বাদামি সংসার পর্ব-১০

0
1325

পর্ব ১০

নব দম্পতির প্রণয়ে ধরায় নেমে এসেছে স্বর্গবাসের সুখ। উভয়ের খুনসুটি, আবেগ, নতুন প্রেমের আস্বাদন, সবমিলিয়ে দুজনেই এখন সুখের রাজ্যে ভাসছে। কোনো দুশ্চিন্তা নেই, অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি নেই, নেই কাজের চাপ। কেবলই একজনের আরেকজনকে চেনা, জানা, আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নতুন বিয়ে করলে ভালোবাসা-বাসির হাট বসে হৃদয়ে। সেই হাটে বেঁচাকেনা হয় প্রেমের উপাদান। বর তার স্ত্রীকে কিছু প্রেম নিবেদন করে, স্ত্রী সেই প্রেমটুকু শুষে নিয়ে বিনিময়ে স্বামীকেও কিছু ভালোবাসা উপহার দেয়। সেই ভালোবাসাবাসির হাটে এখন দুজন মানুষ ঘুরছে, ভাবছে, কি কিনবে? কি উপহার দেবে? ভাবনাতেই যেন কেটে যাচ্ছে তাদের অর্ধদুপুর।

রাতের খাওয়াদাওয়ার পর দুজনে ছাদে হাওয়া খেতে আসে। ছাদের এক কোণায় দোলনা রাখা। সেখানে পাশাপাশি বসে দুজনেই ভাবতে থাকে, ‘ঠিক কি বললে ওই মানুষটাকে মুগ্ধ করে দিতে পারবো?’ প্রেমে মুগ্ধতা ছাড়া কিছু নেই। বেশি বেশি মুগ্ধ করতে হবে আর বেশি প্রেম আদায় করতে হবে। প্রত্যেকটা ছেলে মেয়েরই বোধহয় এমন হয়। কাউকে ভালো লেগে গেলে তাকে আকর্ষণ করার জন্য চলতে থাকে নিত্যনতুন পরিচর্যা। সেখানে একজন আরেকজনের সাথে বাকি জীবন কাটাতে হবে। প্রেম না হয়ে উপায়ই নেই যখন, তখন তো উভয়ের উভয়কে পাগল করে দিতেই চলবে যত আয়োজন।

বাদামী সংসার
লেখক- মিশু মনি

ক্ষণিক প্রহর পেরিয়ে যায় ভাবনাতেই আচ্ছন্ন হয়ে। নীলাক্ষীর চুড়ির রিনরিনে শব্দে অম্লানের ভ্রম ভাঙে। ও ব্যকুল হয়ে জানতে চায়, ‘আচ্ছা নীলু, আমার কাছে তুমি কি চাও?’

প্রশ্ন শুনে নীলাক্ষী ভীষণভাবে চমকে যায়। ও এই মুহুর্তে ঠিক এটাই ভাবছিলো। অম্লান ওর কাছে কি আশা করে, এ প্রশ্ন ঠোঁটের আগায় এসে আটকে আছে। তার আগেই অম্লানের প্রশ্ন শুনে ওর চোখের পলক পড়তে চায় না।

নীলাক্ষী বললো, ‘আমি চাই আপনি আমাকে আগলে রাখুন। আমরা যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একসাথে থাকতে পারি।’
অম্লান বললো, ‘এ তো আমার চাওয়া। তুমি অন্যকিছু চাও?’
নীলাক্ষী কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ‘আপনি আমাকে সবকিছুর সঙ্গী করে নিন। আমরা একসাথে পথ চলবো। এটাই চাই।’

অম্লান নীলাক্ষীর একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় রেখে বললো, ‘আমি কি চাই জানো?’
নীলাক্ষী মাথাটা দুদিকে নাড়ায়। এর মানে ও জানেনা।

অম্লান বললো, ‘আমি চাই তুমি পুরোপুরি আমার হয়ে যাও। শুধুমাত্র আমার। পুরোটাই আমার। তোমার চোখ, তোমার দেহ, তোমার আত্মা, তোমার হৃদয় সবকিছু আমার হয়ে যাক। তোমার পৃথিবীটা তুমি শুধু আমাকে দিয়ে সাজাও। আমি ছাড়া যেন একটা মুহুর্ত বাঁচতে না পারো। তুমি পুরোপুরি আমার হয়ে যাও নীলু।’

নীলাক্ষী অমত্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে। অম্লানের কথাগুলি ওর হৃদয়ে তুষারপাতের মতো হিম হিম ঝড় বয়ে আনে। উত্তপ্ত হৃদয়টা হঠাৎ করেই শীতল হয়ে যায়। আচ্ছন্ন হয়ে যায় প্রেম বরফের আচ্ছাদনে। ওকে সবাই নীলা বলে ডাকে, কেউ কখনো নীলু বলে নি। অম্লানের মুখে ‘নীলু’ ডাকটা শুনে যেমন ভালোলাগে, তেমনি উষ্ণ আদর লাগে ওর এই আপন হওয়ার কামনায়। নীলাক্ষীও তো চায় অম্লানের খুব আপন হয়ে যেতে। যতটা আপন হলে আর তাকে ছাড়া বাঁচা যাবে না। যতোটা পাগল হলে আর তাকে ছাড়া পথ চলতে ইচ্ছে করবে না। এতটাই মগ্ন হতে চায় যে, মানুষটার স্পর্শ পেলেই পৃথিবীটাকে সুখে পরিপূর্ণ মনে হবে।

অম্লান কোনো উত্তর না পেয়ে ঠায় তাকিয়ে থাকে নীলাক্ষীর দিকে। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় নীলাক্ষীর গালে, চুলে, কানে। শিউরে ওঠে নীলাক্ষী। ওর কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। মনে হতে থাকে কোনো এক ঘুমপুরীতে ঢুকে যাচ্ছে ও। চোখে ঘুম ঘুম ভাব, কিন্তু হৃদয়টা জেগে আছে। যেখানে ভালোবাসাবাসির হাট বসেছে।

অম্লানের নিরবতায় নীলাক্ষীর ধ্যানভঙ্গ হয়। ও ঢোক গিলে বললো, ‘আমাকে আপনি আপনার করে নিন। এই আমার আমিটাকে পুরোপুরি দখলদারিত্বের অধিকার তো কেবল আপনারই।’

অম্লান বললো, ‘নীলু, যত সহজে সম্পর্ক ভাঙা যায় ততো সহজে গড়া যায় না। এইযে আমরা দুজনেই চাইছি একজন আরেকজনের মাঝে প্রবেশ করতে। দেখবে দেখতে দেখতে এক বছর, দু বছর, দশ বছর কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের একজনের আরেকজনকে জানাই হবে না। মানুষের সারাজীবন লেগে যায় একে অপরকে জানতে। অথচ এত বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পর্কটা কিন্তু মুহুর্তেই ভেঙে যায়। সেই দিনটা যেন কখনো আমাদের জীবনে না আসে।’

নীলাক্ষী আবছা আলোয় ফ্যালফ্যাল করে অম্লানের দিকে চেয়ে থাকে। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি আসলে খুব আবেগী একটা মেয়ে। খুব অল্পতেই কেঁদে ফেলি। এই যে দেখুন আপনার কথা শুনে আমার কান্না পাচ্ছে। আপনার কি মনে হয় আমার মতো পাগলী একটা মেয়ে কখনো আপনাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে?’

অম্লান নীলাক্ষীর চিবুক স্পর্শ করে দেখে সত্যিই সেখানটা জলে সিক্ত। অম্লান দুই ঠোঁটের কোমল স্পর্শে নীলাক্ষীর ভেজা চিবুকের জলটুকু শুষে নেয়। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় নীলাক্ষীকে। নীলাক্ষী লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, ‘কেউ দেখে ফেললে কি ভাব্বে?’

শব্দ করে হেসে ওঠে অম্লান। তারপর বললো, ‘আমার বন্ধুরা কি বলে জানো?’
– ‘কি?’
– ‘বিয়ে না করলে ছেলেরা আজীবন ধরে ভাবতো তাদের জীবনে কোনো ভুল নেই।’
– ‘মানে কি? বিয়েটা তাহলে ছেলেদের জীবনের একমাত্র ভুল? হা হা হা।’

এবার হেসে ওঠে নীলাক্ষী। অম্লান মনেমনে সেটা এতদিন বিশ্বাস করলেও আজ পরম সুখের আবেশে ওর মনে হচ্ছে বিয়েটা আরো আগে করা উচিৎ ছিলো। তাহলে আরো বেশি সময় পাওয়া যেতো এই সুখটুকু উপভোগ করার। কয়দিন ই বা বাঁচবো?

নীলাক্ষী অম্লানকে বসিয়ে রেখে ছুটে যায় নিচে। অম্লান বসে বসে গুগলে সার্চ করে কোন কবিতা’ টা আবৃত্তি করে শোনানো যায় ওকে। কোনো কবিতা- ই অম্লানের মুখস্থ নেই। সার্চ করতে করতে কিছুই যখন পেলো না, তখন নীলাক্ষী এসে উপস্থিত। হাতে দুই মগ ভর্তি চা। অম্লান খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে, ‘তুমি এজন্য নিচে গেছিলা? আর বললা কি জরুরি একটা দরকার। আমি তো ভাবলাম কি না কি..’

নীলাক্ষী মুচকি হেসে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। অম্লান এক চুমুক খেয়ে বললো, ‘কবিতা শুনবে?’
– ‘হুম শুনবো। বলুন?’
– ‘কবিতা কেউ বলে নাকি আবৃত্তি করে?’
– ‘সরি। আবৃত্তি করুন।’
– ‘কোনটা শুনবে?’
– ‘যেকোনো টা।’
– ‘আচ্ছা দাঁড়াও।’

নীলাক্ষী দোলনায় বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখে লেগে রইলো ফিচকে হাসি। অম্লান ফিক করে হেসে বললো, ‘দাঁড়াইছো কেন?’
– ‘আপনি না বললেন দাঁড়াও?’
– ‘আমি কি একাই ফাজিল? তুমিও কম নও।’

হাসি চলতে থাকে দুজনাতে। নীলাক্ষী অম্লানের পাশে বসে পা দোলাতে থাকে। অম্লান পা দুটো দোলনায় তুলে বসেছে। মাঝেমাঝে দোল দেয় নীলাক্ষী। মগ থেকে চা যাতে পড়ে না যায় সেই ভয়ে আস্তে করে দোলায়। একইসাথে দোল খায় প্রেমের তীব্র পিপাসার্ত হৃদয়খানি।

অম্লান গলা খাকাড়ি দিয়ে কবিতা আবৃত্তি শুরু করে,

এতই অসাড় আমি, চুম্বনও বুঝিনি ।
মনে মনে দিয়েছিলে, তাও তো সে না-বোঝার নয়-
ঘরে কত লোক ছিল, তাই ঋণ স্বীকার করিনি ।
ভয়, যদি কোন ক্ষতি হয় ।
কী হয়? কী হতে পারতো? এসবে কী কিছু এসে যায়?
চোখে চোখ পড়ামাত্র ছোঁয়া লাগলো চোখের পাতায়-
সেই তো যথেষ্ট স্বর্গ- সেই স্পর্শ ভাবি আজ; সেই যে অবাক করা গলা
অন্ধকারে তাও ফিরে আসে…
স্বর্গ থেকে আরো স্বর্গে উড়ে যাও আর্ত রিনিঝিনি
প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু আজ বলো, দশক শতক ধ’রে ধ’রে
ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জনস্রোতে আমাকে কি
একাই খুঁজেছো তুমি? আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি?

নীলাক্ষী কবিতা শেষে হাত তালি দেয়। কবিতার ভাষাগুলি হৃদয় থেকে উচ্চারিত হয় অম্লানের। বড় তৃপ্তি নিয়ে আবৃত্তি করেছে ও। তৃপ্তির সুধাটুকু পেয়েছে নীলাক্ষী নিজেও। রাত যত বাড়তে থাকে, দুজনের গল্প আর প্রেমের কাব্য ততোই আলোকরশ্মি বিচ্ছুরণের মতো প্রীতিরশ্মি বিচ্ছুরণ করে উভয়ের মনে ছড়াতে থাকে।

বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হয় খুব ধুমধাম করে। কত আত্মীয় স্বজন, ক্যামেরা, কত আলোকরশ্মি, সবার বাহারি জমকালো পোশাক আর বন্ধুবান্ধবদের হাসি আনন্দ। অম্লান ও নীলাক্ষী আজ ছবি তুলছে আগের দিনের চেয়ে একেবারে ভিন্নভাবে। আজ যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, খুব কাছ থেকে আলিঙ্গন করে, চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে যেভাবে ছবি তুলছিলো তাতে বন্ধুদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ওরা একজন আরেকজনের প্রেমে কিভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রেমসাগরের অতলে ডুবে ডুবে হাওয়া খাচ্ছে ওরা।

আমজাদ সাহেব মেয়েকে দেখে অন্যরকম হয়ে যান। বাবার স্নেহময় ভালোবাসাটুকু পেতে নীলাক্ষী ছুটে এসে জাপটে ধরে বাবাকে। মুখে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলে, ‘আব্বু তুমি এমন হয়ে গেছো কেন? টেনশন করছো বুঝি অনেক?’

আমজাদ সাহেব কথা বলতে পারেন না। মেয়েকে একদিন পর দেখার আনন্দে ওনার কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। আয়োজন শেষ করে নীলাক্ষী ও নতুন জামাইকে নিয়ে রওনা দেন নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

যদিও মাত্র দুটো দিন কাটিয়ে এসেছে, তবুও নীলাক্ষীর মনে হলো যেন কত বছর ধরে সে শ্বশুরবাড়িতে ছিলো। এর মাঝে যেন বহু যুগ পেরিয়ে গেছে! আপন বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে ওর বুকটা উথাল পাথাল করে। নিজের ঘরে ঢুকে কেমন যেন কান্না কান্না পায়। অম্লান ঘরে ঢুকেই বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে বললো, ‘আহ শ্বশুরবাড়ির নরম বিছানা। আজ রাতে হেব্বি মজা হবে।’

নীলাক্ষী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলো। অম্লানের কথা শুনে অগ্নিবর্ষণমুখর দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। অম্লান বলল, ‘মানে মজার একটা ঘুম হবে আরকি।’

নীলাক্ষী মুচকি হাসে। মানুষটা ভীষণ দুষ্টু। ঘরের আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখে খুব হতবাক হয়ে যায় নীলাক্ষী। নিজের সেই চেনা পরিচিত চেহারাটাকে বড় অপরিচিত লাগে ওর। নিজেকে নিজেই সুধায়, ‘তুমিই কি সেই আগের নীলা? অনেক বদলে গেছো।’ নাকে নাকফুল টায় হাত ছুঁইয়ে নীলাক্ষী অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ওর বুকের ভেতর চিনচিন করে। এই অনুভূতির কোনো উপমা হয়না। এক ধরণের আবেগী মর্মযন্ত্রণা। অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখে নীলাক্ষী। আয়নাটা ঝাঁপসা হয়ে এলে বুঝতে পারে ওর চোখ ছলছল করছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here