে।
দুই ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে আমার ভরভরন্ত সংসার। ছেলে দুটো ও মেয়েদের সবার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। সবার আর্থিক অবস্থাও মাশাআল্লাহ ভালো। কিন্তু খুব ভালো করেই জানি ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ঘরের আবহাওয়া দিন দিন দুষিত হচ্ছে। বাইরে থেকে কুশীলবদের সুখী মনে হলেও কখন তাসের ঘর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে তা কে জানে !!!! ঘরে ঢুকে চায়ের সসপ্যানে পানি বসাই। এবার শীতে কিরকম চোরা ঠান্ডা একটা বাতাস যেন মিশে আছে। আমার ভেতরের হাড়গোড় সুদ্ধু কাঁপিয়ে দিয়ে যায় যেন। না কি ভুল বললাম, প্রতিবারই এরকম হতো। কিন্তু সম্পর্কের উঞ্চ বেড়াজাল তাকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখত। তাই আগে হয়তো কখনো কাঁপাতে পারেনি।
লাল চা খাই আমি, হামানদিস্তায় আদা কিছুটা ছেঁচে ছেড়ে দেই। এবার আর এলাচি ও লং এর কৌটা খুঁজে পাই না। নাতিনাতনি দের নুডুলসের সাথে ফ্রি পাওয়া একটি কৌটায় থাকে এগুলো। ইদানিং অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে সবকিছু যেন ভ্যানিশ হবার নেশায় মেতেছে। আপনমনে নিজেকে নিজেই বলি,থাক নাজমা বেগম এতো খোঁজার দরকার নেই। একবেলা এলাচি ও লং না খেলে পৃথিবীটা মোটেই উল্টো পাল্টে যাবে না। নোনতা বিস্কুট মুখে দিয়েই মনে হলো, কি এক মধুমেহ রোগ হলো জীবনের সব মধু কেড়ে নিয়ে বিস্বাদে জিহ্বা ভরে দিয়েছে যেন। মুড়িও চিবোতে কষ্ট হয়। কিছু করার নাই………….. বয়সের থাবা হয়তো একেই বলে।
নীরব নিস্তব্ধতার মধ্যে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে না। সারাজীবন একা থাকতে ভালো লেগেছে কিন্তু ইদানিং কেন যেন ভয় ভয় লাগে। ঠিক বুঝতে পারি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জরিনা চলে আসবে।
আর শুতেও ইচ্ছে করছে না। সুতরাং তসবিহ পড়া ই ভালো। শীতে কাঁপতে কাঁপতে জরিনা এসে ঢুকলো। বকা দেই, কি রে কাঁপছিস কেন? তোর চাদর কই? সে হেসে এড়িয়ে যায়,কাম করা শুরু অইলে কই যাইব শীত আম্মা। গরম লাগা আরম্ভ অই যাইব। এবার হালকা ধমক দেই,যা বলছি তার উত্তর দে। চাদর কোথায়?
ডাইনিং টেবিলের গ্লাসপেপার মুছতে মুছতে মৃদু স্বরে বললো, কি করুম পোলাটা ঠান্ডার মধ্যে উঠে বিয়ানবেলায় কামে যায়। হের নাকি একটাও গরম কাপড় নাই,আমারে কয় তোমার চাদ্দর আমারে দিলাও। মন মানে না, পোলা ঠান্ডায় কুনু
শক্ত বেমার বান্ধাইলে কি অইবো? তাই তারে
দিলাইছি। আমি মুখে বলি, খুব ভালো কাজ করেছো। নিজে নিমোনিয়া বাধাও আর ছেলেকে ঠান্ডা থেকে বাঁচাও। কিন্তু মনে মনে বলি, এজন্যই তো আমরা মায়েরা মরি। বাচ্চার কষ্ট ভেবে ভেবে জীবনপাত করি তারপর তাদের কথার খোঁচায় বুকের রক্তক্ষরণে আবার কাঁদি।
মনে পড়ে গেল, আমার ছোট ছেলে সজলের এইচএসসি পরীক্ষার দিন কি বৃষ্টি ছিল। ওর বাবা সময়মতো দোকানে চলে গেছে। আমি চিন্তায় শেষ, রাস্তার পরিধি এতো কম ছিল রিক্সা ছাড়া অন্য কিছু যাবে না। রিক্সায় বসে ছাতা টা দিয়ে পুরোপুরি তার মাথা ও শরীর ঢাকি। তখন সে চেঁচাচ্ছে,মা তুমি যে ভিজছো তোমার টনসিল ফুলে জ্বর আসবে তো। আমি হেসে বলি, আমি এক্ষুনি বাসায় চলে যাচ্ছি বাপ। গিয়েই কাপড় বদলে নেবো। কষ্ট করে ছাতা ধরে রাখি, একবিন্দু জলও ছেলের মাথায় পড়ে যেন মাথাব্যথার কারণ না হয়। সেই ছেলে কতো হারামি হয়েছে, দরকার ছাড়া কথা ই বলে না। এতো ব্যস্ত থাকার ভান করে যেন সে ছাড়া বাংলাদেশের হাসপাতাল গুলোতে ডাক্তারের অভাব লেগে যাবে, কোথাও কেউ চিকিৎসা পাবে না। হিসেব মেলাতে পারিনা, ওদের বাবা বা আমি কেউই তো এত তো হারামী নই। আপনজনের আপদে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
বড়বৌমা উঠেছে,চা বানাতে গিয়ে টুকটাক শব্দ হচ্ছে। আর তক্ষুনি পুরো বাড়ি যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সবার স্কুল,কলেজ, দোকান ও হাসপাতালে যাবার তাড়া কাজ করছে। দারোয়ান সকালে সব্জির বাজার করে দেয়। রান্নাবান্না আগে
বড়বৌমা ও আমিই করতাম। ওদের বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বুঝতেই পারিনি কিভাবে যেন শাড়িতে আগুন লেগে যায়। তারপর থেকে সবার বারণে আর রান্না করিনি। ইদানিং লবণ ও মসলার আন্দাজও যেন পাই না। হয় বেশি না হয় কম দিয়ে দেই।
নাঈম আমাদের গ্ৰোসারিশপে বসে। অনেক চেষ্টা করে , সাথে সাথে থেকে থেকে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে আমি ওকে গ্ৰ্যাজুয়েশন করিয়েছি। পড়ালেখায় কোনো মন ছিল না। বাধ্য হয়ে ক্যাশে বসিয়ে আস্তে আস্তে কাজ শিখিয়েছে ওর বাবা। পরে আমাদের পাশের গ্ৰামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মেহেরকে পুত্রবধূ করে আনে। বৌমা এইচএসসি পাস। হাতে ধরে আমি ঘরকন্নার কাজ শিখিয়ে, পড়িয়ে এক্সপার্ট গৃহিণী বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ছোট বৌমা শায়লা ডাক্তার। ভুলেও এককাপ চা বানিয়ে খায় না বা হাজবেন্ড কেও খাওয়ায় না। মেহেরের এটা নিয়ে মনে দুঃখ লাগতে পারে ভেবে আমিই তার কাজের সাহায্য কারী হয়ে যাই।
কিন্তু বড় বৌমা ওর শশুর মারা যাওয়ার পর আর রাঁধতে চায় না। এক সকালে দেখি সে রাগে বাসনকোসন আছড়ে আছড়ে রাখছে। কি হয়েছে দুইবার বলার পরও কিছু বলে না। বড় ছেলে নাঈম টেবিলে বসে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বলে, কি আবার হবে? খুব ই সিম্পল ব্যপার মা। তুমি কেন বুঝতে পারছো না আমি বুঝিনি।
ও শুধু একা একা সারা পরিবারের রাঁধবে কেন? তোমার ওই বৌ তো রান্নায় হাতও লাগায় না। ডাক্তার বৌ হলে কি রাঁধা বারণ নাকি ? তাই আমি মেহের কে বলেছি রান্নার লোক দেখার জন্য। ছেলের কথার খোঁচায় মনে হচ্ছে এই সবকিছুর মূলে আমিই আছি। আমার আবার একটা মহা সমস্যা আছে। কখনো কারো কড়া কথা শুনলে আমার শরীর খারাপ লাগে। সেজন্য আমার বাবা বলতেন, তুমি এ কঠিন পৃথিবীতে খুব ই আনফিট মা।
আমার উচিত ছিল সাথে সাথে নাইমকে জিজ্ঞেস করা, রান্নার লোক রাখতে চাইলে রাখ না। আমার সাথে চেঁচাচ্ছিস কেন? আর ভাইয়ের বৌ না রেঁধে খায় কেন………. সেটা তুই ওদেরকে গিয়ে বল। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বলতে পারি নি। কারণ ৪২ বছরের সংসারে এই প্রথম আমার সন্তান বিনা দোষে সম্পুর্ন অন্যায় ভাবে আমার সাথে গলা তুলে কথা বলছে।
নাঈমের একটাই ছেলে, সজলের ছেলে মেয়ে দুটি সন্তান। একই স্কুলে পড়ে বলে ৮,৫ ও ৩ বছরের তিন নাতি নাতনিকে আমিই স্কুল থেকে আনি। সজলের বাচ্চাদের জন্য বুয়া রাখা আছে। শুধু ছোট বৌমার অনুরোধ থাকে,মা ওদের মাঝে মাঝে একটু খেয়াল রাখবেন। আমার অভিধানে আবার কখনো কখনো বা কিছু কিছু বলে কোনো কিছু নেই। খেলো কিনা,ঘুমালো কি না একটু পর পর দেখি গিয়ে। আর রায়ান তো ছোট থেকে আমার বিছানায় ই ঘুমায়। ওর মা অনেক সুন্দর করে আলাদা রুম সাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওর সেই এক কথা,দাদীর জর্দার খুশবু আমার নাকে না ঢুকলে ভালো লাগে না। বড়বৌমা তো এখন অনেক সাহসী হয়ে গেছে। আমাকে শুনিয়েই বলে
খুশবু না গন্ধ বল্। রায়ান তখন কি বুঝে আল্লাহ মালুম। সে চিৎকার দেয়, না খুশবু। আমার দাদী কে খবরদার বকবে না। ওর মা অবাক হয়ে বলে,
বকলাম আবার কোথায়? বেশি পাকা হয়ে গেছো তুমি। আমার মেরুদন্ডহীন বড়ছেলে এসব দেখে শুনেও অন্ধ ও বধির হয়ে থাকে। যেন সে এখানে অদৃশ্য হাতের মুদ্রায় এক নাচনেওয়ালা।
ভাবতে থাকা অবস্থায় ই সবাই ব্রেকফাস্ট করতে টেবিলে বসে পড়েছে। আমি এখন আর কিছু খাই না। দশটার দিকে রুটি খাবো। তাই উঠে তাজা তাজা লাইপাতা গুলো বেছে, ধুয়ে পানি ঝরাতে ঝাজরিতে রাখি। চিকন করে কেটে ভাজা কয়েক টুকরো বড়মাছ বেছে ভর্তা করলে নাঈমের আর কিছু লাগে না। ছোটবেলা থেকেই শীতে ওর প্রিয় খাবার এটা। সজলের প্রিয় ফুলকপি টা কেটে লবণ পানিতে ডুবিয়ে রাখি। এতে পোকাগুলো বের হয়ে আসে। আমাদের মনের ক্ষতিকর সব পোকাগুলো যদি এরকম বের করার উপায় থাকতো তবে খুব ভালো হতো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি,সময় হয়ে গেছে। এসে বাকিগুলো কুটবো, উঠে মাথায় বড় উড়না জড়িয়ে পিচ্চিদের নিয়ে গাড়ির দিকে রওনা হই।
দুপুরে বড়বৌমা চ্যারিটির টাকা তুলতে কোথায় গেছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে বলে সমস্ত বাসা নীরব নিস্তব্ধ। ভেজা চুল শুকাতে বারান্দার এক চিলতে মিঠে রোদ গায়ে লাগিয়ে বসে আছি। ঠিক সেসময় আমার ছোট জা এর ফোন এলো, মনে আছে ভাবী আগামী মাস কিন্তু অগ্ৰহায়ন মাস। ধান কাটা শুরু হবে। বেশি না হলেও ১৫ দিনের জন্য চলে আসেন। আমি হেসে বলি, এখানে আমি না থাকলে সংসার অচল হয়ে যাবে মায়মুনা। সে এবার মিনতি করে এক সপ্তাহের জন্য অন্তত আসতে বলছে। আমি জানি ওরা স্বামী স্ত্রী কৃতজ্ঞতা দেখাতে আমাকে মাথায় তুলে রাখতে চায়।
কিন্তু আমি মনে মনে হাসছি, মেয়েদের বাসা একই শহরে থাকা সত্ত্বেও দুদিনের জন্য যেতে পারি না। ওরা এলেও এরা মুখে স্পষ্টতই বিরক্তি দেখায় বলে মেয়েগুলো আসতে চায় না। শুধু বড় জামাই রনি কোনো কথা শুনে না। মাসের প্রথম শুক্রবার একটা না একটা দরকারি জিনিস নিয়ে দেখতে আসবেই। ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া, ঔষধ কিনে দেয়া…… জোর করে এসব করবে। মানা করলেই বলবে, আমি তো আপনাকে আমার মা ই ভাবি। বুঝি না আপনি কেন এতো সংকোচে ভুগেন। আমি করুণ হেসে বলি, আমি তো তোমাকে মনের খুশি মতো চারটা ভাতও খাওয়াতে পারি না। নিজের হাতে কোনো ক্ষমতা না থাকলে যা হয়রে বাবা। ও এবার বলে, বিয়ের পর থেকে বাবা মারা যাওয়া পর্যন্ত আপনি আমাকে কম খাইয়েছেন না কি? আপনার ছোট জামাই বরং এর অর্ধেকও পায়নি। আমাকে আমার কর্তব্য করতে দিন মা প্লিজ। এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।
ইদানিং বড় বৌমাও কি সব সমাজ সেবা সংস্থায় যোগ দিয়েছে। প্রায় সারাদিন ই ব্যস্ত থাকে। আমি বুঝি এতদিনে সে মনে হয় নিজেকে আর শুধু গৃহবধূ ভাবতে রাজি নয়। আমিও খুশি,তাকে মনে দুঃখ পুষে রাখতে না দেখে। এতো দিন হয়তো বা শশুরের ভয়ে বলেনি মেয়েটা। জা ও ননদের কর্মজীবী হিসেবে দেখে হয়তো নিজেকে অনেক ছোট মনে হতো। মনে শান্তি না থাকলে কি আর সংসার ভালো লাগে? বুকটা হাহাকারে ভরে যাবে না? তাই আমি কিছু বলি না, সংসার যেভাবে চলছে সেভাবেই না হোক চলুক। বলে আর কি ই বা হাতিঘোড়া উল্টাবে !!!
রাতে খেতে বসে আর এক নাটক। দিনে রাঁধা চিকেনের চার টুকরো আছে মাত্র। শায়লা এবার চেঁচাচ্ছে টাকা দেবার সময় বেশি দিবো আমরা আর আমাদের বাচ্চাদের খাওয়া কম থাকবে? মেহের তীক্ষ্ম স্বরে বললো এতো সমস্যা হলে খালাকে বলে গেলেই তো হয়। ও পক্ষের জবাব আমি বলবো কেন? সবসময় তো আপনিই বলেন,
না পারলে আমাকে বলতেই তো পারেন। এজন্যই
সজলকে বলেছিলাম এভাবে একসাথে থাকা আর সম্ভব নয়। কিন্তু ও আমার কথা শুনলে তো। আমি এবার হাল ধরি, কি শুরু করলে তোমরা? সামান্য চিকেন নিয়ে তোমাদের বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া করছো !!! চুপ করো তো সবাই। কিন্তু আমি বেশ জানি,এখন চুপ করলেও যে আগুন লেগেছে তা আর নিভবে না। এটা জ্বলতে জ্বলতে খুব শীঘ্রই আমার এতো দিনের গড়া সুন্দর সংসার টা ছারখার করে দিবে।
(রিপোষ্ট)
###চলবে