#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৬
#সুমাইয়া মনি।
ইগনোর কত প্রকার। ও কী কী? সেটা আবির এই তিনদিনে ঠিক বুঝতে পেরেছে। বিভা ওঁকে ইগনোর করছে। শুধু ইগনোর নয় কঁড়া ভাবে ইগনোর করছে। কথা বলতে আসলেই উল্টোদিকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। যেটা দেখে আবির প্রচণ্ড ক্ষেপেছে। বিভার এতটা ইগনোর করার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আগের মতো ক্যান্টিনেও আসে না। লাইব্রেরীতে যায় না। মাঠেও বসতে দেখা যায় না। হঠাৎ এমন পরিবর্তন ভাবিয়ে তুলছে আবিরকে। আবির জামিলা, মারুফ, সামিম দের সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টিনে বসে রয়েছে।
‘এমন চুপ করে আছিস কেন আবির? তুই কি সত্যি বিভার প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?’ জামিলা প্রশ্ন করে।
‘জানি না। আপাতত বিভাকে সামনে চাই। ওর এমন ইগনোর আমি মেনে নিতে পরছি না। ভীষণ পীড়া দিচ্ছে।’ রেগেমেগে বলে উঠল আবির।
‘কাম সারছে। আবির বিভাকে ভালোবাসে কনফার্ম।’
আবির সামিমের কথায় পাত্তা না দিয়ে জামিলাকে রিকুয়েস্ট করে বলল,
‘জামিলা বোইন আমার, তুই একটু বিভার সঙ্গে দেখা করিয়ে দে আমায়।’
‘আরে বাপরে! কত ভালো ব্যবহার। কেন রে তুই তো ক্লাসরুমে গিয়েও কথা বলতে পারিস ওর সঙ্গে।’
‘নাহ! সেখানে আরো স্টুডেন্ট রয়েছে। তাদের সামনে ও যদি আমার সঙ্গে কথা না বলে ইগনোর করে তখন প্রচণ্ড রাগ হবে। যদি সিনক্রিয়েট করে বসি, বুঝতে পারছিস আমার কথা।’
‘বুঝালাম। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। ঐটুকু একটা আনস্মার্ট মেয়ের জন্য তুই এত পাগলামি করছিস। হাউ ফানি ফানি..’ জামিলা ভাব নিয়ে বলল।
‘হ্যাঁ! জামিলা ঠিক বলেছে। সেখানে কলেজের অনেক মেয়েই তোর উপর ক্রাস। বাহিরেও আছে। আর তুই সেখানে বিভার জন্য… ‘ বলে সামিম থামে। বাকি কথা মারুফ বলে,
‘আমার তো লজ্জা হয় তোর জন্য আবির।’
বন্ধুদের এরূপ লাগামহীন কথা কর্ণপাত হতেই আবির ভীষণ রেগে যায়। টেবিলের উপর মুঠোবন্দী হাত দিয়ে সজোরে ভারি মেরে ‘সেট-আপ’ বলার ফলে ভয়তে কেঁপে উঠলো ওরা সহ আরো কিছু স্টুডেন্ট। চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেছে আবিরের। কিছু স্টুডেন্ট ক্যান্টিন থেকে প্রস্থান করেছে এই ভয়ে রেগে আবির চেয়ার না উড়িয়ে মারে তাদের গায়ে।
‘তুই বিভার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবি কি-না?’ ধমক দিয়ে বলে আবির।
জামিলা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
‘চেষ্টা করব।’
‘চেষ্টা নয় দেখা করিয়ে দিতে হবে ব্যস!’
‘এর আগের বারও তো আমি ওঁকে ডাকতে গিয়েছিলাম
বিভা কি এসেছিল? আসেনি।’
আবির সামিমের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকায়। সামিম কিছুটা ধমে যায়। কেউ আর কোনো কথা বলে না। আবির আবার বলে,
‘ছুটির পর ওঁকে লাইব্রেরীতে নিয়ে আসবি। না করলে কথা শুনবি না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসবি। আর সামিম, মারুফ লাইব্রেরীতে গিয়ে বাকি স্টুডেন্টদের বের করে দিবি। বলবি আজ লাইব্রেরী বন্ধ, যাহ!’
‘আচ্ছা।’
ছুটির পর জামিলা বিভাকে কথা শোনার বাহানায় লাইব্রেরীতে নিয়ে আসে। আগে থেকেই আবির সেখানে উপস্থিত ছিল। ওঁকে দেখেই জামিলার লাইব্রেরী আনার কারণ বুঝে যায়। বেরিয়ে যেতে নিলে আবির খপ করে বিভার হাত ধরে ফেলে। জামিলাকে ইশারায় মোহনাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে বলে। জামিলা মোহনাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
বিভা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আবির কন্ঠে ক্রোধ নিয়ে বলল,
‘বেশি জবরদস্তি কোরো না, হাতে ব্যথা পাবে।’
‘আমার হাত ছাড়ুন, কি অসভ্যতামী শুরু করেছেন।’
‘আমায় ইগনোর কেন করছো?’
‘ইগনোর করার মতো সম্পর্ক আপনার আমার মধ্যে নেই।’
‘নেই, তবুও তুমি আগে এমন ছিলে না।’
‘ভুল ধারণা। আমি আগেও এমন ছিলাম।’
‘এমন কেন করছো আমার সঙ্গে?’
‘আমি আপনাকে আগেই সব বলে দিয়েছি। আপনার আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরী হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে কলেজে পড়তে এসেছি, শান্তিপূর্ণভাবেই পড়তে চাই।’
‘বিভা আমি তোমাকে পছন্দ করি। তোমাকে ভালো…’
‘থামুন! প্রেম, ভালোবাসা আমাদের মতো গরীবদের জন্য নয়। আর আমি কখনোই রিলেশনে জড়াব না। কথাটা মনে রাখবেন।’
‘বিভা…’ বাকিটা বলার আগেই হাত ছাড়িয়ে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আবির ফের বিভার হাত ধরতে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিভার ওড়না আবিরের হাতে লেগে কাঁধ থেকে সরে যায়। আবির সেটা খেয়াল করে দ্রুত ওড়না ছেড়ে দিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। প্রচণ্ড রেগে যায় বিভা। কাঁধে ওড়না উঠিয়ে পিছনে ফিরে সজোরে আবিরের গালে চড় মারে।
আবির ঘাড় ডান দিকে কাত করে রাখে। বিভার দিকে নজর ফেরানোর স্পর্ধা তার নেই। সে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ভুলের শিকার হয়েছে। সেটা বিভাকে কীভাবে বোঝাবে। কণ্ঠ খাদে ফেলে বলল,
‘স্যরি, বিভা। আমি ইচ্ছে করে…’
বিভা অবশিষ্ট কথা বলতে না দিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠে,
‘চুপ করুন! সাফাই গাওয়ার দরকার নেই। আপনার মতো বড়োলোক ঘরের ছেলেরা ভালোবাসা তো দূর, প্রেমিকাকে সম্মানটুকু করার ক্ষমতা রাখে না।’
আবির বিভার কথা শুনে ডাম হাত মুঠোবন্দী করে নেয়।
বিভা হাত জোর করে বলে,
‘দয়া করে, আজকের পর থেকে আমার থেকে দূরে থাকবেন আপনি। যতোটা দূরে থাকলে আমি ভালো থাকবো। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন। থাকতে দিন প্লিজ!’ কথাটা বলে বিভা দ্রুত লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে যায়।
আবির ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে চোখ জোড়া হালকা বন্ধ করে নেয়। বিভাকে তার অনুভূতি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। বোঝাতে পারল না তার প্রতি এমন এক অনুভূতি কাজ করে, যেটা তাকে ক্ষণে ক্ষণে তার প্রতি কাবু করে দিচ্ছে। হৃদয়ে এক শূন্য অনুভব হচ্ছে। দরজার দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাইব্রেরী ত্যাগ করে সে।
__________
ববি মেশিন চালানোর এক পর্যায়ে হঠাৎ আফিনের কথা মনে উঠে। স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে রয়। তার জীবনে এমন ভাবে উপস্থিত হওয়া পুরুষ ছিল আফিন। যার আচরণে মুগ্ধ হয়েছে ববি। মৃদু হাসি ফুটে ঠোঁটে। আগের ন্যার কাজ শুরু করে। দূর থেকে আকবর আলি ববিকে দেখে জ্বলছে। ক্ষোভ হচ্ছে মনে। এ যাবৎ সে তিনটি বিয়ে করেছে। বিনাকারণে বিয়ের এক বছরের মাথায় তিন বউকে ডিভোর্স দিয়েছে। আপাতত সে সিঙ্গেল। এই জন্য ববিকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। ববি রিজেক্ট করার দরুন সে কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। অপমানের জ্বালা মিটাবেই সে, এই ভেবে চলে যায়। ববির পাশের মেয়েটি বাথরুমে গিয়েছিল। মেয়েটি ফিয়ে আসার পর ববির উদ্দেশ্যে বলল,
‘ববি আফা জানেন, পাশের সিপ্টে আরেকটা মাইয়া সাথীর মতো মাথা ঘুরাইয়া পইড়া গেছে। হেই মাইয়ার নাকি ইপান্টিস(এপান্টিস) নামের একটা রোগ হইছে। তারেও নাকি অপারেশন করাইতে হইবো। এর খরচও নাকি কোম্পানির মালিক বহন করব।’
ববি মেয়েটির কথা শুনে চুপ রয় কিছু সময়৷ পরমুহূর্তে বলে,
‘মেয়েটি এখন কোথায়?’
‘মেডিকেলে নিয়া গেছে।’
‘আচ্ছা।’
‘যাইবেন নি ওরে দেখবার?’
‘হুম, ছুটির পর যাব।’
‘আপনের লগে আমিও যামু নে।’
ববি কিছু বলে না। কাজ করতে আরম্ভ করে। তবে তার মধ্যে কিঞ্চিৎ ভাবনা এসে জড়ো হয়।
___
বিভা বাড়িতে এসে আবিরকে চড় দেওয়ার মুহূর্তের কথা ভেবে রাগ হয় তার। ঠিক কারণেই সে চড় দিয়েছে বলে মনে করে। ওড়না ধরে টানাটানি কিছুতেই মেনে নিবে না সে। অসভ্যতামীর লিমিট ক্রস করেছে। পছন্দ করলেই কি হাত, ওড়না ধরে টান দিনে? এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। বই পড়া বন্ধ করে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে ববি বিভাকে প্রশ্ন করে বসে,
‘পড়া রেখে এমন কি ভাবছিস বিভা?’
বিভার ভাবনা ফেলে পড়তে পড়তে বলে,
‘কিছু না।’
‘ওহ! তোকে একটা কথা বলা হয়নি।’
বইয়ের থেকে মুখ সরিয়ে বোনের দিকে তাকায়। বলে,
‘কি কথা আপু?’
‘তোর প্রাইভেট টিচার আফিনের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল।’
‘দেখা হয়েছিল বলতে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বিভা।
ববি দেখা হবার বিষয়টি বলে বিভাকে। কথা শেষ করে বলল,
‘খুব বিনয়ী লোক সে।’
‘প্রচুর ভালো স্যার। একদম সরল-সুন্দরের অধিকারী।’
‘সেটা বুঝতে পেরেছি। জানিস যখন গাড়ি থেকে নামলাম, এলাকার লোকজন আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন আমরা কোনো ক্রাইম করেছি।’
‘ছাড়ো তো। কিছু মানুষের কাজই তো কটু দৃষ্টি ফেলানো।’
‘বিষয়টি বিব্রতকর ছিল রে বিভা।’
‘আরে ভুলে যাও। তুমি একটা কথা জানো আপু? আমার সঙ্গে একটি ছেলের কলেজের প্রথম দিন দেখা হয়েছিল পাঁচশো টাকা নিয়ে, সেই ছেলেটি আফিন স্যারের ছোট ভাই আবির।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ! আপু। আইরিন ম্যামের দু ছেলে আফিন, আবির।’
‘বলিস কি!’কিছুটা অবাক হয়ে।
‘ঠিক বলছি। আইরিন ম্যাম, আফিন স্যার কত ভালো তারা। আর এই আবির একটা আনলিমিটেড ফাজিল পোলা।’ রেগে বলল বিভা৷
‘কেন, কি করেছে?’
‘সে আ…’ বলে বিভা থেমে যায়। সে চায় না আপুকে সব সত্যি বলতে। এড়িয়ে যায়। পুনোরায় বলে,
‘কিছু করে নি। তাকে দেখে বুঝা যায়।’
‘বিভা একটা মানুষকে চিনতে হলে তার সঙ্গে সময় বা বাক্যবিনিময় করতে হবে। মিশতে হবে। ওপর থেকে মানুষকে যাচাই করা বোকামি।’
‘গাঁধি মেয়ে সেটা বুঝবে নাকি।’ বিলকিস বানু কথাটি তেজি কণ্ঠে ছুঁড়ে দিল। এতক্ষণ চুপ থেকে দু মেয়ের কথপোকথন শুনছিল।
‘না আমি তো বুঝি না কিছু। বাচ্চা তো আমি।’ মেকি রাগ নিয়ে বলে বিভা।
‘বাচ্চাই। কাছে আয় ফিটার খাইয়ে দেই।’
মায়ের এরূপ কথায় ববি হাসে। বিভাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘এমন কোরো না মা। শত হলেও আমার ছোট আদরের বোন বলে কথা।’
‘তোমার মা’কে একটু বুঝাও আপু। আমি এখনো ছোট নই।’
‘বলব তো।’ হেসে বলে।
দু মা মেয়ের খুনসুটি চলছে। ববি মজা পাচ্ছে তাদের ঝগড়ায়।
.
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।