বাইজি কন্যা পর্ব-২৯

0
1200

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৯ (শেষাংশ)
[৪২]
পাঁচফোড়ন গৃহের পরিবেশ বেশ থমথমে। আনাচে কানাচে ভৃত্যদের ছাড়া কাউকেই তেমন নজরে পড়ছে না। কারো মুখে একটুখানি রা নেই, চারিদিকে কেমন ভয়াবহ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। প্রতিটি ভৃত্যের চোখ,মুখে স্পষ্ট ভয় দেখা যাচ্ছে। সকলেই বেশ আতঙ্কিত। একটি পরিবার’কে মুরুব্বি’রা যে ছায়া দিয়ে আগলে রাখে, অলিওরের মৃত্যুর পর পাচঁফোড়ন গৃহে সেই ছায়া বিলীন হয়ে গেছে। মুরুব্বি’রা ভালো হোক বা মন্দ হোক যতোদিন তারা বেঁচে থাকেন ততোদিন তাদের ঘর,সংসারে সমস্ত বিপদ মাথার উপর দিয়েই চলে যায়। মানুষের শরীরে মাথার ভূমিকা যতোটা পরিবারে বাবার ভূমিকাও ঠিক ততোটাই। আজ অলিওর বেঁচে থাকলে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে পরাজিত হতে বাধ্য থাকতো তার ছেলেরা। সকল ঝড় ঝাপটা গৃহের বাইরেই সারতো সে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যে ঝড় গৃহে প্রবেশ করেছে সেই ঝড় সব কিছু তছনছ না করে ছাড়বে না। এটা পরিবারের সকলের আত্মায়ই জানান দিয়েছে। ভোজন কক্ষে উপস্থিত হয়েছে পল্লব, পলাশ এবং প্রণয় চৌধুরী। তিন ভাই অপেক্ষা করছিলো মা প্রেরণার জন্য। অরুণা তিনজনের পাতেই ধীরে ধীরে খাবার বাড়তে লাগলো। আজ তিন ভাইয়ের মুখই বেশ গম্ভীর। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। রান্নাঘরে শবনম শাহিনুরের জন্য খাবার বেড়ে এক ভৃত্য’কে দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। প্রণয় তা খেয়াল করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বড়ো আম্মা অরুণা’কে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ আম্মা কোথায়? ‘
অরুণা চেয়ার টেনে তিন পুত্রের সম্মুখে বসলো৷ বললো,
-‘ চুপচাপ খেয়ে নাও তোমরা, ছোটো বউ এখানে আসবে না। কেন আসবে না তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো? ‘
অরুণার কথা শুনে পলাশ কঠিন মুখে এক পলক প্রণয়ের দিকে তাকালো তো আরেকবার পল্লবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। পল্লব চোখের ইশারায় তাকে সংযত থাকতে বলে হালকা কেশে ওঠে প্রণয়’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ তুই কী ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস? এটা কিন্তু আমাদের সম্মানের ব্যাপার। জমিদারের বংশধর আমরা, আমাদের জন্য তাদের সম্মানে আঘাত লাগবে এমন কাজ করা অনুচিত। ‘
অরুণা প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে তার কঠোর মুখোভঙ্গি দেখে পল্লব’কে বললো,
-‘ খাবার বসে এসব আলোচনা কেন? ‘
প্রণয় অরুণা’কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ থাক বড়ো মা কথা যখন ওঠেছে উত্তর আমি দেবো৷ ‘
পলাশ থম মেরে বসে আছে, পল্লব উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে প্রণয়ের থেকে কিছু শোনার জন্য, অরুণাও চুপ মেরে গেলো। কথা বলার পরিস্থিতি তৈরি করে নিয়ে প্রণয় পল্লবের দিকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, ঈষৎ তাচ্ছিল্য সহকারে হেসে বললো,
-‘ বেয়াদবি নেবেন না ভাইয়া, ঘরে দু’টো বউ রেখে বাইজি গৃহের বাইজিদের সঙ্গে মেলামেশা করে আপনি এবং আপনারা জমিদার’দের কোন সম্মান রক্ষা করছেন? ‘
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠলো পল্লবের। প্রণয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ বাইজি গৃহ আজকের নয় প্রণয়, এটা আমাদের পূর্ববংশীয়দের বাইজি গৃহ। আমরা তাদের ধারাগুলোই মেনে চলছি। কিন্তু কোন বাইজি’কে আমাদের এই পবিত্র গৃহে স্থান দেইনি, দেওয়ার কথা ভাবিওনি৷ ‘
-‘ আমিও কোন বাইজি’কে তুলে নিয়ে আসিনি। ‘
চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় সুরে বলে ওঠলো প্রণয়৷ একটু থেমে আবারও বললো,
-‘ আপনি জমিদার’দের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এতে আমি বাঁধা দেইনি, ঠিক তেমনি আপনিও আমার সিদ্ধান্তে বাঁধা দেবেন না। যদি কিছু ভুল মনে হয় বলতে পারেন।’
-‘ ভুল তো অবশ্যই একটা বাইজির মেয়ে এ বাড়ির বউ হয় কি করে! ‘
-‘ একটা বাইজির মেয়ের জন্য জমিদারের চার ছেলেদের কামপ্রবৃত্তি জাগা যদি স্বাভাবিক হয় একজন পুত্রের ভালোবাসা জেগে ওঠা অস্বাভাবিক কেন হবে ? ‘
থতমত খেয়ে পল্লব বললো,
-‘ এটা আমাদের নীতিবিরুদ্ধ। ‘
-‘ বাহ বড়ো ভাই বাহ আপনারা সৃষ্টিকর্তার দেওয়া নিয়ম ভঙ্গ করতে পারেন, আর আমি সামান্য আপনাদের নিয়ম ভাঙতে পারবো না? ‘
কথোপকথনের এ পর্যায়ে পলাশ কূটবুদ্ধি খাটানোর চেষ্টা করে বললো,
-‘ তুই কি জানিস ঐ মেয়ে রঙ্গনের সঙ্গে খুব বাজেভাবে মেলামেশা করেছে? ‘
চোখজোড়া ঈষৎ রক্তিম হয়ে ওঠলো প্রণয়ের৷ সামনে বড়ো ভাই,বড়ো মা রয়েছে। শাহিনুর’কে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে আরেক বড়ো ভাই। নিজের ক্রোধটুকু কোনক্রমে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো সে। পলাশের দিকে নিবিড়ভাবে তাকালো, অধরে কিঞ্চিৎ পরিমাণ তাচ্ছিল্য নিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
-‘ সে যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কলঙ্কিত নারীও হয় তবুও তাকে আমার বউ করবো। ‘
বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো তিনজনই। আশপাশে যেসব ভৃত্যরা প্রণয়ের বলা বাক্যটি শুনতে পেলো সকলেই ক্ষণকাল থমকে দাঁড়ালো। অবিশ্বাস্য কতোগুলো দৃষ্টি তাকিয়ে রইলো তার পানে। প্রণয় এবার বেশ উচ্চবাচ্যে বললো,
-‘ এবার যদি বলো তুমি তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য তোমার প্রবৃত্তি মেটানোর জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছো। তাহলে বলবো, নিজের ভালোবাসা’কে নিজের না করে নিজ আত্মার সঙ্গে স্বার্থপরতা বা বেইমানি কোনটাই আমি করতে পারবো না৷ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো বেইমান সে যে নিজের সঙ্গে বেইমানি করে! আমি তোমাদের প্রকৃতির নয় বলে আমি খুব বেশী উদার হবো এটা ভাবা বোকামি। জমিদারের পুত্র এক বাইজি কন্যা’কে ভালোবাসে,বিয়ে করতে চায়, এটা যদি পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম কাজও হয় তাহলে সেই জঘন্যতম কাজটি আমি অনায়াসেই করে ফেলবো।
” বাইজি কন্যা’কে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, সে অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে মৃত্যুদন্ড গ্রহণ করতেও আমি প্রস্তুত। বাইজি কন্যা’কে নিজের বউ করা যদি অন্যায় হয় তাহলে এ পৃথিবীর সব ন্যায় ভুলে গিয়ে হলেও এই অন্যায়টুকু সুকৌশলে করে নেবো আমি ” ‘

সকলেই স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ। অরুণা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ভৃত্যরাও। পল্লব হতবাক হয়ে বসে আছে। পলাশ ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। সে দৃষ্টি’কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো প্রণয়৷ আর একটি বাক্যও সে খরচ করলো না৷ নিজের মতো খাবার খেয়ে চলে গেলো নিজের কক্ষে। সে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনে থাকা খাবারের প্লেট ছুঁড়ে ফেললো পলাশ। হতভম্ব হয়ে অরুণা চেয়ে রইলো৷ পলাশ তাকে উদ্দেশ্য করে হুংকার ছাড়লো,
-‘আম্মা’কে কিছু করতে বলুন নয়তো ধ্বংসলীলা শুরু করবো আমি! ‘
[৪৩]
গোসল শেষ করে ভেজা চুলগুলো পিঠজুড়ে ছড়িয়ে,ছিটিয়ে দিয়ে কক্ষে এলো শাহিনুর। দেখতে পেলো গোলাকার বেতের টেবিলে তার জন্য খাবার রেখে দিয়েছে। আশপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে অপেক্ষা না করে একে একে খাবারগুলো মেঝেতে রাখলো। তারপর হাঁটু মুড়িয়ে বসে পড়লো। সদ্য ভেজা কোঁকড়ানো চুলগুলো মেঝেতে ছুঁয়ে রইলো। টপ টপ করে পানি ঝড়তেও লাগলো। শাহিনুর সম্মুখের খাবারের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বড়োসড়ো একটি প্লেটে সাদা ভাত দেওয়া হয়েছে তাকে, ভাতের মাঝবরাবর একটা ডিম সিদ্ধ, ছোট ছোট বাটিতে কয়েক রকমের ভাজি,তরকারি দেওয়া হয়েছে। এতো খাবার দেখে বিচলিত হয়ে গেলো মেয়েটা৷ তার ছোট্ট পেটে এতো খাবারের জায়গা হবে না। জীবনে কখনো এতো খাবার একসাথে খাওয়া হয়নি তার। তাছাড়া তার মা সবসময় খাবার নিয়ে একটি কথা বলতো, খা, না। খাওয়াটা যেমন প্রয়োজন তেমন অতিরিক্তও খাওয়াও অনুচিত। ভেবেচিন্তে সব খাবার দূরে ঠেলে শুধু মাত্র ডিম সিদ্ধ আর সবজি দিয়ে অল্প ভাত খেলো সে। মাংস তার প্রিয় হলেও আজ খেলো না। আর মাছ তো মা’কে ছাড়া সে কখনো খেতেই পারেনা। গলায় কাঁটা ফুটে যায়। কক্ষে প্রবেশ করলো প্রণয়৷ ভিতর কক্ষে দেখতে পেলো শাহিনুর খাবারগুলো গুছিয়ে রাখছে। দোনোমোনো করে শাহিনুরের কাছে গেলো সে। প্রণয়’কে দেখে শাহিনুর পরিহিত শাড়ির আঁচলটি ডান কাঁধে টেনে নিলো৷ সদ্য গোসল করে আশা শাহিনুর’কে দেখে বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো প্রণয়ের৷ ঢেউ খেলানো ভেজা চুলগুলো বেয়ে পানি পড়ায় শাহিনুরের পিঠ, কোমড় সহ মেঝেও ভিজে চুপেচুপে হয়ে যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে কয়েক পল তাকিয়ে রইলো প্রণয়৷ শাহিনুর জড়োসড়ো হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে তার। অস্বস্তি টুকু বুকে ভীষণ পীড়া দিতে শুরু করায় সে প্রণয়ের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
-‘ আপনি কি সবসময় এ’ঘরে আসবেন? ‘
কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় দ্বিগুণ কুঁচকে গেলো প্রণয়ের। কিছুক্ষণ পূর্বে ভোজন কক্ষে বলা নিজের বলা একটি বাক্য স্বরণ হলো তার,
-‘ সে যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কলঙ্কিত নারীও হয় তবুও তাকে আমার বউ করবো। ‘
বক্ষঃস্থলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জেগে ওঠলো। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে শাহিনুরের স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, কতো সহজেই আজ বলে দিলো কথাটি। অথচ সেদিন রোমানার বেলায় এই কথাটি তার মাথায়ও আসেনি। সত্যি ভালোবাসা কি না পারে…। প্রণয়ের প্রগাঢ় চাহনি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শাহিনুর। নিজের দৃষ্টি থেকে শাহিনুরের দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন হতেই প্রণয় সম্বিৎ ফিরে পেলো। বললো,
-‘ এ প্রশ্ন কেন? ‘
নিরুত্তর রইলো শাহিনুর। উত্তর না পেয়ে প্রণয় বললো,
-‘ ব্রিফকেসে তয়ালে আছে মাথা মুছে নাও। ‘
শাহিনুর কথা শুনলো না। চুপচাপ গিয়ে পালঙ্কে বসলো। প্রণয় আবারো বললো,
-‘ চুলগুলো থেকে পানি ঝড়ছে আমার ঘর নষ্ট হচ্ছে। অন্যের ক্ষতি করা অনুচিত। ‘
শাহিনুর নীরস দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়ের পানে। প্রশ্ন করলো,
-‘ আমার এতোবড়ো ক্ষতিটা কে করলো? ‘
-‘ মানে? ‘
-‘ আমার আম্মা’কে কে মারলো? ‘
-‘ সবটা জেনেও বোকার মতো প্রশ্ন করছো কেন? ‘
-‘ সবটা জানি বলেই তো বিশ্বাস করতে পারছিনা। ‘
-‘ কী জানো তুমি? ‘
-‘ কিছু না। ‘
অকপটে এ কয়েকটি জবাব দিয়ে আর কিছু বললো না শাহিনুর, চুপচাপ পিঠ ঘুরে শুয়ে পড়লো। শুধু অলিওর তার মায়ের হত্যাকারী এটা কেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার? এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত নিদ্রাহীন থাকার ফলে খুব দ্রুতই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলো সে। প্রণয় চিন্তামগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর খেয়াল করলো শাহিনুরের ভেজা চুলে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তয়ালে বের করে ধীরেপায়ে এগিয়ে শাহিনুরের পাশে বসলো। চুলগুলো উঁচিয়ে নিচ দিয়ে তয়ালে দিয়ে কৌশলে পেঁচিয়ে ফেললো। শাহিনুরের ধবধবে ফর্সা কোমল ত্বকে দৃষ্টি পড়তেই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। একহাত তার ভেজা মাথায় রাখলো নম্র কন্ঠে বললো,
-‘ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন সব স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। ‘

চলবে…
[ কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ ]
[ জরুরি প্রয়োজনে এ উপন্যাসটি দু’টো খন্ডে ভাগ করা হবে। ১ম খন্ডের সমাপ্তি দিব খুব শিঘ্রই। পাঠকদের কাছে অনুরোধ সকলেই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আপনাদের মন্তব্য আমার লেখায় বিরাট ভূমিকা পালন করবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here