#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৪৫
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
আম্বের এর প্রতি মাহাদ এর দূর্বলতা দেখে তাকে বিয়ে করার কথা বলেন আহমেদ।কিন্তু মাহাদ এর পক্ষে তখন বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না।তাই আহমেদ এর জোরাজুরিতে শুধু রেজিস্ট্রি করিয়ে রাখে।আহমেদ এও বলে আম্বের তার মেয়ে নয়।মাহাদ আরো বিপাকে পড়ে।কারণ মাহতাব খান এর কাছে পিতৃমাতৃহীন একটা মেয়ের ক্ষতি করা কোনো ব্যাপার না।
কিন্তু আহমেদ অনুশোচনায় ভোগেন।তিনি আম্বের এর বাবাকে না চিনলেও এইটা জানতেন তিনি শহরের বড় কোনো ব্যক্তি।আলতাফ যখন আহমেদ কে মাহাদ এর অতীত সম্পর্কে বললেন তখন তার মনে হলো মাহাদ কে সত্যটা জানানো প্রয়োজন।এতে তার উপকার হবে।আহমেদ আসমীরাদের বাড়ির আশ্রিতা ছিলো।বিয়ের পর আসমীরা তেমন গ্রামে যায়নি।আর গেলেও মাহতাব খান কখনো যেতেন না।আসমীরাকে জানানো হয় তার মেয়েকে নিয়ে আহমেদ পালিয়ে যায়।কিন্তু আহমেদ সেদিন আম্বের কে বাঁচিয়েছিলো।
মাহাদ এর সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় ভাগ্যক্রমে আসমীরার সাথে দেখা হয় আহমেদ এর।আক্রোশে ফেটে পড়েন আসমীরা।আহমেদ ধীরেসুস্থে সব ঘটনা খুলে বললে আসমীরা অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌছেন।কিন্তু তিনি অন্য ছক কষেন মনে।আহমেদ কে থামিয়ে দেন।রেজিষ্ট্রি পেপার নিয়ে যান।সারাদিন সময় কাটিয়ে ফেরার পথে দূর্ঘটনার স্বীকার হোন আহমেদ।রাস্তার কারো থেকে মোবাইল নিয়ে মৃত্যুর আগে মাহাদ কে এতটুকুই বলতে পেরেছেন আম্বের এর বাবা চাইলেই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।
আহমেদ এর মৃত্যুর পর মাহাদ তার ঘর তন্ন তন্ন করে আম্বের এর বার্থ সার্টিফিকেট খুঁজে বেড়ায়।কিন্তু সেখানে আহমেদ এর নামই লেখা।মাহাদ রিমেল এর মাধ্যমে আম্বের এর গ্রামে খোঁজ চালায়।কিন্তু তার মামার পরিবার ততদিনে অন্যগ্রামে চাকরিসূত্রে চলে গেছে।শুধু একটা নাম জানা ছিলো।আসমীরা।সেই এলাকার সকল আসমীরার খোঁজ নেওয়া হলো।রিমেল ভোটার ডাটা পর্যন্ত চেক করতে লাগলো।এক সময় তার পরিশ্রম সফল হয়।
মাহাদ চুপচাপ দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে।সে একদম শান্ত।আসমীরা মাহাদ এর কাছে গিয়ে ব্যস্ত গলায় বললেন—-
“মাহাদ তোমাকে এখন আম্বের এর সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।আমাদের যেতে হবে।”
মাহাদ বার কয়েক নাক টেনে অসহায় গলায় বললো—
“আম্বের এর ফিজিক্যাল কন্ডিশন ভালো নেই।ফাইরুজা কোনোরকম উত্তেজনা যেনো সৃষ্টি না হয় তার জন্য সব সময় তার খেয়াল রাখতে বলেছে।এখন কী হবে মা?
আমার আম্বের!আমার সন্তান!
ঝুমঝুম করে কেঁদে ফেললো মাহাদ।আলতো হাতে তার মাথায় হাত ছোঁয়ালেন আসমীরা।দৃঢ় গলায় বললেন—
“আমার আম্বের ফাইটার।দেখবে সে হারবেনা।তার সৌরভ ছড়াবেই।এখন আমাদের যেতে হবে মাহাদ।চলো।”
মাহাদ ঝাপসা চোখে ভাবতে লাগলো তার আর আম্বের এর প্রথম দেখার কথা।স্বপ্নে দেখা সেই নাম শুনে মাহাদ বুঝতেই পারছিলো না কেন সে এই মেয়েটিকে স্বপ্নে দেখেছে।আজ বুঝতে পারছে।আদ্রিতার মৃত্যুর সাথে সাথে আম্বের এর ভাগ্য জুড়েছে মাহাদ এর সাথে।তার প্রশ্নের জবাব সে পেয়েছে।কিন্তু এইভাবে সে চায়নি।
“ঘৃণা জন্ম নিতে সময় লাগে কিন্তু ভালোবাসা জন্ম নিতে সময় লাগে না।তা চোখের পলকেই হৃদয়ে ঘর বাঁধে।”
যেমনটা মাহাদ এর সাথে হয়েছে।প্রথম পলকেই সে তার শ্যামাঙ্গিনী কে ভালোবেসেছে।
,
,
,
হসপিটালের করিডোরে ডাক্তার,নার্স আর আম জনতার ভীড়।বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মাহতাব খান এসেছে।আম্বের এর চিৎকারে হতভম্ব মাহতাব খান।ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন তার।উদ্ভ্রান্তের মতো হসপিটালে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন মাহতাব খান।হসপিটালের সিনিয়র ডক্টর সাগ্নিক এসে পুরো ব্যপারটা পর্যবেক্ষন করলেন।আম্বের এর অবস্থা দেখে তাকে দ্রুত ওটিতে নিতে বললেন।আম্বের এর চিৎকারে থেমে থেমে কেঁপে উঠছে ওটি রুম।
মাহতাব খান নিরস্ত্র সৈনিক এর মতো হাঁটু গেড়ে বসলেন।ঝরঝর করে কাঁদছে সে।তার চোখের সামনে আদ্রিতার মৃত চেহারা ভেসে উঠলো।সে কোনোভাবেই আম্বের কে হারাতে চায় না।কোনোভাবেই না।
কিছুক্ষন পর ডক্টর সাগ্নিক একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওটি থেকে বের হয়ে আসলেন।আগ্নেত্রী তাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।কিন্তু তিনি মানতেই চাইছেন না।তার এক কথা সময়ের মূল্য রয়েছে তার কাছে।
মাহতাব খান বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলেন–
“কী হয়েছে?
আগ্নেত্রী জানায় আম্বের এর ইউটেরাস অনেক দূর্বল।প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।তার উপর বেবির পজিশন ঘুরে গিয়েছে।এমন অবস্থায় নর্মাল ডেলিভারি কোনোমতেই সম্ভব না।কিন্তু আম্বের সার্জারির জন্য রাজী হচ্ছে না।মাহাদ না আসলে সে সার্জারি করাবে না।
মাহতাব ভেঙে পড়েন।ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বললেন—
“মাহাদ কে আমি কোথায় পাবো?
প্লিজ আপনারা আমার মেয়েকে বাঁচান।যত টাকা লাগে আমি দিবো।”
“টাকায় সবকিছু হয় না আঙ্কেল।”
চকিতে পেছন ফিরে তাকায় মাহতাব খান।ফাইরুজা ডক্টর সাগ্নিক কে সালাম জানালেন।মাহতাব খানের দিকে তাকিয়ে নিরুদ্বেগ গলায় বললো—
“মাহাদ হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।আপনি যান।তাকে নিয়ে আসেন।”
মাহতাব খান উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন।উৎফুল্ল গলায় বললেন–
“যাচ্ছি।যাচ্ছি আমি।”
ওটির বেডে ঠোঁট কামড়ে শুইয়ে আছে আম্বের।তার ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না।ব্যথায় মরে যাওয়ার মতো অবস্থা।কিন্তু কিছুতেই সে সার্জারি করাবে না।এতোক্ষন আওয়াজ করলেও এখন ঠোঁট কামড়ে পাথরের মতো শুইয়ে আছে সে।চোখের জল বলে দিচ্ছে তার শরীরের আদ্যোপান্তে কী চলছে।ফাইরুজা কে দেখে স্বশব্দে কেঁদে উঠে আম্বের।ভেজা গলায় বললো–
“আপু!
ফাইরুজা কাছে এসে আম্বের এর মাথায় হাত বোলালো।ডক্টর সাগ্নিক এর বিরক্তির মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।তিনি বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আগ্নেত্রী তাকে থামানোর চেষ্টা করলে তিনি বলেন তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাকে যেতে হবে।আগ্নেত্রী বিপদে পড়লেন।এই ধরনের কেস সে আগে সামলায় নি।ভয়ে হিম হয়ে আসছে তার শরীর।আম্বের এর পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে সে।কী হবে এখন!
ফাইরুজা আম্বের কে শান্ত করতে ব্যস্ত।নির্বিকার গলায় বললো—
“কী শুরু করলে তুমি!অবস্থা দেখেছো!বেবি ঠিক নেই আম্বের।ব্লিডিং থামানো যাচ্ছে না।ইমিডিয়েট সার্জারি না হলে কী হবে তুমি বুঝতে পারছো!
“মাহাদ এর সাথে কথা না বলে আমি কিছু করবো না।মরে যাবো আমি।”
“এইসব কী বলছো!সময় নেই আমাদের হাতে।প্লিজ।”
আম্বের কিছুতেই রাজী হচ্ছে না।মাহাদ এর সাথে কথা না বলে সে সার্জারি করাবে না।আগ্নেত্রী ভাবছে অন্যকিছু।সঠিক সময়ে সব হবে তো!বাঁচবে দুটি প্রাণ!নাকি!!
হসপিটালের বাইরে এসে তটস্থ হয়ে মাহাদ কে খোঁজে মাহতাব খান।হসপিটালের পাশেই একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট।সেখানেই বসে আছে মাহাদ।ঠান্ডা লাচ্ছি তে স্ট্র ডুবিয়ে তা মুখে দিয়ে আছে।পাশেই বসে আছে আসমীরা।সপ্রতিভ তার দৃষ্টি।মাহতাব খান এসেই হুড়মুড়িয়ে মাহাদ এর হাত টেনে ধরলেন।মাহাদ ব্যগ্র গলায় বললো–
“আরে আরে!
মি.মাহতাব খান।করছেন টা কী!
“প্লিজ মাহাদ চলো আমার সাথে।”
মাহাদ অক্ষিপল্লব নাচিয়ে বললো—
“কোথায়?
“আম্বের এর কাছে।”
“আরে ধ্যাত!আমি কেন যাবো!আপনার মেয়ে আপনি দেখেন।”
মাহতাব খান ক্রোশভরা গলায় বললেন—
“মাহাদ!
মাহাদ আওয়াজ করে হেসে ফেললো।লাচ্ছি থেকে এক সিপ টেনে দৃঢ় গলায় বললো–
“চিৎকার করে লাভ নেই মাহতাব খান।আপনার মেয়ের এই অবস্থার জন্য আপনিই দায়ী।আমার কী!একজন গেলে আরেকজন।আরেকটা বিয়ে করে নিবো।মেয়ের অভাব হবে না।ইউ নো দ্যাট।”
মাহতাব খান অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইলেন।রোজা মেয়েটাকে শুধু নিজের আক্রোশের কারণে মেরে ফেলেছেন।মাহাদ ঠিক বলেছে।কিন্তু এখন কী করবে সে।মাহাদ না গেলে আম্বের কে বাঁচাতে পারবে না।মাহাদ এর কোনো ক্ষতিও সে করতে পারবে না।আদ্রিতার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে।নিজের স্ত্রীর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে অনুনয়ের স্বরে বললো—
“কেন বলো নি আম্বের এর কথা আমাকে!আমার মেয়ে!
আসমীরা হাসলেন।দাম্ভিক গলায় বললেন—
“ভাগ্য বড় অদ্ভুত মি.খান।দেখেন আজ আপনাকে কোথায় নিয়ে এসেছে!
“তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
“উঁহু।কারণ আমার জানা মতে আমার মেয়ে তো অনেক আগেই মরে গেছে।যে আজ আছে সে আপনার নিয়তি।নিয়তি বদলানো যায় না।পাপের শাস্তি সবাইকে পেতে হয়।আপনিও পাবেন।”
“এমন করে বলো না।আদ্রিতাকে হারিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে আছি জানো।যদি আম্বের এর কিছু হয়ে যায় আমি বাঁচবো না।”
“সেইটা আপনার বিষয়।আমি তো মা হওয়ার যোগ্য নই।তাহলে আজ কেন আমার কাছে এসেছেন?
মাহতাব খান নিরব হয়ে গেলেন।তিনি কিছু দেখতে পারছেন না।সিংহের মতো গর্জনকারী মাহতাব খান আজ বিড়ালের মতো বসে আছে।তার চোখে মুখে অনুতাপ,অসহায়ত্ব।
মাহাদ উঠে দাঁড়ালো।নিজের মুখে কিছুক্ষন হাতের তালু ঘঁষে ফিচেল গলায় বললো—
“চলি মা।অনেকদিন হলো সেভ করিনা।আম্বের এর দেখাশোনা করতে করতে আমি শেষ।ভেবেছিলাম আম্বের কে ফাঁদে ফেলে শশুরবাবার উপর শোধ নিবো।তা তো হলো না।তাই আবার কাজে নামতে হবে।এই চেহারায় কিচ্চু হবে না।আসি শশুরবাবা।মিষ্টি টা পাঠিয়ে দিয়েন যদি সম্ভব হয় তো!
না মানে অতীত না আবার ফিরে আসে।তাহলে মিষ্টি খাওয়া আর আমার হবে না।আসি।”
মাহাদ পা বাড়াতেই মাহতাব খান তার হাত টেনে ধরে ধীরগতিতে হাঁটু গেড়ে বসে।উপস্থিত সবাই চাপা উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে আছে।দু হাত জোড় করে অনুনয় করে বললো—
“সময় নেই মাহাদ।আমার মেয়েটাকে বাঁচাও।”
মাহাদ স্থির দৃষ্টিতে আসমীরার দিকে তাকালো।
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ
এরপর এন্ডিং পার্ট আসবে।সো সময় তো লাগবেই।কিন্তু আপনারা চাইলে আমি কাল দিতে পারি।কষ্ট করে হলেও।তার জন্য আপনাদের কী করতে হবে জানেনই তো😁😁😁😁।
আচ্ছা এখন বলেন,মাহাদ কী করবে?মাহতাব খান কে ক্ষমা করা কী আদৌ উচিত?)