#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৫
#সুমাইয়া মনি।
আবির নিজের কক্ষে শুয়ে অন্যমনস্ক হয়ে টেনিস বল দিয়ে খেলছে। বার বার বলটি দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে ফিরে আসার পর ক্যাচ ধরছে। তার ভাবনার সাগর জুড়ে বিভার বসবাস। বিভার পুরো কথা শুনে নিরুত্তর থেকে যায় আবির। যাওয়ার দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। রাগ, জেদ্দ কাজ করেছে মনে। ক্যাম্পাসের সামনে তাকে এভাবে অপমানসূচক কথা বলায় ফলে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নতুনে বিভার সঙ্গে সেধে কথা বলেছে। ভেবেছিল ভালোবাসা নয়তো বন্ধুত্বের জালে ফেলবে ওঁকে। কিন্তু বিভা তার ভাবনার উর্ধ্বে ছিল। সহজ ভাবে ক্ষমা চেয়েছে। অথচ ভুল তার ছিলই না। সেই মুহূর্তটায় বিভার প্রতি চুম্বকের মতো আকর্ষন করেছিল তাকে। সাদামাটা ভাবে চলতে বিভা পছন্দ করে। তার এই স্বভাব সবার কাছে ঘৃণামিশ্রিত হলেও, তার কাছে ভালো লাগে। বল হাতে নিয়েই উঠে বসে আবির। এক মুহূর্তের জন্য নিজের উপরই অবাক হয়। বিভার কথা ভাবছে সে। অদ্ভুত বিষয়! আর ভাবতে পারে না। বল ফেলে রেখে বাহিরে বেরিয়ে যায়।
___
আজ বেতন দিয়েছে। তাই বাজার করতে এসেছে ববি। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ধীরেধীরে ঠান্ডা বাড়ছে। শুক্রবার বেতন দিলে হয়তো সুবিধা হতো। আবার ভাবে তাদের ঘরে তো ফ্রিজ নেই। তাই সল্প কিছু বাজার করে বাড়ির পথে হাঁটছে। মাঝ রাস্তায় হাঁটার সময় হঠাৎ আফিনের গাড়ির মুখোমুখি এসে যায় ববি। আফিন দ্রুত ব্রেক কষে।
ববি ভয়তে থমথমে খেয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়।
আফিন সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসে। রীতিমতো এই ঘটনা কিছু লোকের নজরে পড়েছে, তারা এগিয়ে আসে।
‘আপনার কোথাও লাগে নি তো।’ আফিনের গলা শুনে ববি চোখ খুলে। নিজের দিকে তাকিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,
‘ঠি..ঠিক আছি।’
‘আই’ম স্যরি।’ অপরাধসূচক কণ্ঠে বলল।
‘নাহ! ভুলটা আমার ছিল। আমিই রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলাম।’
তাদের দু’জনার কথপোকথন শুনে যারা এগিয়ে এসেছিল তারা ফিরে যায়। আফিন বলে,
‘গাড়িতে উঠুন আমি আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।’
‘দরকার হবে না। আমি চলে যাব।’
‘না গেলে মনে করব আপনি আমার ওপর রেগে আছেন।’
আফিনের পানে তাকায় ববি। এমন বিনয়ীকন্ঠে বলা কথাটি শুনে ববি কিছু বলতে পারে না। মন না চাইতেও উঠতে হবে ভাবে সে। বলে,
‘আচ্ছা চলুন।’
আফিন খুশি হয়ে দরজা খুলে দেয়। উঠে বসে ববি। গাড়ি স্টার্ট দেয়। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করে তাদের মাঝে। তারপর আফিন নিজে থেকেই ববির নাম জিজ্ঞেস করে। উত্তরে ববি নিজের নাম বলে আফিনের নামও জিজ্ঞেস করে।
‘আফিন আহমেদ।’
নামটা শুনে ববির চেনাচেনা লাগে। কৌতূহল মিটাতে জিজ্ঞেস করে,
‘বিভার প্রাইভেট চিটার আপনি?’
‘আপনি বিভাকে চিনেন নাকি?’ অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে আফিন।
‘বিভা আমার ছোট বোন।’
‘মানে আপনারা আপন দুই বোন?’
‘জি।’
‘কি ভাগ্য আমার।’ মৃদু হেসে বলে।
‘খারাপ ভাগ্য তাই তো।’
‘নাহ! তেমন কিছু না। আসলে আমি বলতে চাইছি আমার নাম না বললে হয়তো আমাকে চিনতে পারতেন না।’
‘সেটা ঠিক।’
‘আপনি কি কাজ করেন?’
‘হ্যাঁ!’
‘কোথায়?’
‘গার্মেন্টে।’
‘ওহ! সেখান থেকে বাজার করে ফিরছেন বুঝি?’
‘হুম, আপনি কি আমাকে খারাপ মনে করছেন?’
‘কেন বলুন তো?’
‘আসলে গার্মেন্টে চাকরি করা ছেলে-মেয়েরা নাকি ভালো না।’
‘নিজের বুকে হাত রেখে জিজ্ঞেস করুন আপনি খারাপ নাকি ভালো।’
ববি সরল চোখে তাকায় আফিনের দিকে। আফিন ড্রাইভ করা অবস্থা আবার বলে,
‘কি জিজ্ঞেস করেছেন?’
‘নাহ!’
‘আচ্ছা, নিজে তো জানেন কতটুকু ভালে বা খারাপ সত্তা লুকিয়ে আছের আপনার মাঝে। কী জানেন না?’
‘জানি।’
‘ব্যস! ভরসা রাখতে শিখুন। মানুষের মধ্যে ভালো, খারাপ গুন মিশ্রিত। তবে অনেকের ধারণা গার্মেন্টের মেয়েরা নাকি খারাপ। তাতের চরিত্র ভালো না। যারা এই বিষয়টি ভাবে তারা কতটুকু ভালো একবারও বলতে পারবে বা প্রমাণ দিতে পারবে? পারবে না। অহেতুক কেন একটি মানুষকে খারাপ বলে গন্য করব। অথচ আদৌও সে খারাপ কি-না আমরা তা জানি না।’
আফিনের প্রতিটা কথার লাইন ববির হৃদয়ে স্পর্শ করে। খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা দিয়েছে সে। বেশিদূর পড়াশোনা না করার দরুন গার্মেন্টে চাকরি করতে হচ্ছে তাকে। অনেকের মুখেই কটু বাক্য শুনতে হয়েছে, শুধু মাত্র গার্মেন্টে চাকরি করে বলে। কিন্তু আজ আফিনের মুখে গার্মেন্টের মেয়েদের প্রতি সম্মান দেখে ভরসা পায়, আশ্বাস পেয়েছে কথায়।
‘কোনো কাজ ছোট নয়। যাদের মন ছোট, তারা সব কিছুকেই ছোট ও কটু দৃষ্টিতে দেখে। অন্যকে বলার আগে নিজের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলান উচিত। তাহলেই সব কিছু সহজ মনে হবে।’ আফিন কথা গুলো বলে ববির দিকে এক নজর তাকায়।
ববির দৃষ্টি নিচু। এভাবে নিরুত্তর দেখে আফিন জিজ্ঞেস করে,
‘একটু বেশি বলে ফেললাম কি। আসলে আমি কথা একটু বেশিই বলি।’
ববি আফিনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। আফিনও হাসে। তার সঙ্গে পরিচয় না হলে বুঝতেই পারতো না আফিন এতটা সভ্য, মার্জিত লোক।
__________
পরেরদিন কলেজে গিয়ে আবিরকে এভয়েড করা শুরু করে বিভা। আবিরের প্রতি তার কোনো দূর্বলতা নেই। তবে সে চায় না আবিরের মুখোমুখি হতে। তাদের মধ্যকার রেশারেশিকে কালই ভেঙে দিয়েছে। অনেক আশা নিয়ে কলেজে পড়তে পাঠয়েছে আপু। আবেগ, জেদের বশে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই আশা ভঙ্গ করতে চায় না। আজ মোহনা কলেজে আসে নি। হয়তো ব্রেকআপ হবার শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফোনে যোগাযোগ করবে তারও উপায় নেই। টিফিন ক্লাস রুমে বসেই খেয়ে নেয়। ছুটির পর প্রাইভেটে আসে। এসেই বিপত্তি কর পরিস্থিতি তৈরি হয়। আজও নাকি আফিন পড়াতে পারবে না। আপাতত পড়ার দায়িত্ব আবিরকে দেওয়া হয়েছে। শুনে দাঁত কিড়মিড় করে বসে থাকে বিভা। না কিছু বলতে পারছে, না সইতে। আবির রুমে প্রবেশ করেই বিভার দিকে নজর ফেলে মৃদু হাসে। বিভা ভেবেছিল সেও আবিরের ওপর প্রতিশোধ নিবে। পরপরই সেটা চাপা দিয়ে দেয়। পড়াশোনায় ফোকাস করা উচিত ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এসব চিন্তাভাবনা।
আবির অসভ্যতার সাথে চেয়ারে বসে পা উঠিয়ে। দেখেই বিভার মেজাজ চওড়া হয়ে যায়। এ ছেলে বড়ো হয়েছে ঠিকিই, কিন্তু তার মধ্যে আদবকায়দার তুমুল অভাব। অঙ্ক বই হাতে নেয়। মনে হচ্ছে আজ অঙ্ক করাবে। সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। মুখে মৃদু হাসি রেখে টেনে বিভার নাম ধরে ডাকে।
‘বিভাআআআ।’
বিভা কান্না ফেইস বানিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘বলুন।’
‘বোর্ডে অঙ্কটা একটু লিখে দিয়ে যাও।’
‘এটা তো স্যারদের কাজ। আপনি কেন লিখেছেন না?’
‘হাতে জং ধরেছে তাই। আসো!’ কিছুটা ধমকের গলায় বলে।
ধমক শুনে বিভাকে যেতে হয়৷ কালো সাইনপেন নিয়ে হোয়াইট বোর্ডে অঙ্কটা তুলতে শুরু করে। আর বিড়বিড় করে যত প্রকার গালাগালি আছে আবিরকে দিতে থাকে। বিভার রাগী আদল দেখে আবির মজা পায়। লেখা শেষ করে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘লিখেছি।’
‘এবার বুঝাও। কীভাবে কি লিখেছো।’
মুখ ঘুচে আসে বিভার। বলে,
‘আপনি কি করবেন?’
‘আমি দেখবো ঠিক মতো বুঝিয়েছো কি-না।’
বিড়বিড় করে আওড়ায় ‘ঠেঙ্গা।’
বিভা বুঝাতে আরম্ভ করে। সবাই বিভার অঙ্কটি খাতায় লিখছে। আবির বিভাকে দেখতে ব্যস্ত। মন না চাইতেও নজর সরিয়ে নিতে পারছে না। আটকে গেছে কোন মায়া মুগ্ধতার মাঝে জানা নেই তার। তাকিয়ে থাকার এক পর্যায়ে কখন যে বিভা ওর সামনে এসে ওঁকে ডাকছে টেরও পাচ্ছে না।
‘শুনছেন? শুনছেন…’ লাস্টের ডাকটি এক প্রকার চিল্লিয়ে দেয় বিভা৷ আবির হকচকিয়ে উঠে। সকলে হেসে দেয়। আবির বিব্রত বোধ করে। বিভা নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আনতে আবির বলে,
‘শেষ বুঝানো?’
‘হ্যাঁ!’
আবির বিভাকে সিটে গিয়ে বসতে বলে। বিভা চলে যায়।
আবির বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘আজকের মতো ছুটি। আমার ভালো লাগছে না, আর পড়াতে পারব না।’
সকলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বিভা মনে মনে স্বস্তি পায় তাড়াতাড়ি ছুটি দেওয়ার জন্য। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে আবির বিভাকে ডেকে থামিয়ে দেয়,
‘বিভা শোনো।’
বিভা চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। পিছনে ঘুরে বলে,
‘আবার কি?’
‘কথা ছিল।’
‘এক মিনিট। আমি একটু আসছি।’ বলে স্বাভাবিক ভাবে বেরিয়ে যায় বিভা। আবির টেবিলের উপর হাতে ভর রেখে দাঁড়ায়। হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারছে না। তবুও অপেক্ষা করতে প্রস্তুত সে। বিভা রুম থেকে বেরিয়ে দুই তিন কদম এগিয়ে গিয়ে বো দৌঁড় দেয়। বাকি রা বিভার এভাবে দৌঁড়ানোর কারণ বুঝতে পারে না। বিভা এক দৌঁড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে শালীনতা বজায় রেখে হাঁটতে আরম্ভ করে। মূলত সে চাইছে না আবিরের কথা শুনতে। তাই এভাবে পালিয়ে এসেছে। এদিকে আবির বসে থাকে। এখনো বিভাকে না আসতে দেখে বিরক্ত হয়। রুম থেকে বের হয়ে হল রুমে খুঁজে। দেখতে পায় না বিভাকে। বাহিরে বের হয়ে সেখানেও দেখে না৷ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হেসে ফেলে। বিভা যে ওঁকে বোকা বানিয়ে পালিয়েছে সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না তার। চোখের উপর আঙুল রেখে হাসতে থাকে।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।