বাদামি সংসার পর্ব-৩০

0
1131

বাদামী সংসার
পর্ব ৩০
মিশু মনি

প্রফুল্ল’র সাথে গভীর সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়েছে অম্লান। জগতের সব বন্ধনই দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। প্রফুল্ল’র দায়িত্ব নেওয়াটাও ছিল সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অম্লান সরাসরি মা বাবাকে নিয়ে বসলো। তাদেরকে মুখ ফুটে বললো, ‘আব্বু আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি।’
‘এটা তো ভালো কথা। মেয়েকে একদিন বাসায় নিয়ে আসো, আমরা পরিচিত হই।’

অম্লান মাথা নিচু করে রাখলো। ক্রমাগত অস্থিরতায় ছটফট করছে সে। বাবার সামনে কিভাবে সত্যিটা পরিষ্কার করে বলবে সেটা বুঝতে সময় লাগলো।
বললো, ‘আব্বু একটা সমস্যা আছে।’
‘যেখানে প্রেম থাকবে সেখানে সমস্যা তো থাকবেই। এখন কি করতে হবে সেটা বলো?’
‘আব্বু অনেক বড় সমস্যা। মেয়েটা না হিন্দু।’

অম্লানের মা চমকে উঠলেন ছেলের কথায়। চোখ বড় বড় করে তিনি তাকিয়ে রইলেন। অম্লান অবিচলিত ভঙ্গীতে কথা চালিয়ে গেলো, ‘আব্বু আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালবাসি। তোমরা যদি বিয়ের ব্যবস্থা না করো তাহলে খুব কষ্ট পাবো।’
‘এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। একটা মেয়ে তোমার জন্য মুসলিম হবে এটা তো সুখবর।’
‘না আব্বু। ও মুসলিম হবে কিনা আমি শিওর না।’
‘মানে? তাহলে কিভাবে কি? কিভাবে বিয়ে?’

অম্লান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘প্রফুল্ল ওর বাবা মাকে কষ্ট দিতে চায় না আব্বু। সে জন্য তোমাদেরকেই ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে। বিয়ের পর আমরা যে যার ধর্ম পালন করবো।’

এতক্ষণ সুস্থির হয়ে মা সবকিছু শুনছিলেন। তিনি এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দোয়েল, এখানে আসো তো। অম্লানকে ঘরে নিয়ে যাও। ওর মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করো।’

দোয়েল দ্রুতপদে এসে দাঁড়ালো, ‘জি মা। কি হয়েছে?’
‘তোমার ছোট’র মাথা হ্যাং হয়েছে। গরম পানি করে ওর গোসলের ব্যবস্থা করো। আর মাথায় পানি ঢালো।’

দোয়েল হতবিহ্বল অবস্থায় একবার অম্লানের দিকে তাকালো, একবার বাবার দিকে। অম্লানের করুণ মুখখানা দেখেই বুঝতে পারছে নিশ্চয় অম্লান কোনো অন্যায় আবদার করছে যেটা বাবা মা মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু আবদারটা এতবেশি ভয়ানক হবে সেটা দোয়েলও জানতো না। সে অম্লানের হয়ে সুপারিশ করতে গেছে, এমন সময় মা বললেন, ‘একটা হিন্দু মেয়েকে আমি আমার বাড়ির বউ করে আনবো এটা তোমরা দুঃস্বপ্নেও ভাব্বে না। নয়তো স্বপ্নের ভেতরেই খারাপ কিছু ঘটবে।’

অম্লান শান্ত গলায় বললো, ‘আম্মু, মেয়েটা অনেক ভালো।’
‘দুনিয়ায় আর ভালো মেয়ে পাবো না? আমি সেসব শুনতে চাচ্ছি না। মেয়েকে বলো সে যদি ধর্ম চেঞ্জ করে , পরিবার ছেড়ে চলে আসতে পারে তাহলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু ওর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো এটা তুই কখনো ভাবিস না। অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের মানসম্মান নাই? নাকি ওর বাপের সম্মান নাই? তোরা কোন আক্কেলে ভাবলি একটা হিন্দু পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তারা নাচতে নাচতে রাজি হবে? দুনিয়ায় এরকম হইছে কখনো?’

দোয়েল অম্লানের দিকে তাকায়। বিষণ্ণতা ভর করেছে ছেলেটার সর্বাঙ্গে। কি মায়া হচ্ছে তার! দোয়েল স্থির গলায় বললো, ‘মা, আমি একটা কথা বলতে চাই। আগে ওরকম হয়নাই জন্য এখনও যে হওয়া যাবে না এরকম কথা তো নেই তাইনা? আমরা ওদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যাই? দুই রীতিতেই নাহয় বিয়ে হবে। বিয়ের পর ওদের লাইফ ওরা যেভাবে ইচ্ছা কাটাক। কিন্তু বিয়েটা তো দিতে হবে।’
মা রাগত স্বরে বললেন, ‘তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারো। তবে একটা কথা বলে রাখি। ওই মেয়ে মুসলিম হলে আমার সমস্যা নেই। এই বাড়িতে এসে হিন্দু রীতি পালন করবে সেটা আমি মানবো কেন? একটা হিন্দু মেয়ে অম্লানকে বিয়ে করলে আমার সাথে অম্লানের সম্পর্ক সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। আমাকে আর কেউ কিছু বলতে আসবে না।’

মা উঠে চলে গেলেন। মেঝেতে মাথা নিচু করে বসে রইলো অম্লান। অম্লান জানতো পৃথিবীতে তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার মতো কেউ থেকে থাকলে সেটা হচ্ছে মা। অম্লানকে তিনি কলিজার টুকরো বলে ডাকেন। ভালোবাসার শুভ্র আদরের ছাউনি দিয়ে সর্বদা আগলে রেখেছেন। তিনি এত কঠোর হবেন, এটা তো কল্পনারও অতীত।

অম্লান বাবার কাছে হাত পাতে। তার আর্দ্র কণ্ঠে প্রেমহীন বেঁচে থাকার পীড়াদায়ক দিনলিপি ভেসে আসে।
‘আব্বু, আমি কি করবো এখন?’

বাবা কোনো উত্তর দেন না। শান্ত হয়ে বসে থাকেন। অম্লানের মায়ের ওপর কথা বলতে পারবেন না তিনি। ত্রিশ বছর ধরে মেয়েটা তিলে তিলে এই সংসার গড়ে তুলেছে। তিনি সেখানে অতিথির মতো কেবল ভ্রমণ করেছেন। তার সংসারের সুখ শান্তি বিনষ্ট করার মতো দুঃসাহস দেখাবেন কি করে?
বললেন, ‘তুই ভেবে দ্যাখ অম্লান। মেয়ের সাথে খোলাখুলি ভাবে কথা বল। প্রেম করার আগে আমাদের সাথে কথা বলিস নাই। এখনও আমাদেরকে প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। বড় হয়ে গেলে তোরা বাপ মাকে ভুলে যাস। বাপ মা ছাড়াই ভালো থাকবি, থাক।’

বাবাও উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন। অম্লান উদভ্রান্তের মতো দোয়েলের দিকে তাকায়। প্রেমিকের বক্ষস্থলে ব্যথার বীণা বেজে ওঠে। ক্রমাগত পীড়াদায়ক ধ্বনিতে বাজতেই থাকে। দোয়েল অম্লানের পাশে বসতে বসতে বললো, ‘এই মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে তোমার?’
‘কি বলো ভাবী? প্রেম করেছি বিয়ে করবো না?’
‘প্রেম তো অনেকের সাথেই করছো। ওদেরকে ভুলে গিয়ে এই মেয়ের সাথে প্রেম করো নাই? তাহলে একে ভুলতে পারবা না কেন?’
‘ভাবী, এইভাবে বলো কেন? আমি মেয়েটাকে ভালোবাসি। আর সব রিলেশনের মতো ওর সাথে আমার সম্পর্কটা নয়। আমরা একে অপরকে অনেক বুঝি।’

ভাবী হাসতে হাসতে বললো, ‘যদি এই মেয়ের সাথে বাকিদের মতো ব্রেক আপ হইতো, তখন কি করতা? জোর করে বিয়া করতা? তখন তো ঠিকই আরেকটার সাথে প্রেম করতা।’
অম্লান হা করে ভাবীর মুখের পানে তাকায়। তার হৃদয়ের গভীর আকুতি কারোরই বোধগম্য নয়, এটা বোঝা হয়ে গেছে অম্লানের।

অম্লান সেদিনই সন্ধ্যায় প্রফুল্ল’র সাথে দেখা করে। প্রফুল্ল চুপ করে সব কথা শুনে যায়। তারপর উত্তর দেয়, ‘আমার বাড়িতেও অবস্থা খারাপ। আব্বু আম্মু ইদানীং ভালো করে কথা বলে না। আমাকে বলে দিয়েছে যেন যোগাযোগ না রাখি। এখনও দেখা করি জানলে আমাকে আস্ত মেরে ফেলবে।’

অম্লান প্রফুল্ল’র হাত ধরে বললো, ‘জানি স্বার্থপরের মতো বলা হচ্ছে। তাও বলছি, আমার জন্য তোমার পরিবারকে ছাড়তে পারবে প্রফুল্ল?’

প্রফুল্ল’র স্থির চোখ দুটো হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। খপ করে সে অম্লানের হাত ছেড়ে দেয়। মুখ ঘুরিয়ে তাকায় অন্যদিকে। তার বাবার চেয়ে ভালো বাবা একটাও নেই দুনিয়াতে। তিনি এখনও প্রফুল্ল’র পছন্দের খাবার নিজের হাতে রান্না করেন। এখনও প্রফুল্ল’র গোসলের আগে গরম পানি করে দেন। প্রত্যেকটা মুহুর্ত পরম আদরে খেয়াল রাখেন মেয়ের প্রতি। তাকে কষ্ট দেয়ার দুঃসাধ্য প্রফুল্ল’র নেই। অতটাও নিমকহারাম হওয়া যায় না।

প্রফুল্ল বললো, ‘আমি পারবো না। তুমি পারবে আমার জন্য বাবা মাকে ছেড়ে চলে আসতে?’
‘পারবো।’

মুহুর্তেই প্রফুল্ল’র কালচে মুখ বিস্ময়ে নীল হয়ে ওঠে। অম্লানের আত্মবিশ্বাসী মুখের দিকে তাকিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে সে।

অম্লান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সে বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাবে প্রফুল্ল’র কাছে। আলাদা করে একটা বাসা নিয়ে একসাথে ছোট্ট সুখের ঘর বাঁধবে। প্রফুল্ল’র বাবা যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করবে অম্লান। ভালোবাসার জন্য এতটুকু সে করতেই পারে। কিন্তু বাঁধ সাধলেন প্রফুল্ল’র বাবা। একটা ছেলে পরিবার ছেড়ে, ধর্ম ছেড়ে তাদের কাছে চলে আসবেন, আর তিনি হাসিমুখে ছেলেটার হাতে মেয়েকে তুলে দেবেন এটা কিছুতেই হতে পারে না। তিনি এমন অনৈতিক কাজ করতে পারবেন না। তিনিও তো একজন বাবা। একটা সন্তান বাবাকে অপমান করে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেলে কতটা কষ্টবোধ হবে, তিনি সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। কিছুতেই রাজি করানো গেল না তাকে। তিনি চান প্রফুল্ল পড়াশোনা শেষ করুক, নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর স্বজাতীয় কাউকে বিয়ে করে সুখে থাকুক।

ঝামেলার সুত্রপাত এখান থেকেই। অম্লান প্রফুল্লকে অনুরোধ করলো, ‘আমিও আমার পরিবার ছেড়ে আসবো, তুমিও তোমার পরিবারকে ত্যাগ করো। দুজনে একসাথে আলাদা থাকবো। আমাদের বাচ্চাকাচ্চা হবে, তাদেরকে নিয়েই আমাদের পরিবার।’

বরফ কখনো গরম হয় না, গরম করতে গেলেই গলে পানি হয়ে যায়। এই আবদারটাও প্রফুল্ল’র কাছে সেরকমই মনে হলো, যেন গরম বরফ। দুটো মানুষ পরিবারকে কষ্ট দিয়ে একসাথে সংসার পাতবে, তারা নাকি সুখী হবে, এ কি করে হয়! যারা পেটে ধরেছেন, সেই অসহায় শিশুটিকে মানুষ করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে থাকলে কখনো এভাবে আঘাত করা যায় না।

প্রফুল্ল হঠাৎ ই কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠলো। একটা বড় দীর্ঘশ্বাসে ভেতর থেকে সমস্ত বেদনাকে নির্বাসন দেয়ার চেষ্টা করে বললো, ‘অম্লান, আমাদের একে অপরকে ভুলে যাওয়াই ভালো। তুমি তোমার ফ্যামিলিকে খুশি রাখো, আমি আমার ফ্যামিলিকে।’

প্রফুল্ল যেন সম্পর্ক ছিন্ন করার এক কঠিন দায়িত্ব অম্লানের হাতেই সমর্পণ করে দেয়। অম্লান জানে না কি করে সে প্রফুল্ল’কে ভুলে থাকবে। কিন্তু যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় প্রফুল্ল নিজেই। পরিণতি কি, তাদের জানা হয়ে গেছে। মিছেমিছি গভীরতার অতলে অবগাহন করে কি লাভ!

কিন্তু যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পর উভয়ের মন মেজাজ হয়ে উঠলো তিরিক্ষি। যেন হঠাৎ করে উপচে আসা সমুদ্রের জোয়ারে প্লাবিত হয়ে হৃদয়ের ঘরবাড়ি স্রোতের টানে ভেসে গেছে। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সমস্ত আনন্দ, খুশি আর ভালো থাকার পায়তারা। প্রফুল্ল মাঝেমাঝে কল দেয় অম্লানকে, আর কখনো থাকতে না পেরে অম্লান কল দেয় প্রফুল্লকে। সেদিন প্রফুল্ল খুব মেজাজ দেখিয়ে কথা বলে মানুষটাকে আঘাত দেয়ার চেষ্টা চালায়। এভাবেই কেটে গেছে দুটি বছর!

তবে এই দু বছরে প্রফুল্ল কতবার মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছে, বাবা মায়ের সাথে সম্পর্কটা হঠাৎ ই খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। যেটা দু বছরের ব্যবধানেও কমতে পারে নি। কখনো হঠাৎ অম্লানকে দেখতে পেলে প্রফুল্ল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরতো। প্রফুল্ল’র কোমল ওষ্ঠদ্বয়ে আদর করে দিয়ে অম্লান বলত, ‘কি করে ছিলে এতদিন আমাকে ছাড়া?’
সেদিন দুজনে খুব করে প্রেম করে। সারাদিন হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ায়, একে অপরকে গভীর আলিঙ্গনে মিশিয়ে আদর করে। কিন্তু আবারও রাতে বাড়ি ফিরে গেলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় প্রফুল্ল। মাসছয়েক এমন দেখা হয়নি। হঠাৎ বাতাসে অম্লানের বিয়ের ঘ্রাণ ভেসে আসে। প্রফুল্ল’র হৃদয় আঙিনায় দলবেঁধে ঘুরতে থাকে অম্লানকে নিয়ে জমাট বাঁধা সমস্ত স্মৃতি। যোগাযোগ না থাকলেপ যেন সম্পর্কটা থেকে গিয়েছিলো। মরিচিকার পেছনে পড়ে না থেকে বিয়ে করে ফেললো অম্লান। পরিবারের চাপ বলেও একটা ব্যাপার সবসময় ঘাড়ের ওপর লেগে ছিল। প্রফুল্ল’র আজও মনেহয়, অম্লান হঠাৎ ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলবে, ‘এতদিন কি করে ছিলে আমাকে ছাড়া?’

প্রফুল্ল’র বন্ধ চোখের পাপড়ি মেলে ধরতেই মোহাচ্ছন্ন মায়া বেরিয়ে আসে। পাঞ্জাবীওয়ালা যুবক অনুভব করতে পারে, প্রফুল্ল’র নিবিড় হৃদয়ের গুচ্ছ আবেগে পরিপূর্ণ প্রেমের সুধাটুকু। সে প্রফুল্ল’র হাতের ওপর নিজের হাত রেখে মধুর গলায় বললো, ‘আপনি ঠিক আছেন?’
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসে প্রফুল্ল হাসার চেষ্টা করে, ‘হ্যাঁ ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা নয়।’
পাঞ্জাবীওয়ালা প্রফুল্ল’র হাত ছাড়লো না। কোমল হাতের ওপর নিজের দরদি হাতের স্পর্শটুকু তার কাছেও বড় অপার্থিব বলে মনে হয়। প্রফুল্ল’র জন্য তার কেমন যেন লাগে। বুক ধকধক করছে। এই মেয়েটা এতগুলো দিন বক্ষস্থলে বাহুল্যবর্জিত প্রেম লালন করে বেড়িয়েছে। হঠাৎ করেই তার সেই প্রেমটুকু নিজের ভেতর ধারণ করতে ইচ্ছে করলো তার।

পাঞ্জাবীওয়ালা বললো, ‘রুমে যাবেন?’
প্রফুল্ল’র চোখ ছলছল করছে। আবেগের স্রোতধারায় টইটম্বুর ওই পাখির নীড়ের মতো চোখ দুটো।
প্রফুল্ল বললো, ‘যাবো না। রুমে তো আমাকে স্বান্তনা দেবার জন্য আপনি থাকবেন না। জানেন, আমার ভেতরে কত কষ্ট, আমি না এই দু বছরে ভালো করে ঘুমাতেই পারিনি। অথচ কেউ নাই আমার কথাগুলো শোনার মতো। আমার ভেতর সব কষ্ট দুমরে মুচড়ে বেড়ায়।’

পাঞ্জাবীওয়ালা শান্ত স্বরে বললো, ‘আমি এসেছি না? কত মনোযোগ দিয়ে আপনার সব কথা শুনছি খেয়াল করেননি বুঝি?’
প্রফুল্ল মাথা ঝাঁকালো, ‘হুম খেয়াল করেছি। আপনাকে বোধহয় ঈশ্বর পাঠিয়েছেন আমার কাছে। আপনি হঠাৎ এসে আমাকে কেমন বদলে দিলেন! কেন? কেন বলুন তো?’

ছেলেটি ঈষৎ হেসে বললো, ‘জানি নাহ!’

প্রফুল্ল স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। দুঃখগুলো ওকে ভীষণ নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কষ্টের এক অসহনীয় বহ্নিশিখায় ভেতরটা পুড়ছে। খা খা করছে সবকিছু। মনে ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কাঁদতে। পাঞ্জাবীওয়ালা টের পেলো প্রফুল্ল’র শরীর কাঁপছে থরথর করে। সে ভয় পেয়ে বললো, ‘প্রফুল্ল আপনি ঘরে যাবেন? রুমে নিয়ে যাবো আপনাকে? শরীর খারাপ লাগছে?’

প্রফুল্ল মাথা নিচু করে ফেললো। চোখ ফেটে জলেএ স্রোত নেমে আসতে চাইছে। বুক ভাঙা আর্তনাদ লুকাতে পারছে না সে। জোর করে কি আর এই দুঃখকে আগলে রাখা যায়?
পাঞ্জাবীওয়ালা প্রফুল্ল’র বাহুতে হাত রেখে ওকে ধরে বললো, ‘আচ্ছা আমার রুমে চলুন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। শরীর ভালো লাগলে আপনার রুমে যাইয়েন। আসুন। প্লিজ ভেঙে পড়বেন না। আপনি অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে। সব ঠিক হয়ে যাবে প্রফুল্ল।’

ছেলেটা প্রফুল্লকে ধরে এগিয়ে নিয়ে চললো রুমের দিকে। প্রফুল্ল’র শরীর খারাপ করেছে খুব। পুরো দেহ থরথর করে কাঁপছে। প্রফুল্ল মৃদু গলায় বললো, ‘জানেন, ও আমাকে অনেক ভালোবাসতো। আমার অনেক কেয়ার করতো অম্লান।’ কথা জড়িয়ে যাচ্ছে প্রফুল্ল’র। কান্নাভেজা স্বর। জড়ানো গলায় প্রফুল্ল বললো, ‘আমরা একসাথে প্রায়ই বিভিন্ন রিসোর্টে বেড়াতে যেতাম। ও আমাকে গা ঘষিয়ে গোসল করিয়ে দিতো। আমাকে তুলে খাওয়াতো, আমার হাত পা টিপে দিতো। আমি অসুস্থ হলে সবার আগে অম্লান আমাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড় দিতো। আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফের মতো ছিলাম। খালি একটা বাচ্চা নেয়া হয়নি। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি। একটা বাচ্চা নিলে ভালো হতো। অম্লান আমাকে ছেড়ে যেতে পারতো না। ও সরি। অম্লান আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমি ওকে ছেড়ে আসছি। কিন্তু আমি তো ওকে ছাড়তে পারিনি। ব্রেক আপের পর প্রত্যেকটা দিন ওকে আরও বেশি করে ভালোবাসছি। এমন কোনো দিন নাই যেদিন ওকে ভালোবাসি নাই। ও তো আমার না? ও তো আমার। ও আরেকটা মেয়েকে নিয়ে আসছে কেন এইখানে?’

যুবক বেশ বুঝতে পারলো প্রফুল্ল ভারসাম্যহীন অবস্থায় চলে গেছে। সব স্মৃতি রোমস্থন করতে গিয়ে ইমোশনাল হয়ে পড়েছে অনেক। সে পরম যত্নে প্রফুল্ল’কে তার রুমে নিয়ে আসলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনি রেস্ট করুন। একদম কথা নয়, চুপ, চুপ। একটা শব্দও করবেন না।’
প্রফুল্ল’র চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। নেশাতুর দেখাচ্ছে ওকে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল জলের স্রোত। বললো, ‘আপনি না গল্প শুনবেন?’
‘আমি সরি। আমাকে মাফ করুন। আমি ভাবিও নাই আপনি এত ইমোশনাল হয়ে যাবেন?’

‘ইমোশনাল? আমি ইমোশনাল হইছি? ধুর বাল। যাও এখান থেকে। ভালো লাগতাছে না।’

যুবক উঠে দাঁড়ালো। রিসোর্টের প্রতিটা কক্ষেই ছোট ফ্রিজে রাখা আছে কোমল পানীয়, ঠান্ডা পানি, আইসক্রিম, তাজা ফলমূল। সে ফ্রিজ খুলে একটা পানির বোতল ও আপেল বের করে আনলো। গ্লাসে পানি ঢেলে প্রফুল্লকে বললো, ‘নিন পানি খান।’
প্রফুল্ল রেগে বললো, ‘পানি খাবো কেন? আপনি আমার রুমে কি করছেন? যান তো এখান থেকে। আপনার রুমে যান।’

যুবক প্রফুল্ল’র মাথার কাছে বসে ওর চুলে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘প্লিজ শান্ত হোন। ইউ নিড টু রেস্ট। ঘুমান। রোদেলা এখনই আসবে। আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়ুন তো।’

প্রফুল্ল হঠাৎ করেই জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে হাফিয়ে উঠলো মেয়েটা। যুবক প্রফুল্ল’র কাছে আসতেই তাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে চললো। বুক ভেঙে আসতে চাইছে যেন। অনেক্ষণ কান্নার পর ধীরেধীরে শান্ত হলো প্রফুল্ল। কিন্তু গায়ের কাঁপুনি থামলো না কিছুতেই। চিন্তার ভাঁজ পড়ল যুবকের কপালে। তারও এখন খুব কান্না পাচ্ছে। মেয়েদের সব কান্নায় ন্যাকামি থাকে না। প্রিয়জনের মৃত্যুতে মানুষ যেমন হাউমাউ করে কাঁদে, সেভাবে ব্যকুল হয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েদেরকে দেখলে বুকের ঠিক মাঝখানে ফাঁকা হয়ে যায়। কষ্ট অনুভব করছে ছেলেটা নিজেও।

প্রফুল্ল মাথায় হাত বুলানোর স্পর্শ পেয়ে ক্লান্ত চোখে ধীরেধীরে ঘুম নেমে এলো। ছেলেটা চলে গেলো হাতমুখ ধুতে। তার ভীষণ মায়া লাগছে। বিষণ্ণ অনুভূত হচ্ছে। মুখে পানি দিয়ে ঘরে এসে তোয়ালে নিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে সে প্রফুল্ল’র দিকে তাকালো। নিষ্পাপ ভঙ্গীতে ঘুমাচ্ছে প্রফুল্ল। ছেলেটা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে সোফার ওপর বসলো। অজান্তেই তার চোখ চলে যাচ্ছে ঘুমন্ত প্রফুল্ল’র দিকে।

চলবে..

(ভুলত্রুটি চোখে পড়লে কমেন্টে জানানোর অনুরোধ রইলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here