বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-৭

0
1219

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৭
#সুমাইয়া মনি

বিরতিহীন ফোন বেজে চলেছে আবিরের। ফোন ধরার কোনো ইচ্ছে নেই তার। সামিম কল দিয়েছে। আবির চোখ বন্ধ করে কাঁপালে হাত রেখে শুয়ে রয়েছে। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে রাগী কন্ঠে বলল,
‘কল দিচ্ছিস কেন? দেখছিস না আমি ধরছি না। তবুও কল দিয়ে যাচ্ছিস। ফোন দিবি না আর।’ বলেই ফোন কেঁটে দিয়ে পাশে রেখে দেয়। আবার সেই আগের ন্যায় শুইয়ে থাকে।
আফিন প্রবেশ করে। রুমে যাওয়ার সময় বাহির থেকে আবিরের তেজি কণ্ঠ শুনতে পায়। তিনদিন ধরে আফিন লক্ষ্য করছে আবির কেমন গোমড়া হয়ে থাকে। ঠিক মতো কথা বলে না। খাওয়া দাওয়ায় মন নেই। পড়তেও বসছে না। আগে প্রায় সময় কলেজের অফিস কক্ষে, তার সঙ্গে বসে গল্প করতো। এখন কলেজেও দেখা যায় না। সারাদিন রুমেই থাকে। নিজেকে কেমন আড়াল করে রাখছে সবার থেকে। আফিন আবিরের পাশে এসে বসে। আবির চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে ভাইকে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে কৃত্রিম হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু বলবে ভাইয়া?’
‘বলবি তো তুই। কি হয়েছে তোর সেই বিষয়ে।’
‘কই? কিছু হয়নি তো ভাইয়া। আমি ঠিক আছি।’
‘মিথ্যা বলার চেষ্টা করিস না।’
‘সত্যি বলছি ভাইয়া।’
‘বৃথাতর্ক করিস না আবির। সত্যি বল কি হয়েছে। যদি কোনো সাহায্য করতে পারি আমি তোর।’
আবিরের ঠোঁটের হাসি মিলে যায়। দৃষ্টি নত রেখে নির্বাক কণ্ঠে বলল,
‘আমি বিভাকে ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া।’
‘ভালো খবর। বিভা কি জানে?’
আবির বিভার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ছোট্ট ঘটনাটি উল্লেখ করে। আফিন মৌন রয়ে বলে উঠে,
‘ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। বিভা তোকে ভালোবাসে না সেটা বলেছে?’
‘নাহ! তবে ও আমাকে পছন্দ করে না, এটা শিওর।’
‘হুমম, বিভার বড়ো বোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ক’দিন আগে।’
‘কীভাবে?’
‘অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ভুলবশত সে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল।’
‘বিভার মতোই কি তার বড়ো বোন?’
‘নাহ! একদম আলাদা। একটা কাজ কর তুই। বিভার পিছনে আঠার মতো লেগে থাক। ভালোবাসায় থাপ্পড়, বকাঝকা এগুলো কমন বিষয়।’
‘দূরে থাকতে বলেছে ভাইয়া।’ মুখ মলিন করে বলল আবির।
‘হ্যাঁ! তুই দূরে থাকবি। দূরে থেকে কি ভালোবাসা যায় না, অবশ্যই যায়। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। ফিল্ম, ড্রামা তো কম দেখিস নি। রোমান্টিক সিনেমা দেখ আইডিয়া পেয়ে যাবি।’
‘আচ্ছা।’
‘আমি গেলাম। জল কতদূর গড়ালো আমাকে বলিস কিন্তু। আর হ্যাঁ! আমি তোর পক্ষে আছি।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ মৃদু হেসে বলল আবির।
আফিন হেসে আবিরের গালে আলতো হাত রেখে চলে যায়।
আবির অনেকটা ভরসা পায়। বুকে সাহস সঞ্চয় হয়। ল্যাপটপ নিয়ে বসে রোমান্টিক মুভি বা ড্রামা দেখার জন্য। যদি কোনো আইডিয়া পেয়ে যায়।
___
গাছের নিচে বসে আলাপনে ব্যস্ত দুই বান্ধবী। কথার টপিক আবিরকে নিয়ে। তিনদিন ধরে আবিরকে বিভা দেখতে পাচ্ছে না। এবং-কি বাড়িতে পড়তে যাওয়ার সময়ও নজরে পড়েনি। এই জন্য বিভা স্বস্তি পাচ্ছে। এতে তার কোনো মাথাব্যথাও নেই।
‘এক রাউন্ডে ছক্কা মেরে দিয়েছি মোহনা। এই তিনদিনে আবির বদটাকে একবারও দেখিনি।’ হেসে বলল বিভা।
‘দেখ, পিছু ছাড়লে তো ভালোই হয়।’ অন্যমনস্ক হয়ে বলল।
‘ছাড়তেই হবে। কত বড়ো বেহায়া পোলা ওড়না ধরে টানাটানি করে।’
‘আবিরের কোনো খারাপ রেকর্ড কলেজে নেই। তোর ওড়না ধরে টান দিয়েছে, মেনে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।’
‘তাহলে কি আমি মিথ্যে কথা বলছি।’ মেকি রাগ নিয়ে বলল বিভা।
‘একদমই না। কিন্তু এই ঘটনায় কতটা সত্যতা আছে, সেটা বুঝতে পারছি না।’ দু কাঁধ উঁচু করে বলে মোহনা।
‘বোঝা লাগবে না তোর। দেখে নিস আবির পাঠায় আমার সামনেও আসবে না।’ কনফিডেন্স নিয়ে বলল বিভা।
‘দেখি।’
‘এক্সকিউজ মি বিভা আপু।’ মেয়েলী কণ্ঠের স্বর শুনে দু’জনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটি মেয়ে এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
বিভা জবাব দিল,
‘হ্যাঁ! বলুন।’
‘এই গোলাপ ফুলগুলো আবির ভাইয়া আপনার জন্য পাঠিয়েছে।’ কথাটা বলে ফুল এগিয়ে দিল বিভার দিকে।
বিভা হতবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
মোহনা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। এই মাত্র বলা কথা বিভার বিফলে গেল। বিভা এটা দেখে রাগ নিয়ে বলল,
‘তোমার আবির ভাইয়া কোথায় বলতে পারো?’
‘ঐতো..’ বলেই তিনতলা ভবনের দিকে ইশা করল মেয়েটি।
বিভা, মোহনা সেদিকে তাকায়। আবির বিভার চাহনি দেখে হাত নাড়িয়ে ‘হাই’ জানায়। বিভা রেগে যায়। ছোঁ মেরে ফুল গুলো নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায় ভবনের দিকে। মোহনা ডেকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করে একবার। রেগে থপথপ পা ফেলে বিভা তিনতলা ভবনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে। আবির বিভাকে আসতে দেখে পকেটে হাত পুরে ভারী মুড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে ছিল কালো রঙের সানগ্লাস। বিভা এগিয়ে এসে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
‘এটা কী?’ বলেই ফুলগুলো আবিরের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল। আবিরের তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ঠোঁটে মৃদু হাসি রেখে বিভার পানে চেয়ে আছে। সে আবার বলল,
‘বলেছিলাম না আমার থেকে দূরে থাকবেন।’
‘দূরেই তো ছিলাম। কাছে তুমি এসেছো।’ একটু বিভার দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বলে।
বিভা থমথমে খেয়ে যায় আবিরের কথায়। তবুও হার মানে না। বলল,
‘দূরে থাকা মানে, এখান থেকে ঐখানে না। আমার চোখের সামনে থেকে দূরে তাকতে বলেছি।’
‘এটা তো বলো নি মাই ভাবী বেবি।’
‘বিভা আমার নাম, কোনো ভাবী-টাবী না।’
‘তার মানে তুমি চাও আমি তোমাকে বিভা বেবি বলে ডাকি।’
‘চুপ করুন।’ ধমক দিয়ে বলল বিভা।
আবির ঠোঁটে আঙুল রেখে ‘চুপ’ উচ্চারণ করল। যেটা দেখে বিভা দ্বিগুণ ক্ষেপে যায়। তেজি কণ্ঠে বলল,
‘দেখুন,আমি…’
বাকিটা বলার আগে আবির মুখ দিয়ে দু বার গোঙ্গানির শব্দ বের করল। আবিরের এমন ব্যবহার দেখে ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ ফেলে বলে,
‘কি হলো? মুখে ঠাডা পড়েছে।’
‘তুমিই তো চুপ থাকতে বললে। বাই দ্যা এই সেই, তোমাকে দেখতে হলে কি সানগ্লাস খুলতে হবে?’
‘দেখতে হলে মানে….’ কথাটা বলেই বুঝে যায় বিভা কেন বলেছে আবির, রেগে নাকের পাটা ফুলিয়ে চোখের ওপর হাত রাখে। যেটা দেখে আবির মুচকি মুচকি হাসে। রাগে গা জ্বলছে তার। বলে,
‘আমি আপনাকে সাফসাফা বলে দিচ্ছি। আমার থেকে আপনি একদম দূরে থাকবেন। চোখের সামনেও যেন না দেখি।’
‘এখন থেকে পিছনে থাকবো। মাথার পিছনে তো আর চোখ নেই।’
‘আপনি একটা অসহ্যকর লোক।’
‘মাত্র? আচ্ছা এই সানগ্লাসটা দেখো, প্রথম দিন যেটা ভেঙে ছিলে সেইম।’ সানগ্লাস খুলে বিভার সামনে ধরে বলল।
বিভা হাত থেকে নিয়ে তিনতলা থেকে ফেলে দিলো। আবির তাতেও কোনো রেসপন্স করে না। বিনিময় হাসে। যেন সে বিভার এমন কর্মকাণ্ডের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বিভা আরো ক্ষেপে যায়। দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করে। বিভার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবির হাসে।
সামিম, জামিলা, মারুফ ক্লাসরুমে বসে এসব দেখছিল। তারা অবাক না হয়ে পারছে না৷ যেখানে আবির মেয়েদের পাত্তা দেয় না। সেখানে কি-না তাকেই বিভা পাত্তা দিচ্ছে না। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ পাগলে পরিনত হয় বলে শুনেছে। আবির তাঁর চাক্ষুষ সাক্ষী।

প্রাইভেটে আসার পর বিভার মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। যার মূল কারণ আবির। আজ আফিনকে সরিয়ে সে নিজে থেকেই তাদের পড়াতে এসেছে। অবশ্য সবাইকে আফিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের বাহানাও দিয়েছে। সকলের এতে আপত্তি না থাকলেও, বিভার ঘোর আপত্তি আছে। সে জানে ওর জন্যই আবির ইচ্ছে করে করেছে এটি। সবাইকে বললে হয়তো কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে না। প্রথমে কয়েকটা অঙ্ক বোর্ডে করিয়ে বুঝিয়ে দেয়। তারপরই নিজের ফইরামগিরি দেখাতে আরম্ভ করে।
‘একটি গাছের ডালে তিনটি দোয়েল পাখি ছিল। পাখি তিনটি উড়ে, বাকি কয়টা থাকে? বিভা তুমি বলো।’ বিভার উদ্দেশ্যে বলল আবির।

এমনে তো ক্লাস ওয়ান, টুয়ের অঙ্কের প্রশ্ন করছে। তার ওপর তাকেই জিজ্ঞেস করল। বাকি সবাই থাকতে তাকেই শুধু নজরে পড়ে। সবই কঁপাল ভেবে বিভা উঠে দাঁড়ায়। বিরক্ত নিয়ে বলে,
‘একটিও থাকবে না পাখি।’
‘কেন?’
‘কারণ তিনটি পাখি উড়ে গেছে।’
‘আচ্ছা আমি কি বলেছি পাখি তিনটি উড়ে গেছে? আমি শুধু বলেছি পাখি তিনটি উড়ে।’ আবির দু হাত দু দিকে দিয়ে উড়ন্ত অভিনয় করে দেখিয়ে বলল।
সকলে উচ্চস্বরে হেসে ফেলে। বিভা রাগে ফুঁসছে । বিড়বিড় করে আওড়ায় ‘কল্লা বলেছে।’
‘এগুলো হচ্ছে সাধারণ জ্ঞান। যেগুলো মাথায় গোবর আলা মেয়েরা বুঝে না।’
মাথায় গোবর বলাতে তেলেবেগুনে ক্ষেপে যায় বিভা। এ নিয়ে দু’বার ওঁকে বোকা বানাল। সবার সামনে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হলো আবার।
_____
‘আফা আমি কঁপাল জোরে বাঁইচা গেছি। যদি না কোম্পানির মালিকে আমারে সাহায্য করতো, তয় আমার মরা লাগতো। খুব ভালো এই কোম্পানির মালিক।’ কান্না জড়িত কন্ঠে মেয়েটি ববিকে বলল। অপারেশন হবার পর ববি মেয়েটিকে আজ দেখতে এসেছে। সঙ্গে আরো দু’জন মেয়েও ছিল।
ববি মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘হুম, আপাতত নিজের দিকে খেয়াল রেখো। আল্লাহর রহমতে সাথীর মতো দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।’
‘দোয়া কইরেন আমার জন্য আফা।’
‘আচ্ছা। আমি এখন গেলাম।’
‘আইচ্ছা, আবার আইয়েন আফা।’
‘আসব।’
ববি বেরিয়ে আসে। ওর সঙ্গে মেয়ে দু’জনও বের হয়। তিনজনে এক সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here