বাইজি কন্যা পর্ব-৩০

0
1232

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৩০
প্রায় দেড় ঘন্টা তন্দ্রামগ্ন থাকার পর ভয়ংকর চিৎকার শুনতে পেয়ে আচম্বিতে তন্দ্রাঘোর কেটে গেলো শাহিনুরের। শোয়া থেকে সটান হয়ে বসে পড়লো সে৷ ক্রমান্বয়ে বক্ষঃস্থল উঠানামা করতে শুরু করলো তার। তীব্র নিঃশ্বাসের শব্দে বদ্ধ ঘরে থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হলো। প্রণয় তখন পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে নিজ পালঙ্কে আধশোয়া হয়ে বসে ডাক্তারি বই পড়ছিলো৷ এমনই সময় ছোট ভাই অঙ্গনের আকস্মাৎ খ্যাপাটে সুর শুনে চমকে ওঠলো সে৷ বইয়ের পৃষ্টা ভাঁজ করে বইটি বন্ধ করে রেখে দিলো, ত্বরিতগতি’তে ওঠে দাঁড়ালো ভাইয়ের কাছে যাওয়ার জন্য৷ মেডিসিন চলছে অঙ্গনের। তাই হঠাৎ এভাবে খ্যাপে যাওয়ার কারণ’টা বোধগম্য হলো না তার। কয়েক কদম এগিয়ে দরজা অবদি গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁচের দেয়ালে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বক্ষঃস্থল মৃদু কেঁপে ওঠলো শাহিনুর’কে অস্থিরচিত্তে বসে থাকতে দেখে। কর্ণকুহরে অঙ্গনের চিৎকার,চেঁচামেচি, ভাঙচুর ভেসে আসছে। চোখের সামনে শাহিনুরের ভয় মিশ্রিত মুখশ্রী। ক্ষণকাল হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত শাহিনুরের জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে ওর নিকটে চলে গেলো। প্রণয়’কে দেখতে পেয়ে কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো সে। নিজের ভয়টুকু গোপন রেখে প্রণয়ের বাড়িয়ে দেওয়া পানির গ্লাসটি বিনাবাক্যে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করলো। গ্লাসটি যখন ফেরত দেওয়ার জন্য প্রণয়ের দিকে তাকালো, প্রণয় সেটা নিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বললো,
-‘ ভয় পেয়েছো? ‘
এক ঢোক গিলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে শাহিনুর জবাব দিলো,
-‘ ভয় কেন পাবো? ঘুম থেকে ওঠার পর পিপাসা লেগেছিলো। ‘
ভ্রু বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রণয় বললো,
-‘ তাই বুঝি… দ্যাটস লাইক এ্যা গুড গার্ল। ভয় কাতুরে নুর’কে আমিও চাইনা। আমার নুর তো বোকাসাহসী! ‘
অধরে কিঞ্চিৎ দুষ্টু হাসি মিশিয়ে কথাটুকু বলে হাতে থাকা গ্লাসটি নিয়ে চতুরতার সঙ্গে কক্ষ ত্যাগ করলো প্রণয়৷ তাকে এবার অঙ্গনের কাছে যেতে হবে, শান্ত করতে হবে ভাইটা’কে। শাহিনুর ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতে চেয়েছিলো,
-‘ আমি আপনার নুর না। ‘
কিন্তু তা আর বলা হলো না। অপছন্দীয় মানুষ টা অপছন্দনীয় বাক্য আওড়িয়ে ঠিক চলে গেলো।
[৪৪]
দু’দিন যাবৎ ওষুধ খায় না অঙ্গন। বাড়ির সংকীর্ণ পরিস্থিতি’তে অঙ্গনের প্রতি কাল থেকেই অবহেলা হচ্ছিল। প্রেরণাও খোঁজ নেয়নি। যার ফলস্বরূপ গতরাতে ঘুম হয়নি তার ৷ সারারাত নানাবিধ চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলো সে। ডুবে ছিলো রোমানার সঙ্গে সেই পুরোনো স্মৃতি’তে। সেসব স্মৃতির শেষ প্রান্তে এসে যখন রোমানার কবরের দৃশ্যটুকু মনে পড়লো, অন্তঃকোণে বেজে ওঠলো, মানুষ টা আর নেই, আর কোনদিন ফিরবে না মানুষ টা। আর কোনদিন সুখ,দুঃখের গল্প বলার জন্য মানুষ’টা অঙ্গন’কে খুঁজবে না। অভিমানে গাল ভারী করে থাকবে না। দু-চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াবে না। তার হৃদয় খোদাই করে তার ভাইয়ের বউ হবার পাঁয়তারা করবে না! যে মেয়েটা জীবনে কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করেনি, কারো দিকে চোখ তুলে কড়া ভাষায় কথা বলার সাহস দেখায়নি। যার ব্যবহারের মাধুর্যতায় ডুবে থাকতো সে। নিজের সমস্তটা দিয়ে যাকে খুশি করার কথা ভাবতো। এতো ত্যাগের পরও ভাগ্য কেন সহায় হলো না? কেন এলো সেই কালরাত্রি? কেন ধ্বংস হলো রোমানা? সহজসরল, ঐ ভীতু মেয়েটা ভালোবাসা’কে হারানোর ভয়ে কেন পালিয়ে গেলো? যাওয়ার আগে কেন একটা বার তাকে মনে পড়লো না৷ ছোট্ট বেলা থেকে সব সমস্যায় অঙ্গন’কে ডাকতে পারলে,অঙ্গনের কাছে আসতে পারলে এবার কেন ডাকলো না? কেন এলো না সে? এই অঙ্গন’কে শেষ পর্ষন্ত ঘৃণা করে, অভিমান করে চলে যায়নি তো?
সবটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠতেই ভয়ংকর উন্মাদ হয়ে ভাঙচুর, চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে অঙ্গন। প্রণয় এসে যখন জানতে পারে ওষুধ সেবনে অনিয়ম হয়েছে, ভৃত্যদের ওপর ব্যাপক চটে যায়, নার্স’দের ধমকাতে ধমকাতে কাঁদিয়ে ছাড়ে৷ হুমকি দেয় এরপর অনিয়ম হলে বরখাস্ত করা হবে। পরবর্তী’তে যেনো কোথাও কাজ না পায় সে ব্যবস্থাও করবে! ভয়ে জর্জরিত হয়ে ওরা ক্ষমা চায়৷ জানায় এরকম ভুল আর হবে না৷ প্রণয়ও সোজাসাপ্টা বলে দেয়, তার ভাইয়ের প্রতি কারো বিন্দু অবহেলাও সে সহ্য করবে না৷ ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে অঙ্গন’কে ঘুম পাড়িয়ে প্রণয় প্রেরণার সঙ্গে দেখা করতে যায়৷ কিন্তু প্রেরণা বদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করে না৷ সে বলে দেয় প্রণয় যতোক্ষণ না নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবে, যতোক্ষণ না বাইজির মেয়েটা’কে এ গৃহ থেকে বের করে দেবে ততোক্ষণ রুদ্ধ দ্বার সে উন্মুক্ত করবে না! গতরাত থেকে না খাওয়া প্রেরণা৷ এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে সে। মায়ের জেদ সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত প্রণয় তাই কুটিলতার আশ্রয় তাকে নিতেই হলো৷ দুপুর বেলা। পল্লব,পলাশ গৃহে আসবে আরো এক,দু’ঘন্টা পর। ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য গোডাউনে গিয়েছে তারা। প্রচন্ড উদ্বিগ্নতা নিয়ে ভৃত্য দিয়ে শবনম কে ডেকে পাঠালো সে৷ শবনম আসার পর তাকে দিয়ে ডেকে পাঠালো মুনতাহা’কে৷ বৈঠকখানায় তখন কেউ ছিলো না৷ দু’জন ভৃত্য’কে সদর দরজা এবং দু’জন ভৃত্যকে বৈঠকখানার মুখ্য দরজায় খেয়াল রাখতে বললো প্রণয়৷ উপস্থিত হলো মুনতাহা৷ শবনম,মুনতাহা আর প্রণয় ছাড়া আর কেউ নেই৷ মুনতাহা দুরুদুরু বুকে মাথা নত করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ অবধি তার সাথে প্রণয়ের তেমন কোন কথা হয়নি৷ সম্পর্কে তারা মামাতো,ফুপাতো ভাই-বোন হলেও প্রণয় গম্ভীর, অমিশুক এবং মুনতাহা চুপচাপ স্বভাবের হওয়ার দরুন দূরত্বটা অনেক বেশীই রয়ে গেছে। অবশ্য এর পেছনে পলাশের ভুমিকাও কম নেই। সাধারণত মুনতাহা’কে পলাশ কারো সাথে তেমন মিশতে দেয় না। তার বড়ো ভাই হোক বা ছোট ভাই কারো সাথেই মুনতাহা স্বাচ্ছন্দ্যে মিশতে পারেনা। সকলের থেকে গুটিয়ে নেওয়ার স্বভাবটি মুনতাহার নিজের নয় পলাশের দেওয়া আদেশমাত্র। যার হেরফের হলে চরম মূল্য দিতে হয় তাকে! পলাশ সম্পর্কে প্রণয়ের ধারণাও কম নেই৷ তাই মুনতাহা’কে উদ্দেশ্য করে সে বললো,
-‘ এক সম্পর্কে তুমি আমার ছোট বোন অন্য সম্পর্কে বড়ো ভাবি৷ আমি তোমাকে স্নেহ, শ্রদ্ধা দু’টোই করি৷ নির্ভয়ে বসো এখানে। ‘
শবনম গিয়ে সোফায় বসলো। মুনতাহা মাথার ঘোমটাখানি আরেকটু সমানের দিকে টেনে নিয়ে নিঃশব্দে গিয়ে শবনমের পাশে বসলো। প্রণয় তাদের খুব কাছাকাছি একটি মোড়া টেনে বসলো। শবনম এবং মুনতাহার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ়চিত্তে বললো,
-‘ রোমানা’কে আমি কখনোই ভালোবাসতে পারিনি৷ কিন্তু ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। আমি ওকে ভীষণ পছন্দ করতাম। আমার বউ হিসেবে যোগ্য ছিলো ও। কিন্তু সমস্যা একটি জায়গাতেই ছিলো তা হলো আমি ওকে ভালোবাসতে পারিনি৷ কেন পারিনি সেটা আমি জানিনা৷ একটা ভুলের জন্য বোকার মতো ও নিজেকে শেষ করে দিলো। আমি যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম ও এভাবে চলে যাবে তাহলে কখনোই ওকে ভালোবাসিনা এ’কথাটি বলতাম না৷ বরং চেষ্টা করতাম ওকে ভালোবাসার যেমনটা পূর্বে করে এসেছি৷ যাইহোক, আমার সম্পর্কে সবাই ভুল ধারণা পোষণ করছে৷ কারণ আমি সবার মতো করে নিজেকে প্রকাশ করতে পারিনা। ছোটবেলা থেকেই আমি চাইনি কারো কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে। আজো হয়তো পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারবো না। ‘
থামলো প্রণয়৷ শবনম, মুনতাহা দু’জনই তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রণয় আবার বলতে শুরু করলো,
-‘ আমি ঐ মেয়েটা’কে, যে মেয়েটা আমার ঘরে পৃথিবীর সকল নীরবতা’কে বরণ করে নির্লিপ্তে অবস্থান করছে সেই মেয়েটা’কে প্রথম দেখেছিলাম আমার কোয়ার্টারে। মধ্যরাত ছিলো তখন। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা। আমার সেদিন মনে হয়েছিলো,
অমন নিষ্পাপ মুখ এ পৃথিবীতে আর দু’টি পাওয়া যাবে না৷ সত্যি হয়তো আমি আর পাবো না। স্নিগ্ধ মুখশ্রী, একজোড়া স্বচ্ছ দৃষ্টি, বোকাসোকা একটা মন। সবকিছুতেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ি আমি৷ ওর সমস্ত সৌন্দর্যে আঁটকে গেছি ঠিক সেদিনই। ওর মাধুর্যতা আমার মন’কে হরণ করে নিয়েছে ঐ রাতেই। প্রথমে ভেবেছিলাম পুরুষ মানুষ আমি। অপরূপা নারী’র সৌন্দর্যে কুপোকাত হয়ে গেছি। কিন্তু পরে অনুভব করলাম বাইজি গৃহে অপরূপা নারী’র অভাব নেই৷ কোনদিন তো তাদের দিকে ফিরেও তাকাইনি৷ নিজের কামনা পূরণ করতে ছুটে যাইনি সেখানে। অথচ শাহিনুরের প্রতি আমি সাংঘাতিক অনুভূতি টের পেয়েছি। অস্বীকার করবো না এতে ওর পবিত্রতার ভূমিকা অনেকাংশে দায়ী ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে, রঙ্গনের সঙ্গে ওকে দেখে আমি যখন ওকে ঘৃণা করার চেষ্টা করেছি পারিনি। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করেছি সবকিছুর পরও ওর প্রতি আমার অনুভূতি বাড়ছে৷ নিজেকে খুব ছোট মনে হতো বাইজি কন্যার জন্য বুক অস্থির হয়ে পড়তো বলে৷ সেই মনে হওয়াটুকুও কেটে গেলো। একদিকে রোমানা’কে বিয়ে করার দিন ঘনিয়ে আসছিলো অপরদিকে নুরের প্রতি অনুভূতি বেড়ে চলছিলো। কেন জানি মনে হতো নুর আমার জন্য তৈরি। ওর চোখ দু’টোতে তাকালে সেই মনে হওয়াটুকু প্রবল বিশ্বাসে রূপ নিতো। আচমকাই ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে গেলো রোমানা চলে গেলো, আব্বা চলে গেলো, চলে গেলো শারমিন বাইজিও। অসহায় হয়ে পড়লো আমার ভালোবাসা। আমি বেঁচে থাকতে ওর অসহায়ত্ব সহ্য করতে পারবোনা। এই উপলব্ধিটুকু হতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ওকে এ বাড়ি নিয়ে আসার, ওকে বিয়ে করার৷ আমার সেই সিদ্ধান্ত’টা মজবুত হলো ভাইয়ার জন্য। নুরের প্রতি ওর কুদৃষ্টি, নুরের শরীরে বাজেভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা মেনে নিতে পারিনি আমি, পারিনি মেনে নিতে। ‘
ক্রোধান্বিত হয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো প্রণয়৷ লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো মুনতাহা৷ দুফোঁটা অশ্রুপাত ঘটলো তার চোখ বেয়ে। প্রণয় শান্ত হলো, শান্ত কন্ঠে বললো,
-‘ তোমার কষ্ট হচ্ছে আমি জানি৷ সত্য যতোই তিক্ত হোক শুনতে হয় মুনতাহা। আমি তোমাকে এসব বলছি তার একটাই কারণ আমি চাই তুমি আম্মা’কে বোঝাও। ‘
চোখ তুলে তাকালো মুনতাহা। প্রণয় আবারও বললো,
-‘ আমি যদি নুরের পাশে না থাকি ওকে বিয়ে না করি এ গৃহে ওকে রাখা সম্ভব হবে না৷ তোমার হাজব্যান্ডের চাহিদা সম্পর্কে তুমি নিশ্চয়ই জানো? যে কোন মূল্যে সে অবৈধ ভাবে নুর’কে নিজের শয্যাসঙ্গীনি করবে! আর এই পথ আম্মাই করে দিচ্ছে। ‘
কাঁপা কন্ঠে মুনতাহা প্রশ্ন করলো,
-‘ মানে? ‘
-‘ আম্মা আজকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে নুর’কে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছে। একটা বার ভাবছে না নুর’কে বাড়ি থেকে বের করা মানে ভাইয়ার রাস্তা ক্লিয়ার করা। তুমি তো জানো বাইজি গৃহের কাজকর্ম আপাতত বন্ধ রেখেছি, এবার নুরের থেকে ভাইয়ার ধ্যান সরাতে হবে৷ আমি নুর’কে বিয়ে করবো। আমার বউয়ের প্রতি আমার বড়োভাই কুদৃষ্টি দেবেনা নিশ্চয়ই। ‘
শবনম বললো,
-‘ যদি এই ভয়ানক কাজটাও করে ফেলে? ‘
-‘ ভাবি আমার স্ত্রী’কে কীভাবে রক্ষা করতে হবে, কীভাবে ভাইদের সঙ্গে নীরব ঘাতক হয়ে লড়াই করতে হবে তা খুব ভালো করে জানি আমি। আপাতত আম্মা’কে বোঝানো জরুরী। আর মুনতাহা ছাড়া আম্মা’কে কেউ বোঝাতে পারবেনা৷ মুনতাহার প্রতি তিনি ভীষণ দুর্বল। ‘
প্রণয়ের কথা শুনে মুনতাহা বললো,
-‘ আমি আম্মাকে বোঝাবো নুর আপনার বউ হলে যদি উনার মোহ নুর থেকে কেটে যায় তাহলে অবশ্যই আমি আম্মা’কে বোঝাবো। উনাকে পাওয়ার জন্য সব করতে পারি আমি সব। আমি নুরের প্রতি খুব হিংসা বোধ করি। কিন্তু নুর আপনার বউ হলে আমার ক্ষতি নয় বরং ভালোই হবে। তাই আমি কথা দিচ্ছি নুরের সঙ্গে আপনার বিয়ে হবেই। ‘
বাঁকা হাসলো প্রণয়। শবনম এবং মুনতাহার দৃষ্টিগোচর হলো না সেই হাসিটুকু। নুর’কে বিয়ে করার জন্য এতোসবের প্রয়োজন ছিলোনা৷ শুধুমাত্র মা’য়ের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে মা’য়ের অনুমতি’কে গুরুত্ব দিলো সে। তাছাড়া মা’কে অসন্তুষ্ট রেখে জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে সে প্রবেশ করতে চায়নি। হাজারহোক প্রেরণা তার জন্মদাত্রী। মানুষ’টাও তো অসহায় খুব। রোমানার মৃত্যু, স্বামীর মৃত্যু, পুত্রের মানসিক বিপর্যয় সবটা মিলিয়ে মানুষটা শোকে জর্জরিত হয়ে আছে। তাই সুকৌশলে একটি খেলা খেললো সে। যে খেলায় না সাপ মরলো আর না লাঠি ভাঙলো!
[৪৫]
বৈশাখ মাসের বিকালবেলা। পশ্চিমা আকাশে মেঘেরা গুড়ুম গুড়ুম গর্জন তুলছে। চুপচাপ ঘরের কোণে বসে আছে শাহিনুর। এই ঝড়’টাকে ভীষণ ভয় পায় সে৷ এই যে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে তার। একটুপরই হয়তো চারদিক ঘনান্ধকার করে আকাশের বুকের হাহাকারগুলো বৃষ্টি হয়ে ভূমিতলে নেমে আসবে। ঝড়ের আঘাতে সবকিছু যখন তছনছ হয়ে যাবে প্রকৃতি’তে নেমে আসা ধ্বংসলীলা সম্পন্ন হবে তখনই আবার কেঁদে ওঠবে আকাশ৷ ভাসিয়ে দেবে ঘর,বাড়ি, গাছপালা, পথ,মাঠ সবকিছুই। জড়োসড়ো হয়ে বসে আম্মার শেখানো দোয়া দরূদ পড়ছে শাহিনুর। সবসময় এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মা’কে কাছে পেয়েছে। ভয়ে নিস্পন্দ হয়ে মা’য়ের বুকে গুটিশুটি মেরে জায়গা করে নিয়েছে, মা’য়ের স্নেহে, মা’য়ের সাহসে ফিরে পেয়েছে নিজ স্পন্দন গুলো’কে। অথচ আজ চারদিক শূন্য তার। মা নেই পাশে, নেই কোন আপনজন, তার এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ে এই কালবৈশাখী ঝড়ের খুব কী প্রয়োজন ছিলো? জীবনে আসা ঝড়টুকু কী কম ছিলো? পরোক্ষণেই ভাবলো, সে কতো বোকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর অভিমান করছে,অভিযোগ তুলছে। ধীরে ধীরে মেঘের গর্জন দৃঢ় হতে শুরু করলো। শাহিনুরও চোখমুখ খিঁচে দোয়া পড়তে লাগলো৷ এমন সময় প্রণয় কক্ষে এলো। শব্দ পেয়ে চমকে তাকালো শাহিনুর৷ দেখলো প্রণয় কক্ষে এসে দরজা লাগাচ্ছে। কিছুটা ভয় কাটলো এই ভেবে তার পাশের ঘরে একটা মানুষ তো আছে। পরোক্ষণেই আবার স্মরণ হলো শারমিনের বলা একটি কথা, নিজের দুর্বলতাগুলো’কে কখনো কারো কাছে প্রকাশ করবে না। এই যে সে এখন ভয় পাচ্ছে প্রণয় যদি বুঝে যায় তাহলে তো তার দুর্বল জায়গাটা বুঝে যাবে। তখন নিশ্চয়ই হাসবে? শাহিনুর জড়োসড়ো অবস্থায় বসেই এসব ভাবছিলো। তখনি প্রণয়ের চোখ পড়লো ওর দিকে। বিচলিত হলো তার দৃষ্টিজোড়া। তা দেখে নিজের ভয় গোপন করার চেষ্টা করলো শাহিনুর। চট করে দাঁড়িয়ে মৃদু পায়ে কক্ষজুড়ে হেঁটে বেড়াতে শুরু করলো৷ এহেন কাণ্ড দেখে হকচকিয়ে গেলো প্রণয়। ব্যাপারটা কি ঘটলো বোঝার জন্য ধীরগতিতে এগিয়ে গেলো সে। দরজা ধাক্কিয়ে ও’কক্ষে প্রবেশ করলো। কিন্তু শাহিনুর বিন্দু ভ্রুক্ষেপ করলো না৷ সে তার মতো মৃদ্যুপায়ে হাঁটতে লাগলো৷ প্রণয় চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ কোন সমস্যা? ‘
হাঁটা পায়ে শাহিনুর তাকে পাশ কাটিয়ে একবার ঘরের উত্তর দিক গেলো তো আরেকবার দক্ষিণ দিকে। প্রণয় পুনরায় প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হয়েছে এমন ছটফট করছো কেন? ‘
শাহিনুর তার দিকে না তাকিয়েই ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলো এবং বললো,
-‘ সারাক্ষণ বসে থাকি তাই ভাবলাম একটু হাঁটি। ‘
ভ্রুদ্বয় উঁচিয়ে শাহিনুরের দিকে চেয়ে চেয়েই পালঙ্কে গিয়ে স্থিরচিত্তে বসলো প্রণয়। পাতলা ও লম্বা গড়নবিশিষ্ট শাহিনুরের চঞ্চল দেহটা ক্রমাগত ছুটে বেড়াচ্ছে। শাহিনুরের এই অস্থিরতা কীসের বোঝার জন্যই নীরবতা পালন করছে প্রণয়৷ বাইরে তুমুল বাতাসে চারপাশ লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। আকাশের মেঘের গর্জন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে প্রণয়৷ শীতল হাওয়া কক্ষেও আসছে। সে হাওয়ার বেগ যখন তীব্র হলো শাহিনুরের আঁচল উড়তে লাগলো। সে হাওয়ায় যখন উলোটপালোট বেগ শুরু হলো শাহিনুরের হাঁটা পা থেমে গেলো। শরীরে শাড়ির আঁচলটুকু জড়িয়ে রাখতে হিমশিম খেয়ে গেলো মেয়েটা৷ একদিকে মনে তীব্র ভয় অপরদিকে বারে বারে বক্ষস্থলে চেপে রাখা আঁচলটুকুর সরে যাওয়ায় তীব্র লজ্জা। সবটা মিলেমিশে যখন সীমাহীন অস্থির হয়ে পড়লো শাহিনুর তখনি আকাশ ফাটিয়ে বিকট শব্দে বজ্রপাত ঘটলো৷ সেই শব্দে প্রণয় দিব্যি ঠায় বসে রইলো৷ অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে এতোক্ষণের চঞ্চল দেহটা আম্মা ডেকে আর্তচিৎকার দিয়ে নুয়ে পড়লো মেঝেতে৷ ক্ষণকাল স্তব্দ হয়ে বসে থেকে সহসা শাহিনুর’কে গিয়ে ধরলো প্রণয়৷ নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়ে বুঝলো বজ্রপাতের বিকট শব্দে তার অতিসাহসী মানুষ’টা জ্ঞান হারিয়েছে। এবার বুঝলো এতোক্ষণের এই তীব্র অস্বস্তির পেছনের কারণ। সন্তর্পণে বক্ষে চেপে ধরলো শাহিনুর’কে। নারী শরীরি উষ্ণতায় শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়লো প্রণয়ের। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠলো। অবাধ্য অনুভূতির আশকারা গুলো তুচ্ছ করে কয়েক পল সেভাবে থেকে পালঙ্কে শুইয়ে দিলো। শাড়ির আঁচল খুলে তখন মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কিশোরী দেহের প্রবৃত্তি জাগানো অনেকাংশই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। নিজের দৃষ্টিজোড়া সংযত করে রুদ্ধ শ্বাস ছাড়লো প্রণয়। ত্বরিতগতিতে মেঝে থেকে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে ঢেকে ফেললো শাহিনুরের বুক৷ ক্ষণকাল পূর্বে যে বুকের উষ্ণতা অনুভব করেছে সে, যেখানটায় দৃষ্টি যেতেই হৃৎপিণ্ডে ধড়াস করে ওঠেছে তার। শ্বাস-প্রশ্বাস হয়ে ওঠেছে ঘন, উত্তপ্ত। হাহ্ এ এক অসহনীয় যন্ত্রণাময় সুখানুভূতি!

চলবে…
কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ
[ সকলের মন্তব্য দেখে পরবর্তী পর্ব দেবো। সবাই সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করবেন কিন্তু… আর হ্যাঁ বাইজি কন্যা ১ম খন্ড শেষ হওয়ার পর আমার পাঠকমহলে উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা এবং রিভিউ কার্যক্রম চালু থাকবে ২য় খন্ড আসার পূর্বমূহর্ত পর্যন্ত। আসা রাখি সকলেই পাশে থাকবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here