বাদামি সংসার পর্ব-২৯

0
1087

বাদামী সংসার
পর্ব ২৯
মিশু মনি

নীলাক্ষী তৈরি হয়ে অম্লানের সামনে এসে দাঁড়ালো।, ‘আচ্ছা তুমি এমন বিমর্ষ কেন? কিছু হয়েছে তোমার?’

অম্লান স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়, ‘হবার মতো কিছু ঘটেছে?’
‘তাহলে এমন ঝিম মেরে বসে আছ কেন?’
‘মেজাজ খারাপ।’
‘মুড সুইং?’
‘নীলাক্ষী প্লিজ। এমনিতেই মেজাজ খারাপ, আর বেশি খারাপ করে দিও না। যাও ব্যাগ গুলো রেডি করো। আমরা এখনই বের হবো।’

নীলাক্ষী বাধ্যগত স্ত্রী। স্বামীর আদেশ তো পূর্ণ করতেই হবে। অম্লানের মন মেজাজ হচ্ছে বর্ষাকালীন আকাশের মতো। ক্ষণিকেই চরিত্র পালটায়। এই পরিষ্কার, এই ধূসর তো একটু পরেই কালচে মেঘে ঢাকা। নীলাক্ষী দ্রুত ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। অম্লান একটি কথাও বললো না। নিঃশব্দে তারা বের হয়ে এলো। রুম থেকে রিসোর্টের প্রধান ফটকে পৌঁছানো পর্যন্ত অম্লানের শঙ্কা কাজ করছিল। প্রফুল্ল’র সাথে আবার দেখা হয়ে যায় কিনা। তবে এবার আর দেখা হওয়ার মতো দুর্ভোগ ঘটলো না। প্রকৃতিও সবকিছু বোঝে। দু’বার আঘাত করলে সেটার তীব্রতা অনেক্ষণ থাকবে, তৃতীয়বার আঘাত করলে ব্যথা প্রশমণের আশংকা থাকে।

বাসে চলছে দ্রুতগতিতে। খোলা জানালার বাইরে দৃষ্টি নীলাক্ষীর। কি সুন্দর সবুজ প্রকৃতি রাস্তার দুপাশে! সারি সারি বৃক্ষলতার গাঢ় সবুজ আচ্ছাদন আর ফুরফুরে বাতাসের ঝাপটায় নিজেকে সতেজ করে তুলছিলো সে। ঢাকায় ফিরে আবারও যোগ দিতে হবে কর্মব্যস্ত জীবনে।
অম্লান বললো, ‘সরি নীলু।’
নীলাক্ষী মুখ তুলে তাকায়, ‘সরি কিসের জন্য?’
‘এতক্ষণ রেগে ছিলাম তাই।’
‘হা হা। তুমি রেগে ছিলে এতে আমাকে সরি বলছো কেন?’

অম্লান এক হাত বাড়িয়ে নীলাক্ষীকে কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে। সহজ স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘নীলু, তুমি কি ভাবছো আমি কেন রেগে আছি?’

নীলাক্ষী মধুর ভঙ্গীতে হাসলো। আচমকা অম্লানের রেগে যাওয়ার কারণ খোঁজার মতো মেয়ে সে নয়। ঠুনকো বিষয় নিয়ে আবেগ চাপিয়ে কাঁদবার শখটুকু তার নেই। নীলাক্ষী আর যাই হোক, ভালোভাবে বুঝতে পারে কোন বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ করতে হবে আর কোনটা নিয়ে করতে হবে না। সে হাসিমুখে উত্তর দিলো, ‘একদমই না। মেজাজ খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি যদি কোনো দোষ করে থাকি তাহলে আমাকে বলতে পারো। নিজেকে শুধরে নেবো। অন্য কারো দোষের কারণ শুনতে চাই না।’

অম্লান মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলো, প্রফুল্ল’র সাথে হঠাৎ দেখা হওয়ার বিষয়টা নীলাক্ষীকে বলবে ভেবে। কিন্তু নীলাক্ষীর এই জবাব শুনে তার বলার ইচ্ছেটা উবে গেলো। মৃদু হাসি দিয়ে নীলুকে বুকের কাছে ধরে চুপ করে রইলো অম্লান।

নীলাক্ষী মনেমনে হাসছে। কেন যেন তার ভীষণ অদ্ভুতুড়ে মজা লাগছে। মাঝেমাঝে কারণে অকারণে মজা লাগে কেন, নীলাক্ষীর জানতে ইচ্ছে করে। আরও কত কি জানতে ইচ্ছে করে তার। যেমন, রাস্তার জ্যামে হঠাৎ করে একটা গাড়ির নিচে বোমা বিস্ফোরণ হলে বাকি গাড়িগুলোতেও আগুন লেগে যাবে কি না।

প্রফুল্ল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমি অম্লানকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রফুল্ল এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিলো। পাঞ্জাবীওয়ালা যুবক একদৃষ্টে প্রফুল্লকে দেখছে। কি এত অবলোকন করছে কে জানে!

প্রফুল্ল বললো, ‘বাদ দিন না এখন। এত সুন্দর সময়টাকে অতীতের ঘ্রাণে না মাখালেও চলবে।’
‘বেশ তো। তাহলে জায়গাটাও বদল করা যাক। চলুন না ওদিকে যাই?’
‘ওদিকে যাবেন? আচ্ছা চলুন।’

ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রফুল্ল অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বেশ তো যাচ্ছিল সময়। অম্লানের সাথে এখানেই দেখা হওয়াটা কি এতই জরুরি ছিল? প্রকৃতির খেলা ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। তবে প্রফুল্ল’র মাঝেমাঝে জানতে ইচ্ছে করে, প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে খেলা করে নাকি মানুষ নিজেই নিজেকে নিয়ে খেলা করার জন্য প্রকৃতি’র সামনে উপস্থাপন করে দেয়! ভাবলেই ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই আসে না।

রাত নেমেছে।
প্রফুল্ল রুম বদলেছে। তার মনে হচ্ছে অম্লান এখনও তার আগের রুমের পাশের রুমটাতেই আছে। অম্লান চলে যাওয়ার পর ওই ঘরে নতুন কাউকে পাঠানো হয়েছে সেটা প্রফুল্ল’র অজানা বিষয়। মনের ভেতর চাপা ক্ষোভের দল বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেয়, আবার ক্ষণিক পরেই স্তিমিত হয়ে পড়ে। কি লাভ বিক্ষোভ করে? কার জন্য করবে? কোনো অধিকার নেই!

রাতের খাবার খাওয়ার পর প্রফুল্ল ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। পাঞ্জাবীওয়ালা আগন্তুকের নাম্বার থেকে কল আসে। লোকটা ভয় ভয় গলায় জানতে চায় বিরক্ত করেছে কিনা? তার বিনয়ের রূপ দেখে মুগ্ধ হতেই হয়।
লোকটা বললো, ‘কাল সকালেই তো চলে যাবো। গল্পটা শেষ করতে হয় তো এখন।’
‘গল্প নাহয় অসমাপ্ত থাক। অন্য একদিন গল্প শোনার ছলে আবার দেখা হলো।’
‘দেখা করার আরও হাজারটা ছল আমি খুঁজে বের করতে পারবো। আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন গল্পটা শেষ করে আপনার জীবন থেকেই মুছে ফেলবেন এই অধ্যায়টাকে। আমি সেই সুযোগটাকে তো নষ্ট করতে পারি না।’

প্রফুল্ল হাসতে হাসতে বললো, ‘দারুণ কথা বলেন ভাই আপনি। আচ্ছা ঠিক আছে। আমাদের রুমে চলে আসুন।’

পাঞ্জাবীওয়ালা মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে হাজির। দরজায় শব্দ করতেই প্রফুল্ল বাইরে বেরিয়ে এলো। বারান্দার সামনে সবুজ ঘাসের ওপর পাতানো বেঞ্চিতে এসে বসে দুজনে। মাঝখানে হাত খানেক দূরত্ব। নিয়ন আলোয় হলুদাভ বর্ণ হয়েছে চারপাশের। প্রফুল্ল মনেমনে ভাবছে, অম্লান নিশ্চয়ই একবার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসবে এবং আমাকে দেখে উলটা পালটা ভাব্বে। ভাবুক, সে সুখী হতে পারলে প্রফুল্ল কেন মিছেমিছি নিজেকে পোড়াবে! অন্যমনস্ক হওয়া মনকে দ্রুত পাঞ্জাবীওয়ালার দিকে ফেরালো প্রফুল্ল। জানতে চাইলো, ‘আপনি কোথায় থাকেন সেটা অন্তত আমি জানতেই পারি?’
‘আমি কলাবাগান থাকি।’
‘হনুমানের বংশধর না তো? হা হা।’
‘তা বলতে পারেন। মানুষ আর কোথায় হতে পারলাম।’
‘হুম। কঠিন কঠিন কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। সহজ সরল কথা বলুন।’

পাঞ্জাবীওয়ালা পাশ ফিরে একবার প্রফুল্ল’র চোখে চোখ রাখলো। স্মিত হেসে বললো, ‘আপনার চুলে আলোর ঝিলিক লেগে ঝলমল করছে।’
‘এটা তো প্রশংসা হয়ে গেলো।’
‘প্রশংসা কি সহজ সরল বাক্যের মধ্যে পড়ে না?’

হেসে উঠলো দুজনেই। হাসি আড্ডার পর্ব চললো অনেক্ষণ ধরে। প্রফুল্ল ইনিয়ে বিনিয়ে বিভিন্ন বিষয় টেনে কথা বলতে চাইছে। অথচ আগন্তুক সবকিছুর অন্তরাল থেকেও উঁকি দিয়ে একটা বিষয়কেই উজ্জ্বল করে তোলে, ‘আপনার গল্পটা শেষ করবেন না?’
তার জোড়াজুড়িতে অবশেষে সমাপ্তির রেখা টানতেই হলো প্রফুল্ল’কে।

অম্লান যখন জানতে পারলো প্রফুল্ল হিন্দু, তার অবয়বে খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেলো না। যেন বিষয়টা নিতান্তই অদরকারী। দুজন মানুষের আত্মিক সম্পর্কের বন্ধনে ধর্ম বাঁধা হতে পারে না। অম্লান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রফুল্লকে খুব আয়োজন করে বিয়ে করবে। অম্লানের মা বাবা নিশ্চয় কোনো আপত্তি করবেন না।
অম্লান প্রফুল্লকে বললো, ‘কিন্তু এর জন্য অবশ্যই তোমাকে ত্যাগস্বীকার করতেই হবে।’
‘কিরকম?’
‘তোমার বাবা না মানলে তোমাকে পরিবার ছেড়ে চলে আসতেই হবে।’

প্রফুল্ল স্তব্ধ। সে যখন তখন অম্লানের কাছে এই বিষয় নিয়ে নিজের শঙ্কার কথা বলে। অম্লানকে তার বাবা মেনে নেয়া তো দূরে থাক, সম্পর্কের কথা জানতে পারলেই দ্রুত প্রফুল্লকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেবেন। প্রফুল্ল নির্ঘুম রাতে অম্লানকে হারানোর ভয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটায়। শেষ অব্দি তবে একটা উপায়ই সামনে এসে দাঁড়ালো।
প্রফুল্ল বিড়বিড় করে বললো, ‘আমাকেই এই অন্যায় করতে হবে! আমি সবাইকে কষ্ট দিয়ে সুখী হতে পারবো? বাবা আমাকে অনেক ভালবাসেন। তাকে..’

অম্লান প্রফুল্ল’র দিকে তাকালো, ‘তুমি নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করো। তোমার বাবাকে আমরা বোঝাবো। প্রয়োজনে আমার পরিবার বোঝাবে।’

প্রফুল্ল অবাক স্বরে বললো, ‘পাগলের মত কথা বলতেছো কেন অম্লান? বাবাকে যদি স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টার এসেও প্রস্তাব দেন, তিনি কি নিজের ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্মের কারো সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন? মানে তোমার বড় আপু একটা হিন্দু ছেলে নিয়ে বাড়িতে এসে উঠলো। বললো, বাবা আমি ওকে বিয়ে করবো। সেই ছেলের একটা বড় পরিবার আছে। ওই পরিবার মেনে নেবে নাকি তোমার বাবা পারবেন নিজের মেয়েকে ওই বাড়িতে পাঠাতে?’

অম্লান নিশ্চুপ। মাথাটাই ধরে যাচ্ছে। দুদিন পরপর এই একটা বিষয় নিয়ে প্রফুল্ল’র সাথে তার তর্ক বিতর্ক শুরু হয়। সেটা শেষ হয় তুমুল কথা কাটাকাটিতে। এভাবে আর কতদিন? সম্পর্কের বয়স হয়েছে অনেক। অম্লান পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। একটা চাকরি হয়ে গেলে, তখন তো পরিস্থিতি সামলাতেই হবে। অম্লান নিজেকে বললো, ‘যখন পরিস্থিতি সামনে আসবে তখন দেখা যাবে।’

কিন্তু সেই পরিস্থিতি টাই সামনে আসার আগে অন্য এক ঘটনা পরিস্থিতিকে পুরোপুরি পালটে দিলো। একদিন রাতে প্রফুল্ল’র বাবা বুঝতে পারলেন তার মেয়ে কারও সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তিনি মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, ‘ছেলের বিষদ কি?’
প্রফুল্ল দু একটা কথা বলে বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবা প্রফুল্লকে ডাকলেন, ‘কি ব্যাপার? এসব কি শুনলাম?’
‘কি শুনছো আব্বু?’
‘আব্বু ডাকটা যার কাছে শিখছো সেই বাপের কথাই বলছি।’

প্রফুল্ল অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালো। চোখমুখ পাংশুবর্ণ হয়ে উঠলো তার। বাবাকে এমনভাবে কথা বলতে সে কখনোই দেখে নি।

প্রবীর মিত্র বললেন, ‘যা শুনেছি আমি ভুলে যাবো। আশাকরি তুইও ভুলে যাবি। তুই ওই ছেলের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দে। অন্যথায় যোগাযোগ বন্ধ করার ব্যবস্থা আমাকেই নিতে হবে।’

থেমে গেলো প্রফুল্ল। পাঞ্জাবীওয়ালা কৌতুহলী মুখে প্রফুল্ল’র দিকে তাকিয়ে রইলো। হলুদাভ আলোয় প্রফুল্ল’কে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে! বিষন্ন। কোমল বিষন্নতা ভর করেছে প্রফুল্ল’র চিবুকে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here