বদ্ধ হৃদয়ের অনুভূতি পর্বঃ৪৩

0
5461

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৪৩
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

“তোমার প্রেমে আমি প্রজাপতি হবো…
ফুলে ফুলে উড়ে ভালোবাসার কথা কবো…
তুমি আমায় কাছে ডাকো না….

আলতো করে মাহাদ আম্বের এর পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো–
“প্রেমের সুরভি মাখো না….

ঝট করে পেছন ফিরে তাকায় আম্বের।নির্মল গলায় বললো—-

“কখন এলেন আপনি?

“এই যে এখন।”

চোখে হাসে আম্বের।কোমল গলায় মাহাদ বললো–

“ভালোই তো গান করেন আপনি।আগে তো কখনো শুনিনি।”

আম্বের মিষ্টি হেসে ভ্রু নাচিয়ে ঠোঁট গুঁজ করে বললো–

“আপনাকে কেন শোনাবো!আমার আমাদ কে শোনাবো।”

মাহাদ বিতৃষ্ণা গলায় ঠোঁট বাকিয়ে বললো—

“সব সময় আমার আমার করেন কেন!আমাদের বলেন।”

আম্বের ঠোঁট উল্টে দম্ভ করে বললো—

“ইশ!শখ কতো।
ও শুধু আমার আমাদ।বুঝলেন ফিল্মস্টার।একদম আমার আমাদ এর দিকে নজর দিবেন না।”

মুহুর্তেই আর্তনাদ করে উঠে আম্বের।ভীতসন্ত্রস্ত মাহাদ ব্যস্ত হয়ে বললো–

“কী হয়েছে?

আম্বের দাঁতে দাঁত চেপে অধর ছড়ায়।বোকা বনে যায় মাহাদ।ভ্রু কুঞ্চি করে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে থাকে।একরাশ আনন্দ নিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় আম্বের বললো—

“বাবাইসোনা কিক করেছে।”

ঝলমলে হাসে মাহাদ।ধপাস করে নিচে বসে পড়ে।দু হাতে আম্বের এর কোমর জড়িয়ে ধরে চুমু খায় উদরে।হাত দিয়ে আলতো স্পর্শ করে।এক গভীর অনুরক্তি হয় মাহাদ এর।তার শরীর ঝিমঝিম করে উঠে।এক অবর্ণনীয় অনুভূতি হচ্ছে তার।এক নতুন শিহরণ।এক অজানা ভালোবাসা হাতছানি দিচ্ছে তার দুয়ারে।আবারও মৃদু আর্তনাদ করে উঠে আম্বের।নিজের হাতে পূর্ন অস্তিত্ব অনুভব করে মাহাদ তার দেহাংশের।

ভাবতেই অবাক লাগে মাহাদ এর।সে বাবা হবে।কেউ একজন তার আধো আধো বুলিতে তাকে বাবা বলে ডাকবে।ঘরময় হেসে খেলে বেড়াবে।ঘরের ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে তার সন্তানের খেলনা।কাজ শেষে যখন বাসায় ফিরবে তখন ছোট্ট দুটি হাত বাড়িয়ে দৌঁড়ে এসে বাবাই বাবাই বলে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ছোট্ট আমাদ।তার প্রজাপতি আর তার ভালোবাসার অংশ।তার ছোট্ট সংসার পরিপূর্ন হবে ভালোবাসায়।কখনো নিজের থেকে আলাদা করবে না সে তার প্রজাপতি আর বাবাইসোনা কে।

স্থির হয়ে কান পেতে থাকে মাহাদ।যেনো সে শুনতে পাচ্ছে তাকে কেউ বাবাই বলে ডাকছে।
জল জমে আসে মাহাদ এর চোখের কোণে।

কী এমন হতো আজ সবকিছু স্বাভাবিক হলে!কী হতো পুরো দুনিয়ার সাথে আজ তার এই খুশি ভাগাভাগি করে নিলে!কবে স্বাভাবিক হবে সবকিছু!
মাহাদ ভাবে সত্যিই বুঝি ভালোবাসা একেই বলে!এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মাহাদ এর।কী নাম এই অনুভূতির!
বাবা হওয়ার আনন্দ বুঝি এমনই হয়।আজ মাহাদ তৃপ্ত।তার পৌরষসত্তা পূর্নতা পেতে চলছে।আর কিছুদিন পরই তাদের কোল আলো করে আসবে তাদের বাবাইসোনা।ডেলিভারির আর কিছুদিনই বাকি।

কিন্তু মাহাদ এর মনে চলছে এক ভয়ংকর আগ্রাসন।গত দু’দিন ধরে কিছুতেই রিমেল এর সাথে কন্টাক্ট করতে পারছে না মাহাদ।বুকের ভেতর ঝড় বয়ে চলছে তার।সবকিছু না তীরে এসে ডুবে যায়।হারিয়ে যায় তার সুগন্ধি প্রজাপতি।
মাহাদ তার হাতের বাঁধন শক্ত করতেই মেকি আর্তনাদ করে আম্বের।

“আমার লাগছে মাহাদ।”
,
,
,
লাগাতার একটা নাম্বারে ডায়েল করে যাচ্ছে মাহাদ।কিন্তু তা আউট অফ রেঞ্জ।গত কয়েকদিন অনেকদিন চেষ্টা করেও রিমেল এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি মাহাদ।তার এখন টাকার প্রয়োজন।দুই একদিনের মধ্যেই আম্বের এর ডেলিভারির ডেট।কিন্তু এখনো অনেক কিছুই ম্যানেজ করতে পারেনি মাহাদ।নিজের অসহায়তায় যেনো গুড়িয়ে যাচ্ছে সে।
চকিতে আম্বের এর চিৎকারে দৌড়ে কিচেনে আসে মাহাদ।নিজের পেটে হাত দিয়ে অনেকটা ঝুঁকে রয়েছে আম্বের।তার পায়ের সামনে একটা কাঁচের গ্লাস টুকরো টুকরো হয়ে আছে।মাহাদ দারাজ গলায় বললো—

“ওখানেই দাঁড়ান।”

নিজেকে স্থির করে আম্বের।তার কাছে এসেই উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো মাহাদ–

“এখানে কেন এসেছেন?এইসব হলো কী করে?

আম্বের অসহায় গলায় প্রত্যুত্তর করলো—

“পানি খেতে এসেছিলাম।আজকাল বাবু খুব বেশি নাড়াচাড়া করে।যেনো এখনি বের হয়ে আসতে চায়।”

মাহাদ অভিমান করে বললো—

“এমনটা করতে কতোবার নিষেধ করেছি আপনাকে।আমাকে বলতেন।আসেন।”

ঘরে নিয়ে বসায় আম্বের কে।জোরে জোরে লম্বা শ্বাস নিতে থাকে আম্বের।আজকাল কিছুই ভালো লাগে না তার।অস্বস্তি লাগে।ঝিমিয়ে আসে শরীর।পিঠেও প্রচন্ড ব্যথা হয়।অসহ্যকর।মাহাদ এর বুকে মাথা হেলিয়ে দূর্বল গলায় আম্বের বললো—

“কী হয়েছে আপনার !সে কখন থেকে দেখছি মোবাইলে কী করছেন।কিছু হয়েছে?

মাহাদ নম্র গলায় বললো—

“রিমেল এর সাথে কিছুতেই কন্টাক্ট করতে পারছি না।আপনার ডেলিভারিতে টাকার প্রয়োজন।গতবার যা উঠিয়েছি সব শেষের পথে।ওর অ্যাকাউন্টও খালি।কিছুই বুঝতে পারছি না।”

আম্বের নিরব হয়ে থাকে।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে।মাহাদ আরেকটু শক্ত করে আড়ষ্ট করে আম্বের কে।নির্বিঘ্ন গলায় মাহাদ বললো—

“চিন্তা করবেন না।আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।”

অস্ফুটভাবে ডেকে উঠে আম্বের–

“মাহাদ!

“হু।”

“যদি আমার কিছু হয়ে যায় আপনি বাবুকে আগলে রাখবেন তো!

মাহাদ ঈষৎ বিরক্তিকর গলায় বললো—-

“এইসব কী বলছেন!

আম্বের মাহাদ এর বুক থেকে মাথা তুলে হাতের উপর ভর দিয়ে বসে।আজকাল একদমই নিজেকে সহ্য হয় না আম্বের এর।পেট বেড়ে যাওয়ার পরতো আয়নাও দেখেনা সে।কেমন বিশ্রী মনে হয়।অনেকটা মোটা হয়েছে সে।হাত পায়ে পানি এসে ফুলে গেছে।নিজেকে কেমন অদ্ভুত মনে হয় তার।কিন্তু মাহাদ সবসময় তাকে আগলে রাখে।এইসবের কিছুই চোখে লাগে না তার।হয়তো সন্তানের প্রতি ভালোবাসা বাহ্যিক সৌন্দর্যের উপরে।

আম্বের নির্বিকার গলায় বললো—

“অনেকেই সন্তানের জন্মদিতে গিয়ে মারা যায়।যদি আমার সাথেও তেমনটা হয়!আপনি আমার বাবাইসোনার খেয়াল রাখবেন তো?

মাহাদ কঠিন গলায় বললো—

“একদম চুপ।আজেবাজে কথা বলবেন না।কিছু হতে দিবো না আপনার আমি।অনেক কষ্ট সহ্য করেছি আমরা।উপর ওয়ালা নিশ্চয় আমাদের এই এক চিলতে খুশি কেড়ে নিবেন না।”

আম্বের আবারো বুক পড়ে মাহাদ এর।গলা ধরে আসে তার।থমথমে গলায় বললো—

“আমার ভয় হচ্ছে মাহাদ।কাল রাতে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।ওরা আমাদের বাবাইসোনাকে কেড়ে নিবে নাতো!

“ভয় পাবেন না।এমন কিছুই হতে দিবো না আমি।আমাদের বাবাইসোনার কিছু হবেনা।”

পুরো ঘরে সুনসান নিরবতা।শুধু একে অপরের নিঃশ্বাস শুনতে পারছে তারা।আর বুকের ভেতর উদ্ভূত হওয়া ভয়ের আশঙ্কা।

মৌনতা ভেঙে মাহাদ সরব গলায় বললো—

“ফাইরুজার সাথে কথা হয়েছে।এখানকার হসপিটালে ওর পরিচিত ব্যাচমেট আছে।আমি আজই তার সাথে কথা বলবো।”

আম্বের কপট রাগ দেখিয়ে গাঢ় গলায় বললো—

“শুরু হয়েছে মেয়েদের সাথে কথা!আদ্রিতা,মিশ্মিয়া এখন ফাইরুজা আপু!আপনার কী কন্যারাশি নাকি!

দুর্বোধ্য হাসে মাহাদ।রসালো গলায় বললো—

“”প্রজাপতি বউ,ভুলে যাচ্ছেন।ফাইরুজা বোন হয় আমার।”

আম্বের ঠাট্টামিশ্রিত গলায় বললো—

“আপন বোন তো না।”

“এতোটাও নিচ নই আমি।আর আমার এমন সুগন্ধি বউ থাকতে অন্য কোথাও ঢুঁ মারবো কেন!

আম্বের নিরব হাসে।এই মানুষটাকে সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না।মাঝে মাঝে নিজেক পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে হয়।এতো ভালোও কেউ কাউকে বাসে বুঝি!
,
,
,
হসপিটালে এসে জরুরী কিছু বিষয়ে খোঁজ খবর নেয় মাহাদ।খুলনার সদর হাসপাতাল।সব ঠিকঠাক থাকলেও এখন টাকার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

মাহাদ কে চেনার উপায় নেই।গত নয়মাস নিজের দিকে তাকায়নি মাহাদ।তার সব চিন্তা তার প্রজাপতি কে ঘিরে। নয় মাসে আসার পর তো রাতে ঘুমায়ও না মাহাদ।বিনিদ্র রজনী তার।কখন আম্বের ডেকে উঠে।সেই উজ্জ্বল বদন,গভীর চাহনি,বিগলিত হাসি সবকিছুই ম্লান আর অবসাদগ্রস্ত।সেভ করেনা কতদিন!খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভরে গেছে গালের দু’পাশ।আম্বের সেদিন কড়া গলায় বললো,,”এই সূঁচের মতো দাড়ি নিয়ে যেনো কোনোমতেই তার বাবাইসোনাকে চুমু না খায়।লেগে যাবে তার।”

সেই কথা মনে পড়তেই একগাল হাসে মাহাদ।হসপিটাল থেকে বেরিয়ে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করতেই মাহাদ এর চোখ আটকে যায় একটা কালো মার্সেডিজ এ।তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটি অতি পরিচিত মুখ।কিন্তু মাহাদ এখানে কোনোভাবেই তাকে আশা করেনি।

ধক করে উঠে মাহাদ এর বুক।তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় এক হিমশীতল ধারা।অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সে সামনে থাকা সেই সুরম্য রমনির দিকে।মাহাদ কে দেখেই তার চিকন অধর কোণে ফুঁটে উঠে উজ্জ্বল হাসি।

মাহাদ এর স্থির চোখের পল্লব হঠাৎই কাঁপতে শুরু করে।পায়ের গোড়ালি যেনো বিবশ হয়ে যাচ্ছে।এক পাও চলতে পারছে না মাহাদ।নোনতা জলে ভরে আসে তার অক্ষিযুগল।ঘোলা চোখে মাহাদ শুধু তার প্রজাপতির চেহারাই দেখতে পাচ্ছে।যেনো ডেকে বলছে—-

“আমাকে বাঁচাবেন না মাহাদ??

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here