বাবুই পাখির বাসা – ২ অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবুই পাখির বাসা – ২
অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কাজ করতে বসলো ঠিকই তবু মনে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই দিনগুলো |
তখন কত বয়েস ছিল সাগরনীলের ? এই পাঁচ-ছ বছর |
দুস্টু ছিল খুব | রবিবার দুপুরে ঠাকুমার পাশে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে শুয়েছিল | যেই ঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়েছেন, ব্যাস!! এক দৌড়ে বাইরের বাগানে | কিছুক্ষন তো খুব হুটোপুটি, তারপর ওই বড়ো মতন পেয়ারা গাছটা থেকে নামাতে গিয়ে পা ফস্কে একদম নিচে | ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল আর ডান পায়ের হাঁটুর কাছে কেটে গিয়েছিল অনেকটা |
সে কি যন্ত্রনা !!
চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল !!
সেই আওয়াজে বাড়ির সবাই বেরিয়ে এসেছিল বাগানে | ওর বাবা ওকে কোলে তুলে দৌড়েছিলেন হাসপাতালে | প্লাস্টার করা হাত আর চার-পাঁচটা সেলাই করা পা সেদিনের ডাকাবুকো, দস্যি ছেলেটাকে একদম কাহিল করে দিয়েছিল | ওইটুকু তো ছিল ও, কষ্ট হয়েছিল খুব | বাড়ি ফিরে এসেও খুব কান্নাকাটি করছিল, “মায়ের কাছে যাবো …” এই বলে | শিশুর মন, সব থেকে নিরাপদ আশ্রয় তো মায়ের কোলেই, আর কোথায় যাবে ?
ডান হাতে প্লাস্টার, তাই নিজের ছোট্ট বাঁ হাতটাই মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, ” মা!! আমাকে কোলে নাও ..”
ওর মা হাত বাড়িয়েছিলেন ওকে কোলে নিতে, কিন্তু তখনই রুদ্রনীল ভাইকে দেখে এমন অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছিল যে ওকে সামলাতে যেতে হয়েছিল | আসলে মা ছাড়া অন্য কারুর কথা শুনতো না রুদ্রনীল, ওরফে বাবুন, আজও শোনে না | ওর ঠাকুমা মাকে বলেছিলেন, “আজ তুমি বাবুইয়ের কাছে থাকো বৌমা, বাবুন কাঁদুক আজ একটু নিজের মতন, আমি বসছি ওর কাছে |”
কিন্তু ওর মা দাদাকে ছেড়ে ওর কাছে আসেনি | ভেবেছিলেন বড় ছেলেকে চুপ করিয়েই চলে আসবেন | আসতে সময় লেগেছিল, আর যতক্ষনে এসেছিলেন তার ছোট ছেলে অভিমানে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল, আর কোনোদিন সে মায়ের কাছে যাবো বলে বায়না করেনি |
সাগরনীলের মন খুব অভিমানী, সেই ছেলেবেলা থেকেই | আর পাঁচজন মানুষে যে জিনিস এক দুদিনে ভুলে যায়, ওর মনে লেগে থাকে বছরের পর বছর, সে ভালো মন্দ দুই | মা তো আসেনি !! মায়ের ওই প্রত্যাখ্যান খুব বেজেছিল ওই ছোট্ট ছেলের মনে | বাবার কোলেই অনেক অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল | এক দুবার মা আদর করতে এসেছিল, অভিমান করে বলেছিল,”আমাকে আদর করতে হবে না, যাও দাদার কাছে যাও | তুমি ওর মা, আমার কেউ না |”
ওর মা ভেবেছিলেন ছেলেমানুষি অভিমান | নিজের ছেলের মনের গভীরতা আঁচ করতে পারেননি, কষ্টটা ধরতে পারেননি | উনি তো ওকেও ভালোবাসতেন, সব সময় বেসে এসেছেন | ছেলে যে সেটা অবিশ্বাস করে তা উনি বুঝতে পারেননি, কল্পনাই করতে পারেননি | তাই ওকে মানিয়ে বুঝিয়ে নেবার চেষ্টাও করেননি | কত ছোট্ট বাচ্চাই তো কোনো না কোনো সময় রাগ করে বলে,”মা আমাকে ভালোই বাসে না “, বলে না ? কিন্তু সেটাই যে সাগরনীলের জীবনের একটা কঠিন সত্যি হয়ে যাবে | ওর বড় বড় সব সিদ্ধান্তের ভিত হবে তা উনি সেদিন ঘুনাক্ষরেও টের পাননি |
যতদিনে পেয়েছেন আর ছুঁতে পারেননি তার ওই অভিমানী ছোট ছেলেকে | সে ততদিনে মাকে ছাড়াই বাঁচতে শিখে গেছে | মায়ের আর কোনো জায়গা ছিল না তার জীবনে |
তবে সাগরনীলকে, ওর কষ্টটাকে খেয়াল করে দেখেছিল আর একজন |
দস্যিপোনা কমে এসেছিল হাতে পায়ে লাগায় তা ঠিক, কিন্তু ব্যথায় হেরে শান্ত হয়ে থাকার ছেলে না সাগরনীল | তাও ওই দুর্ঘটনার দুসপ্তাহ পরেও ওইরকম চঞ্চল ছেলে ছুটির দুপুরে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে দেখে, উনি বুঝছিলেন শুধু ব্যাথা না আরও কিছু হয়েছে | ওই নিষ্পাপ শিশু মুখে একটা বেমানান উদাস দৃষ্টি দেখে, ওর মনের খবর পেয়ে গিয়েছিলেন সেই মানুষটি |
তিনি ওর বাবা |
“বাবুই ? এখন একা বসে আছিস কেন রে ? কি দুস্টু বুদ্ধি আঁটছিস রে, হুঁ ?” পাশে বসে জিজ্ঞেস করেছিলেন |
“জানো বাবা, মা কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে ?”
ওর বাবা জানতেন এই প্রশ্নের কি উত্তর ছেলের মনে, তাও নিজের ভাবনা চাপিয়ে দেননি, উল্টে হেসে ওকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কাকে রে ? আমি তো জানি না |”
নির্দ্বিধায় বলেছিল, “দাদাকে | আর আমাকে একটুও না জানো বাবা | আমাকে মা ভালোই বাসে না”, চোখ দিয়ে নোনা জলের বড় বড় ফোঁটা গড়িয়ে নেমেছিল |
ওর বাবা বুঝেছিলেন যে এখন যদি ওকে বোঝাতে বসেন যে “না বাবুই | মা তোকেও খুব ভালোবাসে” সে বুঝতে চাইবে না | তাই সেদিকে না গিয়ে ওরই কথার সুর ধরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আর বাবা কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে বল তো দেখি ?”
এটা তো ভেবে দেখে নি ?
মন ঘুরে গিয়েছিল এই জিজ্ঞাসায় | সহজ কৌতূহল মাখামাখি হয়েছিল গলায়, চোখ চকচক করে উঠেছিল, অজানা আশংকায়, অচেনা আশায়, “কাকে বাবা ? কাকে তুমি সব থেকে বেশি ভালোবাসো ?”
উনি হেসে বলেছিলেন, “সে আছে জানিস একটা দস্যি ছেলে, দুপর বেলা গাছে চেপে বেড়ায় একা একা | কি নাম বল তো তার ?”
মুখ থেকে সব অন্ধকার দূর হয়ে গিয়েছিল, আনন্দে কানায় কানায় ভোরে গিয়েছিল ছোট্ট মন, বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, “বাবুই ! বাবা তুমি আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো ? কি মজা !!”
এই কথা বলেই বাবাকে একদম জড়িয়ে ধরেছিল সেদিনের সেই ছোট্ট বাবুই | সেই গরমের দুপুরে বাবা হয়ে গিয়েছিলেন ওর সারা জীবনের এক আশ্রয় | সেইদিন থেকে সাগরনীলকে এত ভালোবেসেছিলেন ওর বাবা আর এত ভাবে প্রকাশ করেছিলেন সে কথা, যে মায়ের সব না দেয়া পুষিয়ে গিয়েছিল |
বাবুইয়ের ছিল শুধু বাবা !!
আসলে হয়তো ওদের বাবা এবং মা দুজনেই দুই ছেলেকেই খুব ভালোবাসতেন | সে ভালোবাসার ধরণ আলাদা ছিল | তবে ওর বাবা নিজের বিচক্ষণতায় বলেছিলেন সেই ছেলেকে যার শোনাটা দরকার ছিল, নাহলে সে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেই ছেলেকে বলতে যাননি যার কথা বোঝার বোধই ছিল না পারতপক্ষে |
ওর মা করছিলেন ঠিক উল্টো জিনিসটা |
তাই রুদ্রনীল ওর ওই সীমিত বোধে শুধু বলেই যেত,”মা আমাকে ভালোবাসে ভালোবাসে …” সে কথাটার মানে ওর কাছে অস্পষ্ট | মায়ের কাছে শুনে শুনে বলা |
কিন্তু সাগরনীল ? সে তো কথার মানে বুঝতো | মায়ের মুখের রং বদল বুঝতো | রুদ্রনীলের এই কথা গিয়ে বিঁধতো ওর মনে | ওর কাছে মানে দাঁড়াতো, “মা শুধু দাদাকেই ভালোবাসে, আমাকে ভালোবাসে না |”
সাগরনীল এইটাই জানলো, যে ও ব্যাথা পেয়ে মায়ের কাছে যাবে বলে আব্দার করেছিল আর মা ওকে কোলে নেয় নি | এই ভেবেই বড় হলো | জানলো না যে ও ঘুমিয়ে পড়ার পর মা কত আদর করলেন | জানলো না, কারণ উনি তো বললেন না |
ওর কানে কানে তো বললেন না, “বাবুই, মা তোকে খুব ভালোবাসে |”
ঘুমন্ত ছেলেকে তো আর কোনো মা ডেকে তুলে বলেন না,”এই শোন ভালো করে মন দিয়ে, আমি তোকে ভালোবাসি | মনে রাখিস এই কথা, কাল আবার বলবো কেমন ?” আর ও যখন জেগে থাকলো উনি একটুও সময় বের করলেন না |
কিন্তু ওর প্রতিটা জেগে থাকা মুহূর্তে যেন ওর বাবা বলেছেন ঠিক সেই কথা, আর বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলে বলে সাগরনীলও যেন মনে মনে জেনেছে এইটাই সত্যি |
“বাবা কাকে ভালোবাসে সব থেকে বেশি ?”
“আমাকে!!”
“হ্যাঁ !! আমার বাবুই পাখি কে !”
মায়ের অভাবে বাবাই হয়ে দাঁড়ালেন ওর গোটা পৃথিবী |
ছেলে গাছে উঠতে ভালোবাসে বলে বানাবেন ঠিক করলেন এক ট্রি-হাউস | বাগানেরই একটা বড় গাছে | ওইটুকু বয়েসেও কিন্তু সাগরনীলের ভাবনা ছিল স্বচ্ছ, হিসেবে নিকেশ বুঝতো ভালো | ট্রি হাউসের পরিকল্পনাতে বাবার সাথে ও নিজেও যোগ দিল | তা সেই ট্রি-হাউস লোক ডাকিয়ে বানালো হলো | ঘোরানো সিঁড়ি দেয়া, একটা বেশ ভালো, বড় ঘর | একজনের জন্যে তো যথেষ্টই, দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষও আরামসে দাঁড়াতে, বসতে পারে |
বাবা ওকে কতটা ভালোবাসে তারই একটা নির্দশন ওই ট্রি-হাউস |
সেটা যেদিন একদম তৈরী হলো, সেদিন যেন আনন্দ ধরে না সাগরনীলের | তাও আরও সোহাগ ছিল পাওনা | ওর বাবা নিজের হাতে লেখা একটা বোর্ড লাগিয়ে দিলেন ওই ট্রি-হাউসের গায়ে, “বাবুই পাখির বাসা” |
সেখানেই বসে কত সময় যে কাটিয়েছে সাগরনীল, কত পড়াশনা করেছে, গল্পের বই পড়েছে | আর কোথাও না পাওয়া গেলে ওইখানেই থাকবে ও, সবাই জানতো | ওর বাবা যেন ওকে একটা আলাদা জগৎ তৈরী করে দিয়েছিলেন | আর সেই জগতেই পাখা মেলেছে ওর সব প্রতিভা, বাবার আদরে সাগরনীল সেইসব কাজে সাহস পেয়েছে যা এমনিতে হয়তো হতো না | এই যে ও ব্যবসায় নামলো, সেই মনের জোরও বাবা ওকে জুগিয়েছেন মৃত্যুর ওপার থেকে |
” তোর যা ইচ্ছে তুই করতে পারিস বাবুই, মন দিয়ে চেষ্টা করলে তোর অসাধ্য কিছুই না”, এই মন্ত্র ওর কানে দিয়ে গেছেন | সাগরনীল জানে ওর অসাধ্য কিছুই না | বুদ্ধি আর শ্রম এই দুই মিলিয়ে সব স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব | মেধা ওর এমনিই ঈশ্বরদত্ত আর ছেলেবেলার দুস্টুমি ছেড়ে একটু বড় হয়ে যেই শান্ত হলো ও, প্রতিদিন যেন আরও মেধাবী হয়ে উঠলো, আরও পরিশ্রমী | সব শিক্ষকরা বলতেন, এই ছেলে অনেক দূর যাবে | ঠিকই বলতেন |

“বাবুন তো ওখানে উঠতে পারবে না, ওর কষ্ট হবে ওটা দেখে | কেন বানালে বাড়িতে ?” এই প্ৰশ্ন করেছিলেন ওর মা, বাবাকে | না সাগরনীলের সামনে না, ও শোনেনি |
ওর বাবা কিন্তু সেদিন রুক্ষ ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, “এমন অনেককিছু বাবুই করবে, পারবে যা বাবুন কোনোদিন পারবে না | একজনের সীমাবদ্ধতা অন্যজনের পায়ের শিকল কোরো না স্বপ্না | বাবুইকে খোলা মনে বড় হতে দাও, ভালো করে বাঁচতে দাও, সাহস দাও এগোনোর |”
“কিন্তু বাবুইকে তো একদিন দাদার দায়িত্ব নিতে হবে | ওকে তো বুঝতে শিখতে হবে |”
ওদের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “এখন তো বাবুই খুব ছোট্ট, এখন এই বোঝা ওর উপর চাপিয়ে দিও না | ও বড্ডো সেনসিটিভ | এইসব এখন বলার সময় আসেনি ওকে, ওকে এখন বুঝতে দাও যে আমরা ওকেও খুব ভালোবাসি,শুধু বাবুনকে না | তুমি ওকেও সময় দাও | ”
সেদিন যেন কেউ স্বপ্নার চোখের সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল | তাই তো !! বাবুই তো সুস্থ, স্বাভাবিক তার জন্যে তো অন্য রকম ব্যবহার দরকার | কিন্তু সময় যেন আর উনার কুলোয়নি, দুই ছেলের দুরকম মা হবার |
বাবুই বেড়ে উঠেছিল উনার নাগালের বাইরে, নিজের ওই বাসায় | সেখানে ওর আর ওর বাবার এক আলাদা পৃথিবী | কেউ সেখানে বাবার সময়ের ভাগিদার না, সেখানে একটাই অক্ষয় সত্যি, “বাবা সব থেকে বেশি ভালোবাসে বাবুইকে” |
সাগরনীল বরাবরই পড়াশোনায় ভালো, বছরের পর বছর ও প্রথম হয়েছে, পুরস্কার পেয়েছে | ওর কোনো পুরষ্কার নেবার অনুষ্ঠানে কিন্তু ওর মা যাননি | ও যখন ট্রফি, মেডেল বা কাপ হাতে বাড়ি ফিরেছে, ওর মা দেখতে চেয়েছেন প্রশ্ন করেছেন কত হাসি মুখে | সেসব ওর মন দাগ কাটেনি | কি লাভ ? একবার যাওয়া যায় না ? যারা দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছে তাদের মায়েরাও এসেছেন | শুধু আসেনি ওর মা | কেন ? প্রতি বছর প্রথম হয় ও, সেটা কি একটুও আনন্দের না ?
ও শুধু শুনে এসেছে মায়ের কাছে যে “দাদাকে রেখে যাওয়া যায় না বাবুই, এই তো আমি এখন দেখছি | কত ভালো লাগছে |” একদিন দাদাকে রেখে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ওর মা হওয়া যেত না ? সাগরনীলের মনে হতো যে মায়ের কাছে ও অবাঞ্ছিত, কিন্তু ওর দোষটা যে ঠিক কি সেটা বুঝতে পারতো না | একটুও সময় নেই কেন ওর জন্যে ?
আজও ও ঠিক বুঝতে পারে না |
প্রথম প্রথম তো ছোট ছিল, উত্তর দিত না | শুধু মন খারাপ করতো | আরেকটু বড় হয়ে পালটা উত্তর দিত, “থাক আর আমার মেডেল দেখার ভান করতে হবে না | যাও দাদার ওই এ, বি, সি, দি লেখা দেখো খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে |”
আর তারও পরে, কিছু জানাতোই না মাকে | মা যেন ওর কেউ না, এই ভাবে উনার কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে | ওর মায়ের ওর কোনো কথাই যেন মনে থাকতো না |
আইআইটিতে ও পেয়ে গেছে সেই খবরও চেপে রাখলো | ওর বাবা অফিস থেকে বাড়িতে ফোন করলেন পেয়েছে কি না জানতে | তখন ও ফোনের পাশেই বসে ছিল, জানতো বাবা ফোন করবে | নিজেই ফোন ধরে খুব ধীর গলায় বাবাকে উত্তর দিল | ওর বাবা ফেরার সময় অনেক মিষ্টি, কেক নিয়ে এলেন ওর জন্যে | এসে দেখেন যে সাগরনীল বাইরে বারান্দায় একা একা উদাস মুখে বসে আছে, আর সারা বাড়ি অন্ধকার |
উনি ঢুকে এসে এল জ্বালাতেই ওর মা বেরিয়ে এসে বললেন, “আসলে আজ বাবুন ওই আলো নিয়ে খুব রাগারাগি করছিল তাই …”
সাগরনীলের হয়ে ওর বাবাই রেগে গিয়ে বললেন, “আজ বাবুই আইআইটিতে পেয়েছে, আর তুমি এমন ঘর অন্ধকার করে রেখেছো যেন কি একটা হয়েছে আমাদের বাড়িতে | ছেলেটা একা একা বাইরে বসে আছে, সেটাও কি তোমার চোখে পড়ে না স্বপ্না ? আর কিছু বিশেষ রান্নাবান্না করেছকিনা ওর জন্যে সেটা তো জিজ্ঞেস করাও ভুল |”
ওর মা অবাক হয়ে বললেন,”আমাকে তো ও বলেই নি | কি করে জানবো ? আর তাছাড়া বাবুন..”
ওর বাবার সেদিন ধৈর্যের সীমা পার হয়ে গিয়েছিল, “বাবুন, বাবুন …যথেষ্ট হয়েছে | একটা না তোমার দুটো ছেলে, ভুলে গেছো নাকি সেটা ?? আর ও বলেনি তোমাকে ? তুমি একবারও জিজ্ঞেস করেছওকে ? জানো না আজ রেজাল্ট বেরোনোর দিন ? থাক আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই …”
সেদিন ওকে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন ওর বাবা, পরেরদিন একটা দামি ঘড়িও কিনে দিয়েছিলেন | সত্যি খুব খুশি হয়েছিলেন |
আর ওর মা ?
পরের দিন সকালে ওর ঘরে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাকে একবার বললি না কেন বাবুই তোর রেজাল্ট বেরিয়েছে? ” শুধু ওরই যেন দায় |
ছেলে উদাস হয়ে বলেছিল, ” কি লাভ হতো মা বলে ? কি করতে তুমি ? এখন তো জানো, কি করছো বোলো ? ”
উনি আর কিছু বলেন নি |
সেদিনও প্রচুর দূরত্ব ছিল মায়ের সাথে, ক্রমশ সেটা আরো বেড়েছে |

কার দোষ ? শুধু ওর, শুধু ওর মায়ের ? না দুজনেরই ? নাকি পরিস্থিতির ?

আলাপ দিব্যি জমে উঠেছে স্বচ্ছতোয়া আর সাগরনীলের | প্রায়ই দেখা হয়, একে ওপরের বাড়িতেও গেছে বেশ কয়েকবার এই ক’মাসে | গল্প ওদের ফুরোতে চায় না, কত যে কথা | সাগরনীলের বইয়ের ঘর দেখে তো তোয়া অবাক হয়ে গেছে, “এত বই ? ইশ কি মজা !!”
“তুমি যেটা ইচ্ছে নিয়ে পড়ো, যখন ইচ্ছে এস”, এই বলে নিজের বাড়ির একটা ডুপ্লিকেট চাবিও ওকে দিয়ে দিয়েছে সাগরনীল | তোয়া ওকে যত দেখে ততই অবাক হয় | বাড়ির চাবি কেউ দিয়ে দেয় নাকি এই ক’মাসের আলাপে ? তা, বাকিরা যা করে তা যে সাগরনীল করে না সেটা যদিও এতদিনে তোয়াও বুঝে গেছে, তাই মনে মনে অবাক হলেও ওকে বলেনি সেটা |
মাঝেমাঝে জোর তর্ক লেগে যায় ওদের কোনো বই নিয়ে, কোনো খবর নিয়ে, বা রাজনীতি নিয়ে | সেই সময়গুলোতে অস্থির হয়ে পায়চারি করে সাগরনীল আর ওই রোগা হাত দুটো নাড়িয়ে অনেক কিছু বলে | তোয়াও নিজের বক্তব্য চোখ গোলগোল করে বলে দেয়, কেউ ছাড়ে না | তারপর তর্ক আবার মিটে আসে, কেউ একজন মেনে নেয় বা দুজনেই তর্ক করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে |
মাঝে মাঝে সাগরনীল বলে, “আচ্ছা বেশ ! আরেকটু পড়তে হবে দেখছি | এখন এই অব্দি থাক, পরের শনিবার আবার বসবো এটা নিয়ে | হার মেনে নিচ্ছি না কিন্তু, যুদ্ধবিরতি |”
তোয়াও অম্লান বদনে বলে, “হ্যাঁ আজ বিরতি, পরের সপ্তাহে তোমার পরাজয় | সে ঠিক আছে |”
তবে, তর্ক তর্কর জায়গাতেই থাকে, সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে ফেলে না ওরা | এই করে সময় ভালোই এগোচ্ছে ওদের |
তোয়ার আগমনে নীলেশ আর শ্রুতিও খুব খুশি | সাগরনীল একা একা থাকতো, ওদের চিন্তা হতো | নীলেশের ছেলে, নৈঋত, এমনিই সাগরনীলের খুব ভক্ত | দেখা হলেই চকলেট, আইসক্রিম লাভ হয় | সাগরনীলের ফ্রিজেও এইসব ঠাসা থাকে, ওর বাড়ি আসলেও হাতে স্বর্গ পায় | এখন তার তোয়াকেও খুব পছন্দ হয়েছে | সাগরনীলকে কানে কানে বলেছে, “তোয়া আন্টি খুব সুইট, তুমি ওকে বিয়ে করে নাও | আমি তোমাদের বাড়ি এসে থাকবো”|
সাগরনীল জিজ্ঞেস করলো, ” তুই চলে আসবি ? তা তোর বাবা, মা কি করবে ?”
তাতে ওর সহজ উত্তর, “ও মাঝেমাঝে বাড়ি যাব, রোজ না | মা শুধু বকে আমাকে আর পড়তে বলে | ”
তাই শুনে হেসে গড়িয়ে গেল সাগরনীল, বললো, “তোর মা আমাকে যা বকবে না এইরম করলে !! আমি রোগা সোগা মানুষ নৈঋত, তোর মা মেরে আমার হাত, পা ভেঙেই দেবে | দেখ শ্রুতি দেখ, তোর ছেলে কি বলছে |”

তোয়াকে নিয়ে অসুবিধে হয়েছে শুধু সাগরনীলের কাজের লোকটির | প্রথম দিন ওর বাড়ি গিয়েই তোয়া বলেছিল, “একি এরকম ধুলো কেন ? কাজের লোক রাখো নি ?”
তাতে একটু ভেবে সাগরনীল বলেছিল, “হ্যাঁ আছে একজন, মাসের এক তারিখে তো পাক্কা আসে |”
সেদিনই তাকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়ে গোটা বাড়ি পরিষ্কার করিয়েছিল তোয়া আর খুব ধমকেছিল, “এইবার যদি দেখি ভালো করে কাজ করছো না, একদম ছাড়িয়ে দেব |” এত কাজ সে বেচারি এত বছরে করেনি এই বাড়িতে | সব ঝেড়ে, ঝাঁট দিয়ে, মুছে তবে ছাড়া পেল | সে যদিও এই কাজ হাতছাড়া করতে চায় না | কাজ করতে হয় না এমনিতেই তার উপর ফ্রিজ থেকে যা ইচ্ছে নিয়ে খাও সাগরনীলের কোনোদিকে হুঁশ নেই, তাই সে বেকায়দায় পড়ে বললো,”আমি তো আসি, দাদাই তো দরজা খোলে না অনেকদিন, আমি কি করবো ?”
তোয়া তাও ছাড়বে না, “দরজা না খুললে ফোন করবে, ওকে না পেলে আমাকে করবে | একদম গল্প দেবে না |”
এইটা যদিও পুরোটা গল্প না, একদিন সত্যি দরজা খোলেনি সাগরনীল, ঘুমোচ্ছিল | সেটা যদিও একদিনই | তারপর সেটাকেই ভাঙিয়েই চলছিল ওই মহিলার | সে তোয়ার সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলো | ভাবলো দিব্যি তো একা ছিল এই আপনভোলা ছেলেটা, এই মেয়ে আবার কোথা থেকে জুটিয়ে আনলো রে বাবা !!
সাগরনীল ও হেসেই খুন, বললো, “বাবা!! কি বকুনি দিলে তুমি !!”
সাগরনীলের বাড়িটা ঠিক যতটা অগোছালো, তোয়ার ভাড়া করা ওয়ান রুম ফ্ল্যাটটা ঠিক যেন ততটাই সুন্দর করে সাজানো | বারান্দায় ফুল গাছ আছে, দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি | ছিমছাম, রুচি সম্মত সাজানো | সেই দেখে সাগরনীল খুব প্রশংসা করলো, বললো, “ভারী সুন্দর তোমার বাড়িটা | সময় পেলে আমার ওখানটাও একটু সাজিয়ে দিও তো প্লিজ | আমার বাড়িটা যেন একদম …মানে বাড়ি বাড়ি না | ”
দেবে বলছে তোয়া, কেন দেবে না ?
তোয়াও একটা জিনিস নিয়ে আবদার করে সাগরনীলের কাছে |
ওর ওই চুলের উপর খুব লোভ তোয়ার | হাতে পেলেই তাতে নানা রকম বাহারের ঝুঁটি, বেনুনি, খোঁপা এইসব বেঁধে দেয় | আপত্তি করে না সাগরনীল | বাকিরা তো খালি “কেটে ফেলো”,”কেটে ফেলো” করতে থাকে, তোয়া যদি ওর চুল নিয়ে একটু ছেলেমানুষি করে মজা পায়, ওর কি সমস্যা ? আর তোয়ার যেটা সব থেকে মজার লাগে সেটা হলো, ও যেমন করেই চুল বেঁধে দিক ওইভাবেই বাইরে বেরোতে কোনোদিন না করে না সাগরনীল, “তুমি থাকবে তো আমার সাথেই ? তাহলে আমার প্রব্লেম নেই | লোকে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না | ”
সাগরনীলের ঘন, কোঁকরা চুলের কথা ভেবেই তোয়া নিজের কোম্পানিতে একটা নতুন ধরণের, বড়ো দাঁতের, নিম কাঠের চিরুনিও লঞ্চ করেছে | খুব চলেছে সেটা | প্রথম যেটা তৈরী হয়ে এসেছিল সেই চিরুনিটা সাগরনীলকে দিয়েছিল তোয়া, সেও খুব খুশি সেটা পেয়ে | তোয়ার প্রশাংসা করে বলেছিল, “উফঃ ! সব দিকে বিজনেস আইডিয়া দেখতে পাও তুমি, হেব্বি ব্যাপার | এইটা বেশ ভালো জিনিস |”

আজকে, এই শুক্রবারে সাগরনীল আর নীলেশের জন্যে দারুন একটা উপভোগ্য সন্ধ্যে| |
আজ ওদের কোম্পানি অনেক ফান্ডিং পেয়েছে | আরও উন্নতি হবে এই আনন্দে খুব ফুর্তি ওদের সবার | জুবিলী হিলস এ প্রস্ট নামের পাবের একটা অংশ আজ বুক করা হয়েছে, ওদের কোম্পানির আজ পার্টি | সেখানেই নাচ, গান, পানীয়, ধোঁয়া সব চলছে | তোয়াও এসেছে আজ ওদের পার্টিতে | সবারই একজন অতিথিকে সঙ্গে আনার অনুমতি আছে, যাকে ইংরেজিতে বলে প্লাস ওয়ান | তোয়া সাগরনীলের প্লাস ওয়ান | তা সাগরনীল তো প্রথমে খুব নাচানাচি করেছে | তারপর, সন্ধ্যে যখন গড়িয়ে রাতে পৌঁছেছে প্রচুর মদ খেয়ে একদম মাতাল হয়ে গেছে | যাকে পাচ্ছে তার সাথেই খোস গল্প জুড়ে দিচ্ছে, খুব হাসছে, জোরে জোরে গান গাইছে বা মাথায় খেয়াল চাপলে অঙ্ক কষতে দিচ্ছে |
এমনিতে যে মদে আসক্তি আছে সাগরনীলের তা নয় | ওই অফিসের বা অন্য কোনো পার্টিতেই যা খায় | তবে কৎচিত কদাচিৎ আনন্দের আতিশয্যে বেশি খেয়ে ফেলে এবং তারপর আর নিজেকে সামলাতে পারে না | তখন গাড়ি চালাতে তো দেয়া যাবেই না, ট্যাক্সি করে নিজে ফেরার মতন অবস্থায়ও থাকে না | কাউকে না কাউকে বাড়ির দরজা অব্দি দিয়ে আসতে হয় | আজকে সেইরকমই একটা সন্ধ্যে | সে কি আর করার ? আগে হয় নীলেশ নিজে গেছে নয়তো অফিসে যে সব থেকে নতুন এসেছে সেই ছেলেটাকে এই কাজটা ধরিয়ে দিয়েছে | কোনো মেয়েকে তো আর বলা যায়না যে যাও তোমার মাতাল বসকে বাড়ি দিয়ে এস, কেলেঙ্কারি হবে শেষে !!
তা এতদিন নাহয় সাগরনীল একদম বিবাগী ধরনের ছিল, আজ তো তোয়া এসেছে ওর সাথে | এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে সাগরনীলের এতদিনের আলাপ পরিচয় দেখছে নীলেশ, বুঝেছে যে বিশেষ কিছুই হবে | তাই তোয়াকে দেখে আজ হাতে চাঁদ পেয়ে, অনুরোধ করলো নীলেশ, “তোয়া তুমি প্লিজ সাগরকে একটু বাড়ি অব্দি দিয়ে আসবে ? আমিই যেতাম কিন্তু অনেকটা দেরি হয়ে গেছে আর আমার বাড়ি উল্টো দিকে |”
অগত্যা, তোয়াই পার্টির শেষে বাড়িতে নামাতে এল |
কিন্তু নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে কি করে ? সোজা হয়ে হাঁটতেই তো পারছে না সাগরনীল, এদিকে হেসেই যাচ্ছে শুধু |
তোয়া খানিক ভাবলো কি করবে, তারপর ঠিক করলো, না ওকে বাড়ি অব্দি তো ছেড়ে দিয়ে আসতেই হবে| একা একা কোথায় যাবে তার নেই ঠিক | আর তাছাড়া মাতাল হয়ে কি করে সেটাও দেখা হয়ে যাবে | সজ্ঞানে তো মানুষ অনেক কিছুই বলে, কিন্তু মাতাল হয়ে গেলে তো আর নিজের আসল চরিত্র চেপে রাখা যায়না | আর সেরকম বেগতিক দেখলে ওর কাছে পেপার স্প্রে আছে, দেবে আচ্ছা করে | এই ভেবে ওর ফ্ল্যাট অব্দিই উঠে এল সাগরনীলকে ভালো করে ধরে | সে তো নিজের মনের আনন্দে লিফ্টেই বেশ জোরে গান ধরলো, তাও কি গান? না, “খাইকে পান বানারাস য়ালা”|
কেন হঠাৎ এই গান ওর মনে এলো সে আর তোয়া কি জানে নাকি ? জিজ্ঞেস করলেও যে সদুত্তর মিলতো সে আশাও ছিল না | তারপর ফ্ল্যাটে ঢুকে যা করলো সাগরনীল, তা বোধয় তোয়া নিজের সমস্ত কল্পনা শক্তি দিয়েও সাজিয়ে উঠতে পারতো না |
প্রথমে ভেতর থেকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরেই দাঁড়িয়ে থাকা তোয়াকে দেখে এক গাল হেসে বললো, “থ্যাংক ইউ তোয়া, বাই” বলে নিজের শোবার ঘরের দিকে না গিয়ে টলতে, টলতে চলে গেল রান্নাঘরে | ওর পিছন পিছন রান্নাঘরে গিয়ে তোয়া দেখলো, আলো না জ্বালিয়ে ওই বড় আলমারির আয়তনের ফ্রিজটা খুলে তার প্রায় ভেতরেই ঢুকে গেছে সাগরনীল |
“এই, কি করছো তুমি নীল ?” তোয়া গিয়ে জিজ্ঞেস করলো |
“আসতে! আসতে কথা বলো তোয়া,” গলা খাদে নামিয়ে সাবধান করলো সাগরনীল ওকে, “এই দেখো কি আছে !” বলে বের করে আনলো দুটো বড় বড় আইসক্রিমের কৌটো, একটা তোয়াকে এগিয়ে দিল |
অন্যটা হাতে নিয়ে ফ্রিজের পাশেই ধপাস করে বসে পড়লো | তারপর নানা রকম আব্দার আসতে থাকলো তোয়ার দিকে, “চামচ দাও”, “চকোলেট সিরাপ দাও”, “তোমার আইসক্রিমটা আমাকে দাও” |
তোয়া একদম অবাক হয়ে গেছে ওর কান্ড দেখে !
নেশাগ্রস্ত অবস্থায়, ফাঁকা ফ্ল্যাটে ওকে একা পেয়ে সাগরনীল অনেক কিছুই করার চেষ্টা করতে পারতো | অনেক রকম সম্ভাবনাই তোয়ার মাথায় এসেছিল | মনে অনেক অল্প আশংকাও এসে জমা হয়েছিল | কিন্তু যা শুরু হলো তাতে তোয়া হাসবে না কাঁদবে ঠিক করতে পারলো না | মাতলামি তো অবশ্যই, সুস্থ অবস্থায় এইরকম করবে না সাগরনীল |
কিন্তু এইটা ঠিক কি ধরণের আচরণ ? কে এরকম করে ? এদিকে নাকি এর নিজেস্ব কোম্পানি আছে, তার কত কাজ করে, সারাদিন কত বই পড়ছে, অঙ্ক কষছে মাথায় সর্বক্ষণ আর পার্টিতে মদ খেয়ে এসে আইসক্রিম খাচ্ছে বসে বসে ?
“আচ্ছা তোয়া, নীল এইটা না করে কি করলে তোমার ভালো লাগতো ? ও যদি মদ খাওয়ার অজুহাতে তোমার সাথে অসভ্যতা করতো, তোমার গায়ে হাত দিতে আসতো, সেটা কি বেশি পছন্দ হত তোমার ?” তোয়ার নিজের মনেই যেন এইসব প্রশ্ন ভেসে উঠলো |
তাই তো !
হঠাৎ যেন সাগরনীলকে আরও ভালো লেগে গেল তোয়ার | দেখ ! কিরম মানুষ | আসল চরিত্র চেপে রাখা যায় না, তাই ভাবছিল না তোয়া ? তা এইটাই নীলের আসল রূপ, একদম সরল, ছেলেমানুষ | সে কৌটো কৌটো আইসক্রিম খায় আর কিছুতে মন নেই তার |
তোয়াও ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো | পা ছড়িয়ে বসে, কিছুক্ষন তো একদম একমনে আইসক্রিম খেলো সাগরনীল | যেন ভুলেই গেছে যে তোয়া ওর পাশে বসে আছে | তারপর কি খেয়াল হলো হামাগুড়ি দিয়েই এগিয়ে একটা ড্রয়ার থেকে বের করলো অনেক চিপস | তোয়ার এই দেখে ভারী রাগ হলো, যত আজে বাজে খাবার | একটু বকার সুরেই বললো, “নীল, এই আইসক্রিম খেলে আবার চিপস খাবে এখন তুমি ?”
নেশার ঘোরে এমন বকা খেয়ে সাগরনীল যেন একটু ঘাবড়ে গেছে, খুব করুন মুখ করে বললো, ” বকছো কেন আমাকে ? আমার খিদে পেয়েছে তো, কি খাবো ?”
তোয়া বুঝেছে যে একে মাতাল অবস্থায় ভয় পাবার কোনো কারণ নেই | মদ খেয়ে এ একদম ছেলেবেলায় ফিরে গেছে মনে হচ্ছে, এর দ্বারা কোনো ক্ষতি করা সম্ভব না | তাই বড়দের গলায় বললো, “চুপ করে বোসো আমি ওমলেট করে দিচ্ছি | ওই চিপস খেতে হবে না | দাও, দিয়ে দাও আমাকে “, বলে হাত বাড়ালো | সাগরনীল চুপচাপ দিয়ে দিল নিজের হাতের চিপসের প্যাকেটটা | তারপর, একদম সুবোধ বালকের মতন ওখানেই বসে থাকলো | তোয়া ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম নিয়ে ওমলেট বানাতে শুরু করলো | পেঁয়াজ কুঁচিয়ে যেই না টমেটোতে হাত দিয়েছে, সাগরনীল ভীষণ বায়নার শুরে বললো , “প্লিজ প্লিজ টমেটো না | একদম না, একদম না | কড়াইশুঁটি দাও ওমলেটে|”
ওকে বেশি না ঘাঁটিয়ে “আচ্ছা” বলে টমেটো রেখে দিল তোয়া | কড়াইশুঁটি কোথায় পাবে এই এত রাতে ? পাগলের প্রলাপ যত! ওমলেট খেয়ে তো খুব খুশি হলো সাগরনীল, বললো, “বেস্ট ওমলেট তোয়া ! বেস্ট ইন দা ওর্য়াল্ড |”
তারপর থালাটা পাশেই নামিয়ে রেখে ওখানেই শুয়ে পড়লো, বললো, “ওকে বাই, এয়ারপোর্ট পৌঁছে মেসেজ করে দিও |” এয়ারপোর্ট?? মাথা গেছে এর | তোয়া ডাকলো এক দুবার কিন্তু সে একদম ঘুমিয়েই পড়েছে | শেষে ওর শোবার ঘর থেকে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে এল | মাথার তলায় বালিশটা দিয়ে, গায়ে চাদর চাপা দিয়ে দিল |
যে মাতাল সে কিছু করলো না, যে সজ্ঞানে আছে সেই নিচু হয়ে মাতালের কপালে আলতো চুমু এঁকে দিল |
“তোমাকে না ভালোবেসে পারা যায় না নীল, খুব কিউট তুমি”, সাগরনীল ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে একটু জোরেই বললো তোয়া | ওমা ! ও যেই উঠে চলে যেতে পা বাড়ালো, ঘুমের মধ্যেই সাগরনীল, “তোয়া, আই লাভ ইউ “, বলে পাশ ফিরে শুলো, চাদরটাকে মাথা অব্দি টেনে নিয়ে |
এই !! এইটা কিরম হলো ? জেগে আছে না ঘুমোচ্ছে ? আর ঘুমিয়ে থাকলে এই কথা তো বাবা ধরা যাবে না, আবার ফেলাও তো যাবে না |

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, ও ঠিক কোথায় আছে বুঝতে একটু সময় লাগলো সাগরনীলের | না, নিজের বাড়িরই রান্নাঘরে শুয়ে আছে দেখলো | তাও ভালো ! বালিশ নিয়ে এসে এখানে শুয়েছি ? নিজের অবস্থায় নিজেরই হাসি পেল ওর |
উঠে বসতেই বুঝলো মাথা একদম ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়, গলাও শুকিয়ে কাঠ আর সর্দি মতন হয়েছে | আর কেউ নেই এই ভেবে জোরেই বললো, “ও বাবা !! মদ খেয়ে আজকাল সর্দিও হচ্ছে ? অনেক বয়েস হয়ে গেছে আমার !” হাঁটু মুড়ে তার উপর মাথা নামিয়ে বসে থাকলো খানিক্ষন | এমন সময় তোয়া এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরে, জিজ্ঞেস করলো, “কি কেমন লাগছে এখন ? শরীর ঠিক আছে ?”
তোয়াকে দেখে একদম চমকে গেছে সাগরনীল, কিছুক্ষন নিস্পলক তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে | তোয়া রাতে আর বাড়ি যায়নি, এই প্রথম এইখানেই থেকে গেছে | সাগরনীলের কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল| তারপর ওরকম রান্নাঘরের মেঝেতেই শুয়ে ঘুমোচ্ছিলো দেখে, একা রেখে যেতেও ইচ্ছে করলো না | তার উপর ওই “আই লাভ ইউ ” সেটাও মাথায় ঘুরছিল | রাতেই পার্টির ড্রেস ছেড়ে পরেছে সাগরনীলেরই একটা টিশার্ট আর শর্টস | অন্যরকম লাগছে ওকে এই অদ্ভুত সাজপোশাকে | সাগরনীলের মনে হলো তোয়া যেন বহুকাল এই বাড়িতেই থাকে, ওর সাথে | এইভাবেই মাঝে মধ্যে ওর জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় বাড়িতে, এইসব ভেবে ফিক করে হেসে ফেললো | তোয়া চোখ পাকিয়ে বললো, “খুব হাসি না ? এখনো নামেনি নাকি নেশা ?”
এই রে !! রাতের কিছু কথা ওরও ভাসা ভাসা মনে আছে, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “এই সরি সরি | ভেরি সরি, খুব কি ছড়িয়েছি কাল ? তোমাকে কিছু উল্টো পালটা বলেছি নাকি ? তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না, আর হবে না এরকম,” তারপর নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ভীষণ মাথা যন্ত্রনা করছে | কেন যে কাল ড্রিংক করতে গেলাম !”
তোয়া তো খুব হাসলো কাল রাতের সব কীর্তি মনে করে, বললো, “যাও ফ্রেশ হয়ে এস | আমি ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি |”
একদম চান করেই ফিরে এল সাগরনীল | এসে দেখলো তোয়া পাউরুটি আর মাখন বের করেছে জল খাবারে | ও কফি বানিয়ে আনলো | খেয়ে দুজনেই ব্যালকনিতে এসে বসলো | প্রায় এগারোটা বাজে, রোদ অন্যদিকে ঘুরে গেছে | এইটা পূর্ব দিকের ব্যালকনি, এখানে এখন ছায়া |
চোখ বন্ধ করেই বসেছিল সাগরনীল, তোয়াই জিজ্ঞেস করলো, “মাথায় ব্যাথা করছে এখনও ?”
“হুঁ, ওই অত আইসক্রিম খেয়েছি বলেই যেন আরো লাগছে মাথায়, গলায়ও ব্যাথা করছে |”
আইসক্রিম শুনেই তোয়া হেসে ফেললো জোরে, বললো, “সত্যি বাবা !! কি যে করছিলে কাল রাতে তুমি ! প্রায় এক বাক্স আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছো একসাথে !” বলেই আবার খুব একচোট হাসলো, “আর যা প্রলাপ বকছিলে, কি এয়ারপোর্ট, ওমলেটে কড়াইশুঁটি, উল্টো পালটা !”
ওর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সাগরনীল কিছুক্ষন, তারপর চোখে, মুখে দুস্টুমি ফুটিয়ে বললো, “সব প্রলাপ না, আমার ওমলেটে কড়াইশুঁটি সত্যি ভালো লাগে | ওটা আমার সব থেকে প্রিয় সবজি | আর …”
তোয়া তো ওর কথা শুনে আরও হাসছে, জিজ্ঞেস করলো , ” প্রিয় সবজি !! আর ? আর কি ?”
সাগরনীল নিজের মুঠোবন্ধ ডান হাতটা এগিয়ে দিল তোয়ার দিকে |
“কি ?” তোয়া বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো |
“আই লাভ ইউ তোয়া”, বলে নিজের মুঠোটা ওর সামনে খুলে ধরলো |
সাগরনীলর হাতের পাতায় একটা আংটি রাখা | অনাড়ম্বর দেখতে সোনার আংটি, তাতে একটাই বেশ বড় মাপের হিরে বসানো |
সব প্রলাপ না….

আজ একটু অবসর পেয়ে পুরোনো অ্যালবাম খুলে বসেছেন স্বপ্না | নিজের দুই ছেলের ছোটবেলার ছবি দেখছেন |
বাবুন আর বাবুই, রুদ্রনীল আর সাগরনীল |
একজনকে রোজ দেখেন আর অন্যজন ? সেই পাঁচ বছর আগে শেষবার দেখেছেন | আবার দেখবেন এই আশা উনি আর করেন না | এত রাগ, এত বিতৃষ্ণা ওর নিজের মায়ের প্রতি !
অথচ অন্য সবাই বলে সাগরনীলের মনটা নাকি খুব নরম, একবার তাকে ভালো করে চিনলে তার মতন মানুষ হয় না | এত ভালো নাকি সে | শুধু মায়ের জন্যেই এক ছটাক মমতা নেই ওর মনে ?
তবে তার জন্যে উনি ওকে দোষ দিতে পারেন না | আজ সত্যি পিছনে ফিরে যখন দেখেন তার এই অভিমানী ছোট ছেলের কষ্টটা দেখতে পান | উনিই হয়তো দূরে সরিয়ে দিয়েছেন ওকে |
রুদ্রনীল জন্মানোর পরেই বোঝা গিয়েছিল যে ও ঠিক আর পাঁচটা বাচ্চার মতন নয় | তখনকার দিনে ওই মফস্বলে, ডাক্তারও ঠিক করে বলতে পারেননি যে কি হয়েছে | তবে সে স্বাভাবিক না, এটাই ছিল চরম সত্যি | স্বপ্না প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিলেন, বাকিদের মতনই | তারপর মন শক্ত করেছিলেন, উনি চেয়েছিলেন ওকে নিয়েই থাকতে | ওকেই যত্ন করতে | উনার স্বামী সেটা মানতে পারেননি | নীলাদ্রি বলেছিলেন আরেকটা সন্তান উনার দরকার, যে সুস্থ, স্বাভাবিক হবে | যে নাকি বয়েসকালে অবলম্বন হবে | যেটা বলেননি সেটা হলো যে দরকার এমন একটা সন্তান চান যে উনার বোঝা হবে না |
সেই সন্তান সাগরনীল, বাবার দেয়া ডাকনাম তার বাবুই |
সে বাবার স্বপ্নের উপাদান দিয়ে গড়া, একদম মনের মতন | বাবার মতোই তার রোগারোগা চেহারা | বাবার সাথে মুখেরও মিল আর মনেরও | বই পাগল বাবার, যোগ্য ছেলে | জড়বুদ্ধি দাদার ভাগের বুদ্ধিও যেন সাগরনীলের কাছে এসে পড়েছিল | মেধাবী ছেলে আর সেরকমই পরিশ্রমীও | বাবা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন, আর এই ছেলে সেই সব যেন অক্লেশে পূরণ করে দিত | বাবুন ওর পাশে কোথায় লাগে ?
স্বপ্না প্রায়ই ভাবেন, “আচ্ছা বাবুই কি ছোটবেলাতেই বুঝতে পেরেছিল যে মা ওকে জন্ম দিতেই চায়নি ? তাই কি ওর এত রাগ ? না না, তা কি করে হয় ?”
উনি নিজের মনেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছেন আজ অনেক কিছু | আসলে এই বাবুনকে একা হাতে সামলে উনি কিছুতেই ওই চঞ্চল ছেলেটার জন্যে সময় বের করতে পারেননি সেভাবে | না, আজ আর অজুহাত দেবেন না মায়ের ভালোবাসা বাবুনই পেয়েছে, বাবুই নামের ওই মিষ্টি ছেলেটা পায়নি |
আসলে অন্য কেউ বাবুনকে ভালোবাসতো না | তাকে ভালোবেসে লাভ কি ? সে তো তোমার কথাও বুঝবে না | প্রথমেই একজন আয়া রেখে দেবার চেষ্টা হয়েছিল | ওই বাবুই যখন একদম ছোট, কিন্তু সে ঠিক করে দেখাশোনা করতো না | তাই বাবুই একটু বড় হতেই আবার উনি বাবুনের সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন আর সেই করতে বাবুইকে সময় দেয়া হলো না | ওর দেখাশোনা করতে গিয়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন স্বপ্না ধীরে ধীরে | কেউ দেখেনি, কেউ সাহায্য করতে আসেনি | কি ভীষণ নিঃসঙ্গ জীবন উনার | বাকিরা ওদের দুজনকে বাদ দিয়েই জীবনে এগিয়ে গেছে |

বাহ্ রে ! স্বপ্নার ইচ্ছে করতো না বাবুইয়ের সাথে খেলতে ? ওকে আদর করতে ?
দুই ভাইকে একসাথে বসিয়ে রাখতেন তাও যখন একদম ছোট ছিল | কিন্তু বাবুই একটু বড় হতেই এমন চঞ্চল হলো, সে দাদার সাথে বসে বসে খেলবে কি ? ঘরে এক মিনিট থাকতো না | সারাক্ষন শুধু দৌড়ে বেড়াতো, গাছে উঠতো, হাজার দুস্টুমি তার | বকলেও একটা খুব দুস্টু হাসি হাসতো, সবাই গোলে যেত সেই দেখে | স্বপ্না যদি জোর করে ওকে ঘরে ধরে আনতে চাইতেন, তাহলে ওদের বাবাই রাগ করে বলতেন, “ওকে টানাটানি করছো কেন ? খেলতে দাও নিজের মতন |”
আর বড় হয়ে যখন শান্ত হলো ? তখন ওর সাথে আর কি খেলতে পারতো নাকি ওর দাদা | একাই দাবা, স্ক্রাবেল, সুডোকু, ক্রসওয়ার্ড | স্বপ্না দেখতেন, ইচ্ছে হতো একবার পাশে বসে দেখার | কিন্তু এ সুযোগ কোই পেলেন ?
কেউ যদি বাবুনের দ্বায়িত্ব নিত একটু সময়ের জন্যে তাহলেই তো উনি সেইসব করতে পারতেন | কিন্তু কে নেবে ?
ওদের বাবা তো একবার বলেছিলেন যে একটা হোমে রেখে আসা হবে, বলেছিলেন, “বাবুই খুব ব্রাইট | ওকে আরও সময় দিতে হবে | বাবুনের সাথে আর সময় নষ্ট কোরো না স্বপ্না | আমি মানছি ওকেও আমরা ভালোবাসি কিন্তু ওকে বাড়িতে রেখে বাবুইয়ের প্রতি অন্যায় হচ্ছে |” স্বপ্নাই আটকেছিলেন | সে তো নিজের কষ্টটুকুও বলতে পারে না, হোমের লোকে কি করে বুঝবে ? বাবুনের কি দোষ ?
উনার শ্বাশুড়ি বলতেন, “বাবুন থাক না ঘরে | একটু কাঁদলে কিছু হবে না “, “ওকে ছেড়ে বাবুইকে দেখো, তোমার দুটো ছেলে ভুলে যেও না”
না, উনি ভুলে যাননি |
মুশকিলটা হলো উনি তাকে ভুলে যাননি যাকে বাকিরা ভুলে যেতে চাইতো বরাবরই | ডাক্তারও বলেছিলেন বড় জোর দশ, বারো বছর বাঁচবে | সেই ছেলে আজ পঁয়ত্রিশ পেরিয়েছে | বড্ডো ক্লান্ত স্বপ্না ওর দেখাশোনা করে করে | একা আর পারেন না, বয়েস হয়েছে তো | এখন একজন আয়াই দেখে |
আচ্ছা উনিই কি বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন নিজের বড় ছেলের সাথে ? আরেকটু কি ছেড়ে দেয়া যেত না ? সারাজীবন নিজেকে ওর সাথে ঘর বন্দি করে ফেলাটা কি ঠিক হয়েছে ?
এখন উনার মাঝে মাঝে মনে হয় উনিও বুঝি ভেবেছিলেন যে উনার বড় ছেলে সীমিত আয়ু নিয়ে এসেছে | ওই দশ, বারো বছর বাঁচবে | তাই কি উনি এত যত্ন করতেন ওকে ? ভেবেছিলেন হারিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি আর তারপর উনি শুধু ছোটছেলেরই মা হয়ে থাকবেন বাকি জীবন ? যদি আগেই জানতেন যে বাবুন এত দিন থাকবে তাহলেও কি উনি… ?
নিজের এই ভাবনায় উনার নিজেরই লজ্জা লাগে | এই কিসব চিন্তা ভাবনা ? উনি না মা ?

আজ পুরোনো ছবি দেখে স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছেন | বাবুই, ছেলেবেলায় খুব মিষ্টি দেখতে ছিল | একটু গোলগাল, এক মাথা কোঁকড়া চুল | ওকে না ভালোবেসে পারা যায় ? বাবা, ঠাকুমা, পিসি, পিসেমশাই সবাই ভালোবাসতেন | একজন সুস্থ, স্বাভাবিক, চঞ্চল বাচ্চা তাকে নিয়ে মানুষ আনন্দ করবে এতে অবাক হবার কি আছে ? সেখানে বাবুন ? সে না পারতো নিজে ভালো করে হাঁটতে, না ঠিক করে কথা বলতে | তাকে সবাই দ্বায়িত্বের খাতিরে ভালোবাসতো, কেউ মন থেকে না সেভাবে, মা ছাড়া | উনি এইটাই বাবুইকে বোঝাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি |
আজ উনার মনে প্রশ্ন উঠছে | ঠিক কি চেয়েছিলেন উনি সাগরনীলের কাছে ? যে ও মায়ের সময় দাবি করবে না, ভালোবাসা চাইবে না কিন্তু দাদার জন্যে করা মায়ের ত্যাগকে সম্মান করবে ? সেটা তো অন্যায় চাহিদা, নয় কি ?
উনি জানেন, উনি একবারও যাননি ওর স্কুলের পুরস্কার বিতরণী দেখতে | সেটা নিয়েও সাগরনীলের খুব অভিমান ছিল | তখন ভাবতেন বাবুন একা থাকবে কি জানি কি করবে ? এখন ভাবেন একবার, দুবার গেলে কি এমন ক্ষতি হতো ? বাবুই এত আশা করে থাকতো, উনি যেতেন না বলে দুঃখ পেত, সেটা কি উনার উচিৎ হয়েছিল মা হিসেবে ? না উচিৎ হয়নি | একবার যদি ওদের বাবা থেকে যেতেন বাবুনের কাছে তাহলেই তো স্বপ্না যেতে পারতেন | না, সে থাকবে না | বলতেন, “তুমিও চলো, বাবুনকে ঘরে তালা দিয়ে রেখে যাও না | কি সমস্যা ?”|
সমস্যা ছিল তো, পারেননি তাই |
এখন ভাবেন বাবুই ঠিকই বলতো, “তুমি দাদার মা,আমার কেউ না |” কিন্তু উনি শুধু যে ওর স্কুলে যাননি তা তো না, উনি কোথাও যাননি | দোকানে, বাজারে, কোনো আত্মীয়ের বাড়ি, পুজোতে ঠাকুর দেখতে গেছেন ? না | সে খবর কে রেখেছে ?
রুদ্রনীলের একনিষ্ঠ সেবিকা, তার মমতাময়ী মা হওয়া সহজ ছিল না | উনি তাই হতে পেরেছেন, বছরের পর বছর | যার জন্যে কষ্ট স্বীকার করা সেই কিছু বোঝে না, তবুও করেছেন |
সাগরনীলের মা হওয়া সহজ ছিল, সৌভাগ্যেরও ছিল | সেটাই উনি হতে পারলেন না নাকি স্বেচ্ছায় হলেন না ? ওকে সবাই ভালোবাসে এই ভেবে উনি আর নিজের ভালোবাসাটা ওকে বোঝাতে গেলেন না ?
রুদ্রনীল ওরকম ভাবেই বেঁচে আছে সেখানে অন্য একটা সুস্থ সন্তানের সান্নিধ্য, তার সাথে আনন্দ করা সেটা কি উনার বিলাসিতা মনে হতো ? নাকি অপরাধ মনে হতো ? বড় ছেলের প্রতিবন্ধকতার জন্যে কি নিজেকে দায়ী করতেন উনি ? কে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে ?
স্বপ্না মনে মনে ভাবতেন যে বাবুই বড় হয়ে বুঝবে ঠিক মাকে | কিন্তু ওর বাবা এমন করে ওর মনের সবটা দখল করে নিলেন যে সেখানে আর মায়ের জন্যে মায়া, মমতা, প্ৰয়োজন কিছুই থাকলো না | রইলো শুধু অভিমান | আর সেই অভিমানের কি তীব্রতা, কি তার ঝাঁঝ !
বাবা অসুস্থ শুনেই ছুটে এসেছিল দিল্লি থেকে, তাও শেষ দেখা হয়নি | ম্যাসিভ হার্ট এট্যাক হয়েছিল নীলাদ্রির, ও এসে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ | সেদিন সাগরনীলের প্রতিক্রিয়া দেখে স্বপ্না বুঝেছিলেন যে উনার স্বামী ওই ছেলেটার জন্যে ঠিক কতটা ছিলেন | আগে আন্দাজ করতেন, সেদিন প্রতক্ষ করলেন |
একটা বছর তেইশের যুবক যে বাবার মৃত্যুতে ওই ভাবে কাঁদতে পারে, উনি চোখের সামনে না দেখলে বিশ্বাস করতেন না | ওকে দেখে বাকিরা কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল | নিঃশব্দ সে কান্না কিন্তু যেন হাহাকারের মতন বাজছিল সবার কানে | থামানো যাচ্ছিলো না, কেউ সামলাতে পারছিলো না | যেন পৃথিবীতে ওর একমাত্র আশ্রয়টা কেড়ে নিয়েছেন ভগবান | এই সুবিশাল পৃথিবীতে যেন আর কেউ নেই ওর, “আমি কি করে বাঁচবো ?” এই কথার রকম ফের শুনেছিলেন ওর মুখে | আর উনি যখন মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন, “বাবুই, আমি আছি তো…”, এই বলে ?
ওরে বাবা !! এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছিল উনার হাত, ” ছেড়ে দাও আমাকে একা | ওটা বাবার দেয়া নাম, ডেকো না আমাকে ওটা ধরে “| বাবার প্রতি যত অনুরাগ, মায়ের জন্যে ওর মনে পুষে রাখাছিল ঠিক ততটাই বিরাগ | তাও আজ প্রায় দশ, এগারো বছর পেরিয়ে উনি দেখতে পাচ্ছেন সেদিনও উনি চেষ্টা করতে পারতেন ওকে কাছে টানার |
করেননি | তাহলে ওর দোষ দেন কি করে ?
ওইরকম সাংঘাতিক কান্নকাটি করে নিজেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সাগরনীল | এমনিতেই রোগা মানুষ, অতো দূর থেকে এসেছিল, এসেই এইরকম ধাক্কা …সব মিলিয়ে খুব কাহিল হয়ে গিয়েছিল | ধুম জ্বর বাঁধিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ একদম বেহুঁশ অবস্থায়, বিছানায় পড়েছিল | ওর পিসি,অঞ্জনা, আসানসোলেই থাকেন, আর নিজের এই ছোট ভাইপোকে খুব ভালোও বাসেন | মায়ের জায়গায় সেদিন পিসিই বসে থেকেছে ওর মাথার কাছে | পিসি আর পিসেমশাই | ডাক্তার দেখানো, দেখাশোনা করা সব উনারাই সামলেছিলেন |
আর স্বপ্না ?
বাবা যে মারা গেছে সেটা তো উনার বড় ছেলে বুঝতেই পারেনি | “বাবা কোই?” এই প্ৰশ্ন করে করে নিদারুন অশান্তি শুরু করেছিল, জিনিসপত্র ছুঁড়ে, ভেঙে কি কান্ড ! তাকে সামলাতেই তো উনার সমস্ত শক্তি চলে গিয়েছিল | নিজের শোকই উনি ছুঁয়ে দেখার সময় পাননি যেন | সাগরনীলের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাবেন কি করে ?
তবে শুধু কি সেটাই কারণ ? উনি সেদিন অপমানে যাননি, সেটাও তো সত্যি | সবার সামনে যে ভাবে সাগরনীল মাকে অপদস্ত করেছিল, “ছেড়ে দাও আমাকে ..”… এই বলে উনি ওর কেউ নন বুঝিয়ে দিয়েছিল, সেটা উনার মনে বাজেনি ? তাই তো আর যাননি ওর কাছে |
এখন ভাবেন, বাবার শোকে বলে ফেলেছে ভেবে ক্ষমা করে দিতে পারতেন না ? নিদারুন ধাক্কা খেলে মানুষ বলে না যে “আমার সান্ত্বনা চাই না, আমাকে একা ছেড়ে দাও”? তখন তাকে যারা ভালোবাসে তারা কি সত্যি একা ছেড়ে দেয় ? না, একদম না | উল্টে আরও আগলে রাখে | তাহলে উনি কেন সেদিন ওর পাশে থাকলেন না ? সেটা যে ওর মনের কষ্টের কথা, উনি মা হয়ে বুঝলেন না ?
সাগরনীল ফিরে যাবার পরে, অঞ্জনা কিন্তু এসে উনার কাছে অভিযোগ করেছিল, “সাগর কিন্তু ভালো করে সুস্থ না হয়েই ফিরে গেল | দাদা চলে যাওয়াতে বেচারা একদম ভেঙে পড়েছে | তুমি একটু ওর কাছে বসতে অব্দি এলেনা বৌদি | ওর সাথে কেন যে এরকম কোরো তুমি আমি বুঝতে পারিনা, ও কিন্তু এইগুলোতে খুব কষ্ট পায় “|
আজ ভাবলেন, কি কৈফিয়ত উনি দেবেন নিজের ব্যবহারের ? সাগরনীলেরই দায় ছিল মাকে বোঝার, উনি কবে চেষ্টা করলেন ছেলেকে বোঝার ?

অথচ উনি কিন্তু ওকে সত্যি ভালোবাসেন | সব সময় চেয়েছেন যে ভালো থাকুক, উন্নতি করুক | তবুও শুধু উনার জন্যে ছেলেটার জীবনটাই কেমন খাপছারা হয়ে গেল | উনার প্রতি রাগটা এত বড় হলো যে সাগরনীল নিজের ভালোবাসাটা অব্দি ছুড়ে ফেলে, পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল একদিন |
সাগরনীলেরই ছোটবেলার বন্ধু ছিল সঙ্গীতা | নরম সরম মেয়ে, খুব মিষ্টি | রুদ্রনীলকে দাদা বলে ডাকতো, ধৈর্য ধরে খেলতে ওর সাথে | বড় হয়ে সাগরনীলের সাথে মন দেয়া নেয়া হয়েছিল | স্বপ্নার সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল, ভেবেছিলেন, ওকেই সোপান করে পৌঁছে যাবেন একদিন ছেলের কাছে | বিয়ের কথা বলতেই এসেছিল সাগরনীল | তখন সবে সবে স্টার্টআপ শুরু হয়েছে, হায়দেরাবাদেও এক বছর আগেই গেছে | তখনও বেশ ভালো মাইনের চাকরি করে | বৌভাত ও হায়দেরাবাদে করবে, এই ইচ্ছে ছিল | বলেছিল, “বাবা তো নেই আর, এখানে অনুষ্ঠান করলে প্রতি মুহূর্তে বাবাকে আরও মিস করবো আমি |”
সেটা অন্যায্য কথা না | ও যে মাকে যেতে বারণ করেছিল এরমও না, কিন্তু উনি হয়তো যেতে পারবেন না সেটা কি জানতো না ? প্রথমে কলকাতা যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে ফ্লাইট | রুদ্রনীলকে নিয়ে অতদূর যাওয়া সোজা কথা না, প্রায় অসম্ভব |
সঙ্গীতা নিজের ভালোবাসার উপর ভরসা করে জেদ করেছিল, ” বাবা নেই সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য, কিন্তু তোমার মা তো আছেন | কাকিমা যেতে পারবেন না হয়তো অতদূর, আর উনি না থাকলে কি করে হবে ? এখানেই হোক বৌভাত, আসানসোলে | ”
“যাবে কি যাবে না সেটা মায়ের ব্যাপার | বৌভাতে মা না থাকলে কি করে হবে ? মানে কি ? বলতে কি চাইছো ? ” বিরক্ত হয়েছিল সাগরনীল|
সঙ্গীতা সামলাতে বলেছিল, “এভাবে কেন বলছো সাগর ? বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনিই থাকবেন না উনি ঐসব আচার, নিয়ম মেনে | বৌভাতে অন্তত থাকতে দাও | উনি আমাদের আশীর্বাদ না করলে কি করে চলবে ?”
কি নিষ্ঠুর একটা হাসি হেসেছিল সেদিন সাগরনীল,”কেমন করে চলবে ? যেমন করে আমার সারাটা জীবন চলে এসেছে সঙ্গীতা | আমার মায়ের আশীর্বাদ, মায়া, মমতা ছাড়াই তো বেঁচে আছি আমি এই সাতাশ বছর | তাহলে এখন আবার কি এইসব ?”
সঙ্গীতা কি করবে বুঝতে পারেনি, তাও সেদিন ওর মায়ের কথা মনে করেই, ওর সাথে উনার সন্ধি করিয়ে দেবার অবুঝ ইচ্ছে নিয়ে বলেছিল, “সাগর নিজের মায়ের উপর এইভাবে রাগ করো না | আমাদের আনন্দের দিনে, আমি চাই উনিও থাকুন |”
চোখে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তবু সাগরনীল ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “সঙ্গীতা, তোমার কাছে আমার কোনো কথা লুকোনো নেই | আমার আনন্দে, দুঃখে, অসুখে, কোনো কিছুতেই আমার মায়ের কিছু যায় আসে না | কাজেই আজ তুমি এইসব কথা তুলে আমাকে কেন কষ্ট দিতে চাইছো, আমি জানি না | তুমি যদি আমার মায়ের উপস্থিতির উপরে জোর দাও, তাহলে আমি বলতে বাধ্য হবো যে এই বিয়ে হবে না | আমি না আমার মা ? কাকে তোমার দরকার তুমি বেছে নাও |”
সেদিন পরিষ্কার করে সাগরনীলের মনের মতন উত্তর সঙ্গীতা দিতে পারেনি | সাগরনীলও আর সে উত্তর খুঁজতে চায়নি | ফিরে গিয়েছিল তার পরের দিনই, শর্তসাপেক্ষ ভালোবাসায় কোনো উৎসাহ ছিল না ওর | স্বপ্না বলেছিলেন হায়দেরাবাদে হোক বৌভাত, উনার কোনো আপত্তি নেই | কিন্তু সে আর কে শুনছে ? সঙ্গীতা সাগরনীলকে আর ফেরাতে পারেনি | আবার এইরকম অন্ধ রাগ দেখে মনে মনে ভয়ও পেয়েছিল | ভবিষৎতে যদি ওর উপরেও এইরকম রাগ হয় সাগরনীলের ? তখন ?
সম্পর্কটা এমন ভেঙে গেল, কি আর করার ছিল ? সঙ্গীতার বাবা, মা আর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি, অন্য জায়গায় মেয়ের বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন, কি বলে আর আপত্তি করতো সঙ্গীতা?
সেই শেষ বার সাগরনীলকে দেখেছেন স্বপ্না, পাঁচ বছর আগে | মাকে টাকা পাঠায় প্রতি মাসে, ফোন করলে জিজ্ঞেস করে প্রতিবার, “শরীর ঠিক আছে ? দাদা কেমন আছে ?”
এই দ্বায়িত্ত্ব তো চিরকাল ক#বাবুই পাখির বাসা – ২
#অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কাজ করতে বসলো ঠিকই তবু মনে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই দিনগুলো |
তখন কত বয়েস ছিল সাগরনীলের ? এই পাঁচ-ছ বছর |
দুস্টু ছিল খুব | রবিবার দুপুরে ঠাকুমার পাশে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে শুয়েছিল | যেই ঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়েছেন, ব্যাস!! এক দৌড়ে বাইরের বাগানে | কিছুক্ষন তো খুব হুটোপুটি, তারপর ওই বড়ো মতন পেয়ারা গাছটা থেকে নামাতে গিয়ে পা ফস্কে একদম নিচে | ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল আর ডান পায়ের হাঁটুর কাছে কেটে গিয়েছিল অনেকটা |
সে কি যন্ত্রনা !!
চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল !!
সেই আওয়াজে বাড়ির সবাই বেরিয়ে এসেছিল বাগানে | ওর বাবা ওকে কোলে তুলে দৌড়েছিলেন হাসপাতালে | প্লাস্টার করা হাত আর চার-পাঁচটা সেলাই করা পা সেদিনের ডাকাবুকো, দস্যি ছেলেটাকে একদম কাহিল করে দিয়েছিল | ওইটুকু তো ছিল ও, কষ্ট হয়েছিল খুব | বাড়ি ফিরে এসেও খুব কান্নাকাটি করছিল, “মায়ের কাছে যাবো …” এই বলে | শিশুর মন, সব থেকে নিরাপদ আশ্রয় তো মায়ের কোলেই, আর কোথায় যাবে ?
ডান হাতে প্লাস্টার, তাই নিজের ছোট্ট বাঁ হাতটাই মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, ” মা!! আমাকে কোলে নাও ..”
ওর মা হাত বাড়িয়েছিলেন ওকে কোলে নিতে, কিন্তু তখনই রুদ্রনীল ভাইকে দেখে এমন অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছিল যে ওকে সামলাতে যেতে হয়েছিল | আসলে মা ছাড়া অন্য কারুর কথা শুনতো না রুদ্রনীল, ওরফে বাবুন, আজও শোনে না | ওর ঠাকুমা মাকে বলেছিলেন, “আজ তুমি বাবুইয়ের কাছে থাকো বৌমা, বাবুন কাঁদুক আজ একটু নিজের মতন, আমি বসছি ওর কাছে |”
কিন্তু ওর মা দাদাকে ছেড়ে ওর কাছে আসেনি | ভেবেছিলেন বড় ছেলেকে চুপ করিয়েই চলে আসবেন | আসতে সময় লেগেছিল, আর যতক্ষনে এসেছিলেন তার ছোট ছেলে অভিমানে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল, আর কোনোদিন সে মায়ের কাছে যাবো বলে বায়না করেনি |
সাগরনীলের মন খুব অভিমানী, সেই ছেলেবেলা থেকেই | আর পাঁচজন মানুষে যে জিনিস এক দুদিনে ভুলে যায়, ওর মনে লেগে থাকে বছরের পর বছর, সে ভালো মন্দ দুই | মা তো আসেনি !! মায়ের ওই প্রত্যাখ্যান খুব বেজেছিল ওই ছোট্ট ছেলের মনে | বাবার কোলেই অনেক অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল | এক দুবার মা আদর করতে এসেছিল, অভিমান করে বলেছিল,”আমাকে আদর করতে হবে না, যাও দাদার কাছে যাও | তুমি ওর মা, আমার কেউ না |”
ওর মা ভেবেছিলেন ছেলেমানুষি অভিমান | নিজের ছেলের মনের গভীরতা আঁচ করতে পারেননি, কষ্টটা ধরতে পারেননি | উনি তো ওকেও ভালোবাসতেন, সব সময় বেসে এসেছেন | ছেলে যে সেটা অবিশ্বাস করে তা উনি বুঝতে পারেননি, কল্পনাই করতে পারেননি | তাই ওকে মানিয়ে বুঝিয়ে নেবার চেষ্টাও করেননি | কত ছোট্ট বাচ্চাই তো কোনো না কোনো সময় রাগ করে বলে,”মা আমাকে ভালোই বাসে না “, বলে না ? কিন্তু সেটাই যে সাগরনীলের জীবনের একটা কঠিন সত্যি হয়ে যাবে | ওর বড় বড় সব সিদ্ধান্তের ভিত হবে তা উনি সেদিন ঘুনাক্ষরেও টের পাননি |
যতদিনে পেয়েছেন আর ছুঁতে পারেননি তার ওই অভিমানী ছোট ছেলেকে | সে ততদিনে মাকে ছাড়াই বাঁচতে শিখে গেছে | মায়ের আর কোনো জায়গা ছিল না তার জীবনে |
তবে সাগরনীলকে, ওর কষ্টটাকে খেয়াল করে দেখেছিল আর একজন |
দস্যিপোনা কমে এসেছিল হাতে পায়ে লাগায় তা ঠিক, কিন্তু ব্যথায় হেরে শান্ত হয়ে থাকার ছেলে না সাগরনীল | তাও ওই দুর্ঘটনার দুসপ্তাহ পরেও ওইরকম চঞ্চল ছেলে ছুটির দুপুরে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে দেখে, উনি বুঝছিলেন শুধু ব্যাথা না আরও কিছু হয়েছে | ওই নিষ্পাপ শিশু মুখে একটা বেমানান উদাস দৃষ্টি দেখে, ওর মনের খবর পেয়ে গিয়েছিলেন সেই মানুষটি |
তিনি ওর বাবা |
“বাবুই ? এখন একা বসে আছিস কেন রে ? কি দুস্টু বুদ্ধি আঁটছিস রে, হুঁ ?” পাশে বসে জিজ্ঞেস করেছিলেন |
“জানো বাবা, মা কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে ?”
ওর বাবা জানতেন এই প্রশ্নের কি উত্তর ছেলের মনে, তাও নিজের ভাবনা চাপিয়ে দেননি, উল্টে হেসে ওকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কাকে রে ? আমি তো জানি না |”
নির্দ্বিধায় বলেছিল, “দাদাকে | আর আমাকে একটুও না জানো বাবা | আমাকে মা ভালোই বাসে না”, চোখ দিয়ে নোনা জলের বড় বড় ফোঁটা গড়িয়ে নেমেছিল |
ওর বাবা বুঝেছিলেন যে এখন যদি ওকে বোঝাতে বসেন যে “না বাবুই | মা তোকেও খুব ভালোবাসে” সে বুঝতে চাইবে না | তাই সেদিকে না গিয়ে ওরই কথার সুর ধরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আর বাবা কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে বল তো দেখি ?”
এটা তো ভেবে দেখে নি ?
মন ঘুরে গিয়েছিল এই জিজ্ঞাসায় | সহজ কৌতূহল মাখামাখি হয়েছিল গলায়, চোখ চকচক করে উঠেছিল, অজানা আশংকায়, অচেনা আশায়, “কাকে বাবা ? কাকে তুমি সব থেকে বেশি ভালোবাসো ?”
উনি হেসে বলেছিলেন, “সে আছে জানিস একটা দস্যি ছেলে, দুপর বেলা গাছে চেপে বেড়ায় একা একা | কি নাম বল তো তার ?”
মুখ থেকে সব অন্ধকার দূর হয়ে গিয়েছিল, আনন্দে কানায় কানায় ভোরে গিয়েছিল ছোট্ট মন, বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, “বাবুই ! বাবা তুমি আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো ? কি মজা !!”
এই কথা বলেই বাবাকে একদম জড়িয়ে ধরেছিল সেদিনের সেই ছোট্ট বাবুই | সেই গরমের দুপুরে বাবা হয়ে গিয়েছিলেন ওর সারা জীবনের এক আশ্রয় | সেইদিন থেকে সাগরনীলকে এত ভালোবেসেছিলেন ওর বাবা আর এত ভাবে প্রকাশ করেছিলেন সে কথা, যে মায়ের সব না দেয়া পুষিয়ে গিয়েছিল |
বাবুইয়ের ছিল শুধু বাবা !!
আসলে হয়তো ওদের বাবা এবং মা দুজনেই দুই ছেলেকেই খুব ভালোবাসতেন | সে ভালোবাসার ধরণ আলাদা ছিল | তবে ওর বাবা নিজের বিচক্ষণতায় বলেছিলেন সেই ছেলেকে যার শোনাটা দরকার ছিল, নাহলে সে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেই ছেলেকে বলতে যাননি যার কথা বোঝার বোধই ছিল না পারতপক্ষে |
ওর মা করছিলেন ঠিক উল্টো জিনিসটা |
তাই রুদ্রনীল ওর ওই সীমিত বোধে শুধু বলেই যেত,”মা আমাকে ভালোবাসে ভালোবাসে …” সে কথাটার মানে ওর কাছে অস্পষ্ট | মায়ের কাছে শুনে শুনে বলা |
কিন্তু সাগরনীল ? সে তো কথার মানে বুঝতো | মায়ের মুখের রং বদল বুঝতো | রুদ্রনীলের এই কথা গিয়ে বিঁধতো ওর মনে | ওর কাছে মানে দাঁড়াতো, “মা শুধু দাদাকেই ভালোবাসে, আমাকে ভালোবাসে না |”
সাগরনীল এইটাই জানলো, যে ও ব্যাথা পেয়ে মায়ের কাছে যাবে বলে আব্দার করেছিল আর মা ওকে কোলে নেয় নি | এই ভেবেই বড় হলো | জানলো না যে ও ঘুমিয়ে পড়ার পর মা কত আদর করলেন | জানলো না, কারণ উনি তো বললেন না |
ওর কানে কানে তো বললেন না, “বাবুই, মা তোকে খুব ভালোবাসে |”
ঘুমন্ত ছেলেকে তো আর কোনো মা ডেকে তুলে বলেন না,”এই শোন ভালো করে মন দিয়ে, আমি তোকে ভালোবাসি | মনে রাখিস এই কথা, কাল আবার বলবো কেমন ?” আর ও যখন জেগে থাকলো উনি একটুও সময় বের করলেন না |
কিন্তু ওর প্রতিটা জেগে থাকা মুহূর্তে যেন ওর বাবা বলেছেন ঠিক সেই কথা, আর বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলে বলে সাগরনীলও যেন মনে মনে জেনেছে এইটাই সত্যি |
“বাবা কাকে ভালোবাসে সব থেকে বেশি ?”
“আমাকে!!”
“হ্যাঁ !! আমার বাবুই পাখি কে !”
মায়ের অভাবে বাবাই হয়ে দাঁড়ালেন ওর গোটা পৃথিবী |
ছেলে গাছে উঠতে ভালোবাসে বলে বানাবেন ঠিক করলেন এক ট্রি-হাউস | বাগানেরই একটা বড় গাছে | ওইটুকু বয়েসেও কিন্তু সাগরনীলের ভাবনা ছিল স্বচ্ছ, হিসেবে নিকেশ বুঝতো ভালো | ট্রি হাউসের পরিকল্পনাতে বাবার সাথে ও নিজেও যোগ দিল | তা সেই ট্রি-হাউস লোক ডাকিয়ে বানালো হলো | ঘোরানো সিঁড়ি দেয়া, একটা বেশ ভালো, বড় ঘর | একজনের জন্যে তো যথেষ্টই, দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষও আরামসে দাঁড়াতে, বসতে পারে |
বাবা ওকে কতটা ভালোবাসে তারই একটা নির্দশন ওই ট্রি-হাউস |
সেটা যেদিন একদম তৈরী হলো, সেদিন যেন আনন্দ ধরে না সাগরনীলের | তাও আরও সোহাগ ছিল পাওনা | ওর বাবা নিজের হাতে লেখা একটা বোর্ড লাগিয়ে দিলেন ওই ট্রি-হাউসের গায়ে, “বাবুই পাখির বাসা” |
সেখানেই বসে কত সময় যে কাটিয়েছে সাগরনীল, কত পড়াশনা করেছে, গল্পের বই পড়েছে | আর কোথাও না পাওয়া গেলে ওইখানেই থাকবে ও, সবাই জানতো | ওর বাবা যেন ওকে একটা আলাদা জগৎ তৈরী করে দিয়েছিলেন | আর সেই জগতেই পাখা মেলেছে ওর সব প্রতিভা, বাবার আদরে সাগরনীল সেইসব কাজে সাহস পেয়েছে যা এমনিতে হয়তো হতো না | এই যে ও ব্যবসায় নামলো, সেই মনের জোরও বাবা ওকে জুগিয়েছেন মৃত্যুর ওপার থেকে |
” তোর যা ইচ্ছে তুই করতে পারিস বাবুই, মন দিয়ে চেষ্টা করলে তোর অসাধ্য কিছুই না”, এই মন্ত্র ওর কানে দিয়ে গেছেন | সাগরনীল জানে ওর অসাধ্য কিছুই না | বুদ্ধি আর শ্রম এই দুই মিলিয়ে সব স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব | মেধা ওর এমনিই ঈশ্বরদত্ত আর ছেলেবেলার দুস্টুমি ছেড়ে একটু বড় হয়ে যেই শান্ত হলো ও, প্রতিদিন যেন আরও মেধাবী হয়ে উঠলো, আরও পরিশ্রমী | সব শিক্ষকরা বলতেন, এই ছেলে অনেক দূর যাবে | ঠিকই বলতেন |

“বাবুন তো ওখানে উঠতে পারবে না, ওর কষ্ট হবে ওটা দেখে | কেন বানালে বাড়িতে ?” এই প্ৰশ্ন করেছিলেন ওর মা, বাবাকে | না সাগরনীলের সামনে না, ও শোনেনি |
ওর বাবা কিন্তু সেদিন রুক্ষ ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, “এমন অনেককিছু বাবুই করবে, পারবে যা বাবুন কোনোদিন পারবে না | একজনের সীমাবদ্ধতা অন্যজনের পায়ের শিকল কোরো না স্বপ্না | বাবুইকে খোলা মনে বড় হতে দাও, ভালো করে বাঁচতে দাও, সাহস দাও এগোনোর |”
“কিন্তু বাবুইকে তো একদিন দাদার দায়িত্ব নিতে হবে | ওকে তো বুঝতে শিখতে হবে |”
ওদের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “এখন তো বাবুই খুব ছোট্ট, এখন এই বোঝা ওর উপর চাপিয়ে দিও না | ও বড্ডো সেনসিটিভ | এইসব এখন বলার সময় আসেনি ওকে, ওকে এখন বুঝতে দাও যে আমরা ওকেও খুব ভালোবাসি,শুধু বাবুনকে না | তুমি ওকেও সময় দাও | ”
সেদিন যেন কেউ স্বপ্নার চোখের সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল | তাই তো !! বাবুই তো সুস্থ, স্বাভাবিক তার জন্যে তো অন্য রকম ব্যবহার দরকার | কিন্তু সময় যেন আর উনার কুলোয়নি, দুই ছেলের দুরকম মা হবার |
বাবুই বেড়ে উঠেছিল উনার নাগালের বাইরে, নিজের ওই বাসায় | সেখানে ওর আর ওর বাবার এক আলাদা পৃথিবী | কেউ সেখানে বাবার সময়ের ভাগিদার না, সেখানে একটাই অক্ষয় সত্যি, “বাবা সব থেকে বেশি ভালোবাসে বাবুইকে” |
সাগরনীল বরাবরই পড়াশোনায় ভালো, বছরের পর বছর ও প্রথম হয়েছে, পুরস্কার পেয়েছে | ওর কোনো পুরষ্কার নেবার অনুষ্ঠানে কিন্তু ওর মা যাননি | ও যখন ট্রফি, মেডেল বা কাপ হাতে বাড়ি ফিরেছে, ওর মা দেখতে চেয়েছেন প্রশ্ন করেছেন কত হাসি মুখে | সেসব ওর মন দাগ কাটেনি | কি লাভ ? একবার যাওয়া যায় না ? যারা দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছে তাদের মায়েরাও এসেছেন | শুধু আসেনি ওর মা | কেন ? প্রতি বছর প্রথম হয় ও, সেটা কি একটুও আনন্দের না ?
ও শুধু শুনে এসেছে মায়ের কাছে যে “দাদাকে রেখে যাওয়া যায় না বাবুই, এই তো আমি এখন দেখছি | কত ভালো লাগছে |” একদিন দাদাকে রেখে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ওর মা হওয়া যেত না ? সাগরনীলের মনে হতো যে মায়ের কাছে ও অবাঞ্ছিত, কিন্তু ওর দোষটা যে ঠিক কি সেটা বুঝতে পারতো না | একটুও সময় নেই কেন ওর জন্যে ?
আজও ও ঠিক বুঝতে পারে না |
প্রথম প্রথম তো ছোট ছিল, উত্তর দিত না | শুধু মন খারাপ করতো | আরেকটু বড় হয়ে পালটা উত্তর দিত, “থাক আর আমার মেডেল দেখার ভান করতে হবে না | যাও দাদার ওই এ, বি, সি, দি লেখা দেখো খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে |”
আর তারও পরে, কিছু জানাতোই না মাকে | মা যেন ওর কেউ না, এই ভাবে উনার কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে | ওর মায়ের ওর কোনো কথাই যেন মনে থাকতো না |
আইআইটিতে ও পেয়ে গেছে সেই খবরও চেপে রাখলো | ওর বাবা অফিস থেকে বাড়িতে ফোন করলেন পেয়েছে কি না জানতে | তখন ও ফোনের পাশেই বসে ছিল, জানতো বাবা ফোন করবে | নিজেই ফোন ধরে খুব ধীর গলায় বাবাকে উত্তর দিল | ওর বাবা ফেরার সময় অনেক মিষ্টি, কেক নিয়ে এলেন ওর জন্যে | এসে দেখেন যে সাগরনীল বাইরে বারান্দায় একা একা উদাস মুখে বসে আছে, আর সারা বাড়ি অন্ধকার |
উনি ঢুকে এসে এল জ্বালাতেই ওর মা বেরিয়ে এসে বললেন, “আসলে আজ বাবুন ওই আলো নিয়ে খুব রাগারাগি করছিল তাই …”
সাগরনীলের হয়ে ওর বাবাই রেগে গিয়ে বললেন, “আজ বাবুই আইআইটিতে পেয়েছে, আর তুমি এমন ঘর অন্ধকার করে রেখেছো যেন কি একটা হয়েছে আমাদের বাড়িতে | ছেলেটা একা একা বাইরে বসে আছে, সেটাও কি তোমার চোখে পড়ে না স্বপ্না ? আর কিছু বিশেষ রান্নাবান্না করেছকিনা ওর জন্যে সেটা তো জিজ্ঞেস করাও ভুল |”
ওর মা অবাক হয়ে বললেন,”আমাকে তো ও বলেই নি | কি করে জানবো ? আর তাছাড়া বাবুন..”
ওর বাবার সেদিন ধৈর্যের সীমা পার হয়ে গিয়েছিল, “বাবুন, বাবুন …যথেষ্ট হয়েছে | একটা না তোমার দুটো ছেলে, ভুলে গেছো নাকি সেটা ?? আর ও বলেনি তোমাকে ? তুমি একবারও জিজ্ঞেস করেছওকে ? জানো না আজ রেজাল্ট বেরোনোর দিন ? থাক আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই …”
সেদিন ওকে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন ওর বাবা, পরেরদিন একটা দামি ঘড়িও কিনে দিয়েছিলেন | সত্যি খুব খুশি হয়েছিলেন |
আর ওর মা ?
পরের দিন সকালে ওর ঘরে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাকে একবার বললি না কেন বাবুই তোর রেজাল্ট বেরিয়েছে? ” শুধু ওরই যেন দায় |
ছেলে উদাস হয়ে বলেছিল, ” কি লাভ হতো মা বলে ? কি করতে তুমি ? এখন তো জানো, কি করছো বোলো ? ”
উনি আর কিছু বলেন নি |
সেদিনও প্রচুর দূরত্ব ছিল মায়ের সাথে, ক্রমশ সেটা আরো বেড়েছে |

কার দোষ ? শুধু ওর, শুধু ওর মায়ের ? না দুজনেরই ? নাকি পরিস্থিতির ?

আলাপ দিব্যি জমে উঠেছে স্বচ্ছতোয়া আর সাগরনীলের | প্রায়ই দেখা হয়, একে ওপরের বাড়িতেও গেছে বেশ কয়েকবার এই ক’মাসে | গল্প ওদের ফুরোতে চায় না, কত যে কথা | সাগরনীলের বইয়ের ঘর দেখে তো তোয়া অবাক হয়ে গেছে, “এত বই ? ইশ কি মজা !!”
“তুমি যেটা ইচ্ছে নিয়ে পড়ো, যখন ইচ্ছে এস”, এই বলে নিজের বাড়ির একটা ডুপ্লিকেট চাবিও ওকে দিয়ে দিয়েছে সাগরনীল | তোয়া ওকে যত দেখে ততই অবাক হয় | বাড়ির চাবি কেউ দিয়ে দেয় নাকি এই ক’মাসের আলাপে ? তা, বাকিরা যা করে তা যে সাগরনীল করে না সেটা যদিও এতদিনে তোয়াও বুঝে গেছে, তাই মনে মনে অবাক হলেও ওকে বলেনি সেটা |
মাঝেমাঝে জোর তর্ক লেগে যায় ওদের কোনো বই নিয়ে, কোনো খবর নিয়ে, বা রাজনীতি নিয়ে | সেই সময়গুলোতে অস্থির হয়ে পায়চারি করে সাগরনীল আর ওই রোগা হাত দুটো নাড়িয়ে অনেক কিছু বলে | তোয়াও নিজের বক্তব্য চোখ গোলগোল করে বলে দেয়, কেউ ছাড়ে না | তারপর তর্ক আবার মিটে আসে, কেউ একজন মেনে নেয় বা দুজনেই তর্ক করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে |
মাঝে মাঝে সাগরনীল বলে, “আচ্ছা বেশ ! আরেকটু পড়তে হবে দেখছি | এখন এই অব্দি থাক, পরের শনিবার আবার বসবো এটা নিয়ে | হার মেনে নিচ্ছি না কিন্তু, যুদ্ধবিরতি |”
তোয়াও অম্লান বদনে বলে, “হ্যাঁ আজ বিরতি, পরের সপ্তাহে তোমার পরাজয় | সে ঠিক আছে |”
তবে, তর্ক তর্কর জায়গাতেই থাকে, সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে ফেলে না ওরা | এই করে সময় ভালোই এগোচ্ছে ওদের |
তোয়ার আগমনে নীলেশ আর শ্রুতিও খুব খুশি | সাগরনীল একা একা থাকতো, ওদের চিন্তা হতো | নীলেশের ছেলে, নৈঋত, এমনিই সাগরনীলের খুব ভক্ত | দেখা হলেই চকলেট, আইসক্রিম লাভ হয় | সাগরনীলের ফ্রিজেও এইসব ঠাসা থাকে, ওর বাড়ি আসলেও হাতে স্বর্গ পায় | এখন তার তোয়াকেও খুব পছন্দ হয়েছে | সাগরনীলকে কানে কানে বলেছে, “তোয়া আন্টি খুব সুইট, তুমি ওকে বিয়ে করে নাও | আমি তোমাদের বাড়ি এসে থাকবো”|
সাগরনীল জিজ্ঞেস করলো, ” তুই চলে আসবি ? তা তোর বাবা, মা কি করবে ?”
তাতে ওর সহজ উত্তর, “ও মাঝেমাঝে বাড়ি যাব, রোজ না | মা শুধু বকে আমাকে আর পড়তে বলে | ”
তাই শুনে হেসে গড়িয়ে গেল সাগরনীল, বললো, “তোর মা আমাকে যা বকবে না এইরম করলে !! আমি রোগা সোগা মানুষ নৈঋত, তোর মা মেরে আমার হাত, পা ভেঙেই দেবে | দেখ শ্রুতি দেখ, তোর ছেলে কি বলছে |”

তোয়াকে নিয়ে অসুবিধে হয়েছে শুধু সাগরনীলের কাজের লোকটির | প্রথম দিন ওর বাড়ি গিয়েই তোয়া বলেছিল, “একি এরকম ধুলো কেন ? কাজের লোক রাখো নি ?”
তাতে একটু ভেবে সাগরনীল বলেছিল, “হ্যাঁ আছে একজন, মাসের এক তারিখে তো পাক্কা আসে |”
সেদিনই তাকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়ে গোটা বাড়ি পরিষ্কার করিয়েছিল তোয়া আর খুব ধমকেছিল, “এইবার যদি দেখি ভালো করে কাজ করছো না, একদম ছাড়িয়ে দেব |” এত কাজ সে বেচারি এত বছরে করেনি এই বাড়িতে | সব ঝেড়ে, ঝাঁট দিয়ে, মুছে তবে ছাড়া পেল | সে যদিও এই কাজ হাতছাড়া করতে চায় না | কাজ করতে হয় না এমনিতেই তার উপর ফ্রিজ থেকে যা ইচ্ছে নিয়ে খাও সাগরনীলের কোনোদিকে হুঁশ নেই, তাই সে বেকায়দায় পড়ে বললো,”আমি তো আসি, দাদাই তো দরজা খোলে না অনেকদিন, আমি কি করবো ?”
তোয়া তাও ছাড়বে না, “দরজা না খুললে ফোন করবে, ওকে না পেলে আমাকে করবে | একদম গল্প দেবে না |”
এইটা যদিও পুরোটা গল্প না, একদিন সত্যি দরজা খোলেনি সাগরনীল, ঘুমোচ্ছিল | সেটা যদিও একদিনই | তারপর সেটাকেই ভাঙিয়েই চলছিল ওই মহিলার | সে তোয়ার সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলো | ভাবলো দিব্যি তো একা ছিল এই আপনভোলা ছেলেটা, এই মেয়ে আবার কোথা থেকে জুটিয়ে আনলো রে বাবা !!
সাগরনীল ও হেসেই খুন, বললো, “বাবা!! কি বকুনি দিলে তুমি !!”
সাগরনীলের বাড়িটা ঠিক যতটা অগোছালো, তোয়ার ভাড়া করা ওয়ান রুম ফ্ল্যাটটা ঠিক যেন ততটাই সুন্দর করে সাজানো | বারান্দায় ফুল গাছ আছে, দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি | ছিমছাম, রুচি সম্মত সাজানো | সেই দেখে সাগরনীল খুব প্রশংসা করলো, বললো, “ভারী সুন্দর তোমার বাড়িটা | সময় পেলে আমার ওখানটাও একটু সাজিয়ে দিও তো প্লিজ | আমার বাড়িটা যেন একদম …মানে বাড়ি বাড়ি না | ”
দেবে বলছে তোয়া, কেন দেবে না ?
তোয়াও একটা জিনিস নিয়ে আবদার করে সাগরনীলের কাছে |
ওর ওই চুলের উপর খুব লোভ তোয়ার | হাতে পেলেই তাতে নানা রকম বাহারের ঝুঁটি, বেনুনি, খোঁপা এইসব বেঁধে দেয় | আপত্তি করে না সাগরনীল | বাকিরা তো খালি “কেটে ফেলো”,”কেটে ফেলো” করতে থাকে, তোয়া যদি ওর চুল নিয়ে একটু ছেলেমানুষি করে মজা পায়, ওর কি সমস্যা ? আর তোয়ার যেটা সব থেকে মজার লাগে সেটা হলো, ও যেমন করেই চুল বেঁধে দিক ওইভাবেই বাইরে বেরোতে কোনোদিন না করে না সাগরনীল, “তুমি থাকবে তো আমার সাথেই ? তাহলে আমার প্রব্লেম নেই | লোকে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না | ”
সাগরনীলের ঘন, কোঁকরা চুলের কথা ভেবেই তোয়া নিজের কোম্পানিতে একটা নতুন ধরণের, বড়ো দাঁতের, নিম কাঠের চিরুনিও লঞ্চ করেছে | খুব চলেছে সেটা | প্রথম যেটা তৈরী হয়ে এসেছিল সেই চিরুনিটা সাগরনীলকে দিয়েছিল তোয়া, সেও খুব খুশি সেটা পেয়ে | তোয়ার প্রশাংসা করে বলেছিল, “উফঃ ! সব দিকে বিজনেস আইডিয়া দেখতে পাও তুমি, হেব্বি ব্যাপার | এইটা বেশ ভালো জিনিস |”

আজকে, এই শুক্রবারে সাগরনীল আর নীলেশের জন্যে দারুন একটা উপভোগ্য সন্ধ্যে| |
আজ ওদের কোম্পানি অনেক ফান্ডিং পেয়েছে | আরও উন্নতি হবে এই আনন্দে খুব ফুর্তি ওদের সবার | জুবিলী হিলস এ প্রস্ট নামের পাবের একটা অংশ আজ বুক করা হয়েছে, ওদের কোম্পানির আজ পার্টি | সেখানেই নাচ, গান, পানীয়, ধোঁয়া সব চলছে | তোয়াও এসেছে আজ ওদের পার্টিতে | সবারই একজন অতিথিকে সঙ্গে আনার অনুমতি আছে, যাকে ইংরেজিতে বলে প্লাস ওয়ান | তোয়া সাগরনীলের প্লাস ওয়ান | তা সাগরনীল তো প্রথমে খুব নাচানাচি করেছে | তারপর, সন্ধ্যে যখন গড়িয়ে রাতে পৌঁছেছে প্রচুর মদ খেয়ে একদম মাতাল হয়ে গেছে | যাকে পাচ্ছে তার সাথেই খোস গল্প জুড়ে দিচ্ছে, খুব হাসছে, জোরে জোরে গান গাইছে বা মাথায় খেয়াল চাপলে অঙ্ক কষতে দিচ্ছে |
এমনিতে যে মদে আসক্তি আছে সাগরনীলের তা নয় | ওই অফিসের বা অন্য কোনো পার্টিতেই যা খায় | তবে কৎচিত কদাচিৎ আনন্দের আতিশয্যে বেশি খেয়ে ফেলে এবং তারপর আর নিজেকে সামলাতে পারে না | তখন গাড়ি চালাতে তো দেয়া যাবেই না, ট্যাক্সি করে নিজে ফেরার মতন অবস্থায়ও থাকে না | কাউকে না কাউকে বাড়ির দরজা অব্দি দিয়ে আসতে হয় | আজকে সেইরকমই একটা সন্ধ্যে | সে কি আর করার ? আগে হয় নীলেশ নিজে গেছে নয়তো অফিসে যে সব থেকে নতুন এসেছে সেই ছেলেটাকে এই কাজটা ধরিয়ে দিয়েছে | কোনো মেয়েকে তো আর বলা যায়না যে যাও তোমার মাতাল বসকে বাড়ি দিয়ে এস, কেলেঙ্কারি হবে শেষে !!
তা এতদিন নাহয় সাগরনীল একদম বিবাগী ধরনের ছিল, আজ তো তোয়া এসেছে ওর সাথে | এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে সাগরনীলের এতদিনের আলাপ পরিচয় দেখছে নীলেশ, বুঝেছে যে বিশেষ কিছুই হবে | তাই তোয়াকে দেখে আজ হাতে চাঁদ পেয়ে, অনুরোধ করলো নীলেশ, “তোয়া তুমি প্লিজ সাগরকে একটু বাড়ি অব্দি দিয়ে আসবে ? আমিই যেতাম কিন্তু অনেকটা দেরি হয়ে গেছে আর আমার বাড়ি উল্টো দিকে |”
অগত্যা, তোয়াই পার্টির শেষে বাড়িতে নামাতে এল |
কিন্তু নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে কি করে ? সোজা হয়ে হাঁটতেই তো পারছে না সাগরনীল, এদিকে হেসেই যাচ্ছে শুধু |
তোয়া খানিক ভাবলো কি করবে, তারপর ঠিক করলো, না ওকে বাড়ি অব্দি তো ছেড়ে দিয়ে আসতেই হবে| একা একা কোথায় যাবে তার নেই ঠিক | আর তাছাড়া মাতাল হয়ে কি করে সেটাও দেখা হয়ে যাবে | সজ্ঞানে তো মানুষ অনেক কিছুই বলে, কিন্তু মাতাল হয়ে গেলে তো আর নিজের আসল চরিত্র চেপে রাখা যায়না | আর সেরকম বেগতিক দেখলে ওর কাছে পেপার স্প্রে আছে, দেবে আচ্ছা করে | এই ভেবে ওর ফ্ল্যাট অব্দিই উঠে এল সাগরনীলকে ভালো করে ধরে | সে তো নিজের মনের আনন্দে লিফ্টেই বেশ জোরে গান ধরলো, তাও কি গান? না, “খাইকে পান বানারাস য়ালা”|
কেন হঠাৎ এই গান ওর মনে এলো সে আর তোয়া কি জানে নাকি ? জিজ্ঞেস করলেও যে সদুত্তর মিলতো সে আশাও ছিল না | তারপর ফ্ল্যাটে ঢুকে যা করলো সাগরনীল, তা বোধয় তোয়া নিজের সমস্ত কল্পনা শক্তি দিয়েও সাজিয়ে উঠতে পারতো না |
প্রথমে ভেতর থেকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরেই দাঁড়িয়ে থাকা তোয়াকে দেখে এক গাল হেসে বললো, “থ্যাংক ইউ তোয়া, বাই” বলে নিজের শোবার ঘরের দিকে না গিয়ে টলতে, টলতে চলে গেল রান্নাঘরে | ওর পিছন পিছন রান্নাঘরে গিয়ে তোয়া দেখলো, আলো না জ্বালিয়ে ওই বড় আলমারির আয়তনের ফ্রিজটা খুলে তার প্রায় ভেতরেই ঢুকে গেছে সাগরনীল |
“এই, কি করছো তুমি নীল ?” তোয়া গিয়ে জিজ্ঞেস করলো |
“আসতে! আসতে কথা বলো তোয়া,” গলা খাদে নামিয়ে সাবধান করলো সাগরনীল ওকে, “এই দেখো কি আছে !” বলে বের করে আনলো দুটো বড় বড় আইসক্রিমের কৌটো, একটা তোয়াকে এগিয়ে দিল |
অন্যটা হাতে নিয়ে ফ্রিজের পাশেই ধপাস করে বসে পড়লো | তারপর নানা রকম আব্দার আসতে থাকলো তোয়ার দিকে, “চামচ দাও”, “চকোলেট সিরাপ দাও”, “তোমার আইসক্রিমটা আমাকে দাও” |
তোয়া একদম অবাক হয়ে গেছে ওর কান্ড দেখে !
নেশাগ্রস্ত অবস্থায়, ফাঁকা ফ্ল্যাটে ওকে একা পেয়ে সাগরনীল অনেক কিছুই করার চেষ্টা করতে পারতো | অনেক রকম সম্ভাবনাই তোয়ার মাথায় এসেছিল | মনে অনেক অল্প আশংকাও এসে জমা হয়েছিল | কিন্তু যা শুরু হলো তাতে তোয়া হাসবে না কাঁদবে ঠিক করতে পারলো না | মাতলামি তো অবশ্যই, সুস্থ অবস্থায় এইরকম করবে না সাগরনীল |
কিন্তু এইটা ঠিক কি ধরণের আচরণ ? কে এরকম করে ? এদিকে নাকি এর নিজেস্ব কোম্পানি আছে, তার কত কাজ করে, সারাদিন কত বই পড়ছে, অঙ্ক কষছে মাথায় সর্বক্ষণ আর পার্টিতে মদ খেয়ে এসে আইসক্রিম খাচ্ছে বসে বসে ?
“আচ্ছা তোয়া, নীল এইটা না করে কি করলে তোমার ভালো লাগতো ? ও যদি মদ খাওয়ার অজুহাতে তোমার সাথে অসভ্যতা করতো, তোমার গায়ে হাত দিতে আসতো, সেটা কি বেশি পছন্দ হত তোমার ?” তোয়ার নিজের মনেই যেন এইসব প্রশ্ন ভেসে উঠলো |
তাই তো !
হঠাৎ যেন সাগরনীলকে আরও ভালো লেগে গেল তোয়ার | দেখ ! কিরম মানুষ | আসল চরিত্র চেপে রাখা যায় না, তাই ভাবছিল না তোয়া ? তা এইটাই নীলের আসল রূপ, একদম সরল, ছেলেমানুষ | সে কৌটো কৌটো আইসক্রিম খায় আর কিছুতে মন নেই তার |
তোয়াও ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো | পা ছড়িয়ে বসে, কিছুক্ষন তো একদম একমনে আইসক্রিম খেলো সাগরনীল | যেন ভুলেই গেছে যে তোয়া ওর পাশে বসে আছে | তারপর কি খেয়াল হলো হামাগুড়ি দিয়েই এগিয়ে একটা ড্রয়ার থেকে বের করলো অনেক চিপস | তোয়ার এই দেখে ভারী রাগ হলো, যত আজে বাজে খাবার | একটু বকার সুরেই বললো, “নীল, এই আইসক্রিম খেলে আবার চিপস খাবে এখন তুমি ?”
নেশার ঘোরে এমন বকা খেয়ে সাগরনীল যেন একটু ঘাবড়ে গেছে, খুব করুন মুখ করে বললো, ” বকছো কেন আমাকে ? আমার খিদে পেয়েছে তো, কি খাবো ?”
তোয়া বুঝেছে যে একে মাতাল অবস্থায় ভয় পাবার কোনো কারণ নেই | মদ খেয়ে এ একদম ছেলেবেলায় ফিরে গেছে মনে হচ্ছে, এর দ্বারা কোনো ক্ষতি করা সম্ভব না | তাই বড়দের গলায় বললো, “চুপ করে বোসো আমি ওমলেট করে দিচ্ছি | ওই চিপস খেতে হবে না | দাও, দিয়ে দাও আমাকে “, বলে হাত বাড়ালো | সাগরনীল চুপচাপ দিয়ে দিল নিজের হাতের চিপসের প্যাকেটটা | তারপর, একদম সুবোধ বালকের মতন ওখানেই বসে থাকলো | তোয়া ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম নিয়ে ওমলেট বানাতে শুরু করলো | পেঁয়াজ কুঁচিয়ে যেই না টমেটোতে হাত দিয়েছে, সাগরনীল ভীষণ বায়নার শুরে বললো , “প্লিজ প্লিজ টমেটো না | একদম না, একদম না | কড়াইশুঁটি দাও ওমলেটে|”
ওকে বেশি না ঘাঁটিয়ে “আচ্ছা” বলে টমেটো রেখে দিল তোয়া | কড়াইশুঁটি কোথায় পাবে এই এত রাতে ? পাগলের প্রলাপ যত! ওমলেট খেয়ে তো খুব খুশি হলো সাগরনীল, বললো, “বেস্ট ওমলেট তোয়া ! বেস্ট ইন দা ওর্য়াল্ড |”
তারপর থালাটা পাশেই নামিয়ে রেখে ওখানেই শুয়ে পড়লো, বললো, “ওকে বাই, এয়ারপোর্ট পৌঁছে মেসেজ করে দিও |” এয়ারপোর্ট?? মাথা গেছে এর | তোয়া ডাকলো এক দুবার কিন্তু সে একদম ঘুমিয়েই পড়েছে | শেষে ওর শোবার ঘর থেকে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে এল | মাথার তলায় বালিশটা দিয়ে, গায়ে চাদর চাপা দিয়ে দিল |
যে মাতাল সে কিছু করলো না, যে সজ্ঞানে আছে সেই নিচু হয়ে মাতালের কপালে আলতো চুমু এঁকে দিল |
“তোমাকে না ভালোবেসে পারা যায় না নীল, খুব কিউট তুমি”, সাগরনীল ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে একটু জোরেই বললো তোয়া | ওমা ! ও যেই উঠে চলে যেতে পা বাড়ালো, ঘুমের মধ্যেই সাগরনীল, “তোয়া, আই লাভ ইউ “, বলে পাশ ফিরে শুলো, চাদরটাকে মাথা অব্দি টেনে নিয়ে |
এই !! এইটা কিরম হলো ? জেগে আছে না ঘুমোচ্ছে ? আর ঘুমিয়ে থাকলে এই কথা তো বাবা ধরা যাবে না, আবার ফেলাও তো যাবে না |

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, ও ঠিক কোথায় আছে বুঝতে একটু সময় লাগলো সাগরনীলের | না, নিজের বাড়িরই রান্নাঘরে শুয়ে আছে দেখলো | তাও ভালো ! বালিশ নিয়ে এসে এখানে শুয়েছি ? নিজের অবস্থায় নিজেরই হাসি পেল ওর |
উঠে বসতেই বুঝলো মাথা একদম ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়, গলাও শুকিয়ে কাঠ আর সর্দি মতন হয়েছে | আর কেউ নেই এই ভেবে জোরেই বললো, “ও বাবা !! মদ খেয়ে আজকাল সর্দিও হচ্ছে ? অনেক বয়েস হয়ে গেছে আমার !” হাঁটু মুড়ে তার উপর মাথা নামিয়ে বসে থাকলো খানিক্ষন | এমন সময় তোয়া এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরে, জিজ্ঞেস করলো, “কি কেমন লাগছে এখন ? শরীর ঠিক আছে ?”
তোয়াকে দেখে একদম চমকে গেছে সাগরনীল, কিছুক্ষন নিস্পলক তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে | তোয়া রাতে আর বাড়ি যায়নি, এই প্রথম এইখানেই থেকে গেছে | সাগরনীলের কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল| তারপর ওরকম রান্নাঘরের মেঝেতেই শুয়ে ঘুমোচ্ছিলো দেখে, একা রেখে যেতেও ইচ্ছে করলো না | তার উপর ওই “আই লাভ ইউ ” সেটাও মাথায় ঘুরছিল | রাতেই পার্টির ড্রেস ছেড়ে পরেছে সাগরনীলেরই একটা টিশার্ট আর শর্টস | অন্যরকম লাগছে ওকে এই অদ্ভুত সাজপোশাকে | সাগরনীলের মনে হলো তোয়া যেন বহুকাল এই বাড়িতেই থাকে, ওর সাথে | এইভাবেই মাঝে মধ্যে ওর জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় বাড়িতে, এইসব ভেবে ফিক করে হেসে ফেললো | তোয়া চোখ পাকিয়ে বললো, “খুব হাসি না ? এখনো নামেনি নাকি নেশা ?”
এই রে !! রাতের কিছু কথা ওরও ভাসা ভাসা মনে আছে, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “এই সরি সরি | ভেরি সরি, খুব কি ছড়িয়েছি কাল ? তোমাকে কিছু উল্টো পালটা বলেছি নাকি ? তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না, আর হবে না এরকম,” তারপর নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ভীষণ মাথা যন্ত্রনা করছে | কেন যে কাল ড্রিংক করতে গেলাম !”
তোয়া তো খুব হাসলো কাল রাতের সব কীর্তি মনে করে, বললো, “যাও ফ্রেশ হয়ে এস | আমি ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি |”
একদম চান করেই ফিরে এল সাগরনীল | এসে দেখলো তোয়া পাউরুটি আর মাখন বের করেছে জল খাবারে | ও কফি বানিয়ে আনলো | খেয়ে দুজনেই ব্যালকনিতে এসে বসলো | প্রায় এগারোটা বাজে, রোদ অন্যদিকে ঘুরে গেছে | এইটা পূর্ব দিকের ব্যালকনি, এখানে এখন ছায়া |
চোখ বন্ধ করেই বসেছিল সাগরনীল, তোয়াই জিজ্ঞেস করলো, “মাথায় ব্যাথা করছে এখনও ?”
“হুঁ, ওই অত আইসক্রিম খেয়েছি বলেই যেন আরো লাগছে মাথায়, গলায়ও ব্যাথা করছে |”
আইসক্রিম শুনেই তোয়া হেসে ফেললো জোরে, বললো, “সত্যি বাবা !! কি যে করছিলে কাল রাতে তুমি ! প্রায় এক বাক্স আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছো একসাথে !” বলেই আবার খুব একচোট হাসলো, “আর যা প্রলাপ বকছিলে, কি এয়ারপোর্ট, ওমলেটে কড়াইশুঁটি, উল্টো পালটা !”
ওর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সাগরনীল কিছুক্ষন, তারপর চোখে, মুখে দুস্টুমি ফুটিয়ে বললো, “সব প্রলাপ না, আমার ওমলেটে কড়াইশুঁটি সত্যি ভালো লাগে | ওটা আমার সব থেকে প্রিয় সবজি | আর …”
তোয়া তো ওর কথা শুনে আরও হাসছে, জিজ্ঞেস করলো , ” প্রিয় সবজি !! আর ? আর কি ?”
সাগরনীল নিজের মুঠোবন্ধ ডান হাতটা এগিয়ে দিল তোয়ার দিকে |
“কি ?” তোয়া বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো |
“আই লাভ ইউ তোয়া”, বলে নিজের মুঠোটা ওর সামনে খুলে ধরলো |
সাগরনীলর হাতের পাতায় একটা আংটি রাখা | অনাড়ম্বর দেখতে সোনার আংটি, তাতে একটাই বেশ বড় মাপের হিরে বসানো |
সব প্রলাপ না….

আজ একটু অবসর পেয়ে পুরোনো অ্যালবাম খুলে বসেছেন স্বপ্না | নিজের দুই ছেলের ছোটবেলার ছবি দেখছেন |
বাবুন আর বাবুই, রুদ্রনীল আর সাগরনীল |
একজনকে রোজ দেখেন আর অন্যজন ? সেই পাঁচ বছর আগে শেষবার দেখেছেন | আবার দেখবেন এই আশা উনি আর করেন না | এত রাগ, এত বিতৃষ্ণা ওর নিজের মায়ের প্রতি !
অথচ অন্য সবাই বলে সাগরনীলের মনটা নাকি খুব নরম, একবার তাকে ভালো করে চিনলে তার মতন মানুষ হয় না | এত ভালো নাকি সে | শুধু মায়ের জন্যেই এক ছটাক মমতা নেই ওর মনে ?
তবে তার জন্যে উনি ওকে দোষ দিতে পারেন না | আজ সত্যি পিছনে ফিরে যখন দেখেন তার এই অভিমানী ছোট ছেলের কষ্টটা দেখতে পান | উনিই হয়তো দূরে সরিয়ে দিয়েছেন ওকে |
রুদ্রনীল জন্মানোর পরেই বোঝা গিয়েছিল যে ও ঠিক আর পাঁচটা বাচ্চার মতন নয় | তখনকার দিনে ওই মফস্বলে, ডাক্তারও ঠিক করে বলতে পারেননি যে কি হয়েছে | তবে সে স্বাভাবিক না, এটাই ছিল চরম সত্যি | স্বপ্না প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিলেন, বাকিদের মতনই | তারপর মন শক্ত করেছিলেন, উনি চেয়েছিলেন ওকে নিয়েই থাকতে | ওকেই যত্ন করতে | উনার স্বামী সেটা মানতে পারেননি | নীলাদ্রি বলেছিলেন আরেকটা সন্তান উনার দরকার, যে সুস্থ, স্বাভাবিক হবে | যে নাকি বয়েসকালে অবলম্বন হবে | যেটা বলেননি সেটা হলো যে দরকার এমন একটা সন্তান চান যে উনার বোঝা হবে না |
সেই সন্তান সাগরনীল, বাবার দেয়া ডাকনাম তার বাবুই |
সে বাবার স্বপ্নের উপাদান দিয়ে গড়া, একদম মনের মতন | বাবার মতোই তার রোগারোগা চেহারা | বাবার সাথে মুখেরও মিল আর মনেরও | বই পাগল বাবার, যোগ্য ছেলে | জড়বুদ্ধি দাদার ভাগের বুদ্ধিও যেন সাগরনীলের কাছে এসে পড়েছিল | মেধাবী ছেলে আর সেরকমই পরিশ্রমীও | বাবা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন, আর এই ছেলে সেই সব যেন অক্লেশে পূরণ করে দিত | বাবুন ওর পাশে কোথায় লাগে ?
স্বপ্না প্রায়ই ভাবেন, “আচ্ছা বাবুই কি ছোটবেলাতেই বুঝতে পেরেছিল যে মা ওকে জন্ম দিতেই চায়নি ? তাই কি ওর এত রাগ ? না না, তা কি করে হয় ?”
উনি নিজের মনেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছেন আজ অনেক কিছু | আসলে এই বাবুনকে একা হাতে সামলে উনি কিছুতেই ওই চঞ্চল ছেলেটার জন্যে সময় বের করতে পারেননি সেভাবে | না, আজ আর অজুহাত দেবেন না মায়ের ভালোবাসা বাবুনই পেয়েছে, বাবুই নামের ওই মিষ্টি ছেলেটা পায়নি |
আসলে অন্য কেউ বাবুনকে ভালোবাসতো না | তাকে ভালোবেসে লাভ কি ? সে তো তোমার কথাও বুঝবে না | প্রথমেই একজন আয়া রেখে দেবার চেষ্টা হয়েছিল | ওই বাবুই যখন একদম ছোট, কিন্তু সে ঠিক করে দেখাশোনা করতো না | তাই বাবুই একটু বড় হতেই আবার উনি বাবুনের সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন আর সেই করতে বাবুইকে সময় দেয়া হলো না | ওর দেখাশোনা করতে গিয়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন স্বপ্না ধীরে ধীরে | কেউ দেখেনি, কেউ সাহায্য করতে আসেনি | কি ভীষণ নিঃসঙ্গ জীবন উনার | বাকিরা ওদের দুজনকে বাদ দিয়েই জীবনে এগিয়ে গেছে |

বাহ্ রে ! স্বপ্নার ইচ্ছে করতো না বাবুইয়ের সাথে খেলতে ? ওকে আদর করতে ?
দুই ভাইকে একসাথে বসিয়ে রাখতেন তাও যখন একদম ছোট ছিল | কিন্তু বাবুই একটু বড় হতেই এমন চঞ্চল হলো, সে দাদার সাথে বসে বসে খেলবে কি ? ঘরে এক মিনিট থাকতো না | সারাক্ষন শুধু দৌড়ে বেড়াতো, গাছে উঠতো, হাজার দুস্টুমি তার | বকলেও একটা খুব দুস্টু হাসি হাসতো, সবাই গোলে যেত সেই দেখে | স্বপ্না যদি জোর করে ওকে ঘরে ধরে আনতে চাইতেন, তাহলে ওদের বাবাই রাগ করে বলতেন, “ওকে টানাটানি করছো কেন ? খেলতে দাও নিজের মতন |”
আর বড় হয়ে যখন শান্ত হলো ? তখন ওর সাথে আর কি খেলতে পারতো নাকি ওর দাদা | একাই দাবা, স্ক্রাবেল, সুডোকু, ক্রসওয়ার্ড | স্বপ্না দেখতেন, ইচ্ছে হতো একবার পাশে বসে দেখার | কিন্তু এ সুযোগ কোই পেলেন ?
কেউ যদি বাবুনের দ্বায়িত্ব নিত একটু সময়ের জন্যে তাহলেই তো উনি সেইসব করতে পারতেন | কিন্তু কে নেবে ?
ওদের বাবা তো একবার বলেছিলেন যে একটা হোমে রেখে আসা হবে, বলেছিলেন, “বাবুই খুব ব্রাইট | ওকে আরও সময় দিতে হবে | বাবুনের সাথে আর সময় নষ্ট কোরো না স্বপ্না | আমি মানছি ওকেও আমরা ভালোবাসি কিন্তু ওকে বাড়িতে রেখে বাবুইয়ের প্রতি অন্যায় হচ্ছে |” স্বপ্নাই আটকেছিলেন | সে তো নিজের কষ্টটুকুও বলতে পারে না, হোমের লোকে কি করে বুঝবে ? বাবুনের কি দোষ ?
উনার শ্বাশুড়ি বলতেন, “বাবুন থাক না ঘরে | একটু কাঁদলে কিছু হবে না “, “ওকে ছেড়ে বাবুইকে দেখো, তোমার দুটো ছেলে ভুলে যেও না”
না, উনি ভুলে যাননি |
মুশকিলটা হলো উনি তাকে ভুলে যাননি যাকে বাকিরা ভুলে যেতে চাইতো বরাবরই | ডাক্তারও বলেছিলেন বড় জোর দশ, বারো বছর বাঁচবে | সেই ছেলে আজ পঁয়ত্রিশ পেরিয়েছে | বড্ডো ক্লান্ত স্বপ্না ওর দেখাশোনা করে করে | একা আর পারেন না, বয়েস হয়েছে তো | এখন একজন আয়াই দেখে |
আচ্ছা উনিই কি বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন নিজের বড় ছেলের সাথে ? আরেকটু কি ছেড়ে দেয়া যেত না ? সারাজীবন নিজেকে ওর সাথে ঘর বন্দি করে ফেলাটা কি ঠিক হয়েছে ?
এখন উনার মাঝে মাঝে মনে হয় উনিও বুঝি ভেবেছিলেন যে উনার বড় ছেলে সীমিত আয়ু নিয়ে এসেছে | ওই দশ, বারো বছর বাঁচবে | তাই কি উনি এত যত্ন করতেন ওকে ? ভেবেছিলেন হারিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি আর তারপর উনি শুধু ছোটছেলেরই মা হয়ে থাকবেন বাকি জীবন ? যদি আগেই জানতেন যে বাবুন এত দিন থাকবে তাহলেও কি উনি… ?
নিজের এই ভাবনায় উনার নিজেরই লজ্জা লাগে | এই কিসব চিন্তা ভাবনা ? উনি না মা ?

আজ পুরোনো ছবি দেখে স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছেন | বাবুই, ছেলেবেলায় খুব মিষ্টি দেখতে ছিল | একটু গোলগাল, এক মাথা কোঁকড়া চুল | ওকে না ভালোবেসে পারা যায় ? বাবা, ঠাকুমা, পিসি, পিসেমশাই সবাই ভালোবাসতেন | একজন সুস্থ, স্বাভাবিক, চঞ্চল বাচ্চা তাকে নিয়ে মানুষ আনন্দ করবে এতে অবাক হবার কি আছে ? সেখানে বাবুন ? সে না পারতো নিজে ভালো করে হাঁটতে, না ঠিক করে কথা বলতে | তাকে সবাই দ্বায়িত্বের খাতিরে ভালোবাসতো, কেউ মন থেকে না সেভাবে, মা ছাড়া | উনি এইটাই বাবুইকে বোঝাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি |
আজ উনার মনে প্রশ্ন উঠছে | ঠিক কি চেয়েছিলেন উনি সাগরনীলের কাছে ? যে ও মায়ের সময় দাবি করবে না, ভালোবাসা চাইবে না কিন্তু দাদার জন্যে করা মায়ের ত্যাগকে সম্মান করবে ? সেটা তো অন্যায় চাহিদা, নয় কি ?
উনি জানেন, উনি একবারও যাননি ওর স্কুলের পুরস্কার বিতরণী দেখতে | সেটা নিয়েও সাগরনীলের খুব অভিমান ছিল | তখন ভাবতেন বাবুন একা থাকবে কি জানি কি করবে ? এখন ভাবেন একবার, দুবার গেলে কি এমন ক্ষতি হতো ? বাবুই এত আশা করে থাকতো, উনি যেতেন না বলে দুঃখ পেত, সেটা কি উনার উচিৎ হয়েছিল মা হিসেবে ? না উচিৎ হয়নি | একবার যদি ওদের বাবা থেকে যেতেন বাবুনের কাছে তাহলেই তো স্বপ্না যেতে পারতেন | না, সে থাকবে না | বলতেন, “তুমিও চলো, বাবুনকে ঘরে তালা দিয়ে রেখে যাও না | কি সমস্যা ?”|
সমস্যা ছিল তো, পারেননি তাই |
এখন ভাবেন বাবুই ঠিকই বলতো, “তুমি দাদার মা,আমার কেউ না |” কিন্তু উনি শুধু যে ওর স্কুলে যাননি তা তো না, উনি কোথাও যাননি | দোকানে, বাজারে, কোনো আত্মীয়ের বাড়ি, পুজোতে ঠাকুর দেখতে গেছেন ? না | সে খবর কে রেখেছে ?
রুদ্রনীলের একনিষ্ঠ সেবিকা, তার মমতাময়ী মা হওয়া সহজ ছিল না | উনি তাই হতে পেরেছেন, বছরের পর বছর | যার জন্যে কষ্ট স্বীকার করা সেই কিছু বোঝে না, তবুও করেছেন |
সাগরনীলের মা হওয়া সহজ ছিল, সৌভাগ্যেরও ছিল | সেটাই উনি হতে পারলেন না নাকি স্বেচ্ছায় হলেন না ? ওকে সবাই ভালোবাসে এই ভেবে উনি আর নিজের ভালোবাসাটা ওকে বোঝাতে গেলেন না ?
রুদ্রনীল ওরকম ভাবেই বেঁচে আছে সেখানে অন্য একটা সুস্থ সন্তানের সান্নিধ্য, তার সাথে আনন্দ করা সেটা কি উনার বিলাসিতা মনে হতো ? নাকি অপরাধ মনে হতো ? বড় ছেলের প্রতিবন্ধকতার জন্যে কি নিজেকে দায়ী করতেন উনি ? কে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে ?
স্বপ্না মনে মনে ভাবতেন যে বাবুই বড় হয়ে বুঝবে ঠিক মাকে | কিন্তু ওর বাবা এমন করে ওর মনের সবটা দখল করে নিলেন যে সেখানে আর মায়ের জন্যে মায়া, মমতা, প্ৰয়োজন কিছুই থাকলো না | রইলো শুধু অভিমান | আর সেই অভিমানের কি তীব্রতা, কি তার ঝাঁঝ !
বাবা অসুস্থ শুনেই ছুটে এসেছিল দিল্লি থেকে, তাও শেষ দেখা হয়নি | ম্যাসিভ হার্ট এট্যাক হয়েছিল নীলাদ্রির, ও এসে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ | সেদিন সাগরনীলের প্রতিক্রিয়া দেখে স্বপ্না বুঝেছিলেন যে উনার স্বামী ওই ছেলেটার জন্যে ঠিক কতটা ছিলেন | আগে আন্দাজ করতেন, সেদিন প্রতক্ষ করলেন |
একটা বছর তেইশের যুবক যে বাবার মৃত্যুতে ওই ভাবে কাঁদতে পারে, উনি চোখের সামনে না দেখলে বিশ্বাস করতেন না | ওকে দেখে বাকিরা কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল | নিঃশব্দ সে কান্না কিন্তু যেন হাহাকারের মতন বাজছিল সবার কানে | থামানো যাচ্ছিলো না, কেউ সামলাতে পারছিলো না | যেন পৃথিবীতে ওর একমাত্র আশ্রয়টা কেড়ে নিয়েছেন ভগবান | এই সুবিশাল পৃথিবীতে যেন আর কেউ নেই ওর, “আমি কি করে বাঁচবো ?” এই কথার রকম ফের শুনেছিলেন ওর মুখে | আর উনি যখন মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন, “বাবুই, আমি আছি তো…”, এই বলে ?
ওরে বাবা !! এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছিল উনার হাত, ” ছেড়ে দাও আমাকে একা | ওটা বাবার দেয়া নাম, ডেকো না আমাকে ওটা ধরে “| বাবার প্রতি যত অনুরাগ, মায়ের জন্যে ওর মনে পুষে রাখাছিল ঠিক ততটাই বিরাগ | তাও আজ প্রায় দশ, এগারো বছর পেরিয়ে উনি দেখতে পাচ্ছেন সেদিনও উনি চেষ্টা করতে পারতেন ওকে কাছে টানার |
করেননি | তাহলে ওর দোষ দেন কি করে ?
ওইরকম সাংঘাতিক কান্নকাটি করে নিজেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সাগরনীল | এমনিতেই রোগা মানুষ, অতো দূর থেকে এসেছিল, এসেই এইরকম ধাক্কা …সব মিলিয়ে খুব কাহিল হয়ে গিয়েছিল | ধুম জ্বর বাঁধিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ একদম বেহুঁশ অবস্থায়, বিছানায় পড়েছিল | ওর পিসি,অঞ্জনা, আসানসোলেই থাকেন, আর নিজের এই ছোট ভাইপোকে খুব ভালোও বাসেন | মায়ের জায়গায় সেদিন পিসিই বসে থেকেছে ওর মাথার কাছে | পিসি আর পিসেমশাই | ডাক্তার দেখানো, দেখাশোনা করা সব উনারাই সামলেছিলেন |
আর স্বপ্না ?
বাবা যে মারা গেছে সেটা তো উনার বড় ছেলে বুঝতেই পারেনি | “বাবা কোই?” এই প্ৰশ্ন করে করে নিদারুন অশান্তি শুরু করেছিল, জিনিসপত্র ছুঁড়ে, ভেঙে কি কান্ড ! তাকে সামলাতেই তো উনার সমস্ত শক্তি চলে গিয়েছিল | নিজের শোকই উনি ছুঁয়ে দেখার সময় পাননি যেন | সাগরনীলের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাবেন কি করে ?
তবে শুধু কি সেটাই কারণ ? উনি সেদিন অপমানে যাননি, সেটাও তো সত্যি | সবার সামনে যে ভাবে সাগরনীল মাকে অপদস্ত করেছিল, “ছেড়ে দাও আমাকে ..”… এই বলে উনি ওর কেউ নন বুঝিয়ে দিয়েছিল, সেটা উনার মনে বাজেনি ? তাই তো আর যাননি ওর কাছে |
এখন ভাবেন, বাবার শোকে বলে ফেলেছে ভেবে ক্ষমা করে দিতে পারতেন না ? নিদারুন ধাক্কা খেলে মানুষ বলে না যে “আমার সান্ত্বনা চাই না, আমাকে একা ছেড়ে দাও”? তখন তাকে যারা ভালোবাসে তারা কি সত্যি একা ছেড়ে দেয় ? না, একদম না | উল্টে আরও আগলে রাখে | তাহলে উনি কেন সেদিন ওর পাশে থাকলেন না ? সেটা যে ওর মনের কষ্টের কথা, উনি মা হয়ে বুঝলেন না ?
সাগরনীল ফিরে যাবার পরে, অঞ্জনা কিন্তু এসে উনার কাছে অভিযোগ করেছিল, “সাগর কিন্তু ভালো করে সুস্থ না হয়েই ফিরে গেল | দাদা চলে যাওয়াতে বেচারা একদম ভেঙে পড়েছে | তুমি একটু ওর কাছে বসতে অব্দি এলেনা বৌদি | ওর সাথে কেন যে এরকম কোরো তুমি আমি বুঝতে পারিনা, ও কিন্তু এইগুলোতে খুব কষ্ট পায় “|
আজ ভাবলেন, কি কৈফিয়ত উনি দেবেন নিজের ব্যবহারের ? সাগরনীলেরই দায় ছিল মাকে বোঝার, উনি কবে চেষ্টা করলেন ছেলেকে বোঝার ?

অথচ উনি কিন্তু ওকে সত্যি ভালোবাসেন | সব সময় চেয়েছেন যে ভালো থাকুক, উন্নতি করুক | তবুও শুধু উনার জন্যে ছেলেটার জীবনটাই কেমন খাপছারা হয়ে গেল | উনার প্রতি রাগটা এত বড় হলো যে সাগরনীল নিজের ভালোবাসাটা অব্দি ছুড়ে ফেলে, পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল একদিন |
সাগরনীলেরই ছোটবেলার বন্ধু ছিল সঙ্গীতা | নরম সরম মেয়ে, খুব মিষ্টি | রুদ্রনীলকে দাদা বলে ডাকতো, ধৈর্য ধরে খেলতে ওর সাথে | বড় হয়ে সাগরনীলের সাথে মন দেয়া নেয়া হয়েছিল | স্বপ্নার সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল, ভেবেছিলেন, ওকেই সোপান করে পৌঁছে যাবেন একদিন ছেলের কাছে | বিয়ের কথা বলতেই এসেছিল সাগরনীল | তখন সবে সবে স্টার্টআপ শুরু হয়েছে, হায়দেরাবাদেও এক বছর আগেই গেছে | তখনও বেশ ভালো মাইনের চাকরি করে | বৌভাত ও হায়দেরাবাদে করবে, এই ইচ্ছে ছিল | বলেছিল, “বাবা তো নেই আর, এখানে অনুষ্ঠান করলে প্রতি মুহূর্তে বাবাকে আরও মিস করবো আমি |”
সেটা অন্যায্য কথা না | ও যে মাকে যেতে বারণ করেছিল এরমও না, কিন্তু উনি হয়তো যেতে পারবেন না সেটা কি জানতো না ? প্রথমে কলকাতা যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে ফ্লাইট | রুদ্রনীলকে নিয়ে অতদূর যাওয়া সোজা কথা না, প্রায় অসম্ভব |
সঙ্গীতা নিজের ভালোবাসার উপর ভরসা করে জেদ করেছিল, ” বাবা নেই সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য, কিন্তু তোমার মা তো আছেন | কাকিমা যেতে পারবেন না হয়তো অতদূর, আর উনি না থাকলে কি করে হবে ? এখানেই হোক বৌভাত, আসানসোলে | ”
“যাবে কি যাবে না সেটা মায়ের ব্যাপার | বৌভাতে মা না থাকলে কি করে হবে ? মানে কি ? বলতে কি চাইছো ? ” বিরক্ত হয়েছিল সাগরনীল|
সঙ্গীতা সামলাতে বলেছিল, “এভাবে কেন বলছো সাগর ? বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনিই থাকবেন না উনি ঐসব আচার, নিয়ম মেনে | বৌভাতে অন্তত থাকতে দাও | উনি আমাদের আশীর্বাদ না করলে কি করে চলবে ?”
কি নিষ্ঠুর একটা হাসি হেসেছিল সেদিন সাগরনীল,”কেমন করে চলবে ? যেমন করে আমার সারাটা জীবন চলে এসেছে সঙ্গীতা | আমার মায়ের আশীর্বাদ, মায়া, মমতা ছাড়াই তো বেঁচে আছি আমি এই সাতাশ বছর | তাহলে এখন আবার কি এইসব ?”
সঙ্গীতা কি করবে বুঝতে পারেনি, তাও সেদিন ওর মায়ের কথা মনে করেই, ওর সাথে উনার সন্ধি করিয়ে দেবার অবুঝ ইচ্ছে নিয়ে বলেছিল, “সাগর নিজের মায়ের উপর এইভাবে রাগ করো না | আমাদের আনন্দের দিনে, আমি চাই উনিও থাকুন |”
চোখে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তবু সাগরনীল ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “সঙ্গীতা, তোমার কাছে আমার কোনো কথা লুকোনো নেই | আমার আনন্দে, দুঃখে, অসুখে, কোনো কিছুতেই আমার মায়ের কিছু যায় আসে না | কাজেই আজ তুমি এইসব কথা তুলে আমাকে কেন কষ্ট দিতে চাইছো, আমি জানি না | তুমি যদি আমার মায়ের উপস্থিতির উপরে জোর দাও, তাহলে আমি বলতে বাধ্য হবো যে এই বিয়ে হবে না | আমি না আমার মা ? কাকে তোমার দরকার তুমি বেছে নাও |”
সেদিন পরিষ্কার করে সাগরনীলের মনের মতন উত্তর সঙ্গীতা দিতে পারেনি | সাগরনীলও আর সে উত্তর খুঁজতে চায়নি | ফিরে গিয়েছিল তার পরের দিনই, শর্তসাপেক্ষ ভালোবাসায় কোনো উৎসাহ ছিল না ওর | স্বপ্না বলেছিলেন হায়দেরাবাদে হোক বৌভাত, উনার কোনো আপত্তি নেই | কিন্তু সে আর কে শুনছে ? সঙ্গীতা সাগরনীলকে আর ফেরাতে পারেনি | আবার এইরকম অন্ধ রাগ দেখে মনে মনে ভয়ও পেয়েছিল | ভবিষৎতে যদি ওর উপরেও এইরকম রাগ হয় সাগরনীলের ? তখন ?
সম্পর্কটা এমন ভেঙে গেল, কি আর করার ছিল ? সঙ্গীতার বাবা, মা আর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি, অন্য জায়গায় মেয়ের বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন, কি বলে আর আপত্তি করতো সঙ্গীতা?
সেই শেষ বার সাগরনীলকে দেখেছেন স্বপ্না, পাঁচ বছর আগে | মাকে টাকা পাঠায় প্রতি মাসে, ফোন করলে জিজ্ঞেস করে প্রতিবার, “শরীর ঠিক আছে ? দাদা কেমন আছে ?”
এই দ্বায়িত্ত্ব তো চিরকাল করে এসেছে, কোনোদিন ফাঁকি দেয় নি সাগরনীল | শুধু যেন কোনো টান নেই…সে জন্যে কি স্বপ্না দায়ী নন ? শুধু সাগরনীলই দায়ী ?
এখন এক জনই আছে আসানসোলের সাথে সাগরনীলের যোগসূত্র, ওর পিসি অঞ্জনা | তার সাথে সাগরনীলের যোগাযোগ আছে বেশ, কথাও হয় অনেক | কোনো নতুন কিছু হলে জানায় | ওই যে ওদের কোম্পানির সাফল্যের জন্যে ওদের পুরস্কার দেয়ার কথাও পিসিকেই বলেছিল, মাকে না | আসলে ছেলেবেলা থেকেই ওকে খুব ভালোবাসেন অঞ্জনা | মায়ের কাছে আদর না পাক, পিসির কাছে গেলেই খুব যত্নআত্তি পেত | সেটা ভোলেনি সাগরনীল, নিজেও খুব ভালোবাসে পিসিকে | অঞ্জনাও ওকে ফোন করেন প্রায়ই, খোঁজ নেন |
অঞ্জনার কাছেই স্বপ্না শুনেছেন একটা নতুন নাম, স্বচ্ছতোয়া |

(চলবে)রে এসেছে, কোনোদিন ফাঁকি দেয় নি সাগরনীল | শুধু যেন কোনো টান নেই…সে জন্যে কি স্বপ্না দায়ী নন ? শুধু সাগরনীলই দায়ী ?
এখন এক জনই আছে আসানসোলের সাথে সাগরনীলের যোগসূত্র, ওর পিসি অঞ্জনা | তার সাথে সাগরনীলের যোগাযোগ আছে বেশ, কথাও হয় অনেক | কোনো নতুন কিছু হলে জানায় | ওই যে ওদের কোম্পানির সাফল্যের জন্যে ওদের পুরস্কার দেয়ার কথাও পিসিকেই বলেছিল, মাকে না | আসলে ছেলেবেলা থেকেই ওকে খুব ভালোবাসেন অঞ্জনা | মায়ের কাছে আদর না পাক, পিসির কাছে গেলেই খুব যত্নআত্তি পেত | সেটা ভোলেনি সাগরনীল, নিজেও খুব ভালোবাসে পিসিকে | অঞ্জনাও ওকে ফোন করেন প্রায়ই, খোঁজ নেন |
অঞ্জনার কাছেই স্বপ্না শুনেছেন একটা নতুন নাম, স্বচ্ছতোয়া |

(চলবে)#বাবুই পাখির বাসা – ২
#অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কাজ করতে বসলো ঠিকই তবু মনে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই দিনগুলো |
তখন কত বয়েস ছিল সাগরনীলের ? এই পাঁচ-ছ বছর |
দুস্টু ছিল খুব | রবিবার দুপুরে ঠাকুমার পাশে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে শুয়েছিল | যেই ঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়েছেন, ব্যাস!! এক দৌড়ে বাইরের বাগানে | কিছুক্ষন তো খুব হুটোপুটি, তারপর ওই বড়ো মতন পেয়ারা গাছটা থেকে নামাতে গিয়ে পা ফস্কে একদম নিচে | ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল আর ডান পায়ের হাঁটুর কাছে কেটে গিয়েছিল অনেকটা |
সে কি যন্ত্রনা !!
চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল !!
সেই আওয়াজে বাড়ির সবাই বেরিয়ে এসেছিল বাগানে | ওর বাবা ওকে কোলে তুলে দৌড়েছিলেন হাসপাতালে | প্লাস্টার করা হাত আর চার-পাঁচটা সেলাই করা পা সেদিনের ডাকাবুকো, দস্যি ছেলেটাকে একদম কাহিল করে দিয়েছিল | ওইটুকু তো ছিল ও, কষ্ট হয়েছিল খুব | বাড়ি ফিরে এসেও খুব কান্নাকাটি করছিল, “মায়ের কাছে যাবো …” এই বলে | শিশুর মন, সব থেকে নিরাপদ আশ্রয় তো মায়ের কোলেই, আর কোথায় যাবে ?
ডান হাতে প্লাস্টার, তাই নিজের ছোট্ট বাঁ হাতটাই মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, ” মা!! আমাকে কোলে নাও ..”
ওর মা হাত বাড়িয়েছিলেন ওকে কোলে নিতে, কিন্তু তখনই রুদ্রনীল ভাইকে দেখে এমন অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছিল যে ওকে সামলাতে যেতে হয়েছিল | আসলে মা ছাড়া অন্য কারুর কথা শুনতো না রুদ্রনীল, ওরফে বাবুন, আজও শোনে না | ওর ঠাকুমা মাকে বলেছিলেন, “আজ তুমি বাবুইয়ের কাছে থাকো বৌমা, বাবুন কাঁদুক আজ একটু নিজের মতন, আমি বসছি ওর কাছে |”
কিন্তু ওর মা দাদাকে ছেড়ে ওর কাছে আসেনি | ভেবেছিলেন বড় ছেলেকে চুপ করিয়েই চলে আসবেন | আসতে সময় লেগেছিল, আর যতক্ষনে এসেছিলেন তার ছোট ছেলে অভিমানে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল, আর কোনোদিন সে মায়ের কাছে যাবো বলে বায়না করেনি |
সাগরনীলের মন খুব অভিমানী, সেই ছেলেবেলা থেকেই | আর পাঁচজন মানুষে যে জিনিস এক দুদিনে ভুলে যায়, ওর মনে লেগে থাকে বছরের পর বছর, সে ভালো মন্দ দুই | মা তো আসেনি !! মায়ের ওই প্রত্যাখ্যান খুব বেজেছিল ওই ছোট্ট ছেলের মনে | বাবার কোলেই অনেক অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল | এক দুবার মা আদর করতে এসেছিল, অভিমান করে বলেছিল,”আমাকে আদর করতে হবে না, যাও দাদার কাছে যাও | তুমি ওর মা, আমার কেউ না |”
ওর মা ভেবেছিলেন ছেলেমানুষি অভিমান | নিজের ছেলের মনের গভীরতা আঁচ করতে পারেননি, কষ্টটা ধরতে পারেননি | উনি তো ওকেও ভালোবাসতেন, সব সময় বেসে এসেছেন | ছেলে যে সেটা অবিশ্বাস করে তা উনি বুঝতে পারেননি, কল্পনাই করতে পারেননি | তাই ওকে মানিয়ে বুঝিয়ে নেবার চেষ্টাও করেননি | কত ছোট্ট বাচ্চাই তো কোনো না কোনো সময় রাগ করে বলে,”মা আমাকে ভালোই বাসে না “, বলে না ? কিন্তু সেটাই যে সাগরনীলের জীবনের একটা কঠিন সত্যি হয়ে যাবে | ওর বড় বড় সব সিদ্ধান্তের ভিত হবে তা উনি সেদিন ঘুনাক্ষরেও টের পাননি |
যতদিনে পেয়েছেন আর ছুঁতে পারেননি তার ওই অভিমানী ছোট ছেলেকে | সে ততদিনে মাকে ছাড়াই বাঁচতে শিখে গেছে | মায়ের আর কোনো জায়গা ছিল না তার জীবনে |
তবে সাগরনীলকে, ওর কষ্টটাকে খেয়াল করে দেখেছিল আর একজন |
দস্যিপোনা কমে এসেছিল হাতে পায়ে লাগায় তা ঠিক, কিন্তু ব্যথায় হেরে শান্ত হয়ে থাকার ছেলে না সাগরনীল | তাও ওই দুর্ঘটনার দুসপ্তাহ পরেও ওইরকম চঞ্চল ছেলে ছুটির দুপুরে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে দেখে, উনি বুঝছিলেন শুধু ব্যাথা না আরও কিছু হয়েছে | ওই নিষ্পাপ শিশু মুখে একটা বেমানান উদাস দৃষ্টি দেখে, ওর মনের খবর পেয়ে গিয়েছিলেন সেই মানুষটি |
তিনি ওর বাবা |
“বাবুই ? এখন একা বসে আছিস কেন রে ? কি দুস্টু বুদ্ধি আঁটছিস রে, হুঁ ?” পাশে বসে জিজ্ঞেস করেছিলেন |
“জানো বাবা, মা কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে ?”
ওর বাবা জানতেন এই প্রশ্নের কি উত্তর ছেলের মনে, তাও নিজের ভাবনা চাপিয়ে দেননি, উল্টে হেসে ওকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কাকে রে ? আমি তো জানি না |”
নির্দ্বিধায় বলেছিল, “দাদাকে | আর আমাকে একটুও না জানো বাবা | আমাকে মা ভালোই বাসে না”, চোখ দিয়ে নোনা জলের বড় বড় ফোঁটা গড়িয়ে নেমেছিল |
ওর বাবা বুঝেছিলেন যে এখন যদি ওকে বোঝাতে বসেন যে “না বাবুই | মা তোকেও খুব ভালোবাসে” সে বুঝতে চাইবে না | তাই সেদিকে না গিয়ে ওরই কথার সুর ধরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আর বাবা কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে বল তো দেখি ?”
এটা তো ভেবে দেখে নি ?
মন ঘুরে গিয়েছিল এই জিজ্ঞাসায় | সহজ কৌতূহল মাখামাখি হয়েছিল গলায়, চোখ চকচক করে উঠেছিল, অজানা আশংকায়, অচেনা আশায়, “কাকে বাবা ? কাকে তুমি সব থেকে বেশি ভালোবাসো ?”
উনি হেসে বলেছিলেন, “সে আছে জানিস একটা দস্যি ছেলে, দুপর বেলা গাছে চেপে বেড়ায় একা একা | কি নাম বল তো তার ?”
মুখ থেকে সব অন্ধকার দূর হয়ে গিয়েছিল, আনন্দে কানায় কানায় ভোরে গিয়েছিল ছোট্ট মন, বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, “বাবুই ! বাবা তুমি আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো ? কি মজা !!”
এই কথা বলেই বাবাকে একদম জড়িয়ে ধরেছিল সেদিনের সেই ছোট্ট বাবুই | সেই গরমের দুপুরে বাবা হয়ে গিয়েছিলেন ওর সারা জীবনের এক আশ্রয় | সেইদিন থেকে সাগরনীলকে এত ভালোবেসেছিলেন ওর বাবা আর এত ভাবে প্রকাশ করেছিলেন সে কথা, যে মায়ের সব না দেয়া পুষিয়ে গিয়েছিল |
বাবুইয়ের ছিল শুধু বাবা !!
আসলে হয়তো ওদের বাবা এবং মা দুজনেই দুই ছেলেকেই খুব ভালোবাসতেন | সে ভালোবাসার ধরণ আলাদা ছিল | তবে ওর বাবা নিজের বিচক্ষণতায় বলেছিলেন সেই ছেলেকে যার শোনাটা দরকার ছিল, নাহলে সে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেই ছেলেকে বলতে যাননি যার কথা বোঝার বোধই ছিল না পারতপক্ষে |
ওর মা করছিলেন ঠিক উল্টো জিনিসটা |
তাই রুদ্রনীল ওর ওই সীমিত বোধে শুধু বলেই যেত,”মা আমাকে ভালোবাসে ভালোবাসে …” সে কথাটার মানে ওর কাছে অস্পষ্ট | মায়ের কাছে শুনে শুনে বলা |
কিন্তু সাগরনীল ? সে তো কথার মানে বুঝতো | মায়ের মুখের রং বদল বুঝতো | রুদ্রনীলের এই কথা গিয়ে বিঁধতো ওর মনে | ওর কাছে মানে দাঁড়াতো, “মা শুধু দাদাকেই ভালোবাসে, আমাকে ভালোবাসে না |”
সাগরনীল এইটাই জানলো, যে ও ব্যাথা পেয়ে মায়ের কাছে যাবে বলে আব্দার করেছিল আর মা ওকে কোলে নেয় নি | এই ভেবেই বড় হলো | জানলো না যে ও ঘুমিয়ে পড়ার পর মা কত আদর করলেন | জানলো না, কারণ উনি তো বললেন না |
ওর কানে কানে তো বললেন না, “বাবুই, মা তোকে খুব ভালোবাসে |”
ঘুমন্ত ছেলেকে তো আর কোনো মা ডেকে তুলে বলেন না,”এই শোন ভালো করে মন দিয়ে, আমি তোকে ভালোবাসি | মনে রাখিস এই কথা, কাল আবার বলবো কেমন ?” আর ও যখন জেগে থাকলো উনি একটুও সময় বের করলেন না |
কিন্তু ওর প্রতিটা জেগে থাকা মুহূর্তে যেন ওর বাবা বলেছেন ঠিক সেই কথা, আর বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলে বলে সাগরনীলও যেন মনে মনে জেনেছে এইটাই সত্যি |
“বাবা কাকে ভালোবাসে সব থেকে বেশি ?”
“আমাকে!!”
“হ্যাঁ !! আমার বাবুই পাখি কে !”
মায়ের অভাবে বাবাই হয়ে দাঁড়ালেন ওর গোটা পৃথিবী |
ছেলে গাছে উঠতে ভালোবাসে বলে বানাবেন ঠিক করলেন এক ট্রি-হাউস | বাগানেরই একটা বড় গাছে | ওইটুকু বয়েসেও কিন্তু সাগরনীলের ভাবনা ছিল স্বচ্ছ, হিসেবে নিকেশ বুঝতো ভালো | ট্রি হাউসের পরিকল্পনাতে বাবার সাথে ও নিজেও যোগ দিল | তা সেই ট্রি-হাউস লোক ডাকিয়ে বানালো হলো | ঘোরানো সিঁড়ি দেয়া, একটা বেশ ভালো, বড় ঘর | একজনের জন্যে তো যথেষ্টই, দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষও আরামসে দাঁড়াতে, বসতে পারে |
বাবা ওকে কতটা ভালোবাসে তারই একটা নির্দশন ওই ট্রি-হাউস |
সেটা যেদিন একদম তৈরী হলো, সেদিন যেন আনন্দ ধরে না সাগরনীলের | তাও আরও সোহাগ ছিল পাওনা | ওর বাবা নিজের হাতে লেখা একটা বোর্ড লাগিয়ে দিলেন ওই ট্রি-হাউসের গায়ে, “বাবুই পাখির বাসা” |
সেখানেই বসে কত সময় যে কাটিয়েছে সাগরনীল, কত পড়াশনা করেছে, গল্পের বই পড়েছে | আর কোথাও না পাওয়া গেলে ওইখানেই থাকবে ও, সবাই জানতো | ওর বাবা যেন ওকে একটা আলাদা জগৎ তৈরী করে দিয়েছিলেন | আর সেই জগতেই পাখা মেলেছে ওর সব প্রতিভা, বাবার আদরে সাগরনীল সেইসব কাজে সাহস পেয়েছে যা এমনিতে হয়তো হতো না | এই যে ও ব্যবসায় নামলো, সেই মনের জোরও বাবা ওকে জুগিয়েছেন মৃত্যুর ওপার থেকে |
” তোর যা ইচ্ছে তুই করতে পারিস বাবুই, মন দিয়ে চেষ্টা করলে তোর অসাধ্য কিছুই না”, এই মন্ত্র ওর কানে দিয়ে গেছেন | সাগরনীল জানে ওর অসাধ্য কিছুই না | বুদ্ধি আর শ্রম এই দুই মিলিয়ে সব স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব | মেধা ওর এমনিই ঈশ্বরদত্ত আর ছেলেবেলার দুস্টুমি ছেড়ে একটু বড় হয়ে যেই শান্ত হলো ও, প্রতিদিন যেন আরও মেধাবী হয়ে উঠলো, আরও পরিশ্রমী | সব শিক্ষকরা বলতেন, এই ছেলে অনেক দূর যাবে | ঠিকই বলতেন |

“বাবুন তো ওখানে উঠতে পারবে না, ওর কষ্ট হবে ওটা দেখে | কেন বানালে বাড়িতে ?” এই প্ৰশ্ন করেছিলেন ওর মা, বাবাকে | না সাগরনীলের সামনে না, ও শোনেনি |
ওর বাবা কিন্তু সেদিন রুক্ষ ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, “এমন অনেককিছু বাবুই করবে, পারবে যা বাবুন কোনোদিন পারবে না | একজনের সীমাবদ্ধতা অন্যজনের পায়ের শিকল কোরো না স্বপ্না | বাবুইকে খোলা মনে বড় হতে দাও, ভালো করে বাঁচতে দাও, সাহস দাও এগোনোর |”
“কিন্তু বাবুইকে তো একদিন দাদার দায়িত্ব নিতে হবে | ওকে তো বুঝতে শিখতে হবে |”
ওদের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “এখন তো বাবুই খুব ছোট্ট, এখন এই বোঝা ওর উপর চাপিয়ে দিও না | ও বড্ডো সেনসিটিভ | এইসব এখন বলার সময় আসেনি ওকে, ওকে এখন বুঝতে দাও যে আমরা ওকেও খুব ভালোবাসি,শুধু বাবুনকে না | তুমি ওকেও সময় দাও | ”
সেদিন যেন কেউ স্বপ্নার চোখের সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল | তাই তো !! বাবুই তো সুস্থ, স্বাভাবিক তার জন্যে তো অন্য রকম ব্যবহার দরকার | কিন্তু সময় যেন আর উনার কুলোয়নি, দুই ছেলের দুরকম মা হবার |
বাবুই বেড়ে উঠেছিল উনার নাগালের বাইরে, নিজের ওই বাসায় | সেখানে ওর আর ওর বাবার এক আলাদা পৃথিবী | কেউ সেখানে বাবার সময়ের ভাগিদার না, সেখানে একটাই অক্ষয় সত্যি, “বাবা সব থেকে বেশি ভালোবাসে বাবুইকে” |
সাগরনীল বরাবরই পড়াশোনায় ভালো, বছরের পর বছর ও প্রথম হয়েছে, পুরস্কার পেয়েছে | ওর কোনো পুরষ্কার নেবার অনুষ্ঠানে কিন্তু ওর মা যাননি | ও যখন ট্রফি, মেডেল বা কাপ হাতে বাড়ি ফিরেছে, ওর মা দেখতে চেয়েছেন প্রশ্ন করেছেন কত হাসি মুখে | সেসব ওর মন দাগ কাটেনি | কি লাভ ? একবার যাওয়া যায় না ? যারা দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছে তাদের মায়েরাও এসেছেন | শুধু আসেনি ওর মা | কেন ? প্রতি বছর প্রথম হয় ও, সেটা কি একটুও আনন্দের না ?
ও শুধু শুনে এসেছে মায়ের কাছে যে “দাদাকে রেখে যাওয়া যায় না বাবুই, এই তো আমি এখন দেখছি | কত ভালো লাগছে |” একদিন দাদাকে রেখে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ওর মা হওয়া যেত না ? সাগরনীলের মনে হতো যে মায়ের কাছে ও অবাঞ্ছিত, কিন্তু ওর দোষটা যে ঠিক কি সেটা বুঝতে পারতো না | একটুও সময় নেই কেন ওর জন্যে ?
আজও ও ঠিক বুঝতে পারে না |
প্রথম প্রথম তো ছোট ছিল, উত্তর দিত না | শুধু মন খারাপ করতো | আরেকটু বড় হয়ে পালটা উত্তর দিত, “থাক আর আমার মেডেল দেখার ভান করতে হবে না | যাও দাদার ওই এ, বি, সি, দি লেখা দেখো খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে |”
আর তারও পরে, কিছু জানাতোই না মাকে | মা যেন ওর কেউ না, এই ভাবে উনার কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে | ওর মায়ের ওর কোনো কথাই যেন মনে থাকতো না |
আইআইটিতে ও পেয়ে গেছে সেই খবরও চেপে রাখলো | ওর বাবা অফিস থেকে বাড়িতে ফোন করলেন পেয়েছে কি না জানতে | তখন ও ফোনের পাশেই বসে ছিল, জানতো বাবা ফোন করবে | নিজেই ফোন ধরে খুব ধীর গলায় বাবাকে উত্তর দিল | ওর বাবা ফেরার সময় অনেক মিষ্টি, কেক নিয়ে এলেন ওর জন্যে | এসে দেখেন যে সাগরনীল বাইরে বারান্দায় একা একা উদাস মুখে বসে আছে, আর সারা বাড়ি অন্ধকার |
উনি ঢুকে এসে এল জ্বালাতেই ওর মা বেরিয়ে এসে বললেন, “আসলে আজ বাবুন ওই আলো নিয়ে খুব রাগারাগি করছিল তাই …”
সাগরনীলের হয়ে ওর বাবাই রেগে গিয়ে বললেন, “আজ বাবুই আইআইটিতে পেয়েছে, আর তুমি এমন ঘর অন্ধকার করে রেখেছো যেন কি একটা হয়েছে আমাদের বাড়িতে | ছেলেটা একা একা বাইরে বসে আছে, সেটাও কি তোমার চোখে পড়ে না স্বপ্না ? আর কিছু বিশেষ রান্নাবান্না করেছকিনা ওর জন্যে সেটা তো জিজ্ঞেস করাও ভুল |”
ওর মা অবাক হয়ে বললেন,”আমাকে তো ও বলেই নি | কি করে জানবো ? আর তাছাড়া বাবুন..”
ওর বাবার সেদিন ধৈর্যের সীমা পার হয়ে গিয়েছিল, “বাবুন, বাবুন …যথেষ্ট হয়েছে | একটা না তোমার দুটো ছেলে, ভুলে গেছো নাকি সেটা ?? আর ও বলেনি তোমাকে ? তুমি একবারও জিজ্ঞেস করেছওকে ? জানো না আজ রেজাল্ট বেরোনোর দিন ? থাক আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই …”
সেদিন ওকে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন ওর বাবা, পরেরদিন একটা দামি ঘড়িও কিনে দিয়েছিলেন | সত্যি খুব খুশি হয়েছিলেন |
আর ওর মা ?
পরের দিন সকালে ওর ঘরে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাকে একবার বললি না কেন বাবুই তোর রেজাল্ট বেরিয়েছে? ” শুধু ওরই যেন দায় |
ছেলে উদাস হয়ে বলেছিল, ” কি লাভ হতো মা বলে ? কি করতে তুমি ? এখন তো জানো, কি করছো বোলো ? ”
উনি আর কিছু বলেন নি |
সেদিনও প্রচুর দূরত্ব ছিল মায়ের সাথে, ক্রমশ সেটা আরো বেড়েছে |

কার দোষ ? শুধু ওর, শুধু ওর মায়ের ? না দুজনেরই ? নাকি পরিস্থিতির ?

আলাপ দিব্যি জমে উঠেছে স্বচ্ছতোয়া আর সাগরনীলের | প্রায়ই দেখা হয়, একে ওপরের বাড়িতেও গেছে বেশ কয়েকবার এই ক’মাসে | গল্প ওদের ফুরোতে চায় না, কত যে কথা | সাগরনীলের বইয়ের ঘর দেখে তো তোয়া অবাক হয়ে গেছে, “এত বই ? ইশ কি মজা !!”
“তুমি যেটা ইচ্ছে নিয়ে পড়ো, যখন ইচ্ছে এস”, এই বলে নিজের বাড়ির একটা ডুপ্লিকেট চাবিও ওকে দিয়ে দিয়েছে সাগরনীল | তোয়া ওকে যত দেখে ততই অবাক হয় | বাড়ির চাবি কেউ দিয়ে দেয় নাকি এই ক’মাসের আলাপে ? তা, বাকিরা যা করে তা যে সাগরনীল করে না সেটা যদিও এতদিনে তোয়াও বুঝে গেছে, তাই মনে মনে অবাক হলেও ওকে বলেনি সেটা |
মাঝেমাঝে জোর তর্ক লেগে যায় ওদের কোনো বই নিয়ে, কোনো খবর নিয়ে, বা রাজনীতি নিয়ে | সেই সময়গুলোতে অস্থির হয়ে পায়চারি করে সাগরনীল আর ওই রোগা হাত দুটো নাড়িয়ে অনেক কিছু বলে | তোয়াও নিজের বক্তব্য চোখ গোলগোল করে বলে দেয়, কেউ ছাড়ে না | তারপর তর্ক আবার মিটে আসে, কেউ একজন মেনে নেয় বা দুজনেই তর্ক করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে |
মাঝে মাঝে সাগরনীল বলে, “আচ্ছা বেশ ! আরেকটু পড়তে হবে দেখছি | এখন এই অব্দি থাক, পরের শনিবার আবার বসবো এটা নিয়ে | হার মেনে নিচ্ছি না কিন্তু, যুদ্ধবিরতি |”
তোয়াও অম্লান বদনে বলে, “হ্যাঁ আজ বিরতি, পরের সপ্তাহে তোমার পরাজয় | সে ঠিক আছে |”
তবে, তর্ক তর্কর জায়গাতেই থাকে, সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে ফেলে না ওরা | এই করে সময় ভালোই এগোচ্ছে ওদের |
তোয়ার আগমনে নীলেশ আর শ্রুতিও খুব খুশি | সাগরনীল একা একা থাকতো, ওদের চিন্তা হতো | নীলেশের ছেলে, নৈঋত, এমনিই সাগরনীলের খুব ভক্ত | দেখা হলেই চকলেট, আইসক্রিম লাভ হয় | সাগরনীলের ফ্রিজেও এইসব ঠাসা থাকে, ওর বাড়ি আসলেও হাতে স্বর্গ পায় | এখন তার তোয়াকেও খুব পছন্দ হয়েছে | সাগরনীলকে কানে কানে বলেছে, “তোয়া আন্টি খুব সুইট, তুমি ওকে বিয়ে করে নাও | আমি তোমাদের বাড়ি এসে থাকবো”|
সাগরনীল জিজ্ঞেস করলো, ” তুই চলে আসবি ? তা তোর বাবা, মা কি করবে ?”
তাতে ওর সহজ উত্তর, “ও মাঝেমাঝে বাড়ি যাব, রোজ না | মা শুধু বকে আমাকে আর পড়তে বলে | ”
তাই শুনে হেসে গড়িয়ে গেল সাগরনীল, বললো, “তোর মা আমাকে যা বকবে না এইরম করলে !! আমি রোগা সোগা মানুষ নৈঋত, তোর মা মেরে আমার হাত, পা ভেঙেই দেবে | দেখ শ্রুতি দেখ, তোর ছেলে কি বলছে |”

তোয়াকে নিয়ে অসুবিধে হয়েছে শুধু সাগরনীলের কাজের লোকটির | প্রথম দিন ওর বাড়ি গিয়েই তোয়া বলেছিল, “একি এরকম ধুলো কেন ? কাজের লোক রাখো নি ?”
তাতে একটু ভেবে সাগরনীল বলেছিল, “হ্যাঁ আছে একজন, মাসের এক তারিখে তো পাক্কা আসে |”
সেদিনই তাকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়ে গোটা বাড়ি পরিষ্কার করিয়েছিল তোয়া আর খুব ধমকেছিল, “এইবার যদি দেখি ভালো করে কাজ করছো না, একদম ছাড়িয়ে দেব |” এত কাজ সে বেচারি এত বছরে করেনি এই বাড়িতে | সব ঝেড়ে, ঝাঁট দিয়ে, মুছে তবে ছাড়া পেল | সে যদিও এই কাজ হাতছাড়া করতে চায় না | কাজ করতে হয় না এমনিতেই তার উপর ফ্রিজ থেকে যা ইচ্ছে নিয়ে খাও সাগরনীলের কোনোদিকে হুঁশ নেই, তাই সে বেকায়দায় পড়ে বললো,”আমি তো আসি, দাদাই তো দরজা খোলে না অনেকদিন, আমি কি করবো ?”
তোয়া তাও ছাড়বে না, “দরজা না খুললে ফোন করবে, ওকে না পেলে আমাকে করবে | একদম গল্প দেবে না |”
এইটা যদিও পুরোটা গল্প না, একদিন সত্যি দরজা খোলেনি সাগরনীল, ঘুমোচ্ছিল | সেটা যদিও একদিনই | তারপর সেটাকেই ভাঙিয়েই চলছিল ওই মহিলার | সে তোয়ার সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলো | ভাবলো দিব্যি তো একা ছিল এই আপনভোলা ছেলেটা, এই মেয়ে আবার কোথা থেকে জুটিয়ে আনলো রে বাবা !!
সাগরনীল ও হেসেই খুন, বললো, “বাবা!! কি বকুনি দিলে তুমি !!”
সাগরনীলের বাড়িটা ঠিক যতটা অগোছালো, তোয়ার ভাড়া করা ওয়ান রুম ফ্ল্যাটটা ঠিক যেন ততটাই সুন্দর করে সাজানো | বারান্দায় ফুল গাছ আছে, দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি | ছিমছাম, রুচি সম্মত সাজানো | সেই দেখে সাগরনীল খুব প্রশংসা করলো, বললো, “ভারী সুন্দর তোমার বাড়িটা | সময় পেলে আমার ওখানটাও একটু সাজিয়ে দিও তো প্লিজ | আমার বাড়িটা যেন একদম …মানে বাড়ি বাড়ি না | ”
দেবে বলছে তোয়া, কেন দেবে না ?
তোয়াও একটা জিনিস নিয়ে আবদার করে সাগরনীলের কাছে |
ওর ওই চুলের উপর খুব লোভ তোয়ার | হাতে পেলেই তাতে নানা রকম বাহারের ঝুঁটি, বেনুনি, খোঁপা এইসব বেঁধে দেয় | আপত্তি করে না সাগরনীল | বাকিরা তো খালি “কেটে ফেলো”,”কেটে ফেলো” করতে থাকে, তোয়া যদি ওর চুল নিয়ে একটু ছেলেমানুষি করে মজা পায়, ওর কি সমস্যা ? আর তোয়ার যেটা সব থেকে মজার লাগে সেটা হলো, ও যেমন করেই চুল বেঁধে দিক ওইভাবেই বাইরে বেরোতে কোনোদিন না করে না সাগরনীল, “তুমি থাকবে তো আমার সাথেই ? তাহলে আমার প্রব্লেম নেই | লোকে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না | ”
সাগরনীলের ঘন, কোঁকরা চুলের কথা ভেবেই তোয়া নিজের কোম্পানিতে একটা নতুন ধরণের, বড়ো দাঁতের, নিম কাঠের চিরুনিও লঞ্চ করেছে | খুব চলেছে সেটা | প্রথম যেটা তৈরী হয়ে এসেছিল সেই চিরুনিটা সাগরনীলকে দিয়েছিল তোয়া, সেও খুব খুশি সেটা পেয়ে | তোয়ার প্রশাংসা করে বলেছিল, “উফঃ ! সব দিকে বিজনেস আইডিয়া দেখতে পাও তুমি, হেব্বি ব্যাপার | এইটা বেশ ভালো জিনিস |”

আজকে, এই শুক্রবারে সাগরনীল আর নীলেশের জন্যে দারুন একটা উপভোগ্য সন্ধ্যে| |
আজ ওদের কোম্পানি অনেক ফান্ডিং পেয়েছে | আরও উন্নতি হবে এই আনন্দে খুব ফুর্তি ওদের সবার | জুবিলী হিলস এ প্রস্ট নামের পাবের একটা অংশ আজ বুক করা হয়েছে, ওদের কোম্পানির আজ পার্টি | সেখানেই নাচ, গান, পানীয়, ধোঁয়া সব চলছে | তোয়াও এসেছে আজ ওদের পার্টিতে | সবারই একজন অতিথিকে সঙ্গে আনার অনুমতি আছে, যাকে ইংরেজিতে বলে প্লাস ওয়ান | তোয়া সাগরনীলের প্লাস ওয়ান | তা সাগরনীল তো প্রথমে খুব নাচানাচি করেছে | তারপর, সন্ধ্যে যখন গড়িয়ে রাতে পৌঁছেছে প্রচুর মদ খেয়ে একদম মাতাল হয়ে গেছে | যাকে পাচ্ছে তার সাথেই খোস গল্প জুড়ে দিচ্ছে, খুব হাসছে, জোরে জোরে গান গাইছে বা মাথায় খেয়াল চাপলে অঙ্ক কষতে দিচ্ছে |
এমনিতে যে মদে আসক্তি আছে সাগরনীলের তা নয় | ওই অফিসের বা অন্য কোনো পার্টিতেই যা খায় | তবে কৎচিত কদাচিৎ আনন্দের আতিশয্যে বেশি খেয়ে ফেলে এবং তারপর আর নিজেকে সামলাতে পারে না | তখন গাড়ি চালাতে তো দেয়া যাবেই না, ট্যাক্সি করে নিজে ফেরার মতন অবস্থায়ও থাকে না | কাউকে না কাউকে বাড়ির দরজা অব্দি দিয়ে আসতে হয় | আজকে সেইরকমই একটা সন্ধ্যে | সে কি আর করার ? আগে হয় নীলেশ নিজে গেছে নয়তো অফিসে যে সব থেকে নতুন এসেছে সেই ছেলেটাকে এই কাজটা ধরিয়ে দিয়েছে | কোনো মেয়েকে তো আর বলা যায়না যে যাও তোমার মাতাল বসকে বাড়ি দিয়ে এস, কেলেঙ্কারি হবে শেষে !!
তা এতদিন নাহয় সাগরনীল একদম বিবাগী ধরনের ছিল, আজ তো তোয়া এসেছে ওর সাথে | এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে সাগরনীলের এতদিনের আলাপ পরিচয় দেখছে নীলেশ, বুঝেছে যে বিশেষ কিছুই হবে | তাই তোয়াকে দেখে আজ হাতে চাঁদ পেয়ে, অনুরোধ করলো নীলেশ, “তোয়া তুমি প্লিজ সাগরকে একটু বাড়ি অব্দি দিয়ে আসবে ? আমিই যেতাম কিন্তু অনেকটা দেরি হয়ে গেছে আর আমার বাড়ি উল্টো দিকে |”
অগত্যা, তোয়াই পার্টির শেষে বাড়িতে নামাতে এল |
কিন্তু নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে কি করে ? সোজা হয়ে হাঁটতেই তো পারছে না সাগরনীল, এদিকে হেসেই যাচ্ছে শুধু |
তোয়া খানিক ভাবলো কি করবে, তারপর ঠিক করলো, না ওকে বাড়ি অব্দি তো ছেড়ে দিয়ে আসতেই হবে| একা একা কোথায় যাবে তার নেই ঠিক | আর তাছাড়া মাতাল হয়ে কি করে সেটাও দেখা হয়ে যাবে | সজ্ঞানে তো মানুষ অনেক কিছুই বলে, কিন্তু মাতাল হয়ে গেলে তো আর নিজের আসল চরিত্র চেপে রাখা যায়না | আর সেরকম বেগতিক দেখলে ওর কাছে পেপার স্প্রে আছে, দেবে আচ্ছা করে | এই ভেবে ওর ফ্ল্যাট অব্দিই উঠে এল সাগরনীলকে ভালো করে ধরে | সে তো নিজের মনের আনন্দে লিফ্টেই বেশ জোরে গান ধরলো, তাও কি গান? না, “খাইকে পান বানারাস য়ালা”|
কেন হঠাৎ এই গান ওর মনে এলো সে আর তোয়া কি জানে নাকি ? জিজ্ঞেস করলেও যে সদুত্তর মিলতো সে আশাও ছিল না | তারপর ফ্ল্যাটে ঢুকে যা করলো সাগরনীল, তা বোধয় তোয়া নিজের সমস্ত কল্পনা শক্তি দিয়েও সাজিয়ে উঠতে পারতো না |
প্রথমে ভেতর থেকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরেই দাঁড়িয়ে থাকা তোয়াকে দেখে এক গাল হেসে বললো, “থ্যাংক ইউ তোয়া, বাই” বলে নিজের শোবার ঘরের দিকে না গিয়ে টলতে, টলতে চলে গেল রান্নাঘরে | ওর পিছন পিছন রান্নাঘরে গিয়ে তোয়া দেখলো, আলো না জ্বালিয়ে ওই বড় আলমারির আয়তনের ফ্রিজটা খুলে তার প্রায় ভেতরেই ঢুকে গেছে সাগরনীল |
“এই, কি করছো তুমি নীল ?” তোয়া গিয়ে জিজ্ঞেস করলো |
“আসতে! আসতে কথা বলো তোয়া,” গলা খাদে নামিয়ে সাবধান করলো সাগরনীল ওকে, “এই দেখো কি আছে !” বলে বের করে আনলো দুটো বড় বড় আইসক্রিমের কৌটো, একটা তোয়াকে এগিয়ে দিল |
অন্যটা হাতে নিয়ে ফ্রিজের পাশেই ধপাস করে বসে পড়লো | তারপর নানা রকম আব্দার আসতে থাকলো তোয়ার দিকে, “চামচ দাও”, “চকোলেট সিরাপ দাও”, “তোমার আইসক্রিমটা আমাকে দাও” |
তোয়া একদম অবাক হয়ে গেছে ওর কান্ড দেখে !
নেশাগ্রস্ত অবস্থায়, ফাঁকা ফ্ল্যাটে ওকে একা পেয়ে সাগরনীল অনেক কিছুই করার চেষ্টা করতে পারতো | অনেক রকম সম্ভাবনাই তোয়ার মাথায় এসেছিল | মনে অনেক অল্প আশংকাও এসে জমা হয়েছিল | কিন্তু যা শুরু হলো তাতে তোয়া হাসবে না কাঁদবে ঠিক করতে পারলো না | মাতলামি তো অবশ্যই, সুস্থ অবস্থায় এইরকম করবে না সাগরনীল |
কিন্তু এইটা ঠিক কি ধরণের আচরণ ? কে এরকম করে ? এদিকে নাকি এর নিজেস্ব কোম্পানি আছে, তার কত কাজ করে, সারাদিন কত বই পড়ছে, অঙ্ক কষছে মাথায় সর্বক্ষণ আর পার্টিতে মদ খেয়ে এসে আইসক্রিম খাচ্ছে বসে বসে ?
“আচ্ছা তোয়া, নীল এইটা না করে কি করলে তোমার ভালো লাগতো ? ও যদি মদ খাওয়ার অজুহাতে তোমার সাথে অসভ্যতা করতো, তোমার গায়ে হাত দিতে আসতো, সেটা কি বেশি পছন্দ হত তোমার ?” তোয়ার নিজের মনেই যেন এইসব প্রশ্ন ভেসে উঠলো |
তাই তো !
হঠাৎ যেন সাগরনীলকে আরও ভালো লেগে গেল তোয়ার | দেখ ! কিরম মানুষ | আসল চরিত্র চেপে রাখা যায় না, তাই ভাবছিল না তোয়া ? তা এইটাই নীলের আসল রূপ, একদম সরল, ছেলেমানুষ | সে কৌটো কৌটো আইসক্রিম খায় আর কিছুতে মন নেই তার |
তোয়াও ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো | পা ছড়িয়ে বসে, কিছুক্ষন তো একদম একমনে আইসক্রিম খেলো সাগরনীল | যেন ভুলেই গেছে যে তোয়া ওর পাশে বসে আছে | তারপর কি খেয়াল হলো হামাগুড়ি দিয়েই এগিয়ে একটা ড্রয়ার থেকে বের করলো অনেক চিপস | তোয়ার এই দেখে ভারী রাগ হলো, যত আজে বাজে খাবার | একটু বকার সুরেই বললো, “নীল, এই আইসক্রিম খেলে আবার চিপস খাবে এখন তুমি ?”
নেশার ঘোরে এমন বকা খেয়ে সাগরনীল যেন একটু ঘাবড়ে গেছে, খুব করুন মুখ করে বললো, ” বকছো কেন আমাকে ? আমার খিদে পেয়েছে তো, কি খাবো ?”
তোয়া বুঝেছে যে একে মাতাল অবস্থায় ভয় পাবার কোনো কারণ নেই | মদ খেয়ে এ একদম ছেলেবেলায় ফিরে গেছে মনে হচ্ছে, এর দ্বারা কোনো ক্ষতি করা সম্ভব না | তাই বড়দের গলায় বললো, “চুপ করে বোসো আমি ওমলেট করে দিচ্ছি | ওই চিপস খেতে হবে না | দাও, দিয়ে দাও আমাকে “, বলে হাত বাড়ালো | সাগরনীল চুপচাপ দিয়ে দিল নিজের হাতের চিপসের প্যাকেটটা | তারপর, একদম সুবোধ বালকের মতন ওখানেই বসে থাকলো | তোয়া ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম নিয়ে ওমলেট বানাতে শুরু করলো | পেঁয়াজ কুঁচিয়ে যেই না টমেটোতে হাত দিয়েছে, সাগরনীল ভীষণ বায়নার শুরে বললো , “প্লিজ প্লিজ টমেটো না | একদম না, একদম না | কড়াইশুঁটি দাও ওমলেটে|”
ওকে বেশি না ঘাঁটিয়ে “আচ্ছা” বলে টমেটো রেখে দিল তোয়া | কড়াইশুঁটি কোথায় পাবে এই এত রাতে ? পাগলের প্রলাপ যত! ওমলেট খেয়ে তো খুব খুশি হলো সাগরনীল, বললো, “বেস্ট ওমলেট তোয়া ! বেস্ট ইন দা ওর্য়াল্ড |”
তারপর থালাটা পাশেই নামিয়ে রেখে ওখানেই শুয়ে পড়লো, বললো, “ওকে বাই, এয়ারপোর্ট পৌঁছে মেসেজ করে দিও |” এয়ারপোর্ট?? মাথা গেছে এর | তোয়া ডাকলো এক দুবার কিন্তু সে একদম ঘুমিয়েই পড়েছে | শেষে ওর শোবার ঘর থেকে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে এল | মাথার তলায় বালিশটা দিয়ে, গায়ে চাদর চাপা দিয়ে দিল |
যে মাতাল সে কিছু করলো না, যে সজ্ঞানে আছে সেই নিচু হয়ে মাতালের কপালে আলতো চুমু এঁকে দিল |
“তোমাকে না ভালোবেসে পারা যায় না নীল, খুব কিউট তুমি”, সাগরনীল ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে একটু জোরেই বললো তোয়া | ওমা ! ও যেই উঠে চলে যেতে পা বাড়ালো, ঘুমের মধ্যেই সাগরনীল, “তোয়া, আই লাভ ইউ “, বলে পাশ ফিরে শুলো, চাদরটাকে মাথা অব্দি টেনে নিয়ে |
এই !! এইটা কিরম হলো ? জেগে আছে না ঘুমোচ্ছে ? আর ঘুমিয়ে থাকলে এই কথা তো বাবা ধরা যাবে না, আবার ফেলাও তো যাবে না |

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, ও ঠিক কোথায় আছে বুঝতে একটু সময় লাগলো সাগরনীলের | না, নিজের বাড়িরই রান্নাঘরে শুয়ে আছে দেখলো | তাও ভালো ! বালিশ নিয়ে এসে এখানে শুয়েছি ? নিজের অবস্থায় নিজেরই হাসি পেল ওর |
উঠে বসতেই বুঝলো মাথা একদম ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়, গলাও শুকিয়ে কাঠ আর সর্দি মতন হয়েছে | আর কেউ নেই এই ভেবে জোরেই বললো, “ও বাবা !! মদ খেয়ে আজকাল সর্দিও হচ্ছে ? অনেক বয়েস হয়ে গেছে আমার !” হাঁটু মুড়ে তার উপর মাথা নামিয়ে বসে থাকলো খানিক্ষন | এমন সময় তোয়া এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরে, জিজ্ঞেস করলো, “কি কেমন লাগছে এখন ? শরীর ঠিক আছে ?”
তোয়াকে দেখে একদম চমকে গেছে সাগরনীল, কিছুক্ষন নিস্পলক তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে | তোয়া রাতে আর বাড়ি যায়নি, এই প্রথম এইখানেই থেকে গেছে | সাগরনীলের কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল| তারপর ওরকম রান্নাঘরের মেঝেতেই শুয়ে ঘুমোচ্ছিলো দেখে, একা রেখে যেতেও ইচ্ছে করলো না | তার উপর ওই “আই লাভ ইউ ” সেটাও মাথায় ঘুরছিল | রাতেই পার্টির ড্রেস ছেড়ে পরেছে সাগরনীলেরই একটা টিশার্ট আর শর্টস | অন্যরকম লাগছে ওকে এই অদ্ভুত সাজপোশাকে | সাগরনীলের মনে হলো তোয়া যেন বহুকাল এই বাড়িতেই থাকে, ওর সাথে | এইভাবেই মাঝে মধ্যে ওর জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় বাড়িতে, এইসব ভেবে ফিক করে হেসে ফেললো | তোয়া চোখ পাকিয়ে বললো, “খুব হাসি না ? এখনো নামেনি নাকি নেশা ?”
এই রে !! রাতের কিছু কথা ওরও ভাসা ভাসা মনে আছে, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “এই সরি সরি | ভেরি সরি, খুব কি ছড়িয়েছি কাল ? তোমাকে কিছু উল্টো পালটা বলেছি নাকি ? তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না, আর হবে না এরকম,” তারপর নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ভীষণ মাথা যন্ত্রনা করছে | কেন যে কাল ড্রিংক করতে গেলাম !”
তোয়া তো খুব হাসলো কাল রাতের সব কীর্তি মনে করে, বললো, “যাও ফ্রেশ হয়ে এস | আমি ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি |”
একদম চান করেই ফিরে এল সাগরনীল | এসে দেখলো তোয়া পাউরুটি আর মাখন বের করেছে জল খাবারে | ও কফি বানিয়ে আনলো | খেয়ে দুজনেই ব্যালকনিতে এসে বসলো | প্রায় এগারোটা বাজে, রোদ অন্যদিকে ঘুরে গেছে | এইটা পূর্ব দিকের ব্যালকনি, এখানে এখন ছায়া |
চোখ বন্ধ করেই বসেছিল সাগরনীল, তোয়াই জিজ্ঞেস করলো, “মাথায় ব্যাথা করছে এখনও ?”
“হুঁ, ওই অত আইসক্রিম খেয়েছি বলেই যেন আরো লাগছে মাথায়, গলায়ও ব্যাথা করছে |”
আইসক্রিম শুনেই তোয়া হেসে ফেললো জোরে, বললো, “সত্যি বাবা !! কি যে করছিলে কাল রাতে তুমি ! প্রায় এক বাক্স আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছো একসাথে !” বলেই আবার খুব একচোট হাসলো, “আর যা প্রলাপ বকছিলে, কি এয়ারপোর্ট, ওমলেটে কড়াইশুঁটি, উল্টো পালটা !”
ওর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সাগরনীল কিছুক্ষন, তারপর চোখে, মুখে দুস্টুমি ফুটিয়ে বললো, “সব প্রলাপ না, আমার ওমলেটে কড়াইশুঁটি সত্যি ভালো লাগে | ওটা আমার সব থেকে প্রিয় সবজি | আর …”
তোয়া তো ওর কথা শুনে আরও হাসছে, জিজ্ঞেস করলো , ” প্রিয় সবজি !! আর ? আর কি ?”
সাগরনীল নিজের মুঠোবন্ধ ডান হাতটা এগিয়ে দিল তোয়ার দিকে |
“কি ?” তোয়া বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো |
“আই লাভ ইউ তোয়া”, বলে নিজের মুঠোটা ওর সামনে খুলে ধরলো |
সাগরনীলর হাতের পাতায় একটা আংটি রাখা | অনাড়ম্বর দেখতে সোনার আংটি, তাতে একটাই বেশ বড় মাপের হিরে বসানো |
সব প্রলাপ না….

আজ একটু অবসর পেয়ে পুরোনো অ্যালবাম খুলে বসেছেন স্বপ্না | নিজের দুই ছেলের ছোটবেলার ছবি দেখছেন |
বাবুন আর বাবুই, রুদ্রনীল আর সাগরনীল |
একজনকে রোজ দেখেন আর অন্যজন ? সেই পাঁচ বছর আগে শেষবার দেখেছেন | আবার দেখবেন এই আশা উনি আর করেন না | এত রাগ, এত বিতৃষ্ণা ওর নিজের মায়ের প্রতি !
অথচ অন্য সবাই বলে সাগরনীলের মনটা নাকি খুব নরম, একবার তাকে ভালো করে চিনলে তার মতন মানুষ হয় না | এত ভালো নাকি সে | শুধু মায়ের জন্যেই এক ছটাক মমতা নেই ওর মনে ?
তবে তার জন্যে উনি ওকে দোষ দিতে পারেন না | আজ সত্যি পিছনে ফিরে যখন দেখেন তার এই অভিমানী ছোট ছেলের কষ্টটা দেখতে পান | উনিই হয়তো দূরে সরিয়ে দিয়েছেন ওকে |
রুদ্রনীল জন্মানোর পরেই বোঝা গিয়েছিল যে ও ঠিক আর পাঁচটা বাচ্চার মতন নয় | তখনকার দিনে ওই মফস্বলে, ডাক্তারও ঠিক করে বলতে পারেননি যে কি হয়েছে | তবে সে স্বাভাবিক না, এটাই ছিল চরম সত্যি | স্বপ্না প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিলেন, বাকিদের মতনই | তারপর মন শক্ত করেছিলেন, উনি চেয়েছিলেন ওকে নিয়েই থাকতে | ওকেই যত্ন করতে | উনার স্বামী সেটা মানতে পারেননি | নীলাদ্রি বলেছিলেন আরেকটা সন্তান উনার দরকার, যে সুস্থ, স্বাভাবিক হবে | যে নাকি বয়েসকালে অবলম্বন হবে | যেটা বলেননি সেটা হলো যে দরকার এমন একটা সন্তান চান যে উনার বোঝা হবে না |
সেই সন্তান সাগরনীল, বাবার দেয়া ডাকনাম তার বাবুই |
সে বাবার স্বপ্নের উপাদান দিয়ে গড়া, একদম মনের মতন | বাবার মতোই তার রোগারোগা চেহারা | বাবার সাথে মুখেরও মিল আর মনেরও | বই পাগল বাবার, যোগ্য ছেলে | জড়বুদ্ধি দাদার ভাগের বুদ্ধিও যেন সাগরনীলের কাছে এসে পড়েছিল | মেধাবী ছেলে আর সেরকমই পরিশ্রমীও | বাবা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন, আর এই ছেলে সেই সব যেন অক্লেশে পূরণ করে দিত | বাবুন ওর পাশে কোথায় লাগে ?
স্বপ্না প্রায়ই ভাবেন, “আচ্ছা বাবুই কি ছোটবেলাতেই বুঝতে পেরেছিল যে মা ওকে জন্ম দিতেই চায়নি ? তাই কি ওর এত রাগ ? না না, তা কি করে হয় ?”
উনি নিজের মনেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছেন আজ অনেক কিছু | আসলে এই বাবুনকে একা হাতে সামলে উনি কিছুতেই ওই চঞ্চল ছেলেটার জন্যে সময় বের করতে পারেননি সেভাবে | না, আজ আর অজুহাত দেবেন না মায়ের ভালোবাসা বাবুনই পেয়েছে, বাবুই নামের ওই মিষ্টি ছেলেটা পায়নি |
আসলে অন্য কেউ বাবুনকে ভালোবাসতো না | তাকে ভালোবেসে লাভ কি ? সে তো তোমার কথাও বুঝবে না | প্রথমেই একজন আয়া রেখে দেবার চেষ্টা হয়েছিল | ওই বাবুই যখন একদম ছোট, কিন্তু সে ঠিক করে দেখাশোনা করতো না | তাই বাবুই একটু বড় হতেই আবার উনি বাবুনের সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন আর সেই করতে বাবুইকে সময় দেয়া হলো না | ওর দেখাশোনা করতে গিয়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন স্বপ্না ধীরে ধীরে | কেউ দেখেনি, কেউ সাহায্য করতে আসেনি | কি ভীষণ নিঃসঙ্গ জীবন উনার | বাকিরা ওদের দুজনকে বাদ দিয়েই জীবনে এগিয়ে গেছে |

বাহ্ রে ! স্বপ্নার ইচ্ছে করতো না বাবুইয়ের সাথে খেলতে ? ওকে আদর করতে ?
দুই ভাইকে একসাথে বসিয়ে রাখতেন তাও যখন একদম ছোট ছিল | কিন্তু বাবুই একটু বড় হতেই এমন চঞ্চল হলো, সে দাদার সাথে বসে বসে খেলবে কি ? ঘরে এক মিনিট থাকতো না | সারাক্ষন শুধু দৌড়ে বেড়াতো, গাছে উঠতো, হাজার দুস্টুমি তার | বকলেও একটা খুব দুস্টু হাসি হাসতো, সবাই গোলে যেত সেই দেখে | স্বপ্না যদি জোর করে ওকে ঘরে ধরে আনতে চাইতেন, তাহলে ওদের বাবাই রাগ করে বলতেন, “ওকে টানাটানি করছো কেন ? খেলতে দাও নিজের মতন |”
আর বড় হয়ে যখন শান্ত হলো ? তখন ওর সাথে আর কি খেলতে পারতো নাকি ওর দাদা | একাই দাবা, স্ক্রাবেল, সুডোকু, ক্রসওয়ার্ড | স্বপ্না দেখতেন, ইচ্ছে হতো একবার পাশে বসে দেখার | কিন্তু এ সুযোগ কোই পেলেন ?
কেউ যদি বাবুনের দ্বায়িত্ব নিত একটু সময়ের জন্যে তাহলেই তো উনি সেইসব করতে পারতেন | কিন্তু কে নেবে ?
ওদের বাবা তো একবার বলেছিলেন যে একটা হোমে রেখে আসা হবে, বলেছিলেন, “বাবুই খুব ব্রাইট | ওকে আরও সময় দিতে হবে | বাবুনের সাথে আর সময় নষ্ট কোরো না স্বপ্না | আমি মানছি ওকেও আমরা ভালোবাসি কিন্তু ওকে বাড়িতে রেখে বাবুইয়ের প্রতি অন্যায় হচ্ছে |” স্বপ্নাই আটকেছিলেন | সে তো নিজের কষ্টটুকুও বলতে পারে না, হোমের লোকে কি করে বুঝবে ? বাবুনের কি দোষ ?
উনার শ্বাশুড়ি বলতেন, “বাবুন থাক না ঘরে | একটু কাঁদলে কিছু হবে না “, “ওকে ছেড়ে বাবুইকে দেখো, তোমার দুটো ছেলে ভুলে যেও না”
না, উনি ভুলে যাননি |
মুশকিলটা হলো উনি তাকে ভুলে যাননি যাকে বাকিরা ভুলে যেতে চাইতো বরাবরই | ডাক্তারও বলেছিলেন বড় জোর দশ, বারো বছর বাঁচবে | সেই ছেলে আজ পঁয়ত্রিশ পেরিয়েছে | বড্ডো ক্লান্ত স্বপ্না ওর দেখাশোনা করে করে | একা আর পারেন না, বয়েস হয়েছে তো | এখন একজন আয়াই দেখে |
আচ্ছা উনিই কি বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন নিজের বড় ছেলের সাথে ? আরেকটু কি ছেড়ে দেয়া যেত না ? সারাজীবন নিজেকে ওর সাথে ঘর বন্দি করে ফেলাটা কি ঠিক হয়েছে ?
এখন উনার মাঝে মাঝে মনে হয় উনিও বুঝি ভেবেছিলেন যে উনার বড় ছেলে সীমিত আয়ু নিয়ে এসেছে | ওই দশ, বারো বছর বাঁচবে | তাই কি উনি এত যত্ন করতেন ওকে ? ভেবেছিলেন হারিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি আর তারপর উনি শুধু ছোটছেলেরই মা হয়ে থাকবেন বাকি জীবন ? যদি আগেই জানতেন যে বাবুন এত দিন থাকবে তাহলেও কি উনি… ?
নিজের এই ভাবনায় উনার নিজেরই লজ্জা লাগে | এই কিসব চিন্তা ভাবনা ? উনি না মা ?

আজ পুরোনো ছবি দেখে স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছেন | বাবুই, ছেলেবেলায় খুব মিষ্টি দেখতে ছিল | একটু গোলগাল, এক মাথা কোঁকড়া চুল | ওকে না ভালোবেসে পারা যায় ? বাবা, ঠাকুমা, পিসি, পিসেমশাই সবাই ভালোবাসতেন | একজন সুস্থ, স্বাভাবিক, চঞ্চল বাচ্চা তাকে নিয়ে মানুষ আনন্দ করবে এতে অবাক হবার কি আছে ? সেখানে বাবুন ? সে না পারতো নিজে ভালো করে হাঁটতে, না ঠিক করে কথা বলতে | তাকে সবাই দ্বায়িত্বের খাতিরে ভালোবাসতো, কেউ মন থেকে না সেভাবে, মা ছাড়া | উনি এইটাই বাবুইকে বোঝাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি |
আজ উনার মনে প্রশ্ন উঠছে | ঠিক কি চেয়েছিলেন উনি সাগরনীলের কাছে ? যে ও মায়ের সময় দাবি করবে না, ভালোবাসা চাইবে না কিন্তু দাদার জন্যে করা মায়ের ত্যাগকে সম্মান করবে ? সেটা তো অন্যায় চাহিদা, নয় কি ?
উনি জানেন, উনি একবারও যাননি ওর স্কুলের পুরস্কার বিতরণী দেখতে | সেটা নিয়েও সাগরনীলের খুব অভিমান ছিল | তখন ভাবতেন বাবুন একা থাকবে কি জানি কি করবে ? এখন ভাবেন একবার, দুবার গেলে কি এমন ক্ষতি হতো ? বাবুই এত আশা করে থাকতো, উনি যেতেন না বলে দুঃখ পেত, সেটা কি উনার উচিৎ হয়েছিল মা হিসেবে ? না উচিৎ হয়নি | একবার যদি ওদের বাবা থেকে যেতেন বাবুনের কাছে তাহলেই তো স্বপ্না যেতে পারতেন | না, সে থাকবে না | বলতেন, “তুমিও চলো, বাবুনকে ঘরে তালা দিয়ে রেখে যাও না | কি সমস্যা ?”|
সমস্যা ছিল তো, পারেননি তাই |
এখন ভাবেন বাবুই ঠিকই বলতো, “তুমি দাদার মা,আমার কেউ না |” কিন্তু উনি শুধু যে ওর স্কুলে যাননি তা তো না, উনি কোথাও যাননি | দোকানে, বাজারে, কোনো আত্মীয়ের বাড়ি, পুজোতে ঠাকুর দেখতে গেছেন ? না | সে খবর কে রেখেছে ?
রুদ্রনীলের একনিষ্ঠ সেবিকা, তার মমতাময়ী মা হওয়া সহজ ছিল না | উনি তাই হতে পেরেছেন, বছরের পর বছর | যার জন্যে কষ্ট স্বীকার করা সেই কিছু বোঝে না, তবুও করেছেন |
সাগরনীলের মা হওয়া সহজ ছিল, সৌভাগ্যেরও ছিল | সেটাই উনি হতে পারলেন না নাকি স্বেচ্ছায় হলেন না ? ওকে সবাই ভালোবাসে এই ভেবে উনি আর নিজের ভালোবাসাটা ওকে বোঝাতে গেলেন না ?
রুদ্রনীল ওরকম ভাবেই বেঁচে আছে সেখানে অন্য একটা সুস্থ সন্তানের সান্নিধ্য, তার সাথে আনন্দ করা সেটা কি উনার বিলাসিতা মনে হতো ? নাকি অপরাধ মনে হতো ? বড় ছেলের প্রতিবন্ধকতার জন্যে কি নিজেকে দায়ী করতেন উনি ? কে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে ?
স্বপ্না মনে মনে ভাবতেন যে বাবুই বড় হয়ে বুঝবে ঠিক মাকে | কিন্তু ওর বাবা এমন করে ওর মনের সবটা দখল করে নিলেন যে সেখানে আর মায়ের জন্যে মায়া, মমতা, প্ৰয়োজন কিছুই থাকলো না | রইলো শুধু অভিমান | আর সেই অভিমানের কি তীব্রতা, কি তার ঝাঁঝ !
বাবা অসুস্থ শুনেই ছুটে এসেছিল দিল্লি থেকে, তাও শেষ দেখা হয়নি | ম্যাসিভ হার্ট এট্যাক হয়েছিল নীলাদ্রির, ও এসে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ | সেদিন সাগরনীলের প্রতিক্রিয়া দেখে স্বপ্না বুঝেছিলেন যে উনার স্বামী ওই ছেলেটার জন্যে ঠিক কতটা ছিলেন | আগে আন্দাজ করতেন, সেদিন প্রতক্ষ করলেন |
একটা বছর তেইশের যুবক যে বাবার মৃত্যুতে ওই ভাবে কাঁদতে পারে, উনি চোখের সামনে না দেখলে বিশ্বাস করতেন না | ওকে দেখে বাকিরা কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল | নিঃশব্দ সে কান্না কিন্তু যেন হাহাকারের মতন বাজছিল সবার কানে | থামানো যাচ্ছিলো না, কেউ সামলাতে পারছিলো না | যেন পৃথিবীতে ওর একমাত্র আশ্রয়টা কেড়ে নিয়েছেন ভগবান | এই সুবিশাল পৃথিবীতে যেন আর কেউ নেই ওর, “আমি কি করে বাঁচবো ?” এই কথার রকম ফের শুনেছিলেন ওর মুখে | আর উনি যখন মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন, “বাবুই, আমি আছি তো…”, এই বলে ?
ওরে বাবা !! এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছিল উনার হাত, ” ছেড়ে দাও আমাকে একা | ওটা বাবার দেয়া নাম, ডেকো না আমাকে ওটা ধরে “| বাবার প্রতি যত অনুরাগ, মায়ের জন্যে ওর মনে পুষে রাখাছিল ঠিক ততটাই বিরাগ | তাও আজ প্রায় দশ, এগারো বছর পেরিয়ে উনি দেখতে পাচ্ছেন সেদিনও উনি চেষ্টা করতে পারতেন ওকে কাছে টানার |
করেননি | তাহলে ওর দোষ দেন কি করে ?
ওইরকম সাংঘাতিক কান্নকাটি করে নিজেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সাগরনীল | এমনিতেই রোগা মানুষ, অতো দূর থেকে এসেছিল, এসেই এইরকম ধাক্কা …সব মিলিয়ে খুব কাহিল হয়ে গিয়েছিল | ধুম জ্বর বাঁধিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ একদম বেহুঁশ অবস্থায়, বিছানায় পড়েছিল | ওর পিসি,অঞ্জনা, আসানসোলেই থাকেন, আর নিজের এই ছোট ভাইপোকে খুব ভালোও বাসেন | মায়ের জায়গায় সেদিন পিসিই বসে থেকেছে ওর মাথার কাছে | পিসি আর পিসেমশাই | ডাক্তার দেখানো, দেখাশোনা করা সব উনারাই সামলেছিলেন |
আর স্বপ্না ?
বাবা যে মারা গেছে সেটা তো উনার বড় ছেলে বুঝতেই পারেনি | “বাবা কোই?” এই প্ৰশ্ন করে করে নিদারুন অশান্তি শুরু করেছিল, জিনিসপত্র ছুঁড়ে, ভেঙে কি কান্ড ! তাকে সামলাতেই তো উনার সমস্ত শক্তি চলে গিয়েছিল | নিজের শোকই উনি ছুঁয়ে দেখার সময় পাননি যেন | সাগরনীলের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাবেন কি করে ?
তবে শুধু কি সেটাই কারণ ? উনি সেদিন অপমানে যাননি, সেটাও তো সত্যি | সবার সামনে যে ভাবে সাগরনীল মাকে অপদস্ত করেছিল, “ছেড়ে দাও আমাকে ..”… এই বলে উনি ওর কেউ নন বুঝিয়ে দিয়েছিল, সেটা উনার মনে বাজেনি ? তাই তো আর যাননি ওর কাছে |
এখন ভাবেন, বাবার শোকে বলে ফেলেছে ভেবে ক্ষমা করে দিতে পারতেন না ? নিদারুন ধাক্কা খেলে মানুষ বলে না যে “আমার সান্ত্বনা চাই না, আমাকে একা ছেড়ে দাও”? তখন তাকে যারা ভালোবাসে তারা কি সত্যি একা ছেড়ে দেয় ? না, একদম না | উল্টে আরও আগলে রাখে | তাহলে উনি কেন সেদিন ওর পাশে থাকলেন না ? সেটা যে ওর মনের কষ্টের কথা, উনি মা হয়ে বুঝলেন না ?
সাগরনীল ফিরে যাবার পরে, অঞ্জনা কিন্তু এসে উনার কাছে অভিযোগ করেছিল, “সাগর কিন্তু ভালো করে সুস্থ না হয়েই ফিরে গেল | দাদা চলে যাওয়াতে বেচারা একদম ভেঙে পড়েছে | তুমি একটু ওর কাছে বসতে অব্দি এলেনা বৌদি | ওর সাথে কেন যে এরকম কোরো তুমি আমি বুঝতে পারিনা, ও কিন্তু এইগুলোতে খুব কষ্ট পায় “|
আজ ভাবলেন, কি কৈফিয়ত উনি দেবেন নিজের ব্যবহারের ? সাগরনীলেরই দায় ছিল মাকে বোঝার, উনি কবে চেষ্টা করলেন ছেলেকে বোঝার ?

অথচ উনি কিন্তু ওকে সত্যি ভালোবাসেন | সব সময় চেয়েছেন যে ভালো থাকুক, উন্নতি করুক | তবুও শুধু উনার জন্যে ছেলেটার জীবনটাই কেমন খাপছারা হয়ে গেল | উনার প্রতি রাগটা এত বড় হলো যে সাগরনীল নিজের ভালোবাসাটা অব্দি ছুড়ে ফেলে, পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল একদিন |
সাগরনীলেরই ছোটবেলার বন্ধু ছিল সঙ্গীতা | নরম সরম মেয়ে, খুব মিষ্টি | রুদ্রনীলকে দাদা বলে ডাকতো, ধৈর্য ধরে খেলতে ওর সাথে | বড় হয়ে সাগরনীলের সাথে মন দেয়া নেয়া হয়েছিল | স্বপ্নার সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল, ভেবেছিলেন, ওকেই সোপান করে পৌঁছে যাবেন একদিন ছেলের কাছে | বিয়ের কথা বলতেই এসেছিল সাগরনীল | তখন সবে সবে স্টার্টআপ শুরু হয়েছে, হায়দেরাবাদেও এক বছর আগেই গেছে | তখনও বেশ ভালো মাইনের চাকরি করে | বৌভাত ও হায়দেরাবাদে করবে, এই ইচ্ছে ছিল | বলেছিল, “বাবা তো নেই আর, এখানে অনুষ্ঠান করলে প্রতি মুহূর্তে বাবাকে আরও মিস করবো আমি |”
সেটা অন্যায্য কথা না | ও যে মাকে যেতে বারণ করেছিল এরমও না, কিন্তু উনি হয়তো যেতে পারবেন না সেটা কি জানতো না ? প্রথমে কলকাতা যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে ফ্লাইট | রুদ্রনীলকে নিয়ে অতদূর যাওয়া সোজা কথা না, প্রায় অসম্ভব |
সঙ্গীতা নিজের ভালোবাসার উপর ভরসা করে জেদ করেছিল, ” বাবা নেই সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য, কিন্তু তোমার মা তো আছেন | কাকিমা যেতে পারবেন না হয়তো অতদূর, আর উনি না থাকলে কি করে হবে ? এখানেই হোক বৌভাত, আসানসোলে | ”
“যাবে কি যাবে না সেটা মায়ের ব্যাপার | বৌভাতে মা না থাকলে কি করে হবে ? মানে কি ? বলতে কি চাইছো ? ” বিরক্ত হয়েছিল সাগরনীল|
সঙ্গীতা সামলাতে বলেছিল, “এভাবে কেন বলছো সাগর ? বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনিই থাকবেন না উনি ঐসব আচার, নিয়ম মেনে | বৌভাতে অন্তত থাকতে দাও | উনি আমাদের আশীর্বাদ না করলে কি করে চলবে ?”
কি নিষ্ঠুর একটা হাসি হেসেছিল সেদিন সাগরনীল,”কেমন করে চলবে ? যেমন করে আমার সারাটা জীবন চলে এসেছে সঙ্গীতা | আমার মায়ের আশীর্বাদ, মায়া, মমতা ছাড়াই তো বেঁচে আছি আমি এই সাতাশ বছর | তাহলে এখন আবার কি এইসব ?”
সঙ্গীতা কি করবে বুঝতে পারেনি, তাও সেদিন ওর মায়ের কথা মনে করেই, ওর সাথে উনার সন্ধি করিয়ে দেবার অবুঝ ইচ্ছে নিয়ে বলেছিল, “সাগর নিজের মায়ের উপর এইভাবে রাগ করো না | আমাদের আনন্দের দিনে, আমি চাই উনিও থাকুন |”
চোখে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তবু সাগরনীল ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “সঙ্গীতা, তোমার কাছে আমার কোনো কথা লুকোনো নেই | আমার আনন্দে, দুঃখে, অসুখে, কোনো কিছুতেই আমার মায়ের কিছু যায় আসে না | কাজেই আজ তুমি এইসব কথা তুলে আমাকে কেন কষ্ট দিতে চাইছো, আমি জানি না | তুমি যদি আমার মায়ের উপস্থিতির উপরে জোর দাও, তাহলে আমি বলতে বাধ্য হবো যে এই বিয়ে হবে না | আমি না আমার মা ? কাকে তোমার দরকার তুমি বেছে নাও |”
সেদিন পরিষ্কার করে সাগরনীলের মনের মতন উত্তর সঙ্গীতা দিতে পারেনি | সাগরনীলও আর সে উত্তর খুঁজতে চায়নি | ফিরে গিয়েছিল তার পরের দিনই, শর্তসাপেক্ষ ভালোবাসায় কোনো উৎসাহ ছিল না ওর | স্বপ্না বলেছিলেন হায়দেরাবাদে হোক বৌভাত, উনার কোনো আপত্তি নেই | কিন্তু সে আর কে শুনছে ? সঙ্গীতা সাগরনীলকে আর ফেরাতে পারেনি | আবার এইরকম অন্ধ রাগ দেখে মনে মনে ভয়ও পেয়েছিল | ভবিষৎতে যদি ওর উপরেও এইরকম রাগ হয় সাগরনীলের ? তখন ?
সম্পর্কটা এমন ভেঙে গেল, কি আর করার ছিল ? সঙ্গীতার বাবা, মা আর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি, অন্য জায়গায় মেয়ের বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন, কি বলে আর আপত্তি করতো সঙ্গীতা?
সেই শেষ বার সাগরনীলকে দেখেছেন স্বপ্না, পাঁচ বছর আগে | মাকে টাকা পাঠায় প্রতি মাসে, ফোন করলে জিজ্ঞেস করে প্রতিবার, “শরীর ঠিক আছে ? দাদা কেমন আছে ?”
এই দ্বায়িত্ত্ব তো চিরকাল করে এসেছে, কোনোদিন ফাঁকি দেয় নি সাগরনীল | শুধু যেন কোনো টান নেই…সে জন্যে কি স্বপ্না দায়ী নন ? শুধু সাগরনীলই দায়ী ?
এখন এক জনই আছে আসানসোলের সাথে সাগরনীলের যোগসূত্র, ওর পিসি অঞ্জনা | তার সাথে সাগরনীলের যোগাযোগ আছে বেশ, কথাও হয় অনেক | কোনো নতুন কিছু হলে জানায় | ওই যে ওদের কোম্পানির সাফল্যের জন্যে ওদের পুরস্কার দেয়ার কথাও পিসিকেই বলেছিল, মাকে না | আসলে ছেলেবেলা থেকেই ওকে খুব ভালোবাসেন অঞ্জনা | মায়ের কাছে আদর না পাক, পিসির কাছে গেলেই খুব যত্নআত্তি পেত | সেটা ভোলেনি সাগরনীল, নিজেও খুব ভালোবাসে পিসিকে | অঞ্জনাও ওকে ফোন করেন প্রায়ই, খোঁজ নেন |
অঞ্জনার কাছেই স্বপ্না শুনেছেন একটা নতুন নাম, স্বচ্ছতোয়া |

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here