#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৩৮
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।সূর্যের তেজি রশ্মি ছুঁইছে ধরণীর বুক।পিচঢালা সড়ক পথে চলছে বিরামহীন গাড়ি।শা শা শব্দে চলছে তা।মাঝপথে ট্র্যাফিক সিগন্যালে অপেক্ষা লাল হলুদ সবুজ বাতির।
আকাঙ্খিত বাতির সিগন্যাল পড়তেই শা শা করে আবার ছুটে গাড়ি।জানালায় মুখ দিয়ে উন্মনা হয়ে বসে আছে আম্বের।তার দীর্ঘ ঘন কালো রেশম চুলে বেনুনি করা।কপালের এধারে ওধারে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট চুল গুলো উড়ছে এলোমেলো হালকা বাতাসের আলোড়নে।বাহিরের জগত খুব কম দেখেছে আম্বের।ছোটবেলা থেকেই হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করা আম্বের তেমন কোথাও যাওয়ার সুযোগ পায়নি।জীবন ছিলো নির্ভেজাল।ছলচাতুরি,মোহ,মায়া কোনোকিছুই ছিলো না তার জীবনে।তাই সবকিছুই এখন নতুন তার কাছে।তবে তার একমাত্র ভরসা মাহাদ।
ড্রাইভ করছে মাহাদ।আড়চোখে দেখে আম্বের কে।উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের আম্বের এর মুখে যখন সূর্যের দীপ্ত আলো দোল খেলে তখন তাকে যেনো সূর্যের অপ্সরী মনে হয়।মৃদু হাসে মাহাদ।সে ভালোবাসে।সে সত্যিই ভালোবাসে তার শ্যামাঙ্গিনীকে।হুট করে মাহাদ এর দিকে তাকিয়ে চটপটে গলায় আম্বের বললো—
“আমরা কোথায় যাচ্ছি মাহাদ?
মাহাদ স্মিত গলায় বললো–
“জানি না।”
আম্বের উৎসুক চোখে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় বললো–
“মানে?
মাহাদ রহস্যচ্ছলে হাসে।শান্ত গলায় বললো—
“যেদিকে দুচোখ যায়।”
মাহাদ ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়।আম্বের নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছে।সূর্য ধীরে ধীরে তার জায়গা বদল করছে।গনগনে সূর্য মাথার উপর চড়ে বসেছে।একটা গাড়ির গ্যারেজের সামনে এসে থামে মাহাদ এর গাড়ি।গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।গ্যারেজের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গাড়ির পার্টস।চার পাঁচজন ছেলে কাজ করছে।একজন বয়স্ক লোক আয়েশী ভঙিতে বসে আছে।মাহাদ কে দেখেই তার দীর্ঘ ঘন দাড়ি গোঁফ ভেদ করে মোটা ওষ্ঠাধর হালকা ছড়াতেই পান খাওয়া দাঁতগুলো দৃশ্যমান হয়।মাহাদ তা দেখেই চোখে হাসে।একে অপরের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করে।একটা চেয়ার টেনে বসতে দেয় মাহাদ কে।মাহাদ আম্বের কে দেখাতেই মৃদু ছন্দে হাসে লোকটি।আম্বের গাড়ির মধ্যেই বসেছিলো।মাহাদ এর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে।সূর্যের তীক্ষ্ম আলো চোখে পড়তেই দু হাতে চোখ ঢাকে আম্বের।হাতের ফাঁক দিয়েই দেখতে পায় মাহাদ কথা বলছে লোকটার সাথে।রোদের আভায় তপ্ত হয়ে উঠে মুখ।যেনো ঝলসে যাবে।আম্বের ঘুরে দাঁড়ায়।
মাহাদ কথা বলে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে আসে।উজ্জ্বল হাসে মাহাদ।পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করে একটা নাম্বারে।রিসিভ করতেই ওপাশের ব্যক্তির শীতল কন্ঠ ভেসে আসে।
“হ্যালো!
মাহাদ স্মিত হেসে বললো—
“কেমন আছেন মাহতাব খান?
মাহতাব খান দম কর উঠে দাঁড়ায়। চোয়াল শক্ত করে বললো–
“তোমার সাহস কী করে হলো আমাকে কল করার?
মাহাদ আওয়াজ করে হাসে।সরস গলায় বললো—
“আপনার জন্য গুড নিউজ আছে।”
মাহতাব খান হুংকার দিয়ে উঠে।তপ্ত গলায় বললো—
“কী বলতে চাও তুমি?
“আমি বিয়ে করেছি।শুধু বিয়েই করিনি আমার স্ত্রী মা হতে চলেছে।আই মিন আই এম গোয়িং টু বি আ ফাদার।”
মাহতাব খান গর্জন করে বলে উঠলো—-
“ওই মেয়েকে আমি ছাড়বো না।”
মাহাদ আওয়াজ করে গা দুলিয়ে হেসে উঠে।দৃঢ় গলায় বললো—
“তাকে ছাড়ার প্রশ্নই উঠে না।কারণ আমি আপনাকে তার ছায়াও মাড়াতে দিবো না।যতদিন না আমি চাইবো আপনি তার চুলও স্পর্শ করতে পারবেন না।”
মাহতাব খান দারাজ গলায় বললো—
“মাহাদ!
মাহাদ এপাশ থেকে দাম্ভিক হাসলো।শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো—
“আপনাকে গুড নিউজ টা দেওয়া হয়নি।নিউজটা হলো আমার সন্তান কিন্তু আপনাকেই নানাভাই বলে ডাকবে।যেমনটা আমার আর আদ্রিতার সন্তান ডাকতো।গেট রেডি ফর ইট শশুরবাবা।এতোদিন আমি পালিয়ে বেরিয়েছি এইবার আপনি আমাকে খুঁজে বের করবেন।বাই এন্ড টেক কেয়ার।খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হবে।”
মাহাদ প্রানখোলা হাসিতে রাঙায় তার অধরযুগল।নিজের গাড়ি রেখে গ্যারেজ থেকে একটা পুরোনো গাড়ি নেয় মাহাদ।আম্বের অনেকবার প্রশ্ন করলেও কোনো জবাব দেয় না সে।মাহাদ পেছন দিকে গাড়ি ঘুরায় যেদিক থেকে সে এসেছিলো।কয়েক মিটার যেতেই নিজের মোবাইল সিমসহ ভেঙে তা রাস্তার পাশের একটা ছোট্ট নালার মধ্যে ফেলে দেয়।মাহাদ আবার গাড়ি ঘুরিয়ে সামনের দিকে আসতে থাকে।আম্বের কিছুই বুঝতে পারে না।কিন্তু সে আর প্রশ্নও করলো না।কারণ মাহাদ তার কোনো কথারই জবাব দিচ্ছে না।
,
,
মেঘের মতো গর্জন করে উঠে মাহতাব খান।মিসেস খান তা দেখে তটস্থ হয়ে এগিয়ে এলেন।উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন—
“কী হয়েছে?আপনাকে এতো চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
মাহতাব খান কপাল কুঁচকে বললেন–
“মাহাদ কল করেছে।”
মিসেস খান ভ্রু কুঞ্চি করে ম্লাণ গলায় বললেন—-
“কেন ছেলেটার পেছনে পড়ে আছেন!থাকতে দিন তাকে নিজের মতো।”
মাহতাব খান ফুঁসে উঠে বললেন—-
“আমার মেয়ের খুনি কে আমি কখনই শান্তিতে থাকতে দিবো না।ওই মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সে আমার মেয়ের জায়গা নিতে চেয়েছে।ওকে মরতে হবেই।”
,
,
,
কুমিল্লা সদরের একটি ছোট্ট এলাকা।আশেপাশে জন কোলাহল।রিক্সার আওয়াজ,হকারদের চ্যাঁ চ্যাঁ,দোকানদারদের সাথে ক্রেতাদের মূল্য নিয়ে দর কষাকষি।সব মিলিয়ে ব্যস্ত জনপদ।তার মাঝ দিয়েই নিঃশব্দে প্রবেশ করে মাহাদ এর গাড়ি।গাড়ি থেকে নিচে নেমে দাঁড়ায় তারা।আম্বের সহিঞ্চু দৃষ্টিতে চারপাশ দেখতে লাগলো।মাহাদ শক্ত করে আম্বের এর হাত ধরে।ভীড় ঠেলে একটা ছোট্ট গলির ভেতর ঢোকে তারা।হাতের বা’দিকে যেতেই চোখে পড়ে চারটা ফ্ল্যাট।যার একটার সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় মাহাদ আর আম্বের।মাহাদ তার পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে তাতে নতুন সিম ইনসার্ট করে।আম্বের হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে।কাউকে কল করতেই একজন লোক এসে তাদের দুই জনকে ফ্ল্যাট এর ভেতরে নিয়ে যায়।
আম্বের অবাক চোখে সব দেখছে।পুরো ফ্ল্যাট সাজানো।কোনো কিছুর কমতি নেই।ঝলমলে গলায় আম্বের বললো—
“আমরা কী এখানেই থাকবো?
মাহাদ আলতো হাতে আম্বের কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো—
“ইয়েস মাই হার্ট।আজ থেকে আমরা এখানেই থাকবো।”
আম্বের উচ্ছ্বাসিত হয়ে স্মিত গলায় প্রশ্ন করলো—-
“আমাদের বাসায় যাবো না?
মাহাদ আম্বের এর গলায় নাক ঘষে বললো–
“নাহ।যতদিন না আমি আপনাকে আপনার যোগ্য সম্মান দিতে পারছি ততদিন পর্যন্ত এভাবেই থাকবো।পুরো দেশ ঘুরবো।ঘুরাও হবে আর হানিমুনও।”
আম্বের চোখের পাল্লা প্রশস্ত করে বিস্মিত গলায় বললো—
“ঘুরবো মানে!
আমরা কী এখানে থাকবো না?
মাহাদ ধুম করে কাউচে বসে।আম্বের কে নিজের পাশে বসিয়ে গলায় মুখ গুঁজে বললো—
“জানি না।আপনাকে এইসব নিয়ে ভাবতে হবে না।আপনি নিজের খেয়াল রাখেন আর আমাদের বাবাইসোনার।বাকিটা আমি দেখে নিবো।ডোন্ট ওয়ারি।”
আম্বের প্রসন্ন হাসে।মাহাদ এর বুকে হেলান দিয়ে তার শার্টের বোতামে গোল গোল রিং বানাতে থাকে।তার পুরো শরীর বেয়ে বয়ে যায় খুশির আলোড়ন।
পুরোদিন তারা ফ্ল্যাটেই থাকে।রাত বাড়তেই ফ্ল্যাটের কেয়ার টেকার এসে খাবার দিয়ে যায়।খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে মাহাদ আম্বের।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মাহাদ।টানা কয়েকদিনের দৌঁড়ঝাপে সে ভীষণ ক্লান্ত।বিছানার পাশেই জানালা।হালকা গরম পড়েছে তাই জানালার পাল্লা দুটো খোলা ছিলো।ফিনফিনে বাতাস সাথে চাঁদের কিরণ হামলে পড়ছে ঘরে।আম্বের তার চোখের পল্লব প্রশস্ত করে চাঁদের দিকে চেয়ে আছে।কুসুম রঙের চাঁদ উঠেছে।অর্ধ চন্দ্র আজ পূর্ন রূপ ধারণ করেছে।তার আশেপাশেই তারকারাজির মেলা।আম্বের আনমনেই তার হাত উঁচু করে।এক পসলা চন্দ্রকিরণ হাতের মুঠোয় ভরে নেয়।পাশ ফিরেই মাহাদ এর দিকে তাকায়।ভরাট চোখ দুটো কেমন ক্লান্ত!
মাহাদ এর ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে।আম্বের আরেকটু পাশ ঘেঁষে আসে মাহাদ এর।হাতের মুঠোয় পুরে রাখা চাঁদের আলো মাখিয়ে দেয় মাহাদ এর পুরো মুখে।
ঈষৎ উষ্ণ স্পর্শ অনুভব হতেই নিমিঝিমি করে উঠে মাহাদ এর অক্ষিপল্লব।ঘুম কাতুরে চোখ দুটো প্রসারিত করে তাকাতেই দেখে আম্বের ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মিষ্টি হাসে মাহাদ।ঘুম জড়ানো মায়াবী গলায় বললো—-
“জেগে আছেন কেন?
আম্বের এর অধর জুড়ে খেলে যায় মিষ্টি হাসি।সরস গলায় বললো—
“ঘুম আসছে না।”
মাহাদ চোখে হাসে নিজের হাত সোজা করে আম্বের কে কাছে টেনে নেয়।নিজের হাতের উপর মাথা রাখে আম্বের এর।আম্বের দু হাতে বাচ্চাদের মতো মাহাদ কে জড়িয়ে ধরে।মাহাদ তার আঙ্গুল গলিয়ে দেয় আম্বের এর চুলে।আম্বের এর শরীর থেকে অদ্ভুত ঘ্রাণ ভেসে আসছে।মাহাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বললো—
“আমি এখন আপনাকে যা বলবো তা শুনে আপনি কোনো রিয়েক্ট করবেন না।আপনাকে শক্ত হতে হবে।আপনি টেনসড হলে বেবির উপর তার প্রেশার পড়বে।”
আম্বের মাহাদ এর বুক থেকে মাথা হালকা সরিয়ে উর্ধ্বমুখী করে নিস্পলকভাবে তাকিয়ে থাকে।মাহাদ শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো–
“মি.আহমেদ আপনার বাবা নন।”
মাহাদ এর কথায় ঈষৎ প্রস্ফুরণ হয় আম্বের এর শরীরে।মাহাদ শক্ত হাতে ধরে রাখে আম্বের কে।আম্বের এর শ্বাসনালী থেকে আধা আধা নিঃশ্বাস পড়তে থাকে।মাহাদ কন্ঠের গভীরতা বাড়িয়ে বললো—-
“আমি আপনাকে টেনসড হতে বাড়ন করেছি।আপনি শুধু শুনবেন।বিচলিত হবেন না।”
আম্বের চুপ করে রইলো।তার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ।ঝড় উঠেছে।বাতাস বইছে।আম্বের এর বুকে শুরু হয়েছে তোলপাড়।কিন্ত সে কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।শান্ত হয়ে চেয়ে থাকলো।মাহাদ বুঝতে পারছে সব।কিন্তু সত্য ক্রমশ প্রকাশ পাওয়া জরুরি।মাহাদ নরম গলায় বললো—-
“জনাব আলম আপনার মামা আর মিসেস আশালতা আপনার মামি।শিলা আর মিলা আপনারই আপন মামাতো বোন।”
আম্বের এর নিঃশ্বাসের গতি বাড়তে থাকে।চোখের ফোয়ারাও তার সকল ঠান্ডা জল উপচে দিচ্ছে।মাহাদ আম্বের এর মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে।শান্ত ও নম্র গলায় বললো—-
“চিন্তা করবেন না।আমি আছি তো।”
আম্বের এর শরীর ঝিমুনি দিয়ে উঠে।তার কলিজায় টান পড়ে।এতোবছর যে মানুষটাকে সে বাবা বলে ডাকতো সে তার বাবা নয়।সেই অপরিচিত মানুষগুলো তার আপনজন।তাহলে সেই মহিলা কী করে তাকে ওই বাজে কথাগুলো বললো!
তার মানে তার মাও তার মতো!
ঘড়ির কাটা চলছে আপন গতিতে।বাইরে থেকে জানালা দিয়ে আযানের মিষ্টি সুর ভেসে আসছে।রাত পেরিয়ে ভোর হতে চললো।নির্ঘুম রজনী কাটিয়েছে আম্বের।মাহাদ ঘুমোচ্ছে বেঘোরে।জীবনের হিসেব নিকেশ কষতে কষতে আম্বের আচমকা তার তলপেটে ব্যথা অনুভব করে।ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ককিয়ে উঠে আম্বের।খামচে ধরে মাহাদ কে।আম্বের এর নখ গেঁথে যায় মাহাদ এর বুকে।আবছা আলো ঘুমের ঘোরে আকস্মিক এহেন কাজে হকচকিয়ে উঠে মাহাদ।তড়িঘড়ি করে উঠে লাইট অন করে।আঁতকে উঠে সে।বিস্ফোরিত দু’চোখ দিয়ে দেখে আম্বের এর কাপড়ের নিম্নাংশে রক্তের আঁচ।
ব্যথায় জর্জরিত উঠে বসা আম্বের পেটে হাত রেখেই চিৎকার করে উঠে।
চলবে,,,