বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ১

4
10609

সুউচ্চ পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।পড়নে তার নীল রঙের সালোয়ার কামিজ।ওড়নার দু’পাশ বাতাসের কারণে উড়ে চলছে।নিতম্ব ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলোও উড়ছে।সামনে থাকা ছোট ছোট অবাধ্য চুলগুলো ঢেকে দিয়েছে মেয়েটির চোখের নিচের অংশ যাতে করে চেহারা পুরোপুরি বুঝা যাচ্ছে না।মেয়েটি পাহাড়ের এমন জায়গায় দাঁড়ানো যেখান থেকে এক পা পিছনে দিলেই ইহকালের জন্য সে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে।মেয়েটির থেকে কয়েক হাত দুরেই দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে।চোখ ভরা তার করুণ আর্তনাদ যা তার গভীর মোহনীয় বাদামী মনিযুক্ত চোখে দৃশ্যমান।তিরতির করে কাঁপছে তার ডার্ক রেড কালারের ঠোঁট দুটো।ধবধবে ফর্সা চেহারায় একরাশ ভয় এসে জোড়ো হয়েছে।বিবশ হয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে।

হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মেয়েটি আচমকাই খিলখিলয়ে হেসে উঠে।ভয়াতুর দৃষ্টিতে অবলোকন করছে ছেলেটি মেয়েটির হাসি।বুকের বা’পাশের যন্ত্রটাও ধীরে ধীরে তার কম্পন থামিয়ে দিচ্ছে।শ্বাসনালী যেনো নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকারটা ক্রমশ কেঁড়ে নিচ্ছে।

মেয়েটি তার অদ্ভুত হাসি থামিয়ে কিছুক্ষন ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে।কিছুসময় পরে আবার স্মিত হেসে আবেগভরা গলায় বললো—

“আমাকে বাঁচাবেন না মাহাদ!আমি আপনার ভালোবাসার আম্বের।আপনার প্রজাপতি।আপনার বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি।বাঁচাবেন না আমাকে?

ছেলেটি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।সে কিছু বলতে চায় কিন্তু তার অন্তর্নিহিত কথামালা গুলো তার গলায় দলা পাকিয়ে আছে যা সে হাজার চেষ্টায়ও ছাড়াতে পারছে না।মেয়েটি কাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছেলেটির দিকে।অধরে তার রহস্যময়ী হাসি।সেই হাসির পরিস্ফুটন ঘটিয়ে আহত গলায় বললো—

“আমি চলে যাচ্ছি মাহাদ।আপনার থেকে দুরে,অনেক দুরে।আর কখনো ফিরে আসবো না।”

ছেলেটি তার অক্ষিপল্লব প্রশ্বস্ত করে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।সামনে এক পা বাঁড়াতেই মনে হলো কেউ যেনো তাকে আটকে রেখেছে।নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইলো ছেলেটি।মেয়েটি তার অধরদ্বয়ে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকলো।
হঠাৎ একঝাঁক নীল প্রজাপতি এসে মেয়েটিকে আপাদমস্তক আচ্ছাদন করে নিলো তাদের নীলিমায়।কিন্তু মেয়েটির সেই চোখ দুটো এখনো ছেলেটির দিকে স্নিগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে আছে।হালকা পা পিছিয়ে নিতেই মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো মেয়েটি পাহাড়ের সেই গভীর গহ্বরে।
ছেলেটি এইবার তার ভারী পুরুষালী কন্ঠে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বললো—-

“আম্বের!!!!!!

বিছানায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাহাদ।ঘন ঘন নিঃশ্বাসের সাথে কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে নেয়।কাঠ কাঠ গলায় তরল পানীয়ের প্রয়োজন।
পৌষের শুরু।পর্দার ফাঁক গলিয়ে পিনপিনে হিমেল হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে জানালার পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসে সুসজ্জিত কৃত্তিম ফুল।কিন্তু এর মধ্যেও মাহাদ এর কপাল জুড়ে খেলা করছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।গলার এডাম’স এপেল এর বেগতিত উঠানামা।মাহাদ অধরযুগল ছড়িয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।কোমরের নিচের অংশে থাকা কমফোর্টারটা সরিয়ে হালকা উল্টো ঝুঁকে বেড সাইড টেবিল থেকে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে তা ঢকঢক করে গিলতে থাকে।কিন্তু তাতেও সেই ভয়ংকর স্বপ্নের রেশ মোটেও কাটে নি।

মাহাদ বিছানা থেকে উঠে ফ্লোরে থাকা জুতো তে নিজের পা গলিয়ে নেয়।চিন্তিত মুখে নরম পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।

মাহাদ আবইয়াজ।সাম্প্রতিক কালের একজন টপ ফিল্মস্টার।টানা তিনবার ফিল্ম ফেয়্যার এওয়ার্ড প্রাপ্ত মাহাদ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।যার দক্ষ অভিনয়ে কেউ কাঁদে তো কেউ হাসে।

সবার জীবনেই একটা গল্প থাকে।নাম না জানা গল্প।সেই গল্পে থাকে হাজারো ছোট ছোট উপাখ্যান।প্রতিটি উপাখ্যানে থাকে এক একটি চরিত্র।পুরো গল্পের কোথাও না কোথাও সেই চরিত্রের প্রভাব লক্ষণীয়।

মাহাদ আবইয়াজ, দিনের আলোতে যার জীবন আলোয় ভরা রাতের গভীরে সে খুঁজে ফিরে তার অস্তিত্ব।গত সাত বছর ধরে সে এই বিভৎস স্বপ্ন দেখে চলছে।এক অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা তার জীবনের অনেকটা সময় কেড়ে নিয়েছে ঘড়ির কাঁটার আড়ালে।পাঁচ বছর ধরে দেশি বিদেশি অনেক সাইক্রিয়াটিস দেখিয়েও মাহাদ তার এই ভয়ার্ত স্বপ্নের কিনারা খুঁজে পায়নি।

ছয় ফুট দু ইঞ্চির সুদীর্ঘ,সুবিশাল বক্ষ বিশিষ্ট এক সুপুরুষ মাহাদ।তার আশেপাশে হাজারো নারীর আনাগোনা।কিন্তু তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।ত্রিশ প্লাস বয়সের মাহাদের জীবনের কালো অধ্যায় সম্পর্কে তার প্রানপ্রিয় ভক্তরা অবগত নয়।
ঘন পল্লব যুক্ত অক্ষিযুগলে একবার যার নজর পরবে ক্ষনে ক্ষনে যেনো তার ইচ্ছে হবে ওই চোখের চাহনিতে যেনো নিঃশ্বাস আটকে যায় তার।অধর জুড়ে লেগে থাকে এক অদ্ভুত গম্ভীরতা।কিন্তু তার মাঝেও তার সেই মোহবিষ্ট রূপ এক দেখায় যেকোনো নারীর হৃদয়হরণ করার জন্য যথেষ্ট।

কপালে চিন্তার ভাঁজরেখা ফুটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের মিররে অক্ষি নিবদ্ধ করে মাহাদ।দেহের নিম্নাংশে অ্যাশ কালারের ট্রাউজার পড়া।ফর্সা পেটা শরীরের নগ্ন বুকে তাকাতেই ঘিন ঘিন করে উঠে মাহাদ এর শরীর।তাকে এভাবে দেখার জন্য হাজারো নারী চাতক পাখির মতো বসে থাকে কিন্তু মাহাদ এর কাছে এই জিনিসটাই সবচেয়ে ওরষ্ট মনে হয়।বিছানায় পড়ে থাকা টি শার্ট গলিয়ে নেয় শরীরে।

পকেটে দু হাত গুঁজে হালকা পায়ে নিজের বিশাল খোলা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় মাহাদ।ঘুম থেকে সদ্য উঠায় এলোথেলো হয়ে আছে মাথার চুল তাতেও একরত্তি তার সৌন্দর্য ফিকে পড়েনি বরং বেড়েছে দ্বিগুন হারে।ব্যালকনিতে পা রেখেই স্থির হয় মাহাদ।কিছুক্ষন নিশ্চল থেকে ব্যালকনির এধার থেকে ওধারে বার দুয়েক পায়চারী করে মাহাদ।কারণ কিছুক্ষন পরই ভেসে আসবে এক অদ্ভুত সুগন্ধ।
গত কয়কদিন ধরেই এমনটা হয়।মাহাদ এর ব্যালকনি থেকেই তার গার্ডেন দৃশ্যমান।ব্যাক ইয়ার্ডেও আছে গার্ডেন যা অনেকটা পার্ক সিস্টেম করা।বিশাল এলাকা জুড়ে মাহাদ এর ডুপ্লেক্স বাড়ির সীমানা।ছাদে দুটো চিলেকোঠা আছে যা সবসময় বন্ধই থাকে।
মাহাদের বাড়িটা শহর থেকে বেশ দুরেই।আশেপাশে কয়েক মিটার জুড়েই বিরান ভুমি।নিরব,নিস্তব্ধ এলাকা।রাতের আঁধারে পুরোই অপার্থিব মনে হয়।

কিছুক্ষনের মধ্যেই ভেসে আসে সে অদ্ভুত সুগন্ধ।মাহাদ টানা দুইদিন সময় নিয়ে তার গার্ডেন এর সব ফুলের ঘ্রান টেষ্ট করে দেখেছিলো।কিন্তু সেই অদ্ভুত ঘ্রাণ এর কোনো হদিস পাওয়া যায় না।
মাহাদ এর বাড়িতে যারা থাকে তার সবাই নিতান্তই তার বেতন ভুক্তভোগী সার্ভেন্ট।আর যদি এইটা কোনো ব্র্যান্ডেড পারফিউম এর ফ্রিগোয়েন্স হয়ে থাকে তাহলে তার সার্ভেন্টের মধ্যে তা এফোর্ড করার ক্ষমতা কেউ রাখে না।
মাহাদ শান্ত হয়ে দাঁড়ায়।এ কয়েকদিনে এই সুগন্ধের প্রতি এক অদ্ভুত মোহ তৈরি হয়েছে তার।মাঝে মাঝে বাড়ির ভিতরেও সে এই অদ্ভুত সুগন্ধ পায়।কিন্তু তার উৎপত্তিস্থল আজোও তার অজানা।

স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া বইছে।মৃদু কম্পন উঠে মাহাদ এর শরীরে।বারকয়েক হাত চালায় নিজের অগোছালো চুলে।এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নেয় মাহাদ সাথে সেই অদ্ভুত সুগন্ধ।হাওয়ার তোড় বাড়তে থাকে।শরীরের সব কয়টা লোম মাথা উঁচু করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।হিম শীতল কনকনে শীতের বায়ু যেন বক্ষ ভেদ করে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে মনে হয়।মাহাদ এখনো নিথর,নিস্তব্ধ,নিষ্প্রভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় অতি মাত্রায় সক্রিয় কারণ সেই অদ্ভুত সুগন্ধি ক্রমশ তার তীব্রতা বাড়াতে লাগলো যেনো আশপাশেই কোথাও তা উঁকি দিচ্ছে।
বেশ কিছু সময় পর মাহাদ বুঝতে পারে তার মোহনীয় সেই সুগন্ধি ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে।মাহাদ ঘরে প্রবেশ করে।ব্যালকনির থাই লাগিয়ে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।
ওয়াটার হিটার অন করে বিবশ চোখে তাকিয়ে থাকে বাকেট এর দিকে।তার শরীর এখানে হলেও তার মস্তিষ্ক জুড়ে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সেই মাতাল করা ঘ্রান।

এক লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয় মাহাদ।কোমরের নিম্নাংশে টাওয়েল পেঁচিয়ে বের হতেই মিররে আবারো নিজেকে দেখে বিশ্রি একটা অনুভুতি হয় মাহাদ এর।ভেজা শরীরেই স্লীভলেস গেঞ্জি পড়ে নেয়।
ঘুম হয়নি ভালো করে তার।শুটিং শেষ করেছে প্রায় মধ্য রাতে।আর ভোরের দিকে সেই ভয়ংকর স্বপ্ন।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।চোখের দুপাশের অংশ অবর্ণনাতীত ব্যথায় ঝিমুনি দিয়ে উঠছে।কাভার্ড থেকে ব্ল্যাক কালারের ট্রাউজার বের করে তা পড়ে নেয়।টাওয়েল দিয়ে আরেকটু সময় নিয়ে মাথা মুছে তা ছুঁড়ে মারে বিছানার উপর।

ঘর থেকে বের হয় মাহাদ।দোতালা বাড়ির নিচ তলায় তিনটা বেড রুম।একটা কিচেন আর লিভিং রুম।একটা সার্ভেন্ট রুম আছে কিন্তু সেটা মাহাদ এর সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকের জন্য।এই বাড়িতে একজন কাজের লোকের পরিচয়ে সে থাকলেও মাহাদ কখনো তাকে কাজের লোক ভাবে না।
বাকি সার্ভেন্টদের জন্য বাড়ির বাইরে সার্ভেন্ট কোয়াটার আছে।তারা সেখানেই থাকে।বাড়ির উত্তর দিকে গেস্ট হাউস।একান্তই স্পেশাল কেউ না হলে বাড়িড় ভিতরের ঘরে থাকার কারো অনুমতি নেই।

দোতলায় দুটো মাস্টার বেড।যার একটা মাহাদ নিজে ইউজ করে।আরেকটা বন্ধ ই থাকে।আর একটা নরমাল বেড রুম।এখানেও একটা কিচেন রুম আছে যার পাশেই ডাইনিং স্পেস।বলা চলে দোতলার করিডোর কে মাহাদ ডাইনিং স্পেস আর ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহার করেছ।তার গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচনা সে এখানেই করে থাকে।
টেবিলে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে।পাশেই দাঁড়ানো আলতাফ মাহমুদ।মাহাদ এর সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী।রক্তের সম্পর্কেও উর্ধ্বেও যে ভালোবাসার সম্পর্ক হয় তার দৃষ্টান্ত আলতাফ মাহমুদ।
থমথমে ভাব নিয়ে চেয়ার টেনে বসেছে মাহাদ।একরাশ গভীর চিন্তা তার নাকের ডগায় ভর করেছে।চোখ দুটোতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট।আলতাফ মাহমুদ নির্ণিমেষ তাকিয়ে মাহাদ কে দেখছে।পিরিচের উপর রাখা স্যান্ডউইচ এ কামড় বসাতেই হকচকিয়ে উঠে মাহাদ।তার নাকের ডগায় বারি খায় সেই সুগন্ধ।মাহাদ উদ্বেলিত চোখে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় কিছু বলতে গিয়ে দমকে যায়।ছোট্ট একটা দম ফেলে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো—-

“এই খাবার কে বানিয়েছে?

আলতাফ মাহমুদ সরল মনের মানুষ।তার কথায় একধরনের মায়া আছে।গত দশবছর ধরে সে মাহাদ এর সাথে আছে।আজকের মাহাদ আবইয়াজ তো আর একদিনে তৈরি হয়নি।এর পেছনেও রয়েছে অনেক ভয়ংকর অতীত।আলতাফ অবিচলিত ভাবে নরম গলায় বললেন—

“যে রোজ তৈরি করে।”

মাহাদ এর ঘরে সব কাজের জন্য আলাদা আলাদা লোক রাখা।রান্নার জন্য স্পেশাল সেফ।মাসশেষে মোটা অঙ্কের স্যালারী দেওয়া হলেও মাসে হাতে গনা কয়েকদিন মাহাদ এর বাড়িতে খাওয়া হয়।
কিন্তু মাহাদ বুঝতে পারলো এই খাবার তার রেগুলার সেফ এর হাতে বানানো নয়।মাহাদ ভাবতে লাগলো গত কয়েকদিন ধরে তার অগোচরে এই বাড়িতে কিছু একটা হচ্ছে।যা সম্পর্কে এই বাড়ির অনেকেই জানে কিন্তু সে কিছুই জানে না।
মাহাদ এর আপন কেউ নেই।এই বাড়িতে কাজ করা লোকগুলোই তার আপন পর যা কিছু।
মাহাদ আরো একটা বাইট বসায় স্যান্ডউইচ এ।গ্লাসে থাকা অ্যাপেল জুস এ কয়েকটা চুমুক দিয়ে উঠে পড়ে চেয়ার থেকে।
শৈত্য প্রবাহের কারণে তার নতুন কন্ট্রার্ক করা এডফিল্ম এর শিডিউল দুদিন পেছানো হয়েছে।সেই মতে আগামী দুই দিন সে একদম ফ্রি।ফিল্মি জগতে অনেক মানুষের সাথে তার সখ্যতা থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে সে সবচেয়ে বেশি হেট করে তার প্রফেশন কে উইথ এই প্রফেশনের সাথে জড়িত মানুষ কে।

মাহাদ ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে তার বাড়ি থেকে যার নাম দিয়েছে সে”স্বপ্নমহল”।হ্যাঁ স্বপ্নই।একদিন এই সবকিছুই স্বপ্ন ছিলো যা আজ বাস্তব।কিন্তু যার জন্য করা এই সবকিছু সে হারিয়ে গেছে মাহাদ এর জীবন থেকে।
নরম পায়ে নিজের চোখ কান খোলা রেখে নিজের বাড়ির আঙিনাতেই গোয়েন্দার মতো ঘুরছে মাহাদ।সেই সুগন্ধের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে সে।
চকিতে মাহাদ এর মনে হলো সেই ঘ্রান ভেসে আসছে তার সার্ভেন্ট কোয়াটার থেকে।মাহাদ থমকে যায়।উদ্ভাসিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেইদিকে।কিছুক্ষন দৃঢ় চাহনিতে সবকিছু অবলোকন করেই সেইদিকে পা বাড়ায় মাহাদ।দুই এককদম সামনে এগোতেই এক নির্মল কন্ঠ ভেসে আসে মাহাদ এর কানে।আলতাফ বললো—

“মাহাদ বাবা!

মাহাদ তার পদযুগল থামিয়ে পিছন ঘুড়ে তাকায়।আলতাফ কে দেখে স্মিত হাসে।নম্র গলায় বলল—

“কিছু বলবেন চাচা?

আলতাফ অধর জোড়া ছড়িয়ে চোখে হাসলেন।মৃদু গলায় বললেন—

“জ্বী।”

আলতাফ থামলেন।সে কী বলতে চায় তা মনে মনে আওড়াচ্ছেন।মাহাদ নিস্পলক তাকিয়ে তার অধরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে।মাহাদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে হৃদয়গলানো হাসি দিয়ে সরস গলায় বললো—

“বলেন কী বলবেন।”

আলতাফ এর ভ্রু যুগলের বিকৃত রূপ মাহাদের চোখ এড়ালো না।এক নিরুদ্বেগ,প্রশান্তিদায়ক চেহারার অধিকারী আলতাফের চোখে,মুখে কৃত্তিম হাসির ফোয়ারা মাহাদ বুঝতে পারলো।আলতাফ তার নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক আর অবিচলিত রাখার চেষ্টা করছে।আলতাফ কৃত্রিম হাসলেন,বললেন—-

“আপনি কী কোনো বিষয়ে চিন্তিত?

মাহাদ বিগলিত হাসলো।পকেটে গুঁজে রাখা বাম হাত বের করে তার আঙ্গুল গুলো চুলে গলালেন।স্বাভাবিক গলায় বললো—

“তেমন কিছু নয় চাচা।আসলে….।”

মাহাদ তার কথা শেষ করলো না।কিছু একটা ভেবে চুপ থাকলো।সে চায় না তার অবান্তর ভাবনার জন্য আলতাফ এর স্নিগ্ধ হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কোনোরকম চিন্তার রেখা ফুটে উঠুক।মাহাদ অধর কোণে স্মিত হেসে মোলায়েম গলায় বললো—

“আসলে অনেকদিন হলো সার্ভেন্টদের সাথে কথা হয় না।তাদের কোনোরকম কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না!

আলতাফ মৃদু স্বরে শান্তভাবে বললেন–

“আপনার কী আমার উপর ভরসা নেই মাহাদ বাবা?

আলতাফ এর করা উদ্ভট প্রশ্নে দমে গেলো মাহাদ।অপ্রস্তুত বোধ করলো সে।তার সার্ভেন্টদের সকল ধরনের কাজের হিসাব রাখে আলতাফ।সেখানে এই ধরনের অসংলগ্ন প্রশ্নে নিজেই খানিকটা লজ্জিত হলেন মাহাদ।
মাহাদ গাঢ় গলায় বললো—

“এমনটা নয় চাচা।দু’দিন ফ্রি।তাই ভাবলাম তাদের সাথে একটু কথা বলি।”

আলতাফ শীতল গলায় বললেন—

“তাহলে আপনি ঘরে যান,আমি তাদের আসতে বলছি।”

মাহাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে।সে অনুতপ্ত।এমনটা তার বলা উচিত হয়নি।মাহাদ আলতাফের আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলেন।আলতাফের গায়ে জড়ানো শীতের শীতলতা থেকে বাঁচার জন্য ভারী চাদরটা আরেকটু ভালো করে তার গায়ে জড়িয়ে দিলেন।মাহাদ দৃঢ় গলায় বললো–

“তার প্রয়োজন নেই চাচা।সরি।”

মাহাদ তার “স্বপ্নমহল” এ পা বাড়ায়।মাহাদ যেতেই এক সুদীর্ঘ চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে আলতাফ এর ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপা শরীরের শ্বাসনালী থেকে।প্রসন্ন হাসলেন আলতাফ।কিন্তু ভয়ের সীমারেখা ক্রমশ তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারার রঙ পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।সে দ্বিধান্বিত।যা হচ্ছে তা কী ঠিক হচ্ছে!মাহাদ কে সত্যটা কী বলে দেওয়া উচিত!আচ্ছা,সে যদি জানতে পারে যে মানুষগুলোকে সে বিশ্বাস করেছে তারা তাকে ঠকাচ্ছে।ব্যাপারটা কেমন হবে!ব্যাপারটা খুবই বিশ্রি আর ভয়ংকর হবে।
আলতাফ ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে সার্ভেন্ট কোয়াটারের দিকে তাকালেন।সার্ভেন্ট কোয়াটার এর জানালায় তিনি কাউকে দেখলেন।তাকে দেখেই প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন।চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলেন ভয়ের কিছু নেই।তারা তার পাশে আছে।
ব্যক্তিটি আলতাফ এর ইশারায় সুপ্রসন্ন হলেন।
,
,
,
সারাদিন অলস সময় কাটায় মাহাদ।ছাদে গিয়ে কিছুক্ষন পায়চারী করে পুরো বাড়ি গভীরভাবে অবলোকন করে।কিন্তু কোথাও সে সন্দেহ করার মতো কিছুই দেখতে পায় না।দুপুরের খাওয়ার পর নিজের ঘরের ল্যাপটপ নিয়ে বিছানার হেডবোর্ড এর সাথে হেলান দিয়ে বসে মাহাদ।সে ভাবছে।এক অদ্ভুত ভাবনা তার মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।সে যা ভাবছে তার কী আদৌও কোনো অস্তিত্ব আছে!নাকী সবই তার অবচেতন মনের অপার্থিব ধারণা!নাকী তার দেখা সে ভয়ংকর স্বপ্নের সাথে এর কোনো যোগসূত্র আছে!
মাহাদ ভাবলো এইবারের এডফিল্মের কন্ট্রাক্ট শেষ হলে সে শেষ বারের মতো চেষ্টা করবে।তার পরিচিত একজন অস্ট্রেলিয়ার খুব নামকরা এক সাইক্রিয়াটিস্ট এর কথা বলেছে।মাহাদ এইবার তার সাথেই দেখা করবে।

বিকেলটা কাটে একদম নীরসভাবে।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো বলে।শীতের রাত বেশ দীর্ঘ হয় আর দিন স্বল্প পরিসর।বেলা পড়তেই সূর্যের রশ্মি ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে।
উত্তুরে হিমেল হাওয়া যেন কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছে মাহাদ এর গায়ে।পাতলা একটা শার্ট পড়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সূর্য্যের রঙবদল দেখছে সে।পশ্চিমাকাশ কমলা রঙে রাঙিয়েছে নিজেকে।ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে ধরনী কুয়াশা চাদরে।ঘোর লেগে যায় যেনো এই দৃশ্যে।

আজ দিনটা একদম ভালো যায়নি মাহাদ এর।তার কোনো পরিকল্পনাই সফল হলো না।রাতের খাবার খেয়ে আর বেশিক্ষন অপেক্ষা করলো না সে।কারণ আগের রাতেও সে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি।

রাত তখন দুটো ছুঁই ছুঁই।কমফোর্টার এর নিচে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মাহাদ।হঠাৎ তার কানে ভেসে আছে নূপুরের মৃদু আওয়াজ।দোতলায় মাহাদ একাই থাকে।তাই বেশিরভাগ সময় দরজা না লাগিয়ে শুয়ে পড়ে।আর দরজার ফাঁক গলিয়েই সে আওয়াজ ভেসে আসছে মাহাদ এর কানে।
নিভুনিভু চোখ দুটো তে হালকা হাতের ঘর্ষণ দিয়ে মাহাদ তার কর্ণ জোড়া সেই শব্দের দিকে অভিনিবেশ করে।শব্দটা জোড়ালো হলো।মাহাদ ঝট করে উঠে বসে।গায়ের উপর থেকে কমফোর্টার সরিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে লাইট অন করে।মাহাদ টের পায় সেই অদ্ভুত মোহনীয় ঘ্রান ভেসে আসছে।
মাহাদ দেরি করলো না।দরজার বাইরে আসতেই সে দেখলো রান্নাঘর থেকে একটা অন্ধকার ছায়া দৌঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।মাহাদ থমকে যায়।বিস্মিত চোখজোড়া প্রশ্বস্ত করে শক্ত গলায় বললো—

“স্টপ রাইট নাউ।ডোন্ট মুভ।”

অন্ধকার ছায়াটি থেমে যায়।মাহাদ কিছুই বুঝতে পারে না।এই বাড়িতে চোর !
জাস্ট ইম্পসিবল।আর সার্ভেন্টরা কেউ এতো রাতে বাড়ির ভেতরে আসবে না।আর আসলেও দোতালায়!
মাহাদ এর মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।অন্ধকার ছায়াটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।আর সেখান থেকে ভেসে আসছে সেই সুগন্ধ।মাহাদ আবারো জোর গলায় বললো—

“ডোন্ট মুভ।”

মাহাদ ধীর পায়ে একটু একটু করে পিছোতে থাকে।করিডোর এর দক্ষিন পাশেই সুইচ বোর্ড।সেখানে গিয়ে সুইচ অন করতেই মাহাদ তাকাতেই দেখলো সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।বিস্ফোরিত চোখ দুটো যেন মুহূর্তেই মিইয়ে যেতে লাগলো।

চলবে,,,

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভুতি
#পর্বঃ১
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

4 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here