###বক্ররেখা(২য় পর্ব)
###লাকি রশীদ
ছোট মেয়ে রাত্রি ফোন করে বলছে,মা গাড়ি পাঠাচ্ছি। তুমি চলে এসো। এই মেয়েটার মেজাজ অল্পতেই গরম হয়ে উঠে। কথা শুনে আমি এবার প্রমাদ গুনি, গতবারের মতো এবার না ও আবার ঝামেলা লাগায়। হেসে বলি, কোনো এক ছুটির দিনে যাবো না হয় মা। এখন বাচ্চাদের স্কুল খোলা
কি করে যাই বল্? উত্তপ্ত কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
কক্সবাজার তোমাকে নিয়ে যাবো মা। কেন এই কয়েক দিন বড়ভাবী কে বলো বাচ্চাদের আনতে। তুমি কিছু বলো না বলেই তো এরা তোমার ঘাড়ে সংসার ফেলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি ও পক্ষের গলার আঁচ কমাতে বলি, হাওয়া লাগাচ্ছে না। রীতিমত কাজ করছে বল্।
এবার মেয়ে রীতিমত কামান দাগছে,শোনো মা কাজ আমরাও করি, সমাজ সেবা থেকে অনেক দ্বায়িত্বপূর্ণ পদে দুই বোন ই আছি। তাই বলে কি সংসারের কোনো দায় থাকবে না বলো? দরকার হয় ওরা লোক রাখে না কেন? অলরেডি টিকেট কেটে ফেলেছি মা, তিনদিনের জন্য কক্সবাজার যাবো। দুদিন অনডে,তাই আমি ও তোমার জামাই
দুদিনের ছুটি নিয়েছি। শুধু একদিন বন্ধের মধ্যে পড়বে। আমার শশুর শাশুরিও যাচ্ছেন। কোনো কথা শুনবো না,কাপড় গোছাও আর চলে এসো।
আমি এবার বলি, ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখবো। কিন্তু সব কাজের একটা নিয়ম আছে সোনা। ওরা বাসায় আসুক, কথা বলে তোকে ফোন দেবো। সে আমার দৃঢ় কন্ঠস্বর শুনে বলে, আমি তো ভেবেছি
পুরনো মাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তোমার এই গলাটা এবার একটু ছেলে ও বৌদের শোনাও মা।
কিন্তু এদের বলতেই সবাই একসাথে বলছে, কি বলো মা? কথা নেই বার্তা নেই রাত্রি হঠাৎ তোমায়
নিয়ে যাবে কেন? মেহের বলছে রায়ানের পরীক্ষা চলছে মা। ও কি আপনাকে ছাড়া থেকে পরীক্ষায়
মন বসাতে পারবে? শায়লা বলছে, আমি আর আপনার ছেলে তো দুই দিনের একটি প্রোগামে
চিটাগাং যাচ্ছি মা। সহকারীদের উপর ভরসা করে বাচ্চাগুলোকে ওদের কাছে রেখে যাওয়া কি উচিত হবে বলেন? মেহের সাথে সাথে সুর মেলাচ্ছে, কি যে বলো না শায়লা !!! দিনকাল যা পড়েছে, প্রতিদিন নিউজ পেপার এ ভয়ংকর সব খবর দেখো না? আমি আজব হয়ে দেখি,প্রবল প্রতিপক্ষ দুই জা স্বার্থের টানে এক হয়ে গেছে।
বললাম কিন্তু রাত্রি তো আমার টিকেট কেটে ফেলেছে বৌমা। আর ও তো জানে সমুদ্র আমার ভীষণ প্রিয়।
ঠিক তক্ষুনি আমার অতি আদরের, মায়ের সাথে বোবা হয়ে যাওয়া সজল বলে, সে আর এমন কি ব্যাপার !!! দেশের ভেতরেই তো কক্সবাজার আছে মা। তোমাকে নিয়ে একবার না হয় শায়লা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। আমি তখনও কিছু বলছি না দেখে রায়ান এসে হাত ধরে বললো, আমিও তোমার সাথে যাবো দাদু। আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ। এবার কি ভেবে সজলের মেয়ে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমিও যাবো। আর কি যাওয়া যায়? স্নেহ নিম্নমুখী হয়তো বা একেই বলে।আমার নাতি
পরীক্ষা না দিয়ে কি আমার সাথে ঘুরতে যাবে? কতো টা পিছিয়ে যাবে না ক্লাশে? রুমে গিয়ে ফোন দিয়ে রাত্রিকে বলতেই চেঁচাচ্ছে,শোনো মা
এতোটাও মায়ায় জড়িও না নিজেকে। তাও যদি ছেলেরা স্বার্থপর না হতো মনকে শান্তনা দিতে পারতাম। রাখি তাহলে এখন,বলেই ঠাস করে ফোন রেখে দিল।
ও এরকম ই, নিজের মতের বিরুদ্ধে কিছু গেলেই
ক্ষেপে যায়। বছর খানেক আগে এক ছুটির সকালে তেমনি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে মা যাবে বলে। আমি তখন রায়ানের গতরাতে ফরমায়েশ দেয়া রাউন্ড পরোটা মানে লাচ্ছা পরোটা বানাচ্ছি। গোলাকৃতির ও লাচ্ছা সেমাইয়ের মতো বিভিন্ন লেয়ার থাকে বলে রায়ান একে রাউন্ড পরোটা বলে। বানাতে অনেক ঝামেলা বলে শুধু মাত্র ছুটির দিনে ই এটি বানাই। কিন্তু গাড়ি দেখেই মনটা খুব গাইছে। মেয়েটা ৪ মাসের প্রেগন্যান্ট। এদিকে ফোনেও কিছু বলছে না। ২ টা পরোটা বানিয়ে আমি গাড়ির দিকে দৌড় দিয়েছি। গিয়ে দেখি মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। প্রায় ৬ বছর পর এটি তাদের দ্বিতীয় বাচ্চা ছিল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই কাঁদছে। ক্লিনিকে প্রায় দুদিন থেকে চিকিৎসা করা হলো,রক্ত ১ ব্যাগ দেয়া হলো। বাসায় এসে বাচ্চা মেয়েদের মতো আমার আঁচল আর ছাড়তে চায় না। এদিকে এরা ফোন দিচ্ছে মা কবে আসছো বলে। এ নিয়ে একদিন ওর শায়লার সাথে তুমুল ঝগড়া হলো। সেই থেকে আমি এসব মনোমালিন্য
ভীষণ ভয় পাই। সংসার একটু একটু করে ভাঙ্গতে দেখতে পৃথিবীর কোন মানুষ খুশি হয়?
বকুল মর্ণিং ওয়াক করতে করতে বলছে আমার ছোট ছেলেটা ইংল্যান্ড চলে যাবে রে আপা। ভার্সিটির কাগজ পত্র চলে আসছে। মনটা খুব খারাপ। আমি হেসে বলি, ছেলে মাষ্টার্স করতে যাচ্ছে। তোর কথায় মনে হচ্ছে একেবারেই চলে যাবে। সে এবার জলভরা চোখে বলে, একবার বের হলে খুব কম বাচ্চাই ঘরে ফিরে। ছেলে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো বুঝতে পারছি না আপা। এবার আমি কঠিন স্বরে বলি এতো বেশি বেশি ভালবাসতে যাস না। তাহলে কষ্ট ই পাবি শুধু। মনে রাখিস পৃথিবীতে সবাই হারামী। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা কে ভালবাসলে তুই ঠকবি না। সে এবার বলছে, খুব তো আমাকে উপদেশ দিচ্ছো। নিজে তো ছেলে, নাতিদের চিন্তায় একই পাড়ায় থাকা বোনের বাসায়ও রাতে থাকো না। কমপক্ষে এক বছর ধরে বলে বলে আমি হয়রান। আমি বলি, থাকবো।রায়ানদের পরীক্ষাটা শেষ হোক,আসবো। এবার সে হালছাড়া ভঙ্গিতে বলছে,আর থাকবে !!! তোমাকে বলে বলে আমি শেষ। দুলাভাই মারা যাওয়ার পর থেকে তোমাকে যেন সংসার ভীষণ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
বাসায় ঢুকে দেখি বড়বৌমা দুকাপ চা বানিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে বললো,আসেন মা। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি, একসাথে চা খাবো বলে। আমার অনেক ভালো লাগে,পুরনো
বৌমা ফেরৎ পেয়েছি মনে হচ্ছে। টুকটাক গল্প করতে করতে জরিনা, রান্নার খালা চলে এসেছে।
সবাই নাস্তা করার সময় মেহের বললো, আমার বোন দেশে এসেছে মা। ওর শশুড়বাড়ির সবাইকে পরশু লাঞ্চে দাওয়াত দিয়েছি। আপনাকে একটু
কষ্ট করে চিতল মাছের কোপ্তা আর বাইম মাছ ভুনা সহ মাছের বাকি আইটেম গুলো করে দিতে হবে। চিকেন,বীফ, মাটন বুয়াকে নিয়ে আমি করে নিতে পারবো। সঙ্গে সঙ্গে সকালবেলার ভালো লাগার রেশটুকু যেন কর্পুরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ও !!! এখন বুঝতে পারছি সকালে চা বানানোর মূল উদ্দেশ্য তার। মনে মনে হাসছি হায়রে দুনিয়া! আর কি কি খেল দেখার যে বাকি
আছে আল্লাহ মালুম। এবার বলি অনভ্যাসে ভুল পড়ে যায় বৌমা। না রাঁধতে রাঁধতে এখন আর আন্দাজ পাই না। নাছোড়বান্দা মেহের হেসে বলে,
তারপরও মা আমার চেয়ে শতগুণ ভালো রাঁধবেন আপনি। কেন জানি মাছের তরকারি আমার হাতে ভালো আসে না। অগত্যা কি আর করা !!! মৃদু হেসে বলি, ঠিক আছে। রেঁধে দেবো না হয়।
মায়মুনা মানে আমার ছোট জা জানে,দুপুর বেলা বড় কেউ বাসায় থাকে না। তাই আবার আজকে ফোন দিয়েছে। এরা স্বামী স্ত্রী আমার এতো ভক্ত হবার কারণ হলো, অনেক আগে আমার সহজ সরল দেবর ফারুক রাজশাহীতে চাকরি করতো। অফিসের কিছু মানুষের কারসাজিতে কি সব ঝামেলায় ফেসে যায় সে। চাকরি তো যায় ই, বৌ ও চারটে বাচ্চা নিয়ে ওকুল সমুদ্রে যেন ভাসে সে। আমাদের বাসায় এলে ওর ভাই ছোটখাট একটা চাকরিতে লাগিয়ে দিলেন। তখন প্রায় প্রতি রাতে মায়মুনা ওর সাথে ঝগড়া করতো। ওর ফারুকের প্রতি অভিযোগ ছিল এভাবে মাগনা মাগনা ৬ জন মানুষ এসে বড়ভাই এর ঘাড়ে বসে খেতে লজ্জা লাগে।
আমাকে বিয়ের পর থেকেই আমার স্বামী হাতখরচ দিতো। টাকা অপচয় করতাম না বলে বেশ কিছু টাকা জমা হয়েছিল। একদিন আমি ফারুককে হাজার তিনেক টাকা ( তখন টাকার মান আরো বেশি ছিল) আমি লুকিয়ে দিয়ে বলি,
এটা মায়মুনাকে দিয়ে বলবে তোমার ভাইকে দেবার জন্য। তাহলে সে খুশি হয়ে যাবে। তোমাকে আর বকবে না। সে তক্ষুনি কেঁদে বলেছিল,ভাবী না আপনি আমার বোন। আমি হেসে বলেছি, এই
ব্যপারটা তোমার ও আমার মধ্যে ই যেন থাকে।
কিন্তু কথা দিয়েও সে কথাটা রাখতে পারে নি।এর
মাস দুয়েক পর ফারুকের অফিস থেকে চিঠি আসে যে, তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে ও সম্পুর্ন
নির্দোষ। সেদিন ওর ভাইয়ের গলা ধরে অনেক কেঁদেছে। যাবার সময় ওর বাচ্চারা চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে,বড়মা কে ছেড়ে যাবো না।আমরা এখানেই থাকবো। আজো সে রকম মায়ার
নজরেই দেখে ওরা। যাবার আগে ফারুক সবার সামনে বলে,মায়মুনার বকা থেকে বাঁচাবে বলে ভাবী আমাকে টাকা দিয়ে ভাইকে দিতে বলেছে।
বিপদের সময় যে সাহায্য করে, নিজের অসুবিধা বুঝতে না দিয়ে ইজ্জতের সাথে থাকতে দেয়………
সে ই আসল শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি যতোদিন বেঁচে থাকবো ততদিন দোয়া করবো, আল্লাহ যেন কখনো আপনাকে বিপদ না দেন। আর দিলেও সবসময় যেন আমাকে ও আমার পরিবার কে আপনি পাশে পান।
শশুর বাড়ি ও শ্যালিকার শশুরবাড়ির জন্য নাঈম সমস্ত বাজার যেন তুলে এনেছে। সব ই ঠিক আছে, শুধু বোনদের দেখলে ভুলেও জিজ্ঞেস করে না তোরা কি খাবি বল। একটা পছন্দের মাছ গোশত এনে দেই। অথচ ওদের বাবা বেঁচে থাকতে মেয়েদের আসতে দেখুন আর ছেলেদের শশুর বাড়ির কাউকে দেখুন চট করে বাজারে চলে যেতেন। এদের ভালো মন্দ না খাওয়ালে উনার আফসোসের সীমা থাকতো না। একদম অস্থির হয়ে যেতেন। এখন এরা বাজার আনা তো দূরের কথা, বোনদের দেখলেই বরং রাজ্যের অন্ধকার এসে মুখে ভর করে। কান ভাঙ্গানি যে কি মারাত্মক জিনিস হাঁড়ে হাঁড়ে তা টের পেয়েছি।
বিসমিল্লাহ, আল্লাহ ইজ্জত রক্ষা করুন বলে একে একে মাছের আইটেম গুলো রাঁধতে শুরু করি।বাইম গুলো ভুনা করে মেহেরকে লবণ চাখতে বলি। আমার মুখে পান,টেষ্ট করবো কিভাবে? সে মুখে দিয়েই চোখ বন্ধ করে বললো, এতো মজা হয়েছে মা আর বলছিলেন সঠিক আন্দাজ করতে
পারবেন না। মাছের আকৃতি দেয়া ডিসে বাইমের তরকারি তুলতে তুলতে খুশি গুলো যেন ওর মুখ দিয়ে চুইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। আমি অন্য তরকারি বাগাড় বসাতে বসাতে ভাবি, আল্লাহ আসলেই আপনি অনেক বড় কারিগর। ছোটখাট একটা হৃদয়ের কুঠুরিতে কারো জন্য টুইটুম্বর ভালবাসা আর কারো জন্য অবহেলা, ঘৃণা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। আপনার মহিমা বুঝা বড় ভার।
বাসা আজ ঝকঝকে হয়ে গেছে। সহকারী নিয়ে মেহের সবকিছু ঠিকঠাক করেছে। মেহমানরা বাইরে থাকে বলে গোশতের চেয়ে মাছ ই ভীষণ খেয়াল করে গেল এবং প্রশংসায় ভাসালো। যাবার আগে মেহেরের বোন খুব সুন্দর একটা শাড়ি দিয়ে বলল আপনি সুতি ছাড়া অন্য কিছু পরেন না সেটা আমি জানি। দেখেন তো খালাম্মা এটা পছন্দ হয় কিনা। বললাম খুব সুন্দর হয়েছে মা। বিকেলে চা এর সাথে খাবে বলে পুলি পিঠা ও
পায়েস বানিয়ে রাখা হয়েছিল। হৈচৈ করতে করতে ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে গেল।
রুমে ঢুকতেই বড় মেয়ে লুনার ফোন। মা কেমন আছো? বললাম ভালো আছি রে। তুই কি করিস?
বললো কি আর করবো। ছেলের কোচিং সেন্টারে
বসে আছি। তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।
রাতে রনিকে পাঠালে ওর সাথে কি তুমি আসবে? আমি হেসে বলি আমি তোকে জানাবো কবে আসতে পারবো। মেয়ে এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলছে, ঠিক আছে মা। তোমার কখন সুবিধা হয় জানিয়ে দিও। মৃদু স্বরে বলি তুই চলে আয় না।
এবার খুব আস্তে আস্তে বলছে, তোমার ছেলে ও বৌদের বিরক্ত মুখ দেখতে আমার ভালো লাগে না মা। রেখে দিল ফোন, এই মেয়েটা আমার মতো ভীষণ অভিমানী। রাত্রি না হয় মেজাজ দিয়ে মন্দ লাগা পুষিয়ে দেয়। লুনা ভেতরে পুষে রাখে।
অজানা অচেনা এক চোরা কষ্টে চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। মনে মনে ঠিক করলাম অনেক দিন মেয়েগুলো বাসায় আসেনি।
খুব শীঘ্রই দুই পরিবারকে সারাদিনের জন্য এনে একবেলা অন্তত খাওয়াতে হবে। এতো ক্লান্ত ছিলাম, কখন যে ফোলা চোখে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারি না।
(রিপোষ্ট)
(চলবে)