বাইজি কন্যা পর্ব-১০

0
675

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_১০
নিজেই নিজেকে তাচ্ছিল্য করা…অদ্ভুত তাইনা? প্রণয় চৌধুরী মানুষটাই অদ্ভুত চরিত্রের। তার স্বভাবে
কখনো মন বলবে, ইশ মানুষ’টার চরিত্র কি অপরূপ! আবার কখনো মন বলবে, ছিঃ মানুষ’টা এতো নির্দয় কেন? মানুষ’টা এতো স্বার্থপর কেন? তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে অনেকে ভুলেই যাবে, স্বার্থের এই পৃথিবীতে নিঃস্বার্থতাই বড়ো আশ্চর্যান্বিত।পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে ফেরার সময় ফুলগুলো চোখে পড়ে প্রণয়ের। অন্তঃকোণে কঠিন ব্যামো ধরেছে তার। ডাক্তারি বিদ্যা থাকায় অতিসহজেই মস্তিষ্ক ধরে ফেলেছে ব্যামোর উৎসর্গ ঠিক কোথায়। তাই তো কোনদিক দ্বিধা না করে ভূমিতল থেকে ফুলগুলো তুলে নিয়ে এসেছে। প্রেমে দ্বিধা না থাকলেও দ্বন্দ্ব থাকবে। তাই প্রণয় দ্বিধা না রেখে দ্বন্দ্বের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। দীর্ঘ সময় ফুলগুলো হাতে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় বসে আছে প্রণয়। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে। চারদিকে যেনো ঘুটঘুটে অন্ধকার এক টুকরো আলোর খোঁজে বিভোর সে। সে আলোর নেশায় বক্ষঃস্থল এতোটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠলো যে অস্ফুট স্বরে ওষ্ঠাধরে উচ্চারিত হলো, ‘নুর!’ তারপরই অকস্মাৎ দ্বারে করাঘাতের শব্দ শুনতে পেলো। হুঁশে ফিরে ত্বরিতগতিতে ফুলগুলো লুকিয়ে ফেললো প্রণয়।একটা ঢিলেঢালা ফতুয়া পড়তে পড়তে দ্বারের বাইরে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ কে? ‘
-‘ ভাই আমি তাড়াতাড়ি দরজা খোল একজন রোগি নিয়ে এসেছি তোমার কাছে। ‘
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে দরজা খুললো প্রণয়। সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে ওঠলো দু’টো মুখ। নুরের নিষ্পাপ, শুভ্র মুখুশ্রী দৃষ্টি’তে অকস্মাৎ সূর্যের তেজস্বী রশ্মির ন্যায় আঘাত হানলো। সুঠাম দেহের শ্যামবর্ণীয় গুরুগম্ভীর মুখটা দেখা মাত্রই রঙ্গনের পিছনে লুকালো শাহিনুর। প্রণয়ের দৃষ্টি এবার রঙ্গনের দিকে চলে গেলো। চোয়ালজোড়া হয়ে ওঠলো দৃঢ়। প্রচণ্ড ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন করলো,
-‘ এসবের অর্থ কী? ‘
-‘ সব’টা বলছি ভাই আগে তো ভিতরে যেতে দাও। ‘
এটুকু বলে রঙ্গন পিছন ঘুরে নুরে’র হাত চেপে ধরলো। বললো,
-‘নুর ভয় পেওনা ভাইয়া খুব ভালো। ভিতরে চলো। ‘
রঙ্গনের কথা শুনে শাহিনুর ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রঙ্গনের হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিয়ে শক্ত করে ধরলো। প্রণয়ের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য বারেবার রঙ্গনের পিছনে থাকার চেষ্টা করতে লাগলো। প্রণয়ের দৃষ্টি দু’টো হাতের এক হয়ে যাওয়া দৃশ্য’তেই আঁটকে রয়েছে। তার নয়নজোড়ায় বিস্ফোরণের বিন্দু চিহ্নও পাওয়া গেলো না। তবে বক্ষঃস্থলে প্রলয় শুরু হয়ে গেলো। ক্ষণকাল বাকরুদ্ধ থেকে বললো,
-‘ ভিতরে আয়। ‘
প্রশস্ত হেসে শাহিনুর’কে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো রঙ্গন। শাহিনুরের ধীরতা,নম্রতায় প্রণয়ের মুগ্ধতা কতোটুকু এলো জানা নেই। কিন্তু ভীতিগ্রস্ত একজোড়া চোখে রঙ্গনের প্রতি অগাধ ভরসার পুরোটাই আঁচ করতে পারলো। বিনিময়ে ওষ্ঠকোণে ফুটে ওঠলো বাঁকা হাসি। যে হাসিটুকু আড়াল করে শাহিনুরের দিকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দৃষ্টি তার দিকে আবদ্ধ করে রঙ্গন’কে প্রশ্ন করলো,
-‘ সমস্যা কি? ‘
রঙ্গন শাহিনুর’কে ডিভানে বসালো। তারপর শাহিনুর’কে শারমিনের আঘাতের কথা ব্যক্ত করে চিকিৎসা দিতে বললো। প্রণয় ধীরগতিতে বারকয়েক পায়চারি করলো। তারপর ওদের মুখোমুখি চেয়ার টেনে এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে বসলো। রঙ্গন’কে আদেশ করলো,
-‘ ও’ঘরে চিকিৎসা বাক্স রয়েছে নিয়ে আয়।’
রঙ্গন ওঠতে নিলেই শাহিনুর রঙ্গনের একটি হাত চেপে ধরলো। চোয়ালজোড়া কঠিন থেকেও কঠিনতর হয়ে ওঠলো প্রণয়ের। রঙ্গন আমতা আমতা করে প্রণয়’কে বললো,
-‘ মেয়েটা ভীষণ ভয়কাতুরে ভাইয়া। ‘
চোখ বুজে লম্বা শ্বাস ছাড়লো প্রণয়। বললো,
-‘ ও’কে বল এখানে কোন বাঘ, ভাল্লুক নেই। ‘
শাহিনুর’কে বুঝিয়ে রঙ্গন ভিতরের রুমে চলে গেলো। রঙ্গন যাওয়ার সাথে সাথেই ওঠে দাঁড়ালো প্রণয়। ক্রোধে শরীর রিরি করছে তার । কোনক্রমেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে শাহিনুরের সম্মুখেই এক লাথিতে এপাশ থেকে চেয়ারটা ওপাশে নিয়ে ফেললো। তীব্র ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে কেঁদে ফেললো শাহিনুর। রঙ্গন চিকিৎসা বাক্স নিয়ে ছুটে এলো৷ বললো,
-‘ কি হয়েছে ভাই? ‘
-‘ কি হয়েছে মানে এই মেয়ে’কে কীভাবে চিকিৎসা দেবো আমি? জমের মতো ভয় পাচ্ছে আমাকে। তুই ওকে স্বাভাবিক কর আমি আসছি। ‘
এটুকু বলেই বেডরুমে চলে গেলো প্রণয়। রঙ্গন জানে তার এই ভাই কতোটা বদমেজাজি। তাই তেমন কোন সন্দেহ করলোনা বরং শাহিনুর’কেই বোঝাতে লাগলো৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো প্রণয়। হাতে এক কাপ দুধ চা, আর এক গ্লাস পানি। রঙ্গনের দুধ চা প্রিয় তাই রঙ্গন’কে বললো,
-‘ তোর চা। তুই বরং ওখানে গিয়ে রিল্যাক্স হয়ে চা খা। আমি রোগির অবস্থা দেখি। ‘
রঙ্গনের হাতে চা’য়ের কাপ দিয়ে পানির গ্লাস শাহিনুরের দিকে ধরলো। বললো,
-‘ এই মেয়ে খুব ভয় পাচ্ছো, পানিটা খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নাও। ‘
রঙ্গন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসলো। প্রণয় গিয়ে শাহিনুরের পাশে বসে শাহিনুর’কে পানি খেতে বললো। শাহিনুর সত্যি ঢকঢক করে পানি পান করলো। প্রণয় পানির গ্লাস নিজ হাতে নিয়ে ট্রি টেবিলে রেখে শাহিনুরের দিকে চেপে বসে শাহিনুরের কাঁধে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো শাহিনুর। প্রণয় বললো,
-‘ আমি একজন ডক্টর। আর ডক্টরের কাছে কোন রোগিরই লজ্জা রাখা উচিত নয়। সো লজ্জা শরম বিসর্জন দিয়ে আমার কাছে আসতে হবে। ‘
প্রণয়ের দিকে দুর্বল দৃষ্টিতে তাকালো শাহিনুর৷ অগাধ ভয়ের সঙ্গে খানিকটা লজ্জিত হয়ে আরেকটু সরে গেলো। কেমন যেনো দুর্বল লাগছে তার। মাথাটা ঝিমঝিম করছে,শরীরের ভার ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। বাঁশিওয়ালা’কে কি বলবে তাকে বাইজি গৃহে নিয়ে যেতে? এটুকু ভেবে রঙ্গনের দিকে তাকালো। কিন্তু রঙ্গন কোথায় সে তো এখানে নেই! নেতিয়ে পড়া দৃষ্টিতে এবার প্রণয়ের দিকে তাকালো শাহিনুর। প্রণয়ের অধরে দুর্বৃত্ত হাসির ঢল নেমেছে যেনো। এটুকু দেখেই ডিভানে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো শাহিনুর। তলিয়ে গেলো নিবিড় তন্দ্রায়। প্রণয় স্বল্প পরিমাণ সময়ও নষ্ট করলো না। ত্বরিত গতিতে শাহিনুর’কে কোলে তুলে নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। বদ্ধ ঘরে একজন ডাক্তার হিসাবে নিজের পুরো দায়িত্ব পালন শেষে বড্ড মুশকিলে পড়ে গেলো প্রণয়৷ জমিদারের চার পুত্র’দের যেমন নারী শরীর মুখস্থ তেমনি নারী’দের সকল বিষয়েই বেশ ভালো মতোন অবগতও। কিন্তু প্রণয় চৌধুরী নারীদের সকল বিষয়ে একেবারেই জ্ঞাত নয়৷ যেমনটা সে এ মূহুর্তে বুঝতে পারছে না কিছুক্ষণ পূর্বে শাহিনুরের দেহচ্যুত করা শাড়িটি পুনরায় পরাবে কি করে! উপায় অন্তর না পেয়ে কোনরকম শাড়িটা শাহিনুরের গায়ে পেঁচিয়ে দিলো। যদিও নিষিদ্ধ চাওয়া’তে মন, মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আসছিলো কিন্তু ফুলের মতো পবিত্র মুখশ্রী, তুলোর অধিক নির্মল শরীর’টার প্রতি সীমাহীন সম্মান, স্নেহের বশিভূত হয়ে কিছুই পারলো না সে। ঠিক এই একটা জায়গাতেই হয়তো নিপুণ ভাবে প্রমাণিত হয় সে জমিদারের বাকি পুত্রদের চেয়ে আলাদা ভীষণ আলাদা। শাড়িতে পেঁচানো ঘুমন্ত শাহিনুর’কে দেখে প্রণয়ের দুর্বৃত্ত হৃদয়ে বেজে ওঠলো,
-‘ বাহ প্রণয় চৌধুরী বাহ জীবনে প্রথমবার কোন নারী’র কাপড় খুললে অথচ পরাতে সক্ষম হলে না৷ যাক জমিদার বংশের অন্তত এই একটি ধারা বজায় রাখলে। জমিদার পুত্র’রা শুধু নারী’দের কাপড় খুলতেই জানে পরাতে জানে না।’
আপনমনেই হেসে ফেললো প্রণয়। শাহিনুর’কে আবারো পাঁজা কোল করে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পাশের ঘরে উঁকি দিলো। যে ঘরে বেঘোরে পড়ে ঘুমাচ্ছে রঙ্গন৷ অতিকৌশলে তখন চা আর পানির মধ্য ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ছিলো যার ফলশ্রুতিতে দু’জনই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ভাবতেই বাঁকা হেসে বিরবির করে প্রণয় বললো,
-‘ ডিয়ার ব্রাদার বারো ঘন্টার আগে তোমার এ ঘুম কাটছে না। ‘
তারপর শাহিনুরের পবিত্র মুখশ্রী’তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-‘ তুমি শুধু অতিসুদর্শিনীই নও তুমি এক মায়াবিনীও বাইজি কন্যা। কেউ তোমার রূপে দগ্ধ হচ্ছে, কেউ বা তোমার মায়া’য় জড়িয়ে যাচ্ছে, কারো হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করছে তোমার সরলতা, কারো মস্তিষ্ক বিগড়ে দিয়েছে তোমার অবুঝ প্রতিবাদী স্বর। এক তুমি’র অগণিত প্রার্থী’দের এক আমিই পরাজিত করবো মনোহারিণী! ‘

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ ]
[ ভুলত্রুটি ক্ষমা করে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন। এটি একটি থ্রিলার,রোমাঞ্চকর উপন্যাস। এ পর্যন্ত আমার কোন গল্পেই এইরূপ রহস্য দেওয়া হয়নি। তাই পড়তে একটু ব্যতিক্রম লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন লম্বা অংশ পড়ে ফেলবেন তখন বেশ মজা পাবেন। আর বুঝতে পারবেন বাকিগুলোর থেকে ঠিক কতোটা ডিফারেন্ট এই উপন্যাস। সর্বোপরি আশা করছি সকলের মন জয় করতে না পারলেও সকলের মন ছুঁয়ে দিব ইনশাআল্লাহ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here