বাইজি কন্যা পর্ব-৫

0
1010

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৫
[১১]
শাহিনুরের উন্মুক্ত পিঠে নিজ হস্তে যত্নসহকারে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলো প্রণয়। শঙ্কিত হয়ে প্রণয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। মনে করার চেষ্টা করলো এই মানুষ’টাকে সে কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় একটুও মনে করতে পারলো না। তাই ঘরে থাকা ব্যক্তিদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সঙ্গে সঙ্গেই পুরো শরীর শিউরে ওঠলো তার। কারণ রঙ্গন, রোমানা দু’জনই তাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখছে। ইতস্ততভাবে নড়েচড়ে বসলো শাহিনুর। রঙ্গনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললো। বক্ষঃস্থলে শুরু হলো ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ আওয়াজ। সম্মুখের গৌরবর্ণের সুশ্রী পুরুষ’টির দৃষ্টিজোড়া কতো মোলায়েম… অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে যে পুরুষ লোকটি বেরিয়ে গেলো সে কতোই না কর্কশ! বেরিয়ে যাওয়া পুরুষ’টিকে স্মরণ হতেই আচমকাই শাহিনুরের মনে পলাশের ভয়ংকর মুখশ্রী’টা ভেসে ওঠলো। অদ্ভুত ভাবেই দু’টো মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত মিল খুঁজে পেলো। দু’জনের গায়ের রঙ যেমন গৌরশ্যাম তেমনি মোটা জোড়া ভ্রু। বিশাল দেহের অধিকারী কর্কশময় এই পুরুষ দু’টোর কি কোন সংযুক্তি আছে? ভাবতেই গা শিউরে ওঠলো শাহিনুরের। থমথমে মুখশ্রী’তে তাকালো রঙ্গনের দিকে। ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে হাসলো রঙ্গন, বসে থাকা মোড়াটি আরেকটু এগিয়ে ডিভানের সম্মুখীন হলো। দৃষ্টি তার তখনও পলকহীন। ঐ দৃষ্টি দেখে কিছুটা লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেলো শাহিনুর। তা দেখে রঙ্গন বললো,
-‘ তো মিস.নুর এবার বলা যাবে কি তুমি ঠিক কীভাবে কাঁটার সঙ্গে মাখামাখি হলে? ‘
উৎসুক হয়ে এগিয়ে বসলো রোমানাও। বললো,
-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের পুরো ঘটনাটি খুলে বলো নুর। ‘
অবিরত ঢোক গিলতে শুরু করলো শাহিনুর। একবার রোমানা আরেকবার রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো সে ভীষণ ভীতু একটা মেয়ে। তার সে ভয়টুকু দারুণ উপভোগ করলো রঙ্গন। মুচকি হেসে বললো,
-‘ আপা নুরমনি যে খুব ভয় পাচ্ছে আমাদের। আচ্ছা আপা আমরা কি বাঘ না ভাল্লুক, এই নুর বনের ভিতর আছি বলে তুমি সত্যি সত্যি আমাদের বন্য প্রাণী ভাবছো না তো! হায় কপাল এই ছিলো আমার কপালে শেষকালে কিনা বন্য প্রাণী বানিয়ে দিলে আমায়? ‘
সকল ভয় জড়তা যেনো এক নিমিষেই কেটে গেলো শাহিনুরের। তার হরিণাক্ষ দৃষ্টিজোড়ায় ভর করলো একরাশ কৌতুহল। রঙ্গনের বলা কথাগুলো কেমন হাস্যরসাত্মক লাগলো তার কাছে। এমন সহজ,সুন্দর হাস্যজনক কথা কোন পুরুষ বলতে পারে! বিস্মিত হলো শাহিনুর। তার হৃদসিন্ধুপারে সৃষ্টি হলো ক্রমাগত ঢেউয়ের খেলা। মস্তিষ্কে কেবল বিচরণ করতে থাকলো কয়েকটি বাক্য –
-‘ এটাই কি তাহলে ভালো মানুষ? সবগুলো মন্দ মানুষের মাঝে কি একটা ভালো মানুষের দেখা মিললো? আম্মার কথা কি তাহলে সত্যি হলো? ‘
রোমানা বললো,
-‘ কি হলো নুর তুমি আমাদের ভয় পাচ্ছো কেন? আমরা খারাপ মানুষ নই আমরা দু’জনই ঐ জমিদার বাড়ির সদস্য। ও জমিদারের ছোট ছেলে আমি ওর খালাতো বোন। ‘
চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো শাহিনুর। অবাকান্বিত হয়ে বললো,
-‘ জমিদার বাড়িতে ভালো মানুষও আছে? ‘
এমন সহজসরল প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো রঙ্গন। তার গোলাপি বর্ণীয় দীপ্তমান ওষ্ঠাধরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। রঙ্গন সে অবাক দৃষ্টিতে প্রগাঢ় চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে মোহনীয় সুরে বললো,
-‘ তোমার এই হাতটা সামনে ধরে দেখো একহাতে পাঁচ টা আঙুল রয়েছে। কিন্তু এখানে একই সমান দু’টো আঙুল খুঁজে পাবেনা। ঠিক তেমনি জমিদার বাড়িতেও অসংখ্য মানুষজন রয়েছে তারা কেউই কারো মতোন নয়। এ পৃথিবী’তে প্রতিটি মানুষই বিচিত্র শাহিনুর। ‘
ভ্রু কুঁচকে সত্যি সত্যি শাহিনুর নিজের ডানহাতটা সামনে ধরলো। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো নিজের আঙুল গুলো। সত্যি একটি আঙুলও সমান পেলো না। তাই অবাক হয়ে বললো,
-‘ তুমি তো সত্যি কথা বলেছো। তুমি আসলেই ভালো মানুষ। আম্মা বলেছে ভালোমানুষ’রাই সত্যবাদী হয়।’
-‘ তাই আর কি বলেছে তোমার আম্মা? ‘
উৎসুক নয়নে আরো অনেক কথাই বলার জন্য ওষ্ঠ নড়ালো শাহিনুর কিন্তু বলা হলো না। তার পূর্বেই রোমানা বললো,
-‘ রঙ্গন তুই কি উল্টাপাল্টা কথা শুনতে চাচ্ছিস তুই আগে এটা শোন ও কীভাবে এতো ব্যথা পেলো? কি হয়েছিলো ওর সাথে? ‘
রঙ্গন বললো,
-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ নুর তুমি আগে এটা বলো তুমি ওখানে কি করে এলে? ‘
নুর বললো,
-‘ বাঁশির সুর শুনে। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেলো রোমানার, অবাক হলো রঙ্গন। বললো,
-‘ তুমি বাঁশির সুর শুনে ওখানে এসেছো? ‘
-‘ না। ‘
-‘ তাহলে? ‘
হঠাৎই বিচলিত হয়ে ওঠলো শাহিনুর। নিঃশ্বাসে বেড়ে গেলো অস্থিরতা। এদিক সেদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে বললো,
-‘ তোমরা কি বাঁশিওয়ালাকে চেনো? সে কোথায় থাকে কি নাম তার জানো তোমরা? ‘
বাঁশিওয়ালা’কে স্মরণ হতেই শাহিনুরের এমন অদ্ভুত আচরণ শুরু হওয়াতে বিস্মিত হলো রঙ্গন,রোমানা দু’জনই। ওরা কিছু বলবে তার পূর্বেই শাহিনুর নিজে থেকেই বললো,
-‘ বাঁশিওয়ালা আজ কেন দেরি করে বাঁশি বাজালো? তার সুরের অপেক্ষায় জানালার চৌকাঠে বসে থাকতে থাকতেই আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। তারপর হঠাৎ যখন বাঁশির সুর শুনলাম তখনই ওপর থেকে সোজা নিচে পড়ে গেছি। ‘
পুরো ঘটনা এক দমে বিবৃতি করে থামলো শাহিনুর। এটাও বললো সে প্রায়ই রাত জেগে বাঁশির সুর শুনে। অজ্ঞাত বাঁশিওয়ালার প্রতি যে তার অদ্ভুত টান রয়েছে সেটাও স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো ওদের। রঙ্গনের বক্ষঃস্থলে এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেলো। মাথা দুলিয়ে হাসলো রঙ্গন, পরিহিত প্যান্টের পকেট থেকে ত্বরিতগতি বাঁশি বের করে ওঠে দাঁড়ালো। শাহিনুরের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করলো। তারপর বাঁশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এক হাঁটু স্বল্প ভাঁজ করে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ রেখে ধরলো সুর, বাজলো বাঁশি। উৎকন্ঠা হয়ে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। রোমানা মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে বললো,
-‘ বাঁশিওয়ালার কাছেই বাঁশিওয়ালার খবর চাইলে? ‘
দু’চোখ জলে ভরে ওঠলো শাহিনুরের। শারীরিক যন্ত্রণাগুলো নাড়া দিলো খুব। বাঁশিওয়ালার সুর থামিয়ে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করলো খুব,
-‘ ও বাঁশিওয়ালা আজ তোমার বাঁশি এতো দেরিতে কেন বাজলো? তোমার এই দেরিটুকুর জন্য আমি কতো ব্যথা পেয়েছি জানো? ‘
ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলো শাহিনুর। তৃপ্তিসহকারে দেখতে থাকলো তার বাঁশিওয়ালাকে। ইশ কতো সুন্দর দেখতে বাঁশিওয়ালা’কে। তার কল্পনার চেয়েও বেশী সুন্দর মানুষ’টা। কল্পনার বাঁশিওয়ালার গায়ের চামড়া এতো সাদা ছিলো না। আর না ছিলো কপালজুড়ে লেপ্টে থাকা অমন বিনীত চুল। নাকটাও কল্পনায় কেমন মোটা গুরুগম্ভীর ছিলো অথচ সম্মুখের মানুষটা পুরোটাই কি প্রাণোচ্ছল। টকটকে চৌকা নাকের অধিকারী। এতো সুশ্রী পুরুষটার মোলায়েম স্পর্শে বাঁশিটাও কত্তো আনন্দে সুর দিয়ে যাচ্ছে… সীমাহীন মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন কিশোরী’র প্রগাঢ় চাহনি’তে চোয়ালজোড়া কঠিন হয়ে গেলো কর্কশময় পুরুষ’টির। আর এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে ধপাধপ পা ফেলে গৃহে পদার্পন করলো। সকল আনন্দ’কে নিরানন্দে পরিণত করে, সকল মুগ্ধতা’কে অসন্তোষে বিলিয়ে দিয়ে শাহিনুরের সম্মুখে দণ্ডায়মান হলো প্রণয়। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে রোমানার দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ এখুনি চলো এখান থেকে। ‘
তারপর রঙ্গনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-‘ আর তুই,তুইও এখুনি বাড়ি ফিরবি। বাইরে বাইজি গৃহের ভৃত্য রেশমা খাতুন দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়ে’টাকে সেই যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। ‘
শেষ কথাটুকু প্রচন্ড চিবিয়ে চিবিয়ে বললো প্রণয়। তারপর জোরে জোরে বারকয়েক শ্বাস ফেলে তাকালো শাহিনুরের দিকে। দেখলো ভীতিগ্রস্ত একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। ক্রোধে ফেটে পড়লো প্রণয়,ধমকে ওঠে বললো,
-‘ লজ্জা করে না রাতদুপুরে বাঁশির সুর শোনার জন্য উৎকন্ঠা হয়ে জানালা ঝাপটে পড়ে যাও ‘

চলবে…
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ)
[প্রিয় পাঠক নায়ক কে তা পূর্বেই ঠিক করে রেখেছি। তাই বিভ্রান্ত হবেন না। যাকে স্থির করেছি সেই নায়ক হবে ইনশাআল্লাহ। এই উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্রই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here