#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ২
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
কাউচের উপর বসে আছে মাহাদ।শান্ত,স্থির,সমাহিত।তার পাশেই আছে একটা পাজেল।মাহাদ সেইটা হাতে নিয়ে সলভ করার চেষ্টা করছে।
মাহাদ এর এইটা একটা স্বভাব।যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয় মাহাদ প্রথমে একটা পাজেল সলভ করে তারপর উক্ত সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবে।
মাহাদ থেকে কিছু দুরেই কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইমু।যার প্রকৃত নাম ইমন।ছোট্ট করে সবাই ইমু বলেই ডাকে।ইমু মাহাদ এর ড্রাইভারের ছেলে।ড্রাইভার রহিম শেখ গত তিনবছর ধরে মাহাদ এর আন্ডারে কাজ করে।কয়েকমাস আগেই পেটের পীড়াজনিত কারণে রহিমের স্ত্রী মারা গেলে নিজের ছেলেকে নিয়ে সে মাহাদ এর সার্ভেন্ট কোয়াটারে থাকা শুরু করে।
বাইরে এখনো আলো ফুটেনি।কুয়াশায় আচ্ছাদিত চারপাশে তুলোর মতো সাদা কুয়াশার ছড়াছড়ি।দরজা,জানালা বন্ধ হওয়াতে বাইরের শীতল পরিবেশের আঁচ ভিতরে তেমন আসছে না।কিন্তু তবুও অনবরত কেঁপে যাচ্ছে ইমু।নিচের দিকে তাকিয়ে ঝড়াচ্ছে তার নেত্রনীর।
ওর থেকে একটু দুরে বামদিকে দাঁড়িয়ে আছে আলতাফ আর তার পাশেই ইমুর বাবা রহিম শেখ।বয়সে খুব জোড় মাহাদ থেকে সাত আট বছরের বড় হবে।আলতাফ আর রহিম গভীর দৃষ্টিতে মাহাদ এর দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রায় দশ মিনিট চেষ্টা করে পাজেল সলভ করে মাহাদ।সেইটা পাশে রেখেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইমুর দিকে।ছেলেটা একবারের জন্যও মাহাদ এর দিকে তাকাচ্ছে না।মাহাদ গভীর শ্বাস ফেলে।গাঢ় গলায় বললো—
“কেন এসেছিলে তুমি বাড়ির ভেতরে?
ইমু কিছু বললো না।মাহাদ কে সে বাঘের মতো ভয় পায়।ইমু ভুল করেও কখনো মাহাদ এর সামনে আসে না।যখন টিভির পর্দায় দেখতো তখন খুব পছন্দ ছিলো ইমুর মাহাদ কে।কিন্তু যেদিন এই বাড়িতে সে প্রথম দিন আসে সেদিন রাতেই কি একটা বিষয় নিয়ে মাহাদ বেশ রাগ করে বাড়ি ফেরে।বাড়িতে ঢুকেই ইচ্ছেমতো ভাঙচুর শুরু করে।আর নিজেকে আঘাত করে মাহাদ।এই বাড়ির লোকজন এইসবে পরিচিত হলেও ইমুর জন্য ছিলো একদম নতুন।সেদিন এর পর থেকে সে মাহাদ কে সাংঘাতিক ভয় পায়।মাহাদ বাড়ি থাকলে সে সহজে ঘর থেকেও বাইরে আসে না পাছে মাহাদ তাকে দেখে ফেলে।
ইমুর বয়স মাত্র বারো বছর।ক্লাস সেভেনে পড়ে সে।রোজ মাইল খানিক হেটে স্কুলে যেতে হয়।কারণ মাহাদ এর বাড়ির আশপাশ জনশূন্য।অত্যন্ত মেধাবী না হলেও পড়ালেখাই খুবই মনোযোগী সে।
ইমুর কম্পন এখনো থামেনি।মাহাদ নির্বিকারভাবে ইমুকে বললো–
“তোমাকে আমি কিছু জিঙ্গেস করেছি ইমু!
ইমু আরো জোরে কাঁদতে লাগলো।মাহাদ ভ্রু কুঞ্চি করে।এইবার তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে।মাহাদ দাঁড়িয়ে ধমকে বললো—
“কাঁদতে বলিনি তোমাকে আমি।কেন বাড়ির ভেতরে এসেছো এতো রাতে?
মাহাদ এর ধমকে মৃদু কেঁপে উঠে ইমু। অনেক ভয় আর আশা নিয়ে তার বাবার দিকে তাঁকালো।রহিম শেখ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ইমুর ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে।এখন সে আওয়াজ করে কাঁদতেও পারছে না।তার মুখ থেকে অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে।ঘোলা চোখে মাহাদ এর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নিচু করে ফেললো।ইমু ভাবছে আজই হয়তো তার শেষ দিন।এরপর আর কখনো তার বাবার হাতে খাওয়া হবে না,বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া হবে না।তার আর ডাক্তার হওয়া হবে না।ইমু চেয়েছিলো তার মায়ের মতো আর কেউ যেনো অসুস্থ হয়ে মারা না যায়।
কিন্তু সে ভাবছে তার সব স্বপ্ন বুঝি স্বপ্নই রয়ে যাবে!
মাহাদ এর গম্ভীর গলায় আওয়াজ এ ধ্যান ফিরে ইমুর।মাহাদ বললো—
“আমি কী তোমার জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা করবো!নাকী তুমি নিজেই বলবে কেন এতো রাতে তুমি এখানে এসেছো?
ইমু তার খসখসে ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো।কাঁপতে কাঁপতে মাথা উঠিয়ে তাকালো মাহাদ এর দিকে।মাহাদ এর চোখ দুটো অরুনলোচন হয়ে আছে।যেনো এখনই এই চোখের আগুনে পুড়িয়ে দিবে ইমু কে।ইমু ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে অস্ফুটভাবে বললো–
“আআমমারর খিইইদেএএ পেএএয়েএছিলো।”
মাহাদ দুম করে জোরে জোরে হেসে উঠলো।ওর হাসির আওয়াজ এ আবার কাঁদতে থাকে ইমু।মাহাদ হাসি বন্ধ করে শক্ত ও কঠিন গলায় বললো—
“জাস্ট স্টপ।ডোন্ট ক্রাই।আই হেট টিয়ারস।”
মাহাদ এর ধমকে আর এক মিনিটও স্থির থাকলো না ইমু।সেখানে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।আলতাফ আর রহিম এখনো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে।নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছে মাহাদ এর পরবর্তী আদেশের জন্য।মাহাদ দু কদম সামনে এসে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো।ইমুর মাথায় হাত দিতেই মনে হলো কোনো শীতল বরফখন্ড।ছেলেটা সত্যিই ওকে খুব ভয় পায়।মাহাদ স্মিত হাসলো।দৃঢ় গলায় বললো—
“ওকে নিয়ে যান।আর ওকে বলবেন আর কখনো যেনো আমার সামনে মিথ্যে না বলে।”
মাহাদ নিজের ঘরে চলে যায়।ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে আলতাফ আর রহিম।ইমুকে কোলে করে নিয়ে যায়।ছেলেটার চেহারা একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ভয়ে।
,
,
সকাল হয়েছে অনেকক্ষন।কিন্তু এখনো আকাশ গভীর ঘুমে মগ্ন।কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারপাশ।বুকের উপর একটা কাঁথা দিয়ে রেখেছে ইমুর।ছেলেটা এখনো উঠেনি।ওর পাশেই বসে আছে আলতাফ আর রহিম।চোখে মুখে উদ্বেগ আর বিসন্নতার ছড়াছড়ি।একরাশ ভয় নিয়ে নিশ্চল চোখে তাকিয়ে আছে রহিম ইমুর দিকে।ছেলেটা বেঁচে আছেতো!
কিছুক্ষন নড়েচড়ে উঠে ইমু।উঠেই হাউমাউ করে কেঁদে নিজের বাবা কে জড়িয়ে ধরে।কান্না জড়ানো গলায় বললো—
“আমি আর যামু না ওই বাড়িতে।আমারে মাইরা ফালাইবো।আমি আর যামু না।”
ইমুকে মাহাদ বলেছে সে যেনো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে।কিন্তু ভয়ে ইমু এখন তার চিরচেনা ভাষায় প্রলোপ্রক্তি করতে ব্যস্ত।ওকে শান্ত হওয়ার জন্য মাথায় হাত বুলায় রহিম।তাতে কান্নার বেগ যেনো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এর মতো বাড়তে থাকলো।ইমুর অবস্থা বেগতিক।যেভাবে কাঁদছে বেশিক্ষন এইভাবে চললে ছেলেটা নির্ঘাত শ্বাসরোধ হয়ে মারা পড়বে।আলতাফ একটা জলচৌকি টেনে বসলেন।ইমুর পিঠে হাত বুলাতে চমকে উঠে ইমু।ভয়াতুর চোখে আলতাফ এর দিকে তাকাতেই ইমু ব্যস্ত হয়ে বললো—
“আফারে কন হেয় যেনো আর বাড়ির ভিততে না যায়।হের লাইগা আইজকা স্যার আমারে মাইরা ফেলতো।”
আলতাফ মৃদু হাসলেন।ছেলেটা বড্ড ভয় পায় মাহাদ বাবা কে।শান্ত গলায় আলতাফ বললেন—
“ঠিক ভাবে কথা বলো ইমু।”
ইমু তাড়াতাড়ি করে তার চোখ মুছে নিলো।নম্র গলায় বললো—
“আপুরে বলবেন আর বাড়ির ভেতরে যেতে না।কাল রাতে যদি সত্যিই মাহাদ স্যার তাকে দেখে ফেলতো!
আলতাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীরভাবে বললেন—
“ঠিক বলেছো।আজ যদি তোমার জায়গায় সে তাকে দেখতো তাহলে খুব খারাপ কিছু হয়ে যেতো।
তবে তুমি মাহাদ বাবা কে অস্বাভাবিক ভাবে ভয় পাও।ভয় পেও না তাকে।অবশ্য তোমার এই ভয় আজ তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।তুমি অজ্ঞান হয়েছিলে বলেই ঘটনার দফারফা হলো।নাহলে তো মাহাদ বাবা এতো সহজে ছাড়বার পাত্র নয়।”
আলতাফের কথা শেষ হতেই ইমু মাথা নাড়াতে লাগলো।ব্যগ্র গলায় বললো—
“না,না,না।আপনারা ভুল করছেন।মাহাদ স্যার সব জানে।”
আলতাফ ছোট্ট ঢোক গিলে বিস্মিত গলায় বললেন—-
“এইসব কী বলছো?
“আমি ঠিক ই বলছি।মাহাদ স্যার সব জানে।আপনারা দেখে নিয়েন।”
আলতাফ আর রহিম একে অপরের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
,
,
বেলা এগারোটা।এখনো সূর্যের দেখা নেই।কেমন থমথমে শীতল পরিবেশ।যেহেতু বাড়িতে কোনো কাজ নেই তাই নিজের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে মাহাদ।মাহাদ বাড়ি থেকে বের হতেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে রহিম।আলতাফ তখন নিজের ঘরেই শুয়ে ছিলো।রহিম তাকে কিছু একটা বলতেই ভয়ে চুপসে যায় আলতাফ।দুইজন মানুষ যেনো নিজেদের জানটা হাতে নিয়ে দৌড়ে এলেন দোতলায়।কিচেন রুম সহ করিডোর এর সব জায়গায় কিছু একটা খুঁজে চলছেন।
তারা নিজেদের কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে কখন তাদের পিছনে মাহাদ এসে দাঁড়িয়েছে তারা বুঝতেই পারেনি।নম্র ও দৃঢ় গলায় মাহাদ বললো—
“আপনারা কী এইটা খুঁজছেন?
মাহাদ এর কন্ঠ শুনতেই দুজন রূদ্ধশ্বাসে এ পিছন ফিরে তাকায়।মাহাদ অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।মাহাদ এর বামহাতে একটা নূপুর।
ঘন ঘন দম ফেলে আমতা আমতা করে আলতাফ বললেন—
“মাআহাআদ বাবা আআপনিই??
মাহাদ হৃদয়হরণ করা হাসি দিয়ে কাউচে গিয়ে বসলো।আলতাফ আর রহিম এর শরীর হালকা কম্পন দিয়ে উঠলো।তারা আর কোনো কথা বললো না।ঘর জুড়ে কেমন একটা ভো ভো ভোঁতা শব্দ।মাহাদ তার হাতের নূপুরটা ঘুরাতে ঘুরাতে থমথমে গলায় বললো—
“চাচা,আমার বাড়িতে মোট কতজন মানুষ?
আলতাফ বৃহৎ ঢোক গিললেন।বুকে তার দামামা বাজছে।মাহাদ রাগে না।কিন্তু একবার রাগলে,রাগের মাথায় কাউকে খুন করতেও দ্বিতীয় বার ভাববে না।কিন্তু আলতাফ এর বিশ্বাস পুরো বিষয়টা জানলে মাহাদ তার বিরোধিতা করবে না।
নিজের সকল চিন্তা বাদ দিয়ে আলতাম মৃদু গলায় স্বাভাবিক ভাবে বললেন–
“বাড়ির বাইরের গার্ডসহ মোট এগারো জন।”
মাহাদ দুবোর্ধ্য হাসলো।খেয়ালি গলায় বললো—
“চাচা,আজকাল গণনা করতে ভুল করেন নাকী!
আলতাফ গাঢ় গলায় বললেন—
“আমার কী কোথাও ভুল হয়েছে?
মাহাদ শক্ত গলায় বললো—
“বাড়ির সকল সার্ভেন্ট কে এখানে আসতে বলেন।জাস্ট টু মিনিট।”
আলতাফ কথা বাড়ায় না।তিনি বুঝতে পারলেন সকালে ইমু মিথ্যে বলেনি।মাহাদ আসলেই কিছু জানতে পেরেছে।আলতাফ নিচে গেলেন।সবাই কে আসতে বললেন।
প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই সেখানে উপস্থিত হলেও ইমু কে কোনোভাবেই নিয়ে আসা গেলো না।কোনোভাবেই সে মাহাদ এর সম্মুখিন হতে চায় না।
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালো সবাই।মাহাদ এখনো কাউচে স্থির হয়ে বসে আছে।হাতে থাকা নূপুরের দিকে একরাশ উৎসুকতা নিয়ে অক্ষি নিবদ্ধ করে রেখেছে।এই নূপুর সে কাল রাতেই পেয়েছে কিচেন রুমের দরজার পেছনে।সেই অদ্ভুত সুগন্ধি এখনো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে এই নূপুরে।
মাহাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে।সার্ভেন্টদের দিকে একবার স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো–
“ইমু কোথায়?
আলতাফ মৃদু গলায় বললেন—
“ইমুর শরীরটা ভালো নেই।তাই সে আসেনি।”
মাহাদ চোখে হাসলো।সে জানে কেনো ইমু আসেনি।ছেলেটা তাকে অস্বাভাবিক ভয় পায়।সে কী আসলে এতোটা ভয়ংকর !
নিজের কথা ভাবতেই মাহাদ এর হাসি পেলো।আসলে তার জীবনটাই ভয়ংকর রকম সুন্দর।সুন্দর এই জন্য কারণ সবাই বলে।আর ভয়ংকর এই জন্য কারণ সে নিজে অনুভব করে।
মাহাদ তার অযাচিত চিন্তা বাদ দিলো।শক্ত গলায় সবাই কে উদ্দেশ্য করে বললো—
“সবাই কী এখানে উপস্থিত?
কেউ কোনো কথা বললো না।স্থির নয়নে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।আলতাফ মাহমুদ যেখানে স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছেন বাকীদের সেখানে কথা বলা সাজে না।কারণ এইসব কিছুর মাষ্টারমাইন্ড আলতাফ মাহমুদ।আর বাকীরা তার বাধ্যগত সহযোগী।
সবাই একরাশ ভয় নিয়ে ভেবে যাচ্ছে আগে কী হবে!
আলতাফ মাহমুদ এই বাড়িতে থাকতে পারলেও মাহাদ আর কাউকে এই বাড়িতে থাকতে দিবে না।
আলতাফ নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নম্র গলায় স্বাভাবিকভাবে বললেন–
“আপনার কী মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি মাহাদ বাবা?
মাহাদ দুর্বোধ্য হাসলো।ক্ষনকাল সময় নিয়ে হাতে থাকা নূপুরের দিকে আস্ত নজর দিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।সে তাকে দেখতে চায় না।শুধু জানতে চায় এই অদ্ভুত সুগন্ধের রহস্য।
সে কী সত্যিই !
মাহাদ তার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে দড়াম করে উঠে দাঁড়ালো।দৃঢ় ও কঠিন গলায় বললো—
“আপনারা কী ভেবেছেন!
আমি কিছুই জানবো না!এই বাড়িতে গত সাতদিন ধরে কী হচ্ছে তার খানিক আন্দাজও কী আমি করতে পারবো না!
এতোটা বোকা ভাবেন আপনারা আমাকে!আমার”স্বপ্নমহল” এ কি হচ্ছে তা কী আমি জানবো না!
মাহাদ এর দারাজ গলার আওয়াজ এ কেঁপে উঠে উপস্থিত সবাই।শরীরের উর্ধ্বাংশ কোনোরকম স্থির থাকলেও নিম্নাংশ থরথর করে কাঁপছে।গলার ভেতরের অংশ শুকিয়ে গেছে।একরাশ হতাশা আর ভয় নিয়ে সবাই তাকালো আলতাফ এর দিকে।
আলতাফ দৃঢ়চিত্তে ভাবলেন সত্য বলার সময় হয়েছে।আর দেরি করা যাবে না।
মাহাদ আবারো গলার আওয়াজ তীক্ষ্ম করে দৃঢ়ভাবে বললো—
“আমি তাকে খুঁজে বের করতে পারবো।কিন্তু যদি আমি তাকে খুঁজে বের করি তাহলে আপনাদের সবাই কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দিবো।আর আপনারা জানেন তা করতে আমার স্রেফ দুই মিনিট লাগবে।”
এইবার সবাই আপাদমস্তক কেঁপে উঠে।সকলের কাতর নয়ন আবদ্ধ হয় আলতাফ এর দিকে।আলতাফ তাদের দিকে তাকিয়ে শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।এই শীতের মধ্যেও সকলের গাল বেয়ে ঝড়ছে ঘাম তা চোখ এড়ালো না আলতাফ এর।
আলতাফ গাল ফুলিয়ে শীতল বায়ু নির্গত করে এক পা সামনে বাড়াতে গেলেই আহমেদ বারী কয়েক কদম সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।সবাই বিস্ফোরিত চোখে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।সবার বুকের ধকধক ধ্বনি এইবার যেনো শান্ত পরিবেশে আলোড়ন সৃষ্টি করলো।সবার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে করুণ আর্তনাদ।কিন্তু তা দমিয়ে রেখেছেন সবাই নিজের মধ্যে।
মাহাদ চোখ বাঁকিয়ে তাকালেন আহমেদ বারীর দিকে।আহমেদ বারী এই বাড়ির গার্ডেনার।মাহাদ এর দুটো গার্ডেন এর দেখাশোনা করেন তিনি।
মাহাদ শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো—
“বাকীরা সবাই এখন যেতে পারেন।”
সবাই যেনো ক্ষুধার্ত বাঘ এর সামনে থেকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ পেলেন।রুদ্ধশ্বাসে সবাই সেখান থেকে প্রস্থান করে নিজেদের প্রান রক্ষা করলেন।মাহাদ যদি এখন কাউকে মেরে গুমও করে দেয় কেউ তার লাশ খুঁজে পাবে না।আর কেউ কোনো কিছু বলতেও পারবে না।
আজকাল টাকার পিছনে সব সত্য ম্লান।
মাহাদ কাউচে স্থিরচিত্তে বসলো।মৃদু হাসলো মাহাদ।স্বাভাবিক গলায় বললো–
“বলেন,কী বলতে চান আপনি আপনার রেফারেন্সে।”
আহমেদ বারী মাটির মানুষ।কোনো উচ্চবাচ্য তিনি করেন না।তার প্রতিটি কথায় থাকে সহজবোধ্যতা আর নির্মলতা।ফিকে গলায় আহমেদ বললেন—
“সে আমার মেয়ে।”
মাহাদ ধীর গলায় বললো—
“সে যে একজন নারী তা আমি জানি।কেন সে এখানে আমি শুধু তা জানতে চাই।নাথিং এলস।”
মাহাদ এর বাড়িতে যারা কর্মরত তারা সবাই পুরুষ।নারীর পদচারনা এই বাড়িতে নিষিদ্ধ।
আহমেদ এর মুখ জুড়ে থমথমে ভাব।তা কাটিয়ে সরস গলায় বললেন–
“আমার মেয়ে চট্রগ্রামের একটা হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করতো।কিছুদিন যাবৎ একটা ছেলে তাকে খুব বাজেভাবে উক্তত্য করে।একদিন সে তাকে তুলে নেওয়ারও চেষ্টা করে।
আমার পক্ষে এইখানে থেকে তাকে রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।তার পরীক্ষাও শেষ।তাই আমি তাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি।”
আহমেদ থামলেন।মৃদু শ্বাস নিলেন তারপর আবার খুব বড় করে একটা সুদীর্ঘ শ্বাস ফেললেন।মাহাদ কিছু বললো না।অধর কোণে স্মিত হাসলো।তারপর
ধীর গলায় বললো—
“এই বাড়ির নিয়ম নিশ্চয় আপনার অজানা নয়?
আহমেদ বুক ভরে শ্বাস নিলেন।বিনম্র গলায় বললেন—
“জানি।আমি তাকে এখানকার কোনো হোস্টেলের থাকার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু এখানকার খরচ বেশি।তাই ভেবেছিলাম আলতাফ ভাইকে বলে আপনার কাছ থেকে কিছু টাকা অগ্রিম নিয়ে তার থাকার ব্যবস্থা করবো।”
মাহাদ হালকা কেঁশে গলার স্বর এর প্রতিবন্ধকতা দূর করলেন।স্বাভাবিক ভাবে বললো–
“আই সি!
তাহলে বললেন না কেন?
আহমেদ নীরস গলায় বললেন–
“গত কয়েকদিন যাবৎ আপনি ব্যস্ত ছিলেন।”
মাহাদ শান্তভাবে উঠে দাঁড়ালো।অধরযুগল গোল করে আবার স্বাভাবিক করলেন।ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে বললো—
“সবকিছু মেনে নিলাম।কিন্তু আপনারা যে অপরাধ করেছেন তা নিশ্চয় স্বীকার করেন!
আহমেদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।মাহাদ দৃঢ় গলায় শান্তভাবে বললো–
“তাহলে তার জন্য বরাদ্দকৃত শাস্তিও আপনাদের প্রাপ্য।
এম আই রাইট?
“জ্বী।”
“ওকে।তো আপনি আর আপনার মেয়ে আজ এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে চলে যাবেন।”
আহমেদ মাথা তুলে তাকালেন মাহাদ এর দিকে।আহমেদ এর চোখে বিশ্বাসী হাসি কারণ তিনি জানতেন এমন কিছু হবে।স্বাভাবিক গলায় বললেন–
“জ্বী।আমি আজই চলে যাবো।”
মাহাদ কঠিন গলায় বললো–
“ধন্যবাদ।আপনি এখন আসতে পারেন।”
,
,
কোয়াটার এর দরজায় উদ্বেগভরা চাহনিতে অপেক্ষা করছে আহমেদ এর মেয়ে।বাবাকে আসতে দেখে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে গেলো।মেয়েটি দেখলো তার বাবার মুখে চিন্তিত ভাব।আহমেদ কে নিয়ে মেয়েটি বিছানায় বসালো।
শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো—
“কী বলেছেন তিনি?
আহমেদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে হতাশ গলায় বললেন—
“আমাদের এখনই চলে যেতে হবে।”
মেয়েটি চোখ,মুখ খিঁচে শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো–
“কেন,কেন যেতে হবে?
“আমরা যা করেছি তা ঠিক ছিলো না।”
“তাই বলে চলে যেতে বলবে!এতোটা পাষান কেন উনি?
আহমেদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ধীম গলায় বললেন–
“শরীরের ক্ষত বোঝা যায় কিন্তু মনের ক্ষত বোঝা যায় না মা।আমরা তার মনের ক্ষত তে আঘাত করেছি।তাহলে কী আমাদের শাস্তিটা প্রাপ্য নয়।”
মেয়েটি ক্ষুন্ন গলায় বললো–
“তাই বলে চলে যেতে বলবে!এতো কীসের অহংকার তার!
“অহংকার নয়।অতীত।বিষাক্ত অতীত যা কারো জানা নেই।
থাক সেইসব।তুই জলদি সব গুছিয়ে নে।আমাদের যেতে হবে।”
“তোমাদের কোথাও যেতে হবে না।”
আলতাফ এর কথায় বিস্মিত নয়নে তাকালেন আহমেদ।প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বললেন–
“কেন?
“তা জানি না।কিন্ত মাহাদ বাবা তোমাদের যেতে বাড়ন করেছেন।কিন্তু….।”
আহমেদ উৎসুক গলায় বললেন–
“কিন্তু কী?
আলতাফ মৃদু হেসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সরস গলায় বললেন–
“তোমার মেয়েকে বাড়ির ভেতরে যেতে নিষেধ করেছে।”
মেয়েটি মনে মেনে বিরক্ত হলো।ভাবলেশহীন ভাবে অধরযুগলকে এপাশ ওপাশ করলো।আলতাফ মেয়েটিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে বললেন–
“এইটা মাহাদ বাবা তোমাকে দিতে বলেছে।”
মেয়েটি হাত বাঁড়িয়ে চিরকুট টি নিলো।ধীরগতিতে চিরকুট টি খুললো।তার ভেতরে লিখা দেখে চোয়াল শক্ত করলো মেয়েটি।তাতে লিখা—
” সুগন্ধি জলে অবগাহন করে রাত বিরাতে ভুতের মতো একদম আমার বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করবেন না।
আই কান্ট টলারেট ইউর ইউজলেস ফ্রিগোয়েন্স।”
মেয়েটি ইচ্ছেমতো কিছুক্ষন মাহাদ বকলো।অস্ফুটভাবে বললো—
“লোকটা শুধু পাষান নয়,একটা অসভ্য,নোংরা,বেহায়া পুরুষ।ছিঃ।”
,
,
,
দুইদিন আর কোনো সমস্যা হলো না।মেয়েটি আর কোনো প্রয়োজনেও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো না।কিন্তু বাড়ির বাইরে তার অবাধ চলাচল।মাহাদ এখনো সে অদ্ভুত সুগন্ধ পায়।
আজ মাহাদ এর শুটিং আছে এডফিল্ম এর।এখন বেরোবে সে।ফিরবে রাতে।গায়ে ভারী জ্যাকেট জড়িয়ে বাড়ি থেকে বের হলো সে।চকিতে তার নাকে ভেসে এলো সেই ঘ্রাণ।মাহাদ থমকে যায়।সেই ঘ্রাণ এর উৎস খুঁজতে খুঁজতে সে চলে যায় তার গার্ডেন এ।মাহাদ দেখতে পায় তার গার্ডেন এর ব্ল্যাক রোজ গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।নিতম্ব ছাড়িয়ে তার ঘন কালো চুল।মাহাদ অবাক হয়।এতো বড় কারো চুল হয়!
কারণ যাদের সাথে সে কাজ করে তারা চুল বলতে ঝামেলাই মনে করে।পটচুলা লাগিয়ে দিব্যি তারা চুলের স্টাইল চেঞ্জ করতে পারে।
মাহাদ নিগূঢ় দৃষ্টিতে মোহিত হয়ে আছে মেয়েটির চুলে।এ যেনো মেঘবরণ কেশ।সাথে সেই সম্মোহনী সুগন্ধ।
মাহাদ গাঢ় গলায় বললো–
“কে আপনি?
মেয়েটি তড়িৎ বেগে ফিরে তাকায়।মাহাদ কে দেখেই নিজের ঘন চুল মুষ্ঠিবদ্ধ করে মুখ আবৃত করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
হ্যাঁ।সে পেড়েছে।ঘন চুলের আড়ালে লুকিয়েছে তার মুখশ্রী।কিন্তু তার উৎসুখ দুই চোখ এখনো উন্মুক্ত যা নয়ন ভরে দেখছে মাহাদ।
এক মুহূর্তের জন্য মাহাদ এর মনে হলো সে এই চোখ আগেও দেখেছে।তাহলে কী তার সমস্যার সমাধান হতে চলেছে!
সে কী সত্যিই সেই!
মেয়েটি হতবিহ্বল এর মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে লুকানো চেষ্টা করছে।কিন্তু কিছু না পেয়ে এক দৌড়ে মাহাদ কে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
মুহূর্তেই মাহাদ হালকা দুলে উঠে। পরম আবেশে নিজের চক্ষুদ্বয় মুদিতো করে।তার মনে হলো একটা সুগন্ধি দেয়াল তাকে ধাক্কা মেরে চলে গেলো।
এ কেমন সুগন্ধ !যেনো কোনো অপার্থিব মোহে সে আচ্ছাদিত হচ্ছে।কোনো মানুষের শরীরে কী করে এতো সুগন্ধ হতে পারে!যা এক নিমিষেই কাউকে মাতাল করে দিতে পারে।এক হৃদয় কাঁপানো ঘ্রাণ।
মাহাদ ঝট করে চোখ খুলে তাকায়।ভাবলো,সে কী সত্যিই মানুষ!!!
চলবে,,,