বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-৩

0
1656

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৩
#সুমাইয়া_মনি

‘আম্মু আমার ব্লু রঙের টিশার্ট কোথায়?’ আবির চিল্লিয়ে আইরিন বেগমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল।
রুম থেকে তিনি হাঁকিয়ে বলেন,
‘ময়নার মা’কে বলেছি। ইস্ত্রি করে নিয়ে যাচ্ছে, একটু ওয়েট কর।’
‘ধ্যাত! এখনো ইস্ত্রি করা হয়নি।’ বিরক্তি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়াতে লাগলো আবির৷ হঠাৎ-ই আয়নার ভেতরে বিভার এক ঝলক প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। বিভা এক প্রকার দৌঁড়ে তার রুমের সামনে থেকে গিয়েছে এমনটা মনে হচ্ছে আবিরের। উন্মুক্ত গায়ে বাহিরে বের হয়ে কাউকে দেখতে পায় না। মনের ভুল মনে করে আবির। তবে হঠাৎ বিভাকে দেখার কারণ সে আদৌও বুঝতে পারছে না। হতে পারে এটা তার হ্যালোসিনেশন! কিছুক্ষণ বাদে ময়নার মা টিশার্ট দিয়ে গেলে সেটি পড়ে তার ওপর জ্যাকেট পড়ে। বাহিরের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। জানুয়ারি মাস বলে কথা। সিঁড়ি বেয়ে হল রুমে আসে। হল রুমের পাশের একটি গেস্ট রুমে আফিন ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে কিছু স্টুডেন্টদের পড়ায়।
কলেজ ছুটির পর পড়ার টাইম ফিক্সড করেছে। কিছু একটা মনে করে আবির এগিয়ে যায় সেই রুমের দিকে। ভেতরে প্রবেশ করতেই আফিন অঙ্ক বুঝানো থামিয়ে দেয়। বাকিদের নজরও আবিরের উপর পড়ে। আবির বিভাকে দেখতে পায় সেখানে। সে বুঝে যায় একটু আগে সত্যি বিভাকে দেখেছিল। হ্যালোসিনেশন ছিল না। বিভা আবিরকে দেখেও না তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। রাগ হয় আবিরের। এই মেয়েটা কিসের এহ দাম দেখায় বুঝতে পারে না সে।

‘কিছু বলবি আবির?’ আফিন প্রশ্ন করে।
‘নাহ! ভাইয়া।’ বলে আবির বেরিয়ে আসে রুম থেকে।

হল রুমের সোফায় বসে। আপাতত বিভার কথা মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে। বন্ধুদের মাধ্যমে খোঁজ লাগিয়ে বিভার সম্পর্কে সব জানতে পারে। বাবা নেই। বড়ো বোন, মা আর বিভা। মধ্যবিত্ত পরিবারের বলা চলে। তবে বিভার ভাব, স্বভাব দেখে তার মোটেও ভালো লাগে না। সে কি শুধু তার সামনেই এমন ভাবের মধ্যে থাকে নাকি সবার সামনেও একই রূপে থাকে দেখায়। এতটুকু ভাবার পর সামিমের ফোন আসে। আবির বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

কলেজ ছুটির পর বিভা, মোহনা সঙ্গে আরো কিছু স্টুডেন্ট রা আফিনের কাছে পড়তে আসে। বাড়ির সামনে এসে বিভা কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে যায়। রাজ প্রাসাদের চেয়ে কম নয় বাড়িটি। আফিন আসার আগে বাড়িটি ঘুরে দেখার জন্য মোহনাকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে যায়। ওপরে পাঁচটি কামরা আছে। ডান পায়ে এডজাস্ট বড়ো বারান্দায়ও রয়েছে। মোহনা বারান্দায় যায় না। সিঁড়ির বগলে দাঁড়িয়ে থাকে। বিভা একাই যায়। এতবড়ো বারান্দা দেখে বিভা মুগ্ধ হয়। পাশে ছোট ছোট টপে ফুলের গাছও রয়েছে। তখনই আবিরের কণ্ঠের স্বর শুনতে পায়। বাহিরে বের হয়ে পা টিপে আবিরের কামরার দিকে উঁকি দিতেই সরে যায় ওঁকে দেখে। প্রথমে তো ভাবে আবির এখানে কেন? পরক্ষণে আইরিন ম্যামের কণ্ঠ শুনে পায়। এক প্রকার দৌঁড়িয়ে মোহনার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় বিভা। আর তখনই আবির বিভার প্রতিবিম্ব দেখতে পায় আয়নাতে। সেখানের স্টুডেন্টদের কাছে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারে। আবির, আফিন দুই আপন ভাই। আফিন বড়ো, আবির ছোট। বোন নেই তাদের৷ শুনে বিভার মাথায় যেন বাজ পড়ার অবস্থা হয়।

‘আগে যদি জানতাম আবির পাঠা আফিন স্যারের ছোট ভাই, তার কাছে পড়তে আসতাম না। স্যার, আর ম্যাম কতটা ভালো বিনয়ী মানুষ। আর এট পাঠা তো চরম বেয়াদবের হাড্ডি। তাদের মতো যে কেন হলো না।’ মনে মনে কথা গুলো বলে আফিনের দিকে তাকায় বিভা। দুই ভাইয়ের চেহারায় একটুআধটু মিল খুঁজে পায় সে। দেখতে ফর্সা, লম্বাচওড়া। চোখে চশমা পড়ে আফিন। শোভন আচরণে যে কেউ মুগ্ধ হবে। মায়ের মতো সেও একজন টিচার। তাও একই কলেজে।
________
সেলাই মেশিন চালানোর সময় হঠাৎ একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ধরাধরি করে ববি সহ আরো কিছু মেয়েরা তাকে নিয়ে গার্মেন্টসের মেডিক্যালে আসে। সেখানের ডক্টর মেয়েটির পরিবারের সদস্যকে আসতে বলে। ততক্ষণে ববি মেয়েটির কাছে থেকে যায়। এক স্থানে পাশাপাশি কাজ করার সুবাধে অনেক আগেই মেয়েটিকে ববি চিনতো। নাম সাথী। ববির চেয়ে বয়সে ছোট । সাথীর মা আছে, বাবা নেই। মা কিছুক্ষণ বাদে সেখানে হাজির হলে ডক্টর আলাদা ভাবে তাকে চেম্বারে ডাকে। ববিও যায় সাথীর মায়ের সঙ্গে।
ডক্টর সাথীর মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আপনার মেয়ের একটি কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে।’
সাথীর মা যেন কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। সে কেঁদে ফেলে। ববির মনও খারাপ হয়ে যায়। তাকে শান্তনা দেয়।
ডক্টর আবার বললেন,
‘আপনি এত টেনশনে করছেন কেন? এটা তো নতুন কিছু নয়। এখানে অনেক বিবাহিত, অবিবাহিত মেয়েদের চিকিৎসা জন্য কোম্পানি থেকে সাহায্য পায়। আপনার মেয়ের অপারেশনের দায়িত্ব পুরো কোম্পানির। আপনাকে এক টাকাও দিতে হবে না।’
সাথীর মায়ের চোখ যেন চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। তিনি হাত জোর করে বললেন,
‘বাঁচাইয়া রাখুক তাগো। আমার মাইয়াডা নতুন জীবন পাইবো।’
‘কার রাতে অপারেশন হবে।’
‘আইচ্ছা।’

কথপোকথন শেষ করে ববি সাথীর মা’কে নিয়ে সাথীর কেবিনে আসে। সাথীর সবে মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সাথীর মা সত্যিটা বলে দেয়। সাথী কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। ববি ওঁকে আশ্বাস দেয়। ভয় পেতে নিষেধ করে। সাথীর বয়স সতেরো। এতটুকু বয়সে অপারেশন কথা ভেবে ববি নিজেও আশংকার মধ্যে থাকে।
.
বিভা বই পড়ছে। বিলকিস বানু হাতে কাঁথা সেলাই করছে। সন্ধ্যার দিকে ববি ওভার টাইম সেরে তবেই বাড়িতে ফিরে।
সঙ্গে কিছু কাঁচা তরকারিও কিনে নিয়ে আসে। একটু জিরিয়ে তারপর গোসল করতে যায়। গোসল সেরে তিন মা মেয়ে এক সঙ্গে গল্পগুজব করে। তাদের খুনসুটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সংসারে অভাব-অনটন আছে। যেমন আছে, যেই পরিস্থিতিতে আছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করে বিলকিস বানু।
______
সকালে যথাসময়ে কলেজে আসে বিভা। ক্লাস শুরু হতে আরো পাঁচ মিনিট বাকি। মোহনার সঙ্গে মাঠের একটি গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মোহনা বার বার ফোন দেখার কারণে বিরক্ত হয়ে বিভা ফোনটি কেঁড়ে নেয়। মোহনা ফোনটি নেওয়ার জন্য জোরাজোরি করছে। ফোন নিয়ে টানাটানির এক পর্যায় সামিম এসে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতি বোঝায়। থেমে গিয়ে দু’জনে দৃষ্টি ফেলে তার দিকে । সামিম বিভার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘পাঁচতলা ভবনে এগারো নাম্বার রুমে আবির তোমাকে ডেকেছে।’
কথাটি শুনে বিভার মুখ বেঁকে আসে। বলল,
‘তার যদি আমাকে দরকার হয়, তাকে গিয়ে বলুন পাঁচতলা ভবনের এগারো নাম্বার রুম থেকে যেন আমার কাছে আসে।’
‘মানে তুমি যাবে না?’
‘নাহ!’
‘ভেবে দেখো?’
‘ভাবছি, এখন আপনি আসতে পারেন।’
সামিম অপমান বোধ করে। ফিরে যায় সেখান থেকে।
সময় ফুরিয়ে যায়। ছুটির পর এক সঙ্গে দুই বান্ধবী হেঁটে হেঁটে প্রাইভেটের জন্য যাচ্ছিল। মেইন রাস্তা ছাড়িয়ে আসার পর রিকশা নিয়ে আফিনের বাড়িতে আসে। আজ হল রুমে আবিরকে দেখতে পায় তারা। বিভা, মোহনা ইনগোর করে।
মাথা ঠান্ডা রাখে আবির। সে নিজেও চায় বিভাকে ইগনোর করতে। কিন্তু বিভার আচার-আচরণ, চালচলন দেখে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না তাকে। বিষয়টি এমন হয়, যেন গরম তেলে কেউ ইচ্ছাকৃত পানির ছিটা দিচ্ছে। একে একে আরো স্টুডেন্টরা সেখানে উপস্থিত হয়। আফিনও রীতিমত চলে আসে। পড়ানো আরম্ভ করে সে। হঠাৎ আফিন বাহিরে বেরিয়ে আসে। আবিরকে হল রুমে ফোন টিপতে দেখে সে এগিয়ে এসে বলল,
‘আবির আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে। তুই ওদের বাকি পড়া গুলো পড়িয়ে দে।’
আবির কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
‘আচ্ছা দিচ্ছি, তুমি যাও।’

আফিন চলে যায়। আবির ঘাড় ডানে-বামে কাত করে উঠে দাঁড়ায়। সেই কক্ষে প্রবেশ করে টেবিলের ওপর উঠে বসে। সকলে ওঁকে দেখে একটু অবাক হয়। আবির চেয়ার টেনে পা রেখে বলল,
‘ভাইয়া একটা কাজে গিয়েছে। বাকি পড়ার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছে।’

কথাটা শুনে বিষয়টি সকলে স্বাভাবিক ভাবে নিল। কিন্তু বিভা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। চোখমুখ ঘুচে আসে তার। বিভা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তাহলে বাকিটা কালই পড়বো।’
‘বোসো চুপচাপ। কোনো কথা হবে না। আমি পড়াবো তোমরা মনোযোগ দিবে।’
বিভা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বসে যায়। আবির বইটি হাতে নিয়ে ঘেটেঘুটে বন্ধ করে পুনোরায় পাশে রেখে দেয়। একটু ঝুঁকে বলল,
‘একটা প্রশ্ন বলছি। উত্তর তোমরা দিবে। শোনো তাহলে। একটি ঘরে একটিমাত্র বিড়াল বসবাস করে। বিড়ালটি এক গ্লাস দুধ টেবিলের ওপর রেখে বাহিরে গিয়েছে আরো কিছু খাবার জোগাড় করতে। খাবার জোগাড় করে সে যখন ফিরে আসে, তখন টেবিলের উপর গ্লাস দেখতে পায়, তবে তার মধ্যে দুধ ছিল না। গ্লাসটি পুরো খালি ছিল। এখন প্রশ্ন হলো বিড়ালের দুধ কে চুরি করে খেয়েছে? ঘরে তো বিড়াল ব্যতীত আর কেউ থাকে না। বলো বিভা?’
সকলে বিভার দিকে তাকায়। মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায় বিভার। একে তো পড়া বাদ দিয়ে ফালতু প্রশ্ন করেছে। তার উপর ওর কাছে উত্তর চাইছে। বিভা দাঁড়িয়ে চটজলদি উত্তর দেয়,
‘আমি জানি না।’
‘আচ্ছা তুমি ইচ্ছে করে ঢেকুর তুলতে পারো নিশ্চয়?’
‘পারি। তো?’
‘একটা ঢেকুর তুলে দেখাও তো।’
‘কেন?’
‘তার মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে।’
‘কীভাবে?’
‘আগে দেখাও না।’
না চাইতেও বিভার ঢেকুর তুলে। আবির চেঁচিয়ে বলে উঠে,
‘এই যে বিড়ালেরর দুধ চোর। চুরি করে দুধ খেয়ে ঢেকুর তুলছে, দেখো সবাই বিড়ালনীকে।’

সকল স্টুডেন্ট বিভার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। মোহনা মুখে হাত রেখে হাসছে। বিভার মুখ হা হয়ে যায়। আবির যে বুদ্ধি খাঁটিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকেই চোর বানাবে সে ভাবে নি। আবির হেসে নিচের ঠোঁট হালকা কামড়ে বাঁ দিকের ভ্রু উঁচু করে বিভার দিকে তাকায়। মানে এটা ছোট প্রতিশোধ ছিল সেটি আঁকার ইঙ্গিতে বুঝায় তাকে। সকলের সামনে হাসির পাত্রী বানিয়ে দিল। বিভা রেগে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রয় আবিরের দিকে। নিজেও প্রতিশোধ নিবে ভেবে নেয়।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here