#বাঁধন_ছেঁড়া_প্রেম
পর্ব:১৫
#যারিন_তাসনিম
নিয়াজ ছাদে গিয়ে দেখলো, রাহা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিয়াজ রাহার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। পাশে দাঁড়ানোর সাহস পেলো না।
রাহা আশেপাশের গাছগুলো দেখছে। দূরের ছোট ছোট ঘরগুলো ছোটবেলায় গ্রামের দৃশ্যে আঁকা ঘরগুলোর মতো দেখাচ্ছে।
রাহার মনোযোগ পাওয়ার জন্য নিয়াজ একটু কাশলো। রাহা পিছন ফিরে স্বাভাবিকভাবে দেখে আবার সামনে তাকালো। মনোযোগ না পেয়ে নিয়াজ জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো?”
মুচকি হেসে রাহা জবাব দিলো,
“এতদিন পর?”
নিয়াজ প্রশ্ন বুঝতে না পেরে আবার আরেকটি প্রশ্ন করলো,
“বুঝলাম না?”
রাহা পিছু ফিরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে হাতটা আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে নিয়াজের চোখে চোখ রেখে বলল,
“মানে এতদিন পর জিজ্ঞেস করছেন কেমন আছি?”
নিয়াজ ঢোক গিলে বলল,
“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উত্তর দেওয়া আমার পছন্দ নয়।”
গভীর নিশ্বাস ছেড়ে রাহা বলল,
“আপনার পছন্দ অপছন্দ ভেবে কাজ করার সময় নেই আমার।”
নিয়াজ হকচকিয়ে গেল। মেয়েটা কি বদলে গেছে। আগের সেই বাচ্চামোগুলো নেই। ব্যবহারে সেই নমনীয়তা নেই। আগে কখনো তর্ক করতো না। এখন তর্ক করাও শিখে গিয়েছে। নিয়াজ জানে, মানুষ কারণে-অকারণে বদলায়। কিন্তু রাহা অকারণে বদলায়নি। পরিস্থিতি তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে।
রাহা রেলিং থেকে সরে গিয়ে ছাদে থাকা দোলনাটার উপর গিয়ে বসলো। নিয়াজ ভাবনাগুলো থেকে বেরিয়ে রাহার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
কিছুক্ষণ আগে নিয়াজ স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করছিলো। আর এখন রাহাকে দেখে সে বারবার অবাক হচ্ছে। রাহা তার থেকেও বেশি স্বাভাবিক আচরণ করছে। রাহা দোলনার একপাশে গিয়ে বলল,
“চাইলে বসতে পারেন।”
নিয়াজ কিছু না ভেবেই বসে পড়লো। পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে নিয়াজ দোলনাটা দুলাতে শুরু করলো। রাহার দিকে তাকিয়ে দেখলো রাহার মুখে মুচকি হাসি লেগে আছে। নিয়াজ আবার সামনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“রাব্বি এবার কীসে পড়ে?”
“এস.এস.সি দিবে৷”
অবাক ভঙ্গিতে নিয়াজ বলল,
“বাচ্চাটা বড় হয়ে গিয়েছে।”
রাহা জবাবে কিছু বললো না। নিয়াজ আবার বলল,
“আমি তোমাকে সেদিন দেখে সত্যিই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আশাও করি নি দেশে ফিরে তোমাকে আবার….”
কথার মাঝে রাহা বলল,
“দয়া করে পুরনো কথা তুলবেন না।”
“আগে তুমি আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতে।”
রাহা ধীরকণ্ঠে বলল,
“অতীতটা অতীতেই থাকতে দিন। সবকিছু বদলে গেছে। বদলে গেছে সময়, বদলে গেছি আমি, বদলে গেছে আপনার ভালোবাসার মানুষ।”
নিয়াজ হতবাক হয়ে বলল,
“মানে?”
“তোমরা এখানে কি করছো?”
অহনার কণ্ঠে নিয়াজ আর রাহা একসাথে পিছনে তাকালো। রাহা উঠে অহনার হাত ধরে নিয়াজের পাশে বসিয়ে বলল,
“আসলে উনি তোমার নামে খুব প্রশংসা করছিলো। তুমি কত সুন্দর একটা মেয়ে, নম্র, ভদ্র; এসবই বলছিলো।”
অহনা অবাক হয়ে নিয়াজের দিকে তাকালো। খুলনায় আসার সাথে সাথেই সে এত দ্রুত সফল হবে, সে কল্পনাতেও আনতে পারেনি। জয়ী হওয়ার হাসি দিলো।
নিয়াজ চোখ মুখ খিঁচে বলল,
“হোয়াট?”
রাহা এড়িয়ে গিয়ে অহনাকে বলল,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
অহনার পূর্বের সেই হাসি মুখে রেখে বলল,
“আমার রুমেই ছিলাম আপু। তারপর ওর কথা মনে পড়ায় খুঁজতে এলাম।”
কথাটা নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো। নিয়াজ বিরক্তিতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রাহার গলায় কিছু একটা এসে আটকে আছে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। জবাবে কিছু বলতে গেলেই হয়তো চোখের পানি গড়িয়ে পড়বে। সেই ভয়ে চুপ করে রইলো।
অহনা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইশ,কি বিরক্তিকর! বৃষ্টি নামবে বোধহয়। অসহ্য লাগে আমার।”
রাহা, নিয়াজ দুজনেই আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ মেঘলা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও কাঠফাটা রোদ ছিলো৷ হঠাৎ আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলো। রাহা, নিয়াজ দুজনের কেউ-ই খেয়াল করেনি। দুজনেই নিজেদের অতীতের স্মৃতিগুলোর পাতা বর্তমানে দেখতে মগ্ন ছিলো।
অহনা বলতে না বলতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। অহনা বিরক্তি নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে দৌঁড়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেলো। ছাদের বাহিরে গিয়ে নিয়াজকে ডাকলো,
“নিয়াজ, চলে এসো। বৃষ্টি নামবে এখনি।”
নিয়াজ দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলো।”
রাহা দোলনায় বসে পড়লো। নিয়াজ আবার বলল,
“কি হলো? বসলে কেন? চলো।”
রাহা নিজের দু’হাত দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ধরলো। ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। অহনা এবার দু’জনকেই জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলো। রাহার চোখও এবার বৃষ্টিবর্ষণ শুরু করেছে। বৃষ্টির পানির সাথে রাহার চোখের পানি মিলিয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টির পানি ছিটকে অহনার গায়ে পড়ায় সে বিরক্তি নিয়ে নিচে চলে গেল। নিয়াজ আর কিছু বললো না। তাকিয়ে রইলো রাহার দিকে।
রাহা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করলো। নিয়াজ রাহার পাশে বসে বলল,
“কষ্ট হচ্ছে?”
নিয়াজের কণ্ঠ রাহার কষ্ট যেনো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো। এবার সে কাঁপা গলায় বলল,
“তুমি বদলে গিয়েছো। তুমি নিজের ভালোবাসার মানুষকে বদলে নিতে পেরেছো। আমি কেনো পারছি না, নিয়াজ?”
নিয়াজ আবারও অবাক হয়ে বলল,
“কে বলেছে তোমাকে যে, আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে বদলে নিয়েছি? আমার আবেগের বয়সটাতে প্রথম তুমিই এসেছিলে আর এখনো তুমিই আছো।”
রাহা নিয়াজের কাছে গিয়ে কলার ধরে বলল,
“চুপ, মিথ্যাবাদী। মিথ্যা কথা কমাও। আমি এখনো তোমার ভালোবাসার মানুষ থাকলে তুমি অন্য কারোর হাত ধরতে না।”
নিয়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
“কার হাত ধরেছি আমি?”
রাহা নিয়াজের কলার ছেড়ে নিজেকে নিজের দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“সকাল বেলায় তুমি অহনার হাত ধরোনি?”
নিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলো। এরপর সশব্দে হেসে উঠলো। সে হাসি দেখে রাহা কান্না থামিয়ে তাকিয়ে রইলো। নিয়াজ হাসি থামিয়ে বলল,
“একবার জড়িয়ে ধরি, রাহা?”
রাহার নাম সহজে উচ্চারণ করতো না নিয়াজ। খুব কম সময়েই উচ্চারণ করতো। কোনো অনুভূতিতে যখন খুব বেশি জড়িয়ে পরতো, ঠিক সেই মুহূর্তেই নিয়াজ রাহার নাম উচ্চারণ করতো।
রাহার জবাব না পেয়ে নিয়াজ অনুমতিবিহীনই রাহাকে জড়িয়ে ধরলো। রাহা এবার কাঁদছে না। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সবথেকে সুখকর স্থানে সে তার মাথা রেখেছে। রাহাও হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
নিয়াজ চোখ বন্ধ করে রাহাকে আরো কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
দু’জনেই কিছু সময়ের জন্য কোনো কথা বললো না। এই সুখময় সময়টা খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে, তাই দু’জন চুপ করে তা অনুভব করছে। যাতে শেষ হয়ে গেলেও কোনো আফসোস না থাকে। যাতে এই সুখের রেশ বহুবছর ধরে না কাটে।
বৃষ্টির গতি কমে এলো। নিয়াজ চোখ খুলতেই সেই সুখময় সময় থেকে বেরিয়ে এলো। রাহার মাথায় হাত রেখে বলল,
“চলো, এবার যাই। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।”
রাহা চোখ খুলতেই বুঝতে পারলো, সে নিয়াজকে জড়িয়ে ধরে আছে। ছিটকে দূরে সরে গেলো। লজ্জায় নিয়াজের দিকে তাকাতে পারলো না। হাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে শুরু করলো। কী বলবে, তা বুঝে উঠতে পারলো না।
এত লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর জন্য রাহা উঠে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো। নিয়াজ বলল,
“শুনো, ঘরে গিয়ে জামা পরিবর্তন করে চুলগুলো ভালোভাবে মুছে নিও।”
নিয়াজের কথায় রাহা থেমে গেলেও পিছে ফিরে তাকালো না। তাকালে নিয়াজ আবার তার লজ্জামাখা চেহারাটা দেখে ফেলবে। তার লজ্জা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
দৌঁড়ে চলে গেলো৷ বুকের যে পাশে রাহা মাথা রেখেছিলো, নিয়াজ সে পাশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আরেকবার সেই সুখময় অনুভূতি অনুভব করার প্রচেষ্টা চালালো।
চলবে,