বাঁধন ছেঁড়া প্রেম পর্বঃ১২

0
652

#বাঁধন_ছেঁড়া_প্রেম
#পর্ব:১২
#যারিন_তাসনিম

এক সপ্তাহ পর,
রাত এগারোটায় রাহা, সিদ্ধী দুজনেই তাশরিকদের বাড়ির সামনে আসে।
খুলনা যাওয়ার জন্য তাশরিক ওর গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করে বাড়ির সামনে রাখে। সেই কালো রঙের গাড়িটার সামনেই দু’জন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। তাশরিক ক্ষণে ক্ষণে ফোন করছে, উপরে যাওয়ার জন্য। সিদ্ধী যেতে চাচ্ছে না। হবু শাশুড়ীর সামনে যেতে খুব ভয় করে তার। কেমন যেন চাহনি! দেখলেই যে কারো বুক কেঁপে উঠবে। কিছুক্ষন পর তাশরিক নিচে নেমে আসে। সিদ্ধীর কাছে এসে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে,
“কথা শুনোনা কেন? উপরে আসলা না কেন?”
রাহা তাশরিকের কণ্ঠ শুনে গাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে সালাম দিল। তাশরিক জোরপূর্বক হেসে সালামের জবাব দিল। তাশরিক সিদ্ধীকে কিছু বলতে চায়, তা বুঝতে পেরে রাহা হেঁটে সামনের দিকে এগোয়। এগারোটা বাজে কে সময় নির্ধারণ করলো, তা ভাবতে থাকে। এত রাতে গাড়ি চালানোও খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও সে কিছু বলে নি। এখানে সে একজন তৃতীয় ব্যক্তি। শুধু সিদ্ধীর আবদার রাখতেই যাচ্ছে। তাও আবার সেখানে তার বুকে কাঁপন ধরা মানুষটাও যাচ্ছে।
উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে, এমনটা মনে হলো রাহার। রাস্তায় বড় একটা পাথর দেখতে পাচ্ছে। এখনি বোধহয় মাথা ফেটে যাবে। চোখগুলো খুলতেই দেখলো, সে আটকে আছে। পেটের উপর কারো হাত অনুভব করলো। আস্তে আস্তে আগন্তুক ব্যক্তি তাকে উঠালো। চুলগুলো পিছনে গুঁজে আগন্তুক ব্যক্তির দিকে তাকালো। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মত ছিটকে আরো পিছনে চলে গেল। অনেকগুলো বছর পর দ্বিতীয়বার দেখা। বুকের ভিতরটা ধুকপুক, ধুকপুক করছে। সেই ধুকপুকানির শব্দ বোধহয় নিয়াজ শুনে ফেলছে, এই লজ্জায় সে আরো পিছনে চলে গেল। নিয়াজ একদৃষ্টিতে চেয়ে রাহার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ভালোবাসা কমেনি। বরং দ্বিগুণ বেড়েছে। না হয় এত ছটফটানি কীসের?
নিয়াজ কথা শুরু করলো,
“আগের মত এখনো উষ্ঠা খাওয়ার অভ্যাস আছে নাকি?”
লজ্জা পেয়ে নিচে তাকিয়ে রাহা বলল,
“না আসলে খেয়াল করিনি ছোট পাথর টা।”
“আগেও খেয়াল করতে না। এক্ষুনি তো মাথাটা ফাটতো। তারপর ঠিকই খেয়াল করতে।”

কন্ঠস্বরে কড়া শাসন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আগের সেই চেনা অনুভূতিগুলো এসে উঁকি দিচ্ছে রাহার মনে। মাথা উঁচু করে দেখলো, নিয়াজ তাশরিকের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দেখলো, নিয়াজ কমলা, সাদা গ্রামীণচেকের গেঞ্জি পড়েছে। শার্ট বরাবরই নিয়াজের পছন্দ নয়। এখনো কি পছন্দ নয়? দ্রুত পায়ে রাহাও নিয়াজের পিছু পিছু গেল।
তাশরিক সিদ্ধীকে এতক্ষণ অনেক কথা শুনিয়েছে, উপরে না যাওয়ার জন্য। সিদ্ধীর প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থা। রাহাকে দেখেই রাহার পাশে এসে দাঁড়ালো। সবার সামনে রাহা কিছু জিজ্ঞেস করলো না। নিয়াজ তাড়া দিয়ে বলল,
“সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। চল এবার।”
বিরক্তি নিয়ে তাশরিক বলল,
“আরেকজন ম্যাডামের আসা বাকি। এই রাত বিরাতে উনি উনার আটা ময়দা দেওয়া শেষ করে আসুক।”
নিয়াজ বুঝতে পারলো, কার আসার কথা বলছে তাশরিক। এক ঢোক গিললো। অহনা বাড়ির গেট থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,
“ইটস নট আটা ময়দা, ভাইয়া। ইটস মেকআপ। মেকআপকে মেকআপ বলতে শিখো।”
রাহা তাকালো। মুখে গাঢ় মেকআপ। হালকা বেগুনি রঙের টপসের সাথে একটা টাইট জিন্স পড়া মেয়ে আসছে। হাতে দামী ঘড়ি। গাঢ় মেকআপ থাকলেও মেকআপ ছাড়াও মেয়েটা ভীষণ সুন্দর, রাহা তা বুঝতে পারছে।
অহনা পিছনের ঝুটি করা চুল আরো টাইট দিল। নিয়াজের দিকে চোখ যেতেই লজ্জা পেল। নিয়াজ চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। অহনা নিয়াজের কাছে এসেই গানের সুরে বলল,
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?”
নিয়াজ দূরে সরে গেল। অহনা কাছে এসে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আবার বলল,
“চিরদিন কেন পাই না?”
রাহার চোখগুলো বড় হয়ে গেল। এ কেমন মেয়ে? নিয়াজের কি হয়?
তাশরিক ধমকের সুরে বলল,
“চিরদিন দেখা পাওয়া লাগবে না। গাড়িতে উঠ।”
অহনা মুখের ভঙ্গিমা স্বাভাবিক রেখে গাড়িতে দ্রুত গিয়ে মাঝের সিটে বসলো। ভালোভাবেই জানে, তার ভাইয়া গাড়ি চালাবে। তারমানে ভাইয়ার সাথে ভাবিই বসবে। পিছনে নিয়াজ সাইডে বসলে ওই অচেনা মেয়েকে কোনোভাবেই তার সাথে বসতে দেওয়া যাবে না। তাই মাঝে গিয়েই বসলো।
সিদ্ধী সামনের সিটে না গিয়ে পিছনের গেট খুলতে গেলে তাশরিক সিদ্ধীর হাত চেপে ধরে। সিদ্ধী হাত মোচড়াতে থাকে। হাত শক্ত করে ধরে সামনের সিটে বসায়। রাহা সাইডে গিয়ে বসে। অপর সাইড থেকে নিয়াজ গেট খুলে বসে। সিটগুলোর প্রস্থ যথেষ্ট। তবুও নিয়াজ একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে।
সব ব্যাগগুলো ঠিকভাবে রাখা হয়েছে কিনা তা দেখে তাশরিক গাড়িতে উঠে। সিদ্ধী তাশরিককে দেখে বাইরের দিকে তাকায়। সিদ্ধীর রাগ দেখে তাশরিক মৃদু হাসে। গাড়ি চলতে শুরু করে। অহনা ব্যাগ থেকে চিপস বের করে খেতে খেতে বলে,
“ভাবি, আমার সাথে একটু কথাও বললা না।”
সিদ্ধী পিছন ফিরে হেসে জবাবে বলে,
“আসলে তখন গাড়িতে উঠা নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিল। তাই কিছু বলি নি।”
রাহা এবার বুঝতে পেরেছে, মেয়েটা সিদ্ধীর ননদ। কিন্তু নিয়াজের সাথে সম্পর্ক কী, তা বুঝে উঠতে পারলো না। হয়তো ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড দেখে ফ্রি’লি কথা বলে, এই ভেবে নিজের মনকে স্বান্ত্বনা দিল। অহনা পাশে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“হাই, কিউটি! তোমার সাথে পরিচয় করা হলো না।”
রাহা হেসে হাত মিলিয়ে জবাবে বলল,
“আমার পরিচয় দেওয়ার মত বেশি কিছু নেই৷ আমি সিদ্ধীর বেস্ট ফ্রেন্ড।”
“বেস্ট ফ্রেন্ডের চেয়ে বড় পরিচয় আর কি হতে পারে। তোমাকে যে আমি প্রথমে কিউট বলেছি, খেয়াল করেছো?”
সিদ্ধী পিছন ফিরে বলল,
“ও খেয়াল না করলে কি হয়েছে। আমি ঠিকই খেয়াল করেছি। আর ও আসলেই কিউট।”
“একদম আমার ভাবির মতো।”
রাহার গাল টিপে বলল। অনেকটা পথ পেরোতেই ঘুমে ঢলে পড়লো অহনা। অহনা বাদে কেউই ঘুমায়নি।
আশেপাশে ভালোবাসার মানুষ থাকলে ঘুমানো যায়? সেই মুহূর্তে তো বুকের ভেতর তোলপাড় চলে৷ এত তোলপাড় নিয়ে মানুষ কীভাবে তার ভালোবাসার মানুষের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোয়? তখন তো ইচ্ছে হয়, ভালোবাসার মানুষটিকে মন ভরে দেখতে।
শেষ কথাটি মনে আসতেই রাহা নিয়াজের দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়ে গেলো। লজ্জা পেয়ে রাহা আবার বাহিরে তাকালো। তাশরিক আয়নায় নিয়াজের অস্থিরতা দেখছে। এই অস্থিরতা দেখায় আলাদা মজা পাচ্ছে। এটা কি না পাওয়ার অস্থিরতা? এমন অস্থিরতা তো তার কখনো হয় নি। হয়তো চাওয়ার সাথে সাথে পেয়ে যাওয়ায় এমন অস্থিরতা সে অনুভব করে নি। আয়নায় অহনার মুখের দিকে তাকালো। ঘুমন্ত অবস্থায় বিশ্বের সবথেকে বড় খুনিকেও নিষ্পাপ মনে হয়। বোনের জন্যও তার কিছু করা উচিৎ। বোনকে যে আবেগ বশ করে ফেলেছে। ক’দিন বাদে যখন জানবে, নিয়াজ অন্য কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। অন্য কারো জন্য এখনো অবধি বিয়ের কথা মুখে আনে নি; তখন তার বোনটা যে আবেগে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
জানালায় হাতের উপর ভর করে মাথা রাখতে কষ্ট হওয়ায় সিদ্ধী হাতের দুটো চুড়ি খুলে ব্যাগে রাখলো। তাশরিক একবার তাকালো। মুখ মলিন হয়ে আছে। এতক্ষণ বাহির থেকে নিজেকে খুশি দেখালেও ভিতরে যে কষ্ট চেপে রেখেছিলো, তা তাশরিক ভালোভাবেই জানে।
চুড়িগুলো রেখে আবার জানালায় হাতের উপর ভর করে মাথা রাখলো। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে। চোখ বন্ধ করার সাথেই একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এই সামান্য বিষয় নিয়ে না বকলেও পারতো। এতদিন ভেবেছিলো, এরেঞ্জ ম্যারেজ করে সে লাকি। তাশরিককে দেখে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় নি, সে বকতে জানে। কিন্তু আজ তার ভুল ধারণা ভেঙে গেল।
একই গাড়িতে পাঁচজনের চারজন একেকরকম ভাবনায় ডুবে আছে। কেউ ভালোবাসার সংজ্ঞা বোঝার চেষ্টায় আছে। কেউ ভালোবাসাকে না পাওয়ায় ছটফট করছে। কেউ নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড আর বোনের অস্থিরতাকে দূর করায় ব্যস্ত। আর কেউ বাচ্চামো করে সামান্য বকা মনের ভিতর চেপে রেখে কষ্ট পাচ্ছে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here