বাঁধন ছেঁড়া প্রেম পর্ব :১৬

0
660

#বাঁধন_ছেঁড়া_প্রেম
পর্ব ১৬
#যারিন_তাসনিম

“সিদ্ধী? কথা বলো।”
দুই হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে সিদ্ধী হাঁটছিলো। তবুও জবাব দিলো না। তাশরিক আবার বলল,
“সিদ্ধী প্লিজ, সামান্য বিষয় নিয়ে এতক্ষণ রাগ করে থাকাটা পছন্দ নয় আমার।”
সিদ্ধী হাঁটা থামিয়ে তাশরিকের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,
“সামান্য বিষয় নিয়ে আমি রাগ করেছি? নাকি সামান্য বিষয় নিয়ে তুমি আমাকে বকাবকি করেছো?”
তাশরিক বড় করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“চলো, ওই গাছটার নিচে একটা বেঞ্চ আছে, সেখানে গিয়ে বসি।”
তাশরিক হাঁটতে শুরু করলো। সিদ্ধীও গেল। তাশরিক বেঞ্চটায় বসলো। সিদ্ধীও পাশে বসে আবার হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করলো। তাশরিক আওয়াজ করে হেসে বলল,
“আমার মনে হচ্ছে, তোমার রাগ প্রকাশের একটা সিগন্যাল হচ্ছে, হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে রাখা।”
সিদ্ধী নাক ফুলিয়ে স্বাভাবিকভাবে বসলো। তাশরিক এবার নরম কণ্ঠে বলল,
“শুনো, যা যা বলবো, মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আশা করি, সব শুনার পর তুমি আমাকে আর ভুল বুঝবে না। মনোযোগ দিয়ে শুনবে তো?”
সিদ্ধী তাশরিকের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে হ্যাঁ-বোধক উত্তরে মাথা নাড়ালো।
তাশরিক এক হাত বেঞ্চের উপর রেখে একটু পাশ ফিরে সিদ্ধীর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,
“তুমি হয়তো বুঝতে পারছো, আম্মু তোমাকে পছন্দ করে না।”
এতটুকু বলার পর সিদ্ধী তাশরিকের দিকে স্থিরভাবে চেয়ে রইলো। তাশরিক আবার বলল,
“আমি জানি, তুমি কষ্ট পাচ্ছো। কিন্তু কষ্ট না পেয়ে এর সমাধান করলে আরও বেশি লাভ হয় না, বলো? একবার সমাধান করতে পারলে আমরা দুজনই সুখে থাকবো। আমরা দুজনই দুজনকে পছন্দ করি। তাই আমাদের দুজনের মতামত পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তার থেকে ভালো উপায়, এর সমাধান বের করা। ”
সিদ্ধী যেনো আশা-ভরসা ফিরে পেল৷ বলল,
“কী সমাধান?”
“আগে তোমাকে কিছু কথা বুঝতে হবে। শাশুরির বকা-ঝকা, খোটা দেওয়া এগুলো পেতে পেতে একটা মেয়ের শাশুরির উপর ঘৃণা চলে আসে। বিরক্ত চলে আসে। শাশুরিকে নিজের মায়ের চোখে দেখতে হবে। হ্যাঁ, তুমি হয়তো এখন বলবে, শাশুরিরও বউকে নিজের মেয়ের চোখে দেখা উচিত। কিন্তু যেকোনো একজনকে তো একটু স্যাক্রিফাইস করতে হবে, তাই না? আচ্ছা একটা কথা বলো তো, তোমার আম্মু কি তোমাকে কখনো বকে না?”
সিদ্ধী গলার আওয়াজ কিছুটা বাড়িয়ে দ্রুত বলল,
“বকে না আবার, বকে বকে একদম সাত আসমানে উঠিয়ে দেয়। আগে কি বলতো জানো? আগে বলতো যে, তুই কাজ পারিস না, তোকে কেউ বিয়ে করবে না। করলেও শ্বশুরবাড়ি টিকবি না। ঝাড়ুর বারি দিয়ে তোকে বের করবে।”
একটু হেসে তাশরিক বলল,
“এগুলো যদি আমার আম্মু বলতো? আম্মু হয়তো বলতো, তুমি এই বাড়িতে টিকবে না। আম্মু বললে তুমি নিশ্চয়ই এগুলোকে খোটা হিসেবে ধরতে। তোমার আম্মু যে বলেছে, তুমি কী খোটা হিসেবে নিয়েছো?”
“নাহ।”
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল সিদ্ধী। তাশরিক আবার বলল,
“হুম, তাহলে আমার আম্মু বললেও খোটা হিসেবে নিবে না। আমার আম্মু বললে তোমাকে হয়তো খোটা দিয়েই বলবে। কিন্তু তোমার আম্মু তোমার ভালোর জন্য বলে। আমার আম্মু খোটা দিলেও তুমি ভেবে নিবে, এগুলো বকা। তোমার ভালোর জন্যই বলছে। এবার আমাদের দুজনের সুখী থাকার সমাধানটা বলি?”
সিদ্ধী জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে বলল,
“বলো।”
“তুমি আমার আম্মুর খোটাগুলোকে খোটা না ভেবে তোমার আম্মুর বকা ভাববে। তোমার আম্মু বকা দেওয়ার পর তুমি ঠিক যেই রিয়েকশন গুলো দাও,সেগুলোই দিবে৷ আম্মুর কখন কোনটা লাগবে, সেগুলো খেয়াল রাখবে। মাঝে মাঝে শাড়ি পরে আম্মুকে সবার আগে দেখাবে। দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে, আম্মু আমাকে কেমন লাগছে? কোথাও যাওয়ার সময় একা একা না সেজে আম্মুকে ডেকে বলবে, আম্মু আপনাকে একটু সাজিয়ে দেই। খুব সুন্দর লাগবে আপনাকে। নিজে রান্না করার পর আমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করবে, সব ঠিকঠাক তো। এতেই আম্মু বুঝবে, তোমার কাছে আমার আম্মুর গুরুত্বটা কত বেশি। আর মেইন পয়েন্ট হচ্ছে, আমার আম্মুকে তোমার আম্মু ভাববে। ব্যস! এতটুকুই এনাফ। হয়তো একটু সময় লাগবে। হয়তো অনেকদিন সহ্য করতে হবে। দেখবে, একদিন ঠিকই আম্মুর মন নরম হবে। আমার আম্মু অতটাও খারাপ না। আম্মুর মন জয় করতে বেশি সময় লাগবে না।”
গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তাশরিকের হাতের উপর পানির ফোঁটা পড়তেই থেমে গেল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সিদ্ধীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, সিদ্ধী পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে।
তাশরিক সিদ্ধীর হাত ধরে বলল,
“চলো, এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।”
বলেই দৌঁড়াতে শুরু করলো। সিদ্ধী তাশরিকের দিকেই তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি শুরু হতেই সিদ্ধী সম্পূর্ণ ভিজে গেল। বাড়ি যেতে আরো অনেকটা পথ বাকি। তাশরিক সিদ্ধীকে টেনে একটা টিনের ঘরের নিচে এসে দাঁড়ালো। মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় টিনের উপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে। সিদ্ধী এখনো তাশরিকের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশরিক টিনের নিচ থেকে মাথা বের করে দেখলো, বৃষ্টি কতটুকু। সিদ্ধীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, সিদ্ধীর চুল দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। দুজন খুব কাছাকাছি। তাশরিককে সিদ্ধীর দিকে আশেপাশে থাকা অদৃশ্য কিছু হয়তো আকর্ষণ করছে। তাশরিক খুব কাছে গেল। হয়তো এক মিটারের দূরত্ব দুজনের মধ্যে। তাশরিক সিদ্ধীর গালে হাত ছোঁয়াতেই সিদ্ধী গাল নিচু করে কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো। সিদ্ধীর চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিলো।
“ছেহ! ছেহ! এই ছেড়া-ছেড়ি কোন জায়গা থেকে আসলো?”
মাঝবয়সী মহিলার কণ্ঠে তাশরিকের জ্ঞান হলো। সে দ্রুত দূরে সরে এলো। সিদ্ধী চোখ খুলে সামনে তাকাতেই মহিলাকে দেখতে পেলো। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। তাশরিক স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“আসলে কাকি, বৃষ্টি হচ্ছে তো; আমরা এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম,তাই আপনাদের ঘরের নিচে আশ্র‍য় নিলাম।”
ভ্রু কুঞ্চিত করে মহিলাটি বলল,
“আশ্র‍য় নিচ্ছিলে নাকি ঘরের নিচে লুতুপুতু করছিলে?”
তাশরিক কূল-কিনারা না পেয়ে সিদ্ধীর হাত ধরে দৌঁড়াতে শুরু করলো। পিছন থেকে আরেকটি আওয়াজ কানে এলো,
“হ, হ! লুতুপুতু কইরা এরুম সবাই-ই পালায়।”
এক দৌঁড়ে ৫ মিনিটেই তাশরিক ওর দাদুর বাড়ির নিচে চলে আসলো। সিদ্ধীর হাত ছেড়ে হাঁপাতে শুরু করলো। সিদ্ধীও হাঁপাচ্ছে। ততক্ষণে বৃষ্টির তীব্রতা কমে গিয়েছে। তাশরিক সিদ্ধীকে বলল,
“তাড়াতাড়ি ঘরে যাও।”
সিদ্ধী তাশরিককে একপলক দেখে উপরে চলে গেল। উপরে গিয়ে রাহাকে দেখেই হতবাক হলো। চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল,
“কীরে? তুই ভিজলি কীভাবে?”
রাহা আমতা আমতা করে বলল,
“ছাদে গিয়ে ভিজেছিলাম।”
সিদ্ধী চোখগুলো আবার ছোট করে রাহার কাছে এসে উপর থেকে নিচ দেখলো। এরপর বলল,
“মনে হচ্ছে, কিছু মিথ্যা বলছিস। ডাল মে কুচ কালা হে!”
রাহা সিদ্ধীকে ঠেলে বাথরুমে পাঠিয়ে বলল,
“কোনো কালা টালা নেই। নিজে ভিজে গিয়েছিস। জ্বর আসবে। গোসল করে নে। আমি তোর গামছা দিচ্ছি।”
সিদ্ধী দরজা না আটকিয়ে বলল,
“তুইও তো পুরো ভিজে আছিস।”
রাহা দরজা বাহির থেকে আটকিয়ে দিয়ে বলল,
“কথা কম বল। আমি চুল মুছে নিয়েছি, আমার সমস্যা হবে না।”
সিদ্ধী ভিতর থেকে জোরে বলল,
“আমি কিন্তু সব সত্যি তোর পেট থেকে বের করে নিব।”
রাহা আর জবাব দিলো না। সে জানে, সিদ্ধী ঠিকই জোর করে সব শুনে ছাড়বে।

রাতে সিদ্ধী, রাহার কাছে এসেই পেটে সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করলো। রাহা সিদ্ধীকে আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। এরপর হাসতে হাসতে বলল,
“প্লিজ, ছাড়! সব বলছি।”
সিদ্ধী থামলো। রাহা কিছুক্ষণ শ্বাস নিলো। এরপর সিদ্ধীর দিকে তাকাতেই দেখলো, সিদ্ধী আরো একবার প্রস্তুতি নিচ্ছে পেট থেকে কথা বের করার জন্য।
রাহা ঢোক গিলে গড়গড় করে সব বলে দিলো।
সিদ্ধী খুশিতে মুখে হাত চেপে রেখে বসে ছিলো। এরপর বলল,
“তারমানে ভাইয়া তোকে এখনো ভালোবাসে।”
রাহা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“কচু বাসে। তোর ননদকে ভালোবাসে।”
সিদ্ধী রাহার কাছে এসে বলল,
“দাঁড়া, দাঁড়া! অহনার এত কাহিনী আমি জানতাম না। জানতে হবে। নিশ্চয়ই ভিতরে অন্য কিছু আছে। আর তোর আর ভাইয়ার ব্যাপারটা সেটিং করার দায়িত্ব আমার।”
রাহা সিদ্ধীর কান মলে দিয়ে বলল,
“কী করবি তুই? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও তুই ওই চিটারের সাথে আমার সম্পর্ক আবার গড়াতে চাস?”
সিদ্ধী রাহার হাত ধরে বলল,
“আহ, ছাড়! লাগছে। ভাইয়া চিটার না। আমরা সবটা না জেনে ভাইয়াকে চিটার বলতে পারি না। আমার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ শুরু করতে হবে।”
রাহা ছেড়ে দিয়ে বলল,
“মন্ডুর প্ল্যান।”
সিদ্ধী একটু ভাব নিয়ে বলল,
“এইসে মাত কাহো। সামনে দেখো, কেয়া কেয়া হোতা হে।”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here