বক্ররেখা(১০ম ও শেষ পর্ব) ###লাকি রশীদ

0
195

###বক্ররেখা(১০ম ও শেষ পর্ব)
###লাকি রশীদ

আজকে রোদ যেন একেবারেই লজ্জাবতী লতা হয়ে লুকিয়ে রয়েছে। বের হতে ভয় লাগছে যেন ওর। আমার এমনিতেই অনেক ঠান্ডা লাগে। যত দিন যাচ্ছে, শরীর ঠিক ততটাই নরম হয়ে যাচ্ছে।তাও ভালো আল্লাহ রহম করায় এবার এখনো ঠান্ডা লাগেনি। নয়তো কাশি,গলাব্যথা আর পিছন ছাড়তো না। সফরে এসে অসুস্থ হওয়াটা আমার
কাছে ভীষণ কষ্টকর মনে হয়।

আমি ও বকুল, রাত্রি ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে হোটেলের সামনে অনেকক্ষণ হেঁটে এলাম। রুমে ফিরবো বলে যখন হোটেলের সামনে এসে পড়েছি তখন এক রিক্সাওয়ালা বকুলকে জিজ্ঞেস করছে, আপনারা পইঞ্চা আর নানরুটি খাওয়াত যাইতা নি এক হোটেলো(আপনারা কি নেহারি ও নানরুটি খেতে যাবেন)? বকুল এবার বলছে,এখান থেকে কত দূরে। উনি বলছেন,১০ মিনিট লাগবো। আমি এবার বাধা দেই, আমরা সিলেটে আসা অব্দি হাঁস মুরগি পরোটার উপরেই আছি। এরমধ্যে আবার নেহারি !!! কোনো দরকার নেই, চল্ আর এক ঘন্টা পর তো হোটেলেই বিনা পয়সায় নাস্তা দিবে।

রাত্রি এখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঠিক সেইসময় ফোন সংকেত দিলো, কেউ আমাকে চাচ্ছে। দেখি লুনা ফোন দিয়েছে, আমি এতো করে মা আমার এখানে এসে কয়েকটি দিন থাকো বলে বলে টায়ার্ড হয়ে গেছি। তুমি আসবো আসছি বলে বুঝ দিয়ে দিয়ে আসলে না। আর এখন ৪ দিন ধরে ছোট মেয়ের সাথে সিলেটে ঘুরছো !!! আমি বলি,
আসবো তো। এবার ঢাকা গিয়ে আমি বাসায় যাবার আগে তোর ওখানে উঠে যাবো। কথা শুনে চেঁচাচ্ছে, সত্যি বলছো মা? আমি হেসে বলি রনি কে বলিস্,ও ভীষণ খুশি হবে। মেয়ে এবার সময় বেঁধে দিতে চাইছে, তোমরা তো কালকেই ফিরবে ইনশাআল্লাহ। পৌঁছেই আমাকে একটা ফোন দিও
মা, রনি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে। আমি ঠিক আছে বলতেই ও বললো খালাকে দাও।

বকুলকে বলছে তুমি আবার বাসায় চলে যেও না। একসাথে সবাই মিলে মজা করবো ক’দিন। উত্তরে বকুল বললো, হবে না রে। আমার বিরহে তোর খালুর প্রান উষ্ঠাগত প্রায়। কখন পৌঁছাতে পারি সময় বলে দিয়েছি। রাত্রির বাসায় গিয়ে অপেক্ষা করবে বলেছে। লুনা এবার বলছে,বাবারে বাবা !!!
এতো দেখি গভীর প্রেম। বকুল হাসছে,হ্যা অকুল
অফুরন্ত প্রেম আমার জন্য তার বলতে পারিস।

আটটার দিকে রাত্রি উঠলে নীচে গিয়ে নাস্তা করে আসলাম। রুমে এসে ওকে লুনার ফোন এর কথা বলে বললাম, রনিকে কাল রাতে তোর ওখানে পাঠাবে বলেছে। মেয়ে এবার রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলছে, কালকেই যেতে হবে কেন? বেশি না আরো এক সপ্তাহ আমার বাসায় থেকে যাবে। আমি আপাকে ফোন করে বলছি। আমি এবার বলি, না সোনা একদিন থাকবো না হয়। এর বেশি থাকলে দেরি হয়ে যাবে। এবার চেঁচাচ্ছে, কিসের দেরি? আমি ইতস্তত করে বলি, রায়ান রাগ করে এতো দিন ধরে কথা বলছে না। ঠিক আছে তোর ওখানে আবার আসবো কথা দিলাম। লুনা কে ফোন দিয়ে বললাম,কাল পরশু রাত্রির ওখানে না থাকলে ও মানছে না রে মা। পরশুদিন এর পরদিন সকালে রনিকে আসতে বলিস্।

বকুল রাতারগুলে পরবে বলে সুন্দর সবুজ শাড়ি নিয়ে এসেছে। এতো শখ ওর……….. হাতের চুড়ি, আংটি, লম্বা ঝুলের মালা সব সবুজ। আমি হেসে বলি,বুঝা গেল তোর কাছে সবচেয়ে স্পেশাল জায়গা হলো রাতারগুল। সে এবার দুই চোখ বন্ধ করে বলছে,আপা ভাবো পানির উপর বেশির ভাগ হিজল গাছ সহ অনেক গাছ আছে। আমরা এর মধ্যে নৌকা দিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি। মেঘের ছায়া বা পাতার ছায়া পড়েছে পানিতে। সুন্দর এই পরিবেশের সাথে মিলিয়ে পরার জন্যই তো আমার কাপড় চোপড়,জুয়েলারি নিয়ে এসেছি।

এবার আমার সদাব্যস্ত মেয়ের আফসোস হচ্ছে আমাকে বললে না কেন খালা? তাহলে আমিও শাড়ি নিয়ে আসতাম। আমি এবার হেসে বলি, কোনো দরকার নেই। শাড়ি পরে কতবার হোঁচট খাস ভেবে দেখ। আর এখানে তো উঁচু নিচু রাস্তা, নৌকায় উঠা…… অনেক ব্যপার আছে। বকুল বলছে আমাকে একঘন্টার সময় আপা বেঁধে দিয়ে
বলেছে,রাত্রি এর ভেতর চলে আসবে। তুই আয়।
আমি তোর খালুকে বলে কিচেনে গিয়ে নির্দেশ দিয়ে এসেছি ভুনা খিচুড়ি ও ডিম ভাজি করে দেয় যেন। আসার পর ব্যগে কাপড় গোছাবো, বুঝতে পারি তোর খালুর মতলব হলো আমাকে দিবে না। তখন আবার আপাকে না করবে কিভাবে সেটা মনে হয় ভাবছে। আমি দোটানায় পড়ে কাপড় না গুছিয়ে সোফায় বসে আছি। পরে আবার কি ভেবে অনুমতি দিয়েছে। সামান্য সময়ের মধ্যে যা
পেয়েছি তা ব্যগে ঢুকিয়েছি। রাত্রি হাসছে,কম সময়ের মধ্যে ই এতো,আর সময় পেলে কি যে করতে !!!

সোয়া দশটার দিকে ভোলাগঞ্জ এর দিকে রওনা হলাম। নিকটবর্তী হতেই চেরাপুঞ্জির বড় বড় পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত এক স্তব্ধতা নিয়ে বিশাল পাহাড় গুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন। শীতের সময় বলে পানি একেবারেই কম মনে হচ্ছে। ৮০০/ টাকা দিয়ে ভোট ভাড়া করে করলো
রাত্রি। বোট থেকে নেমে ৫/৭ মিনিট এর মতো হেঁটেছি জিরো পয়েন্ট এর দিকে যাবো বলে।স্বচ্ছ,
নির্মল পানি।পা ভিজিয়ে বসলাম অনেকক্ষণ। বকুল খুব সাবধানে বসার চেষ্টায় আছে। বেড়াতে এসে এতো কিছু পরে এলে কি স্বস্তিতে চারদিকের পরিবেশ ও কর্মকাণ্ড উপভোগ করা যায়? আমার
আরো বেশি ভালো লাগতো যদি জায়গাটা আরো
একটু নীরব হতো। এতো ভিড় এখানে, মানুষ যেন গিজগিজ করছে।

হঠাৎ পাশের একটা পরিবারের দিকে নজর গেল।
রায়ানের মতো বাচ্চা একটা ছেলে দুষ্টুমি করায় মা বকছে। সাথে সাথেই রায়ান কে মনে পড়ে গেল। সেই যে রাগ করে ফোন রেখে দিয়েছিল, আমি ২ বার কথা বলতে চেষ্টা করেও আর বলাতে পারিনি। অভিমানে ছোট বুকটা ভরে গেছে মনে হয়। দাদী কেন, আমাকে নিয়ে যায়নি? হঠাৎ করে না বলেই দাদী কি সুন্দর চলে যায় কিভাবে? রাত্রি আমড়া কিনে আনলো। খেতে খেতে আমরা সবাই নৌকার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এপারে তখন সূয্যি, মামা মধ্য গগণে বিচরণ করছেন। শীতকাল বলে কষ্ট হচ্ছে না হাঁটতে।

লাঞ্চ করলাম, আইটেম অনেক কিছু আছে।ভর্তা,
করলা ভাজি,ভেন্ডি ভাজি, হাঁস,মুরগি,গরু,ডাল….
……….. সবকিছু আছে। প্যাকেজ ১৫০/ টাকা করে। ছোট মাছ আর করলা ভাজি দিয়ে আমি খেলাম। ওরা দুজনে নানান পদ চেখে দেখছে। আসার সময় নুরু মিয়ার পানসুপারি নিয়ে এসেছি লাম। এখন বসে বসে আয়েশ করে মুখে চালান দিলাম আর মনে মনে আল্লাহ তাআলার অশেষ শুকরিয়া আদায় করতে লাগলাম। শারীরিক ও মানসিক সামর্থ না থাকলে এখানে ঘুরা কি আমার পক্ষে আদৌও সম্ভব ছিল?কক্ষণো নয়। মেয়েটার
জন্য বলছি, আল্লাহ আমার মেয়ে মা খালাকে খুশি করবে বলে এতো টাকা,শ্রম খরচ করছে তুমি ওকে দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তিতে রাখো।

যাত্রা এবার রাতারগুলের উদ্দেশ্যে। রাত্রি নাকি খবর নিয়ে জেনেছে,অন্যান্য ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে গেলে নৌকা বদলানো লাগে কিন্তু চৌমুহনী
ঘাট থেকে নৌকা নিলে বদলাতে হবে না। দরদাম করে এখানেও নৌকা ৮০০/ টাকায় ভাড়া করা হলো। প্রাপ্তবয়স্ক দের ফি ৫০/ টাকা, ছাত্রদের ২৫/ টাকা। চারদিক খুবই শুস্ক। নৌকা চলছে। চলা শুরু হতেই মনে হচ্ছে,আহা !!! এতো সুন্দর জলাবন !!! এতো সবুজের সমারোহ !!! শুনশান নীরবতা দেখে রাত্রি বলছে, কেমন একটা পিনড্রপ সাইলেন্স তাই না মা? পাখির আওয়াজ, পানির মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এটা বলে বোঝানোর মতো নয়। অনুভব করতে হয় শুধু। মাঝি বলছে,ইনো আওয়ার কোনো সিজন নাই। যে কোনো সময়ঔ ভালা লাগবো(এখানে আসতে হলে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন নেই। যে কোনো সময় এলেই উপভোগ করবেন)। গোধূলির শেষ লগ্নে ভাসমান গাছের কাছ দিয়ে যেতে যেতে, আমি পানির দিকে তাকিয়ে ভাবছি ইয়া আল্লাহ, তোমার সৃষ্টি এতো সুন্দর তাহলে তুমি যে কতো সুন্দর !!! সুবহানাল্লাহ !!! ভাবতেই অবাক লাগে।

শীতের সময় বলে পানি কম,বর্ষায় ভরা থাকে। রাত্রি নৌকায় বসে গাছের ডাল ধরে ধরে এগুচ্ছে।
হঠাৎ মাঝি বললো, সামনোর গাছো বাক্কা বড় একটা সাপ দেকরাম। আফনে ডালো আর আত দেইন না যানি(সামনের গাছে বেশ বড় একটা সাপ দেখছি। আপনি ডালে হাত দিবেন না)। এবার রাত্রি চেঁচাচ্ছে, দেখো মা সবুজ একটি সাপ। মনে হচ্ছে গাছের সাথে ম্যাচ করা সাপ এগুলো।

মাঝিগুলো দুজনেই কমবয়সী ছেলে। এবার তারা
গান ধরেছে:
কইলজা ছিড়িয়া খাওয়াইলাম তবু থাকলি না
বাফর টেকা খাওয়াই তবু তোরে পাইলাম না।

আমি মনে মনে হাসছি, পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে কমদামী জিনিস মনে হয় কলিজা ই। খাওয়ালেও
কোনো লাভ নেই। ফিরতি পথে সবাই গাড়িতে উঠে চুপচাপ বসে আছে। নৈস্বর্গিক দৃশ্য দেখে এসে,আহা !!! কি দেখলাম সেটাই হয়তো ভাবছে।

সুন্দর একটা শীতল পাটি, নামাজের পাটি,এক খাঁচা কমলা, অনেকগুলো মণিপুরী শাড়ি, পান সুপারি, বাচ্চাদের খেলনা,সাতকরা,আদালেবুএবং কিছু মানুষের ভালবাসা নিয়ে পরদিন সকালে সিলেট ছাড়লাম। লাঞ্চ ছাড়া কোথাও না থেমেও পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

রাত্রির শশুর, শাশুরি, স্বামী সবাই আদর যত্নের চুড়ান্ত করছেন। বেয়ান লেপ বের করে রোদে শুকিয়ে ওয়াড় লাগিয়ে রেখেছেন। আলাদা রুম,
ওয়াশরুম দেয়া হয়েছে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। নাঈম এসেছিল আমাকে নিতে, এসে দুই মেয়ের বাসায় থাকার এতো লম্বা প্রোগ্ৰাম দেখে রেগে চলে গেছে। একদিন,দুইরাত থেকে বেয়ানের উপহার দেয়া সুন্দর ১টা কাশ্মিরী শাল বগলদাবা করে রনির সাথে ওদের বাসায় গেলাম।

আমাকে কাছে পেয়ে আমার বড় মেয়েটা যেন ওর
ছোটবেলায় ফিরে গেছে। পুরো ১ সপ্তাহ থাকলাম,
প্রত্যেক রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। স্বামী,বাচ্চা
রা হাসছে, মেয়ের তাতে কোনো হিল দোল নেই।
আছরের নামাজ পড়ে আমি মোজা পড়ে নেই।
একদিন পড়বো বলে মাত্র ঝুঁকতে গেছি, রনি কোথা থেকে এসে ছোঁ মেরে মোজা নিয়ে পড়িয়ে দিলো। আমি হেসে বলি,তোমরা যে বাবা আমাকে নড়তে দিচ্ছ না শেষে না আবার অকর্মা,অথর্ব বানিয়ে দাও। মায়মুনা সেদিন ফোন করে প্রায় ঘন্টাখানেক কথা বলল। যাবার দিনে রনি আমার
২ ছেলের পরিবার ও বকুল এবং রাত্রির পরিবার কেও দাওয়াত দিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম সজল আসবে না কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে সে ও তার পরিবার এসেছে। রায়ান এসেই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুখ তুলে দেখি কাঁদছে।

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমি বলি, তোমরা সবাই যখন উপস্থিত আছো, তাহলে এখানেই আমি একটা কথা বলে ফেলি। অনেক দিন ধরে ভাবছি, বাড়িতে যাবো। ভালো লাগলে ওখানেই
থাকলাম। মাঝে মাঝে এসে সবাইকে দেখে যাবো।সংসার তো করলাম ৪২ বছর ধরে, এবার একটু নিজের পছন্দ মতো, ইচ্ছে মতো থাকি। নাঈম বলছে, ওখানে কিভাবে থাকবে? তোমার ওয়াশরুম ঝকঝকে পরিষ্কার না হলে, তুমি তো ব্যবহার করতেই পারো না। তাছাড়া,হাই কমোডে বসে তুমি অভ্যস্ত। তোমার বেড ছাড়া তোমার চলে না। দয়া করে এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো তো মা।

আমি এবার হেসে বলি, তোদের মা কি কখনো না চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? আমার চোখের ছানি অপারেশন এর দিন মায়মুনার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম ফারুকের হাতে দিতে। রুম ও ওয়াশ রুম যেন এই টাকা দিয়ে ঠিক করায়। আমার ওয়াশ রুমে যেন ১টা হাইকমোড লাগায়। এসব লাগিয়ে মায়মুনা পরশু ফোন দিয়েছে। ওরা সবকিছু পরিস্কার ও ঝাড়পোছ করে রেখেছে। আর বেড এর চিন্তা আমি করছি না। কবরের মাটিতে থাকবো কিভাবে সেটা ভাবছি শুধু। নাঈম চোখে টলটলে পানি নিয়ে বললো, আমি জানি তুমি আমাদের উপর রাগ করে চলে যাচ্ছ মা। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি, কেন রাগ করবো বাবা? কারো উপরেই আমার কোনো রাগ নেই সোনা। এতো মন খারাপ করার কিছু হয়নি। আমি কি নির্বাসনে যাচ্ছি না কি? আপাতত ২/৩ দিন রায়ানের সাথে থাকবো। তারপর চলে যাবো ইনশাল্লাহ। অগ্ৰহায়ন মাসের অর্ধেক চলেই গেল। নিজের কাছে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর ভাসমান নৌকা পার খুঁজে পেল মনে হয়।

রায়ানের মনে এতো ভয় ঢুকেছে বলার মতো না। স্কুলে যাবার সময় জিজ্ঞেস করে, আজ তোমাকে
এসে পাবো না কি দাদী? আমি পাবি বলে হাসি কিন্তু নিজের বুকেই যেন বেদনার লাভাস্রোত বয়ে
যেতে দেখি। ইদানিং প্রতিরাতে আমার স্বামীকে ভেবেও কান্না করি। স্মৃতি বড় বোঝা……… কখনো
কখনো এর বহন ভার বড্ড কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
বকুলের ঘ্যানঘ্যান শুনতে শুনতে ওর বাসায় দুই দিন থেকে এলাম। একই কথা বলে কাঁদছে,একা একা আমি হাঁটব কিভাবে? তুমি যে চলে যাচ্ছো? ওর স্বামীকে বলে এসেছি, তোমার খুব বেশি সমস্যা না হলে, ওকে মাঝে মাঝে দুদিনের জন্য আমার ওখানে দিও। মাথা নেড়ে হ্যা বলেছে।

মায়মুনা কাল আবার ফোন দিয়েছে,আর দেরি করবেন না। প্রতিরাতে ধান মাড়াই হচ্ছে, দেখলে অন্যরকম লাগবে আপনার। অতঃপর ৫ম দিনের সকালে নাঈমকে বলি, আমি আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি। সকালে রওনা হবো, রনিকে দিয়ে আসতে
বলবো। সে বললো,যাবেই তাহলে তুমি? ঠিক আছে, আমিও যাবো তোমাকে পৌঁছিয়ে দিতে। না করলে ছেলে রাগ করবে,তাই আর কিছু বলিনি।
মেহের চুপ করে শুনছে, আমিও আর উচ্চবাচ্য করিনি। রুম্পার বাচ্চা হবে শুনে ওকে দেখে এলাম। স্বামী স্ত্রী ভীষণ খুশি, আজকাল সুখ আনন্দের দেখা পাওয়া বড় মুস্কিল। তাই, আমার হাসিখুশি এই নবদম্পতিকে দেখে ভালো লাগছে।

যাবার দিনে তিন জন মানুষ ই অবিরাম কাঁদছে। রায়ান, জরিনা ও আমাদের চৌকিদার। মেয়েরা গতরাতে এসে কান্নারত অবস্থায় বিদায় নিয়ে চলে গেছে। আর নাঈমের দুটো চোখ রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে। আমার ডাক্তার ছেলে আর বৌ এসেও গতরাতে বিদায় নিয়ে গেছে। একাউন্ট নম্বর নাঈমের হাতে দিয়ে বললাম,ভাড়ার ৩০ হাজার এতে জমা দিবে। বাকি ১০ হাজার বিকাশ করে আমার কাছে পাঠাবে। বললো, ঠিক আছে মা।সময় মতো তুমি পেয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। এতো দিন এর সংসার !!! যেদিকে তাকাই বুকটা কেমন যেন করে উঠে। প্রত্যেকটা জিনিস এর সাথে জুড়ে থাকা স্মৃতি চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে
আল্লাহর কাছে আমার স্বামীর জন্য দোয়া করছি, আর্থিক স্বচ্ছলতার পথ খুলে রেখে ভদ্রলোক আত্মসম্মান নিয়ে স্বাধীন ভাবে চলার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আমাকে।

দুই চোখ ভরা পানি নিয়ে নাঈমের সাথে গাড়ির পেছনে উঠে ভাবি,কাঁদছি কেন আমি? বক্ররেখার মতো জীবনটাকে সরলরেখার আকৃতিতে নিয়ে আসার জন্য এতো জীবন সংসার সংসার করে কাটিয়ে দিলাম। এবার না হয় বেঁচে থাকার অবশিষ্ট দিনগুলোতে একটু নতুনত্ব আসুক। আপাতত গন্তব্য বাড়ি,ডাক আসলে স্থায়ী ঠিকানায় চলে যাবো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দোয়া করছি, আল্লাহ আমার শরীরটা তুমি ভালো রেখো। তুমি ছাড়া আর কারো মুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল করো না আমাকে। আমাদের গাড়ি ততক্ষণে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here