#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৩৩
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
সুনসান নিরাবতায় এসির ভোঁতা আওয়াজ এ ঝিমঝিম করছে মস্তিষ্ক।রুদ্ধ নিঃশ্বাসের সাথে একে অন্যের দিকে ক্ষীপ্ত চাহনি যেনো ভেঙে দিচ্ছে সব নিস্তব্ধতার মায়াজাল।
মাহাদ এক পলক তাকায় আম্বের এর দিকে।ভীতসন্ত্রস্ত আম্বের তার শিয়র নত করে ফাইরুজার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।আম্বের কে দেখেই নম্রতা নেমে আসে মাহাদ এর চোখে।অনবরত কাঁদছে আম্বের।আম্বের থেকে চোখ ফিরিয়ে ফাহাদ এর দিকে তাকায় মাহাদ।জ্বলন্ত চোখ দুটো দিয়ে ইচ্ছে হচ্ছে যেনো এখনই ফাহাদ কে জ্বালিয়ে দেয়।
অধর ছড়িয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো—
“তোর সাহস কী করে হলো আমার সন্তানকে মারার কথা বলার?
ফাহাদ বিস্মিত দৃষ্টিতে ব্যগ্র গলায় বললো—
“তততুইই!
এখানেএএ কেন?
মাহাদ চোয়াল শক্ত করে বললো—
“কেন!
আসা উচিত হয়নি?
ফাহাদ ভীত গলায় বললো—
“দেখ মাহাদ তুই কিন্তু….।”
“আমি কিন্তু তোকে এখনই খুন করতে পারি।”
মাহাদ এর কথায় গর্জে উঠে ওলিজা।গমগমে গলায় বললেন—
“এইসব কী বলছিস তুই!নিজের ভাইকে মারার কথা বলতে লজ্জা করছে না তোর?
উদ্ভ্রান্তের মতো হাসে মাহাদ।অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে ঠোঁট চিপে ধরে বললো—-
“ভাই!কিসের ভাই!
যখন আমি কারো সন্তানই নই তখন আমার ভাই আসবে কোথা থেকে মিসেস শেখ?
ওলিজা তপ্ত গলায় বললো—
“মাহাদ!
“শিষষষ!
একদম আওয়াজ না।”
আম্বের এর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে নিরীহ গলায় বললো—
“আই এম সরি মিস আম্বের।যা হয়েছে বা যা হচ্ছে তার কোনোটাই ঠিক নয়।কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যে নয় না আমাদের সন্তানের অস্তিত্ব।চলেন আমার সাথে।”
আম্বের নড়লো না।শ্বাস আটকে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।ফাইরুজা আম্বের কে পুশ করে বললো—
“দেখো আম্বের সবসময় আমরা যা চোখে দেখি তা সত্য নাও হতে পারে।অনেক সত্যই মিথ্যের আঁড়ালে ঢেকে যায়।আমি তোমার আর মাহাদ এর সম্পর্কের গভীরতা জানি না।তুমি ওকে ক্ষমা করবে কিনা তা একান্ত তোমার ইচ্ছে।কারণ যা ঘটেছে তার একমাত্র ভুক্তভোগী তুমি।কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি একা নও।তোমার সন্তানকে তুমি এদের হাত থেকে একা বাঁচাতে পারবে না।আর সব মা তো এক নয় যে অর্থের লোভে নিজের সন্তানকে ত্যাগ করবে।তাই বলছি যাও মাহাদ এর সাথে।বাঁচাও তোমার অনাগত সন্তানকে।”
আম্বের কিছুক্ষন মাহাদ এর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।সত্যিই তার এখন নিজের সন্তানের সেফটি প্রয়োজন।মাহাদ হাত বাড়িয়ে কাতর গলায় বললো–
“প্লিজ মিস আম্বের।”
আম্বের নিজের কান্নার দলা গিলে নেয়।মাহাদ এর পাশে এসে দাঁড়াতেই তেতে উঠে ওলিজা।তীক্ষ্ম গলায় বললেন—
“মাহাদ!
তুই আমাকে কথা দিয়েছিস।”
মাহাদ বিগলিত হাসে।শক্ত গলায় বললো—
“কথা দিয়েছি এবং সেই কথা রেখেছি।আমার প্রাণেশ্বরী কে আমি আপনার হাতে তুলে দিয়েছি।কিন্তু আপনি কী করেছেন!
যার গায়ে আমিও ভুলেও একটা আঁচড় লাগতে দেইনা আপনারা মা ছেলে তার গায়ে হাত তুলেছেন!
মাহাদ থামে।ফিচেল হেসে বললো—
“এখন নিশ্চয়ই আপনি চাইবেন না আপনার একমাত্র আদরের ছেলের সাথে এমন কোনো মেয়ের বিয়ে দিতে যে অন্য পুরুষের সন্তানের মা হতে চলেছে!
ওলিজা উত্তপ্ত গলায় বললেন—
“মাহাদ!
মাহাদ শান্ত ভঙিতে বললো—
“সরি মিসেস শেখ।আমি আমার কথা রেখেছি কিন্তু আপনি আপনার শর্ত ভেঙেছেন।তাই আমি আমার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
আর আজকের পর আমার আর কোনো ঋণ নেই আপনার কাছে।সব পরিশোধ করেছি আমি।আমাকে জন্ম দেওয়ার ঋণ,আমাকে বাঁচানোর ঋণ।
যেই মা নিজের বিলাসিতার জন্য নিজের পাঁচ বছরের সন্তানকে ছেড়ে চলে আসতে পারে সে আর যাই হোক মা হতে পারে না।”
মাহাদ এর আর্দ্র গলার আওয়াজ এ বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয় ওলিজার।চোখ জ্বলে উঠে তার।আসলেই মা হওয়ার যোগ্য না সে।নিজের সুখের জন্য নিজের সন্তানকে ছেড়ে আসতেও দুবার ভাবে নি ওলিজা।
অগ্নিশর্মা ফাহাদ পা বাড়াতেই আক্রোশভরা গলায় মাহাদ বললো—-
“ওখানেই দাঁড়া।আজকের পর আমার স্ত্রী আর সন্তানের দিকে তাকাবি তো তোর চোখ আমি উপড়ে ফেলবো।এই কাহিনি এখানেই শেষ।
চলেন মিস আম্বের।”
আম্বের কে নিয়ে চেম্বার থেকে বের হয় মাহাদ।আহত বাঘের মতো হুংকার দিয়ে উঠে ফাহাদ।মোবাইল বের করেই কল করে কাউকে।ওলিজা ব্যস্ত হয়ে বললেন—
“কাকে কল করছিস তুই?
“মাহতাব খান কে।আম্বের যখন আমার হবেই না তখন ওর বেঁচে থেকে কী লাভ!
ওলিজা আঁতকে উঠে।অনেক কষ্ট দিয়েছে সে মাহাদ কে আর না।কিন্তু সে কিছু করার আগেই ফাহাদ সব জানিয়ে দেয় মাহতাব খান কে।
,
,
,
দু গালে দুটো সজোরে থাপ্পড় পড়ায় ফ্লোরে গিয়ে পড়ে ওলিজা।প্রজ্জ্বলিত চোখে তাকিয়ে নিজের উপর ঘৃণা ধরছে রাহাত শেখ এর।মাত্রই ফিরেছেন তিনি।আম্বের এর সাথে হওয়া কোনো ঘটনাই তার অজানা নয়।ফাইরুজা সব খুলে বলেছে।ছোটবেলা থেকে কখনো ফাহাদ এর গায়ে হাত তুলেনি রাহাত।কিন্তু আজ আর নিজেকে থামাতে পারলেন না।দু ঘা দিলেন তিনি।ওলিজা কে উদ্দেশ্য করে কড়া গলায় বললেন—
“কেমন মা তুমি!এক ছেলেকে বানের জলে ভাসিয়ে আরেক ছেলে সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছো!তোমার উচিত ছিলো মেয়েটাকে শেল্টার দেওয়া।সে জায়গায় তুমি তাকে ব্ল্যাকমেল করলে!
হোয়াই ওলিজা হোয়াই?
ফাহাদ এর জন্য?
মাহাদ কী তোমার সন্তান নয়!জন্ম দাওনি তুমি তাকে!বাবার মৃত্যুর পর মা থাকা সত্ত্বেও এতিমখানায় বড় হয়েছে মাহাদ।নিজের পরিশ্রমে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে।আর সেখানে গিয়েও হানা দিলে তোমরা।আরে ওর মতো ছেলে তো লাখে এক হয়।
আর এইটাকে কী বানিয়েছো!রাস্তা থেকে মেয়ে তুলে আনা,ড্রাগস নেওয়া,টর্চার করা এইসব!শেইম অন ইউ ওলিজা,শেইম অন ইউ।”
গজরাতে গজরাতে নিজের ঘরের দিকে যায় রাহাত।আজ এতোদিন পর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে সে।
,
,
,
হাইওয়ে তে ফুল স্প্রীডে চলছে গাড়ি।নৈঃশব্দে শুধু শোনা যাচ্ছে গাড়ির শা শা আওয়াজ।শহর থেকে অনেক দূর চলে এসেছে তারা।হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আর একটা কথাও বলেনি আম্বের।ধুম ধরে বসে আছে সে।
আচমকা আম্বের ধমকে উঠে বললো—
“গাড়ি থামান।”
মাহাদ হকচকিয়ে বললো—
“কিন্তু মিস সুগন্ধি..।”
“থামাতে বলেছি আপনাকে।”
মাহাদ ব্রেক লাগায়।দরজা খুলেই হনহন করে পেছন দিকে হাঁটা ধরে আম্বের।মাহাদ ত্রস্ত পায়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আম্বের এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।স্বাভাবিক গলায় বললো—
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
আম্বের দৃঢ় গলায় বললো—
“ধন্যবাদ।আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন।এখন আমাকে যেতে দিন।”
মাহাদ ছোট্ট শ্বাস ফেলে আম্বের এর হাত ধরতেই ঝাঁটকা মেরে সরায় আম্বের।দাঁতে দাঁত চেপে বললো—
“একদম আমাকে ছোঁবেন না।”
মাহাদ অধর ছড়িয়ে এক দীর্ঘ শ্বাস টেনে তা আবার নিঃসৃত করলো।কোমল গলায় বললো—
“আপনার রাগ জায়েজ।কিন্তু আমাকেও একবার নিজের রেফারেন্সে কিছু বলতে দিন।”
“আমি শুনতে চাই না।”
“আপনাকে শুনতে হবে।”
আম্বের ঝরা হাসে।উপহাসমিশ্রিত গলায় বললো—
“কেন?
আমি আপনার দাসী!আমি তো দুইটাকার মেয়ে।যার সাথে আপনি রাত কাটিয়েছেন।আর আপনার সেই সুখময় রাতের শাস্তি আমাকে দিলেন।আমি মা হতে চলেছি মাহাদ,আমি মা হতে চলছি।
এক রাস্তার মেয়ের গর্ভে বেড়ে উঠছে আপনার সন্তান।মাহাদ আবইয়াজ এর সন্তান।”
শেষের কথাগুলো আম্বের চিৎকার করে বললো।মাহাদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নিঃশব্দে বয়ে চলা তার ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সে কাউকে দেখাতে পারছে না।তার পুরুষালী পাথর শরীরের কোথাও যে হৃদয় নামে একটা যন্ত্র আছে তা তো সে অনেক আগেই তার সুগন্ধির নামে সমর্পণ করেছে।ভালোবাসে সে তাকে।নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।এমন করে তো নিজেকেও কখনো ভালোবাসেনি সে।চায়নি জীবনে কাউকে যতটা তার প্রজাপতি কে চেয়েছে।নিজের মন,শরীর,সত্তা সবকিছুর সাথে লড়াই করে আজ সে ক্লান্ত।সে তৃষ্ণার্ত।আর এই তৃষ্ণার্ত বুকের অথৈ সাগর যে তার ভালোবাসার সুগন্ধি প্রজাপতি।
আম্বের শান্ত গলায় অনুরক্তির সাথে বললো—
“আমি কী পন্য মাহাদ!যখন যেখানে খুশি ছুঁড়ে ফেলছেন আপনি।একবার এই জায়গায় তো একবার ওই জায়গায়।ভালবেসেছি আপনাকে।বিশ্বাস করেছি।কিন্তু আপনি!
কেন করছেন আমার সাথে এইসব!আপনার ভাই,আপনার মা,আপনার সবকিছু।তাহলে সে সবকিছুর মাঝে আমাকেই কেন কষ্ট পেতে হয়!তাহলে কী সব আমারই দোষ?
মাহাদ কিছু বললো না।চোখ বুজে অশ্রু বিসর্জন দিলো।আম্বের তার স্থির চোখ দুটো মাহাদ এর মুখচ্ছবি তে আবদ্ধ করে রেখেছে।মাহাদ দুম করে হাঁটু ভেঙে আম্বের এর সামনে বসে পড়ে।আম্বের এর কোমর জড়িয়ে ধরে দুই হাত দিয়ে।নিজের মাথাটা চেপে ধরে আম্বের এর পেটের সাথে।আর্দ্র গলায় বললো—-
“ক্ষমা চাইবো না আমি আপনার কাছে।আমার জন্য না হোক একবার শুধু আমাদের সন্তানের কথা ভেবে আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিন প্রজাপতি।শুধু একবার বলার সুযোগ দিন।”
আম্বের এর হেঁচকি তোলা কান্নায় ক্ষনে ক্ষনে তার বুক কেঁপে উঠে।কম্পনরত ডান হাতটি মাহাদ এর চুলে গলিয়ে দেয় আম্বের।নিজেও বসে পড়ে সড়ক পথের সেই অজানা রাস্তায়।
আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।থালার মতো চাঁদের আশেপাশের হাজারো তারার ঝলকানি।পাশেই রয়েছে ফুটপাতের গ্রীল।সেখান থেকে নিচে তাকালে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় নদীর পানি।আঁকাবাঁকা ঢেউ খেলছে নদীতে।
সেই চাঁদের রুপালি আলোয় আম্বের ভালো করে দেখে মাহাদ কে।তার চোখ,মুখ,ঠোঁট।এই কয়েকদিনে একদম বদলে গেছে মানুষটা।চেহারার সেই উজ্জ্বলতা যেনো ম্লাণ হতে চলেছে।ঠোঁটের সেই দীপ্ত হৃদয় গলানো হাসি মনে হয় না হেসেছে সে অনেকদিন।আম্বের নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে মাহাদ এর দিকে।মাহাদ আরেকটু কাছে এসে বসে।তার চোখ নিবদ্ধ আম্বের এর চোখে।নির্বিকারভাবে মাহাদ বললো—
“একবার আমাকে বলার সুযোগ দিন।”
আম্বের নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়।আম্বের এর কম্পিত ওষ্ঠাধর ক্রমশ টানছে মাহাদ কে।নিজের বাম হাত রাখে আম্বের এর গালে।বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে স্লাইড করে তার গালে।ঘাড় কাত করে এক দীর্ঘ চুম্বন করে আম্বের এর ঠোঁটে।আম্বের তার অক্ষিযুগল বুজে নেয়।
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ
কমেন্টস করতে এতো কেন কষ্ট😒😒😒😒।
আমিও আর রোজ রোজ কষ্ট করবো না🙂🙂)