বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-৮

0
1160

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৮
#সুমাইয়া মনি

কলেজে আসার পরপরই বিভা লক্ষ্য করে সকল স্টুডেন্ট কেমন বাঁকা নজরে তাকাচ্ছে। বিভা এটা দেখেও না দেখান ভান ধরে ক্লাসরুমে আসে। ক্লাসরুমে এসেও সবাই ওঁকে দেখে কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলাবলি করছে। বিভা বিরক্ত হয়ে যায়। হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতি সে মেনে নিতে পারছে না। কিছুক্ষণ বাদে মোহনা আসে। বিভা কিছুটা হলেও স্বস্তি পায় ওঁকে দেখে। মোহনা পাশে এসে বসে। বিভা নির্মল কণ্ঠে বলে,
‘সবাই আমাকে দেখে এমন রিয়েক্ট করছে কেন? আমি কি কোনো খুন করেছি নাকি।’
‘তোর আপু গার্মেন্টসে চাকরি করে ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে। তাই কানাঘুষা করছে।’
‘এখানে খারাপের কি হলো?’
‘তুই আমি সেটা খারাপ না বুঝলেও ল, অন্যরা তো সেটা খারাপ বুঝছে, ভাবছে। এই কলেজ বেশ নাম করা। এখানে বড়োলোক ঘরের ছেলেমেয়েই বেশি পড়তে আসে। তোর পয়েন্ট ভালো ছিল তাই এডমিশন নিতে সমস্যা হইনি। এ ছাড়া গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা কমই আছে এ কলেজে।’
‘গরীব বলে কি আমরা মানুষ নই?’
‘বিভা দেখ…’ বাকি কথা শেষ করার আগেই আবির তীব্র রাগ নিয়ে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে। ওঁকে দেখে সকলের ফিসফিসানি বন্ধ হয়ে যায়। রাগী দৃষ্টিতে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বিভার হাত ধরে ক্লাসরুম থেকে বের করে নিয়ে যায়। অকস্মাৎ ঘটনায় বিভা সহ বাকি সকলে অবাক। বিভা ক্রোধ কণ্ঠে বলে উঠে,
‘কি করছেন হাত ছাড়ুন।’
আবির বিভার কথা কানে নেয় না। বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভা আবিরের রাগান্বিত আদল দেখে নিজেও ভড়কে যায়। হঠাৎ এভাবে রেগে যাওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করছে। এমন কিছু সে করেনি, যার ফলে আবির এতটা রেখে যাবে। নিরুত্তর থেকে যায় বিভা। আবির বিভাকে টানতে টানতে মাঠের মাঝ বরাবর নিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকে জামিলা, সামিম, মারুফ থেকেই উপস্থিত ছিল। বিভার হাত ছেড়ে আবির মারুফের হাত থেকে মাইকটি নেয়।
এই ঘটনায় অনেকই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাকি দের আবির মাইকের সাহায্যে ডাকে।
‘এই কলেজের সকল স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্য করে বলছি। বিভার বোন গার্মেন্টসের একজন দক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজ করে, কোনো আবাসিক হোটেলের পতিতা হিসাবে নয়।’

বিভা আবিরের মুখে এরূপ কথা শুনে চমকে যায়। অপমানে দৃষ্টি নত করে রাখে। আবির পুনোরায় বলল,
‘তোমদের মতো কিছু বড়োলোক ঘরের স্টুডেন্ট রা গরীবের কাজের মর্ম কী করে বুঝবে। ছোট বলে কোনো কাজ নেই। কাজ তো কাজই হয়। পেটের দায়ে মানুষ ভিক্ষা করে সেটাও এক ধরনের কাজের মধ্যেই পড়ে। বিভা ও তার বোনকে নিয়ে কটুক্তি করা বন্ধ করো। যে এই নিউজটি ছড়িয়েছে, তাকে শীঘ্রই ধরা হবে। আর রইলো বিভার সাপোর্ট নিয়ে আমি কেন কথা বলছি। কারণ বিভা আমার ভালোবাসা, আমার প্রেয়সী। প্রেয়সীর ওপর আঙুল তুলে কেউ কথা বলবে আমি সেটা মানতে প্রস্তুত নই। কথাটি মনে রাখবে সবাই।’ এতটুকু বলে আবির থেমে যায়।
বিভা অপমানে, রাগে, কষ্টে কেঁদে মাঠ ত্যাগ করে। দৌঁড়ে কলেজের পিছনের বাগানে ছুঁড়ে আছে। আবির বিভার পিছনে আসে। বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরাবার সঙ্গে সঙ্গে বিভা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কান্না আটকে বলে,
‘দরকার কি ছিল আপুর বিষয় বলার। যে যা ভাবছে ভাবুক। আর আপনার ভালোবাসার কথা…। একটু আগে আমাকে সবাই কি নজরে দেখতো জানি না। কিন্তু এখন….’
‘এখন তোমাকে কটু দৃষ্টিতে কেউ দেখবে না। যদি কেউ তাকায়ও চোখ উপ্রে ফেলবো।’ রেগে বলল আবির।
‘কেন আমার পিছু পড়ে আছেন? সবার সামনে ভালোবাসার কথা কেন বললেন?’
‘যেটা সত্যি, যেটাই বলেছি। আমার হৃদয়ে তাকেই বাঁধিব যাকে আমার মন চাইবে। পরবর্তীতে এঁরা তোমার বিষয় কিছু বলার আগে আমার কথা একবার হলেও ভাববে।’
‘অনেক করেছেন আর না। প্লিজ আপনি আমার জীবন থেকে সরে যান। আপু যদি এগুলো জানতে পারে কষ্ট পাবে, পড়াশোনা বন্ধ করে দিবে।’ মিনতীর স্বরে বলল।
‘কিচ্ছু হবে না। আমার ওপর ভরসা রাখো বিভা। তোমার উপর থেকে মুভ অন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কথাটি যেন দ্বিতীয় বার না শুনি।’
কান্নারত চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসে। আবির আটকায় না। এমুহূর্তে বিভাকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো বলে মনে করে।

কিছুক্ষণ পর….

‘তুই যা করেছিস, ঠিক করেছিল আবির। আম্মু, প্রিন্সিপাল স্যারকে আমি ম্যানেজ করে নিবো।’ আফিন আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
‘ভাইয়া আমি কলেজে এসে বন্ধুদের মুখে এসব শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। ভালোবাসার মানুষটির পরিবার নিয়ে খারাপ মন্তব্য ছড়াবে, আমি সেটা মেনে নিবো না। আসল দোষীকে পাইনি, যে বদনাম ছড়িয়েছে।’ তেজি কণ্ঠে বলল আবির।
আফিন আবিরকে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘রাগ নিয়ন্ত্রণ কর। তবে বিভাকে ভালোবাসার বিষয়টি না বললেও হতো আবির। এতে বিভা অনেকটা লজ্জা পেয়েছে।’
‘আমি চাই না বিভার নজর কারো উপর পড়ুক। তাই সবাইকে ওয়ার্ন করেছি। তুমি একটু এই দিকটা সামলে নেও ভাইয়া।’
‘নিবো। তুই বাড়িতে যাহ!’
‘বিভার সঙ্গে কথা বলে তারপর যাব।’
‘প্রাইভেটে যাওয়ার পর কথা বলিস। এখন বাড়িতে ফির।’
আবির কিছু বলে না। আফিনের কথায় সে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। এদিকে বিভা কোনোমতে ক্লাস শেষ করেছে। আবিরের ভয়তে ক্লাসের কোনো স্টুডেন্ট ওর দিকে তাকানোর সাহস করেনি। এটা ভয় হিসাবে নিবে, নাকি রেসপেক্টের হিসাবে নিবে, বুঝা মুসকিল তার পক্ষে।
আজ বিভা প্রাইভেটে না গিয়ে বাড়িতে চলে আসে।

বিভার মুখ কালো দেখে বিলকিস বানু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না। হয়তো স্যার বকাঝকা করেছে এই জন্য মুখ মলিন হয়ে আছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে কিছু বলল না।
____
মেশিন চালানোর সময় মাথা কেমন ঘুরে আসে ববির। কাজ অফ রেখে ব্যাগের ভেতর থেকে পানি খেয়ে নেয়। চোখেমুখে পানি দেওয়ার জন্য বাথরুমে আসে। কয়েকবার পানির ঝাঁপটা দিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে বাহিরে। সামনে এগিয়ে যেতেই আকবর আলি আগের ন্যায় আজও পথরোধ করে দাঁড়ায়। ববি কিছুটা হকচকিয়ে উঠে। এই দিকটায় তেমন কেউ ছিল না। যে যার সিপ্টে কাজ করতে ব্যস্ত ছিল। সেটারই ফায়দা উঠিয়েছেন তিনি। ববি কণ্ঠে তেজ এনে শুধায়,
‘কি হলো, পথ আঁটকলেন কেন?’
‘কথা কমু তাই।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
‘কি কথা বলার আছে বলুন।’
‘শেষ বারের মতো কও, আমারে বিয়া করবা কি-না?’
‘আপনার কঁপার ভালো যে আমি আপনাকে এখনো সম্মান করছি। নয়তো সেদিনই আপনার গালে থাপ্পড় দিতাম।’
‘ববি!’ চেঁচালেন তিনি।
‘চিল্লাবেন না। এতদিন সম্মান করেছি এটাই অনেক বেশি। চোখের সামনে থেকে সরুন। তৃতীয় বার আমার সামনে আসবেন না।’
‘তার মানে তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি না?’
‘নাহ! বাংলা কথা বুঝেন না।’ চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলল।
‘আইচ্ছা, আমিও দেখমু তোমার দেমাগ কতদিন থাকে।’ বলেই তিনি চলে গেলেন। ববি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো।
মেজাজ খারাপ করার মতো একজন লোক তিনি। মন, মেজাজ বিগড়ে গেছে ববির। সে ব্যাগ নিয়ে বের হয়। আজকে আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না ।
আসার সময় ববি খেয়াল করে অন্য সিপ্টের আরেকটি মেয়েকে ধরাধরি করে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে। ববি অবাক হয়। এই মাসে এই মেয়েটিকে নিয়ে তিনজন মেয়ে অসুস্থ হলো। আগের মাসে নাকি অসংখ্য মেয়ে অসুস্থ হয়েছে। তাদের অপারেশন করানো হয়েছে কি-না সে ববি জানে না। তার কাছে বিষয়টি ঘোলাটে লাগে। মাথা ব্যথা করার ফলে আপাতত সে এসব না ভেবে বাসায় ফিরে। পরে একদিন এই বিষয়ে খোঁজ লাগবে বলে ভাবে।
____
বিভা আজ প্রাইভেটে আসেনি। এতে আবির প্রায় পাগলের মতো বিহেভ করতে থাকে। একটু কথা বলার জন্য মন ছটফট করছে। ফোনও ব্যবহার করে না যে কল দিবে। সে সিদ্ধান্ত নেয় বিভাকে একটি ফোন কিনে দিবে। নিচে এসে মোহনাকে বিভার না আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই ‘ওর ভালো লাগছে না’ বিষয়টি জানায়। ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় আবির।

সন্ধ্যার দিকে আকাশে মেঘ জমে। মাগরিবের নামাজ শেষ হতেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। এই শীতের মৌসুমেও বর্ষার উৎপাত একদমই না পছন্দ বিভার। ববি শুয়ে আছে। মাথা ব্যথা এখনো কমেনি। বিলকিস বানু কাঁথা সেলাই করছে। এখনো বিভার মনে সকালের ঘটনা উঁকি দিচ্ছে। বিভা নিজে থেকেই বলতে চেয়েছিল ববিকে। কিন্তু ববির অসুস্থতার কারণে আর বলা হয় না। পড়াতে মন দিতে পারছে না। না চাইতেও আবিরের কথা গুলো কানে পুনোরায় বাজচ্ছে। প্রাইভেটে যায়নি শুধু আবিরের জন্য। হয়তো এতক্ষণ সকালের ঘটনা আইরিন ম্যামও জেনে গেছে। কীভাবে তাকে ফেইস করবে এই ভেবে আজকের পড়া মিস করতে হয়। জোরে বৃষ্টি বর্ষিত হবার আগেই বিলকিস বানু জানালার কপাট দিতে বলে। বিভা এগিয়ে যায় জানালার দিকে। বাহিরে দৃষ্টি পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে আবিরকে দেখে। এক হাতে ধরে রেখেছে গোলাপি রঙের ছাতা। অন্য হাতে কিছু একটা রয়েছে।
আদল জুড়ে ছেঁয়ে আছে এক রাশ খুশির ঝিলিক। তবে কি তাকে দেখেই ঝিলিক ধরেছে আদলে। এই ছেলের সাহস দেখে বিভা বিস্মিত! সে বিস্ময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। দ্রুত জানালার কপাট লাগাতে নিলে আবির জানালা শক্ত করে ধরে ফেলে। বিভার দিকে এগিয়ে দেয় হাতের বাক্সটি। বিভার ভয়তে রূহ যেন নেড়ে উঠলো। তবে ভেতরটা সম্মোহনী এক অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। অনুভূতিটা বলে বুঝানোর মতো নয়। আবির চুপিসারে বলল,
‘এটা নেও, নয়তো চেঁচাবো।’
আবিরের এমন নরম ধমক বার্তা বিভার ভয়ের রেশ আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলে। যদি একবার মা দেখতে পায় কঁপালে শনি আছে ভেবে ঢোক গিলে। উপায় না পেয়ে বিভা বাক্সটি নিয়ে ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেলে জানালা আটকে দেয়।
দ্রুত এগিয়ে আসে পড়ার টেবিলের দিকে। মায়ের দিকে একবার দৃষ্টিপাত ফেলে ওড়না থেকে বের করে ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখে। বুকে হাত রেখে অনুভব করে বুক এখনো ধুকপুক করছে। গলা শুঁকানো। তৃষ্ণা পেয়েছে। পানি খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here