বাবুই পাখির বাসা – ৩ অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবুই পাখির বাসা – ৩
অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সাগরনীলের দেয়া আংটিটা এখন তোয়ার অনামিকায় নিজের চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে |
ওকে ওরম চমকে দিয়ে সাগরনীল প্রেম নিবেদন করে বসাতে তোয়া একটু অবাক হয়েছিল ঠিকই তবে ফিরিয়ে দেয় নি | ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নই ওঠে না |
তার বদলে ও কি দেবে অনেক ভেবে দেখেছে তোয়া | আংটি না, অন্য কিছু দিতে চায় |
সাগরনীলের কি পছন্দ হবে ?
বই দেয়া যায়, কিন্তু সেও তো আছে প্রচুর |
ওর মনে আছে সাগরনীল ওর সাজানো বাড়ি দেখে বলেছিল, “সময় পেলে আমার ওখানটাও একটু সাজিয়ে দিও তো প্লিজ |” তাই সেটাই উপহার |
এমনিতেই সাগরনীলের ফ্ল্যাটটা একদমই অগোছালো, সাজানোর অনেক সুযোগ আছে | সাগরনীল আর নীলেশ মুম্বাই গেছে একটা কাজে এই ফাঁকে তোয়া কাজে লেগে পড়লো |
প্রথমেই ব্যালকনিতে মন দিল | ব্যালকনিটা অনেকটা বড় | তোয়া নিজের পছন্দের গাছ, সুন্দর সুন্দর টবে সাজালো একদিন বসে বসে | বেতের একটা টেবিল আর চেয়ারও পাতলো | চেহারা ফিরে গেল জায়গাটার | তারপর ওই হলের একটা বন্দোবস্ত করলো | অতটা জায়গায় এদিকে একটা ভালো সোফা নেই | বিশ্রী লাগে ওই মোড়া আর বিন ব্যাগ দেখতে, ওগুলোকে বিদায় করে দিল | আইকিয়া থেকে একটা গাঢ় নিল রঙের সোফা আর সেন্টার টেবিল আনালো | দেয়ালে সাজালো সুন্দর কিছু ছবি | সব পর্দা পালটে দিল | সেগুলো মনে হয় অনেক বছর আগে লাগানো হয়েছিল আর কোনোদিন খুলে কাচা হয়নি |
ইশ ! ফেলে দেয়া ছাড়া আর রাস্তা দেখলো না তোয়া | পুড়িয়ে দিলে বোধয় শান্তি হতো | ভাবলো, “কি করে যে থাকে নীল ! যাতা !”
সবশেষে সাগরনীলের খাটের পাশে রাখলো ওদের দুজনের একটা সাদাকালো ছবি, তার ফ্রেমে অজস্র হৃদয় আঁকা | ছেলেমানুষি দেখতে ফ্রেমটা, তা বাবা এইটুকু ছেলেমানুষি চলে |
ছবিটা নীলেশে তুলেছিল | কোনো একটা পার্টিতে ওরা দুজনে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, এমন সময় ওদের না বলেই তোলা | কেউ তাই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নেই | পার্টির আওয়াজ ছাপিয়ে কথা বলতে তোয়ার মুখের একদম কাছাকাছি সাগরনীলের মুখ, হাসছে দুজনেই | অন্য কারুর দিকে খেয়াল নেই যেন | একটা সাধারণ কিন্তু তাও অসামান্য সুন্দর মুহূর্ত ধরে ফেলেছে যেন নীলেশ | ছবিটা খুব প্রিয় ওদের দুজনেরই |
একদিন ও এই বাড়িতেই থাকবে, সেটা মাথায় রেখেই সাজিয়েছে তোয়া | আরও অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে তবে সাগরনীল মাত্র তিন দিনেই ফিরে আসবে | নিজের কাজ সামলে, তাই এতদূরই এগিয়েছে এইবারের মতন |
এইবার আজ সন্ধ্যে বেলায় বোঝা যাবে কেমন লাগলো সাগরনীলের |
তোয়া এয়ারপোর্ট থেকে আনতে গিয়েছিল ওকে | সে তো সবসময় নিজের খেয়ালই থাকে | ফোনে কি একটা দেখতে দেখতে নিজের বাড়িতে ঢুকেই, ‘ওহ ! সরি” বলে আবার বেরিয়ে এলো | দেখে তো তোয়া খিলখিল করে হাসতে লাগলো |
তখন বুঝলো সাগরনীল যে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে, “এই তোয়া ? কি ব্যাপার ?” এই বলে তোয়াকে এগিয়ে দিয়ে ওর পিছন পিছন ঢুকলো আবার | তার আগে দুবার ফ্ল্যাটের নম্বরটা ভালো করে দেখে নিল | দেখে তো খুব খুশি হলো, “দারুন লাগছে দেখতে, ইশ! এতদিন কি হয়েছিল বাড়িটা, থ্যাংক ইউ সো মাচ তোয়া | তুমি এই তিন দিনে করে ফেললে সব ? অসাধারণ ক্ষমতা তোমার !!”
“তোমার পছন্দ হয়েছে তো নীল ?”, তোয়া ওর একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো |
“খুব খুব পছন্দ ! এত সুন্দর লাগছে !! আমি তো বুঝতেই পারিনি এটা আমারই বাড়ি”, সে তো তোয়া দেখতেই পেল |

সাগরনীলের অনেক ট্রফি, মেডেল এইসব ওই বসার ঘরে ওর বাবার ছবির সামনে জড়ো করা আছে | তার মধ্যে অনেকগুলো কলেজের সময়েরও আছে, তারপরও যখন যেটা পেয়েছে, ওই ছবির সামনেই নামিয়ে রেখেছে | ওখানেই জমা হয়েছে | তোয়া ভেবে দেখলো যে একটা সুন্দর শোকেস বানিয়ে নিলে এইগুলো সাজিয়ে রাখা যায় | এই ভেবে একটু কাঠের কাজ করাবে ঠিক করেছিল | সাগরনীল আগেই বলে দিয়েছিল যে ও বাড়িতে থাকাকালীন যেন কাজ না হয় ব্যাস ! আর কোনো আপত্তি নেই ওর | তোয়ার কোনো কথাতেই আপত্তি সেরম করে না ও |
তাই তোয়াই একদিন লোক ডাকিয়ে কাজ শুরু করিয়ে দিল, ওই বসে থেকে তদারকি করলো | প্রথম দিনের কাজ করে লোক দুটো ফিরে গেল সন্ধ্যে বেলায়, এমনি মোটামুটি পরিষ্কার করিয়েই তোয়াও নিজের বাড়ি ফিরে এসেছিল সেদিন | কাজ শেষ হতে লাগবে আরও তিন চার দিন | একটু এদিক ওদিক তো জিনিসপত্র, ওই কাঠের গুঁড়ো টুরো পড়ে থাকবেই এই কদিন |
সাগরনীল বাড়ি ফিরল এই দশটা, সাড়ে দশটা নাগাদ | কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই কাঠের গুঁড়ো থেকে এমন এলার্জি হলো যে বেচারা হেঁচে, হেঁচে একদম বেহাল হয়ে পড়লো | এক দেড় ঘন্টার মধ্যেই গা, হাত,পা লাল হয়ে ফুলে উঠলো | প্রথমে সেরম পাত্তা দেয়নি, একটু পরেই নিজেই ঠিক হয়ে যাবে ভেবেছিল | কিন্তু ঠিক তো হলোই না, উত্তরোত্তর বেড়েই চললো | শেষে আর না সহ্য করতে পেরে তোয়াকেই ফোন করলো |
তখন রাত দেড়টা |
তোয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল, হাতড়ে হাতড়ে ফোন খুঁজে ধরেই সাগরনীলের গলা শুনেই কিন্তু একদম সজাগ হয় উঠে বসলো | “তোয়া…আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে, প্লিজ এস “, এই শুনে তো ফোন কানেই, গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তোয়া |
ভাগ্গিস ওর কাছেই আর একটা চাবি ছিল বাড়ির | তখন আর উঠে এসে দরজা খুলতে পারতো না সাগরনীল | ওর শোবার ঘরে এসে তোয়া দেখলো সাগরনীল একদম কাবু হয়ে পড়েছে | নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে জল ঝরছে | শ্বাসকষ্ট হচ্ছে | সর্বাঙ্গ লাল হয়ে ফুলে ফুলে উঠেছে | হাত, পায়ের কিছু জায়গা তো এমন চুকলেছে যে রক্ত বেরিয়ে এসেছে | সেকি অবস্থা !!
তোয়াকে দেখেই বললো, ” প্লিজ হসপিটাল নিয়ে চলো, খুব কষ্ট হচ্ছে | আজ মরেই যাবো আমি” |
নিয়ে গেল তোয়া, আর উপায় কি ?
হাসপাতালে ইঞ্জেকশান দেয়ায় বেশ খানিক্ষন পরে কমে এল অস্বস্তি |
পরেরদিন সকালে একটু সুস্থ হতেই সাগরনীল আতঙ্কিত স্বরে বললো,” তোয়া, আমি কিন্তু আর বাড়ি যাব না | ওই কাঠের কি সব কাজ তুমি শুরু করিয়েছো আগে শেষ হোক বাবা !! আমি হোটেলে থাকবো ততদিন প্লিজ | ওই কাঠের গুঁড়ো খেয়ে আমিই ফটো হয়ে যাবো নাহলে, ট্রফির পাশে রেখে দিও |”
তোয়া বললো, ” এইসব কথা বোলো না প্লিজ | আর তুমি হোটেলে থাকবে কি করে এরকম শরীর খারাপ নিয়ে ? আমার বাড়িতে থাকো | কেউ এই অবস্থায় একা একা থাকে নাকি ?”
সাগরনীল যেন খুব অবাক হলো, একা একাই তো থেকে এসেছে ও এতদিন | কিন্তু আজ তো আর একা না ও | এখন তো তোয়া আছে ওর পাশে |
তোয়া জিজ্ঞেস করলো, “নীল, তোমার কাঠে এইরকম এলার্জি হয় আগে বলোনি তো? বই রাখার সেল্ফ বানানোর সময় এরম হয়েছিল ?”
সাগরনীল কাঁধ ঝাকিয়ে বললো, “আমি বাড়িতে ছিলাম নাকি তখন ? সে তো কাজ ফাজ হয়ে যাবার পরে, বাড়িতে রং হয়েছে, পরিষ্কার হয়েছে তারপর তো শিফট করেছি | ওই সব কাজের প্রগ্রেস আমি দেখতেও আসিনি | জানবো কি করে কাঠ কাটার কাজ হলে আমিই ইহলোক থেকে কেটে যাবো ? জানলে কি আর সাধ করে বলতাম যে “হ্যাঁ, কাজ করাও | এই ট্রফি, মেডেল সাজানো দেখে তবেই আমার মরে শান্তি !” ”
আর করায় নাকি কাজ ? যা হয়েছিল সেসব খুলিয়ে দিল তোয়া, রেডিমেড জিনিস এনে লাগিয়ে গোটা বাড়ি ভালো করে পরিষ্কার করিয়ে তবে শান্তি | দুদিন তো বেশ কাবু হয়েই ছিল সাগরনীল, সব মিলিয়ে এক সপ্তাহ পরে আবার ফিরেছিল নিজের বাড়িতে, তাও ভয়ে ভয়ে | সেই রাতে তোয়াও ওখানেই থেকে গিয়েছিল, আবার যদি কিছু হয় সেই চিন্তায় | তবে আর কিছু হয়নি | পরের দিন সাগরনীল মিচকে হেসে বলেছিল, “তোমার কাঠের কাজ করানোর হলে আমাকে এইবার থেকে…”
ওর কথা মাঝে থামিয়েই তোয়া বলেছিল,”আর কোনোদিন না বাবা !! যা খেল তুমি দেখালে | ”
“বেস্ট! আর কাঠ কাটতে হবে না | এমনিও গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে, গাছ কাটা ঠিক না “, এই বলে খুব হেসেছিল সাগরনীল |
পরেরদিন তোয়া যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলো সাগরনীল হঠাৎ বললো, “আচ্ছা তোয়া আমার এই থার্ড বেডরুমটা তো একদম খালি | তুমি ওটাকে নিজের মতন করে সাজিয়ে নাও না | এখানেই থেকে যাও আবার আলাদা আলাদা থাকার কি দরকার ?”
ঐযে সাতদিন ও তোয়ার কাছেই ছিল, দিনগুলো যেন ওর জীবনের সেরা দিনের মধ্যে পরে | তোয়া কত খেয়াল রেখেছে | এই এত বছর তো কেউ এমন যত্ন করেনি সাগরনীলকে, সেখানে তোয়া নিজের কাজ সামলে ওর জন্যে সুপ্ বানিয়ে দিয়েছে | বাড়িতে একা থাকলে তো ওই চকলেট, কোল্ড্রিংকস, কর্নফ্লেক্স খায় এমনি দিনেও | ওরকম গরম গরম রান্না করা খাবার কোথায় জোটে ? কে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়?
তাই আজ তোয়াকে ছাড়তে একদম ইচ্ছে করছে না, একটুও ভালো লাগছে না সাগরনীলের | এত বছর একা থেকেছে ঠিকই, কিন্তু এই কদিনেই যেন সে অভ্যেস ভেঙে গেছে | মনে হচ্ছে তোয়ার সাথেই যেন ও থাকতো চিরকাল |
ওর প্রশ্নে তোয়া মনে মনে ভাবলো, “জাব্বাবা !! বিয়ের আগেই এখানে থাকবো নাকি পার্মানেন্টলি !!”
তোয়া বিয়েতে বিশ্বাসী | যদিও নিজের বাবা, মায়ের বিয়েই ভাঙতে দেখেছে চোখের সামনে | তাও ওই লিভ ইন না, ও বিয়ে করে তবেই একসাথে থাকতে চায় | তবে ও তাড়া দিতে চায় না সাগরনীলকে, বললো, ” সবসময় না তবে আমি মাঝে মাঝে এসে থাকতে পারি নীল, চলবে ?”
“একদম একদম ! দৌড়োবে তোয়া”, হেসেই উত্তর দিল সাগরনীল |
সেই মতন একটু একটু করে ওই ঘরটা তোয়া নিজের খেয়াল খুশি হিসেবে সাজালো |একদিকে তো সুবিধেই হলো | ওদের দুজনেরই ব্যস্ত জীবন, সব সময় বাইরে দেখা করার সময় হয় নাকি ? এক জায়গায় থাকলে তো অনেক বেশি সময় কাটানো যাবে একসাথে | তাই তোয়ার নিজের ফ্লাটটাও থাকলো, তবে সপ্তাহে বেশ কিছুদিনই এখানে থাকতে শুরু করলো | সাগরনীল আর ও, দুজনে যেন ফ্ল্যাটমেট |

ক্রমশ সময় এগিয়েছে, প্রায় এক বছর পার করে এসেছে ওরা একসাথে | একে অপরকে বুঝতে শিখেছে | কখন কথা বলতে, কখন শুধু শুনতে হয় | কখন সময় দিতে হয় আর চুপচাপ পাশে থাকতে হয়, দুজনেই এখন জানে | কাজ থাকলে বিরক্ত করতে নেই, আবার একদম সরেও থাকতে নেই | সব সময় যে একে ওপরের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হবে এরকম ওদের কেউই ভাবে না, পাশাপাশি বসে নিজের নিজের বই পড়াটাও দামি | কত রাতে এমনিই সাগরনীলের ওই আঠেরোতলার বারান্দায় বসে থেকেছে ওরা, আকাশের দিকে তাকিয়ে | কথা বলেনি কেউ, কিন্তু শুনেছে যেন কত কিছুই |

তোয়া ওর সাথে কদিন থেকেই বুঝেছিল বুঝলো কি পরিমান অনিয়ম করে সাগরনীল | তোয়া থাকলেই রোজ দুবেলা বকুনি জুটতো সাগরনীলের | “এত বেলা করে উঠেই কফি খাচ্ছ খালি পেটেই ?” আচ্ছা বেশ খাবে না | রাতে ভাত, রুটি কিছুই না কাজ করতে করতে খেতে সুবিধে হয় বলে গুচ্ছের চকলেট আর কোল্ডড্রিঙ্কস ! সেই দেখে একদম হতবাক হয়ে তোয়া শুধু বললো, “নীল, এইটা ডিনার ?”
ওর মুখ দেখে সাগরনীল বকুনির ভয়ে নিজেই সামাল দিতে বললো, “না, না | এইসব একদম খাই না আমি | এই আজই শুধু| ডিনার করবো তো, এই একটু পরেই |” এদিকে ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা বাজে |
একসাথে থেকে কিন্তু তোয়াও একটা জিনিস ছেড়েছে, বকেনি সাগরনীল তবে যা করলো সে বকুনিরও বাড়া |
তোয়ার ছেলেবেলা থেকেই বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু ভিজলেই বেচারির খুব সর্দি হয় | সেটা একদিন লক্ষ্য করেছে সাগরনীল | পরেরবার বৃষ্টি দেখে তোয়া যখন গুটিগুটি ব্যালকনির দিকে যাচ্ছে তখনই সাগরনীল বারণ করেছিল, “এইতো আগের বারই ভিজে সর্দি হলো, আবার কেন ভিজতে যাচ্ছ ? যেও না তোয়া, শরীর খারাপ করবে |”
তোয়াও দুস্টু, শোনেনি বারণ | ওর যে ভিজতে খুব মজা লাগে, কি করবে ? ভিজে এসে সত্যি আবার সর্দি, জ্বর বাঁধিয়েছিল | যত্ন ঠিকই করেছিল | রান্না করতে না পারুক, গরম দুধ, স্যান্ডউইচ এইসব এনে এনে দিয়েছিল, ওষুধ এগিয়ে দিয়েছিল | কিন্তু টানা দুদিন ওর সাথে কথা বলেনি সাগরনীল |
একটাও না | সাগরনীলের জেদ কি সহজ জিনিস নাকি ? বলবে না তো বলবেই না কথা |
কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় নি, “কেন কথা বলছো না?” অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে তোয়া | শেষে হাল ছেড়ে বলেছে, “আমার ভুল হয়েছে নীল আর ভিজবো না |” অমনি সাগরনীল জিজ্ঞেস করেছে, “প্রমিস ?”
“হ্যাঁ, প্রমিস”, শপথ করেছে বাবা !! আর ইচ্ছে করে ভিজবে না |

ওর ওই চুপ করে যাওয়াতে যদি তোয়া ঘাবড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তোয়ার একদিনের প্ৰচণ্ড রাগে সাগরনীলেরও কেঁদে ফেলার জোগাড় হয়েছিল | এমন বকুনি খেয়েছে সাগরনীল যে ওর সারাজীবন মনে থাকবে | তবে কাজও সেরমই করেছিল, দোষ সবটাই ওর |
প্রচুর কাজের চাপ যাচ্ছিলো, ওদের একটা নতুন ফিচার লঞ্চ হবে তার তোড়জোড় চলছিল | কদিন তাই কথা বলারও সময় পায়নি সাগরনীল | তোয়া বোঝে সেটা, কাজ পাগল মানুষ নীল | তা এই সময়ই তোয়াকেও কিছুদিনের জন্যে হায়দরাবাদের বাইরে যেতে হয়েছিল, কাজের সূত্রেই | শুক্রবার রাতেই ফিরে এসেছিল, কিন্তু সোজা নিজের বাড়ি গিয়েছিল| পরেরদিন, শনিবার সকালে দেখা করতে এলো এই দশটা নাগাদ | সেদিন সাগরনীল বাড়িতেই থাকবে তাই নিজের চাবি দিয়ে না খুলে প্রথমে বেলই বাজালো | দরজা খুললো না দেখে ভাবলো নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে, তাই নিজেই ঢুকে এল | ঢুকেই দেখে সাগরনীল টেবিলে ল্যাপটপগুলোর পাশে দুহাতে নিজের মাথা ধরে বসে আছে | মুখ একদম ফ্যাঁকাসে ! দেখেই খুব কাহিল মনে হচ্ছে |
এক টানা বসে বসে কাজ করেছে, সারারাত ঘুমোয়নি, খায়নি কিছুই | কাজ করতে করতে বোঝা যায় না, কিন্তু অনেক্ষন পরে যখন কাজ শেষ হয়, তখন ওই নির্ঘুম রাত, এতক্ষন না খেয়ে থাকা সব এসে ক্লান্তি হয়ে জড়িয়ে ধরে একসাথে | খুব দুর্বল লাগে | নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানে তোয়া এইটা, ওকে দেখেই বুঝেছে | তাড়াতাড়ি একটা বড় গ্লাসে জুস্ আর চকলেট, আর তারপর ব্রেড টোস্ট করে নিয়ে এল | সেগুলো সব সঙ্গেসঙ্গে খেয়ে ফেলে, অনেকটা জল খেয়ে সাগরনীল বললো, ” থ্যাংক ইউ, ভাগ্গিস এলে | অনেক্ষন খাইনি তো ভীষণ মাথা ঘুরছিলো, উঠেই পারছিলাম না “|
তোয়ার যা রাগ হলো না এই শুনে, তখন চেপে গেল, বললো, “একটু শুয়ে নাও “| সত্যি ক্লান্ত লাগছিলো, শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়লো সাগরনীল |
ওমা!! দেড়, দুঘন্টা ঘুমিয়ে উঠে দেখে তোয়া নিজের সুটকেস নিয়ে উদাস মুখে সোফাতে বসে আছে |
কি ব্যাপার ?
ও উঠে এসেছে দেখে, তোয়া জিজ্ঞেস করলো, “শরীর ঠিক লাগছে এখন ?”
সাগরনীল একটু নিভে যাওয়া গলাতেই বললো,”হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ ? এই তো এলে |”
তোয়া একদম স্বাভাবিক স্বরে বললো, “আমি চলে যাচ্ছি নীল, আর কোনোদিন আসবো না | প্লিজ আমাকে ফোন কোরো না বা দেখা করার চেষ্টা কোরো না | বাই”, বলে উঠে দাঁড়ালো |
সেকি ! কেন ? সাগরনীলের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল | “কি হয়েছে তোয়া ?”, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল |
ব্যাস!!
তোয়া একদম ফেটে পড়লো, “কি হয়েছে ? হ্যাঁ ? জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগে না তোমার ? কাজ করছো ঠিক আছে, খেতে মনে থাকে না ? এত নির্বোধ হয় একজন ? বাড়িতে বসে বসে, না খেয়ে এইরকম শরীর খারাপ বাঁধাবে ? আমি না আসলে কি করতে ? না, না চুপ করে থেকো না নীল | বলো ? যে মানুষ নিজে খেতেই ভুলে যায় সে আবার কি রিলেশানে থাকবে ? নিজেকেই সামলে রাখতে পারছো না, আমি যদি পাশের ঘরে মরেও যাই তুমি তো জানবেও না | তোমার তো কাজই সব !!”
হাত নেড়ে, পা ঠুঁকে, খুব রেগে রেগে, প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট একদম সাংঘাতিক বকাবকি করলো সাগরনীলকে | মাঝেমাঝে বলছে, “দাও উত্তর” বা “বলো কি বলার আছে এতে” | বেচারা সাগরনীল কিছু বলবে কি, মুখ খোলারই সুযোগ পেলো না তো | একদম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তোয়ার চেঁচানো শুনে গেল, ভয়ে বসলোও না | স্কুলে কোনোদিন বকা খায়নি সাগরনীল, অন্যদের খেতে দেখেছে | অনেকটা সেইরকমই যেন |
শেষে তোয়া যখন সুটকেস হাতে বেরিয়ে যাবে বলে দরজার দিকে এগোলো, তখন একদম মরিয়া হয়ে ওর হাত চেপে ধরে বললো, “প্লিজ প্লিজ, যেও না তোয়া …আর কোনোদিন এরকম হবে না | সরি, তোয়া সরি | প্লিজ তোয়া, তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার …প্লিজ যেও না | আমার ভুল হয়ে গেছে ..”
তোয়া ভীষণ গম্ভীর হয়ে বললো,”কথা দাও, আমাকে ছুঁয়ে বলো আর এইরকম অনিয়ম করবে না |”
সাগরনীল ওর হাত খানা দুহাতে ধরে বললো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ কথা দিচ্ছি আমি | আর অনিয়ম করবো না | একদম না |”
খালি সুটকেসটা নামিয়ে রাখলো তোয়া, ফিক করে হাসলো, “কেমন দিলাম” ধরণের ভাব !
সত্যি চলে যাচ্ছিলো নাকি, দূর !
কাছে এগিয়ে এসে, খুব মন দিয়ে, চোখ সরু করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এই নীল তুমি কাঁদছো নাকি ? তুমি না বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী ? ”
কিরম বোকা বানিয়েছে ওকে তোয়া এইবার বুঝেছে, “না, একদম না | মটেও না | মিথ্যে কথা বলে ফালতু আমাকে টেনশানে ফেলা ! ছাড়ো আমাকে, আমার অনেক কাজ আছে”, বলে পালিয়ে বাঁচলো সাগরনীল |
তোয়া তো হেসেই খুন, মনে মনে বললো, “বেশ করেছি !”

তোয়া আজ একটা সংবর্ধনা সভায় যাবে | সেখানে সরকারের তরফ থেকে এমন মানুষের সম্মান জানানো হবে যারা নিজেদের ব্যবসায় গ্রামের মানুষদের কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন | তোয়ার কোম্পানি কংসমেটিক্স এর পাশে পাশে গ্রামের মহিলারদের হাতে বানানো গয়না বিক্রি করে | সেগুলো কোনোটা কাঠের, আবার কিছু আছে নানারকম ফল,পাতা শুকিয়ে বানানো | এর জন্যে সেই মহিলাদের গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয় না | সাপ্লাই চেন তোয়ার অফিসের লোকে সামলে নেয় | মোট পঞ্চাশটা গ্রাম থেকে জিনিস কেনে ও এখন, আরও বাড়াবে আসতে আসতে | একদিকে কুটির শিপ্লীরা সাহায্য পাচ্ছেন আবার প্রযুক্তির সাহায্যে এইসব জিনিসগুলো আরও বেশি লোকের কাছে পৌঁছচ্ছে | বিদেশেও রফতানি হচ্ছে |
সেইজন্যে আরও অনেকের সাথে তোয়াও আজ সম্মানিত হবে |
ওর বাবা আর মাকে এই খবরটা জানিয়ে রেখেছে, তবে উনারা দুজনেই আসবেন এইরকম আশা ও রাখে না | তবে ওর সাথে সাগরনীল যাবে আর সে ওর থেকেও বেশি উত্তেজিত এটা নিয়ে | তোয়ার এই বিশেষ দিনে খুব খুশি সাগরনীল, ও নিজে যদিও আমন্ত্রিত না, তোয়ার অতিথি হয়েই যাবে |
অনেকবার বলেছে, “এইটা তুমি দারুন জিনিস করেছ| এইটাই আসল চেঞ্জ!! সোসাইটির উপর তোমার কাজের একদম ডাইরেক্ট ইমপ্যাক্ট | তুমি ব্রিলিয়ান্ট তোয়া !!”
তোয়া মনে মনে আশা করেছিল যে অন্যদের মতন কাজ নিয়ে সাগরনীল ঈর্ষাকাতর হবে না | চেয়েছিল যে তোয়ার এই কৃতিত্বকে সম্মান করবে, নিজের সাথে তুলনা টেনে রেগে যাবে না বা ছোট করবে না | তাও একটু আশংকাও ছিল | দুজনের বিচরণ ক্ষেত্র এক হলে তো মান-অভিমান এসেই যায়, সম্পর্ক তো নষ্ট হয় এতে | অনেকেই মুখে বলে, “তুমি আমি সমান” কিন্তু আচরণে বুঝিয়ে দেয় যে “আমিই বড়, তুমি কি করে আমার সমকক্ষ হবে ?”
তাই সাগরনীলের প্রতিক্রিয়াতে আস্বস্ত হয়েছে তোয়া | তবে সেদিন কি পরে যাবে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে বসলো যখন, তোয়ার হাসিই পেয়ে গেল | কি পরবে এ নিয়ে সাগরনীলকে চিন্তা করতে এই প্রথম দেখলো ও |
এতটা গুরুত্ত্ব দিয়েছে শুধু তোয়ার জন্যে |
তোয়া নিজে আজ একটা সিল্কের লাল-গোলাপি মেশানো শাড়িতে সেজেছে | সাথে মাননসই গয়না, ওই গ্রামের মহিলাদেরই বানানো| চুলে বেঁধেছে বিনুনি | সহজ সাজ, আজকের অনুষ্ঠানের উপযুক্ত | নিজে তৈরী হয়ে, সাগরনীলকে নিয়ে একেবারে যাবে ও | তো তাকে নিতে এসে বেশ অবাকই হলো তোয়া | এত যত্ন করে নিজের পুরস্কার নেবার দিনও সাজেনি সাগরনীল | আজ থ্রি-পিস্ সুট পরেছে, নীল রঙের, সাদা শার্ট আর গাঢ় নীল টাই | জুতোগুলো দেখে নতুন মনে হলো নতুন, একদম চকচক করছে, মোজা তো অবশ্যই আছে আজ | তোয়া লক্ষ্য করলো চুলটাও একদম পরিপাটি করে বেঁধে এসেছে হেসে, জিজ্ঞেস করলো, “আজ কে চুল বেঁধে দিল তোমার ? এত সুন্দর করে নিজে তো বাঁধোনি বুঝতেই পারছি|”
সাগরনীল চোখ নাচিয়ে বললো, ” আমার চুল বেঁধে দেবার লোকের অভাব নেই তোয়া!” তোয়ার ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছে দেখে বললো, “আররে ছেলেটার নাম তো ভুলে গেছি …এই আমাদের কমপ্লেক্সেই একটা সালোন আছে, পরের বার জিজ্ঞেস করে আসবো, তোমাকে আজ দারুন লাগছে তোয়া !! আমাকে ঠিকঠাক লাগছে তো তোমার পাশে ? ”
তোয়া জোরে হেসে ফেললো, এইটা নাকি চিন্তার কথা? বললো, “হ্যাঁ তোমাকে ফাটাফাটি লাগছে!”
কিন্তু মনে মনে খুব খুশি হলো | সাগরনীল তো নাই যেতে পারতো, এইসবে যেতে যে ও খুব পছন্দ করে তা না, কিন্তু ও জানে যে ও পাশে থাকলে তোয়ার কত ভালো লাগবে, তাই তো এত যত্ন করে জামাকাপড় পরে, আবার সালোনে গিয়ে চুল বেঁধে এসেছে |

অনুষ্ঠানে ওর বাবা, মা দুজনেই এসেছিলেন, একজন দিল্লি, অন্যজন মুম্বাই থেকে | এইরকম সাধারণত হয়না | তোয়া খুব খুশিই হলো | সংবর্ধনার শেষে ওরা চারজন বাইরে খেতে এল, এই সুযোগে তোয়া নিজের বাবা, মা আর সাগরনীলের পরিচয়ও করিয়ে দিল |
তোয়ার বাবার দিল্লিতেই কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা, যথেষ্ট বড়োলোক উনি | অন্যদিকে ওর মা নিজের পারিবারিক গয়নার ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন প্রথম বিয়ে ভেঙে যাবার পর | প্রথমে তো তোয়ার এই সংবর্ধনায় খুব খুশি হলেন দুজনে, উনারা কিছু খাবার ওদের করলেন না, শুধু ড্রিঙ্কস নিলেন দুজনেই | ভালো কথা দিয়েই শুরু হলো সন্ধেবেলাটা | তারপর কি করে যে মোড় ঘুরলো সাগরনীল নিজে তো খেয়াল করেইনি, তোয়াও যেন একদম হকচকিয়ে গিয়েছিল |এইভাবেই বলবেন ঠিক করে এসেছিলেন না দুজনেই ওই পানীয়ের প্রভাবে এইরকম আচরণ করলেন, তোয়া বা সর্গনীল বলতে পারবে না | শুরু হয়েছিল এক রাশ আনন্দ নিয়ে সেটা কিন্তু শেষ হতে হতে বিশ্রী রূপ নিল সন্ধ্যেটা |
ওর মাই বললেন,”এইসব স্টার্টআপ তো অনেক হলো মুনিয়া, এইবার একটা ভালো, স্টেবেল জিনিসে যোগ দাও | আমার সাথে চলে এসে বিজনেসে |” মুনিয়া, ওরফে, তোয়া এই কথার কি মানে বের করবে বুঝলো না | মানে ? ওর ব্যবসাটা ভালো না ? কি বলতে চাইছে ওর মা ?
ওর উত্তরের আগেই ওর বাবা বললেন, “সেই স্টেবেল নাকি তোমাদের ওই জুয়েলারির বিজনেস, রাব্বিশ ! তুমি দিল্লি ফিরে চলো তোয়া, এইসবে কোনো ফিউচার নেই | অলরেডি ইউ আর থার্টি ! তোমার মায়ের মতন উল্টোপাল্টা জিনিসে ইন্টারেস্ট তোমার !!”
প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল, তোয়ার সুন্দর সন্ধ্যেখানা একদম নষ্ট হয়ে গেল | দুজনেই ওকে শিখন্ডি করে ঝগড়া শুরু করে দিলেন আর মাঝেমাঝেই তোয়াকে এইসব বলতে থাকলেন | সাগরনীল সাধারণ বাড়ির ছেলে সেটা জেনে, ওকেও অকারণ অপমান করলেন, ” তোমাকে ভালোবাসে মনে হয় তোমার ? ওর চোখ আমাদের টাকার উপর তোয়া, তুমি জেনে রাখো | তোমার বাবাও এইজন্যেই আমার সাথে বিয়ে করেছিল, পায়সা দেখে |”
এত রাগ হলো এইটা শুনে সাগরনীলের, খাওয়া থামিয়ে হাত গুটিয়ে নিল | তোয়া না থাকলে তখনই উঠে চলে যেত | কিন্তু আজ উঠে এল না, আগে অনেকবার রাগ করে এরকম করেছে ও | এতে তোয়ার তো দোষ নেই | নিশ্বাস ধরে রাখলো, যেন অপেক্ষা করলো সাগরনীল, তোয়া যদি এর প্রতিবাদ না করে এখুনি চলে যাবে |
তোয়া কিন্তু সঙ্গেসঙ্গেই প্রতিবাদ করে বললো,”নিজেদের প্রব্লেমে ওকে টানছো কেন ? নীলকে ইনসাল্ট করে কোনো কথা বলবে না |”
তোয়ার বাবা বললেন, “তুমি বেশি গলা চড়িয়ে কথা বলো না তো তোয়া | একদম নিজের মায়ের মতন হয়ে যাচ্ছ দিনদিন |”
তোয়ার মনে হলো ও ছেলেবেলায় ফিরে গেছে | সেই ঝগড়া, চেঁচামেচি, একে অপরকে অপমান করে কথা বলা | এইসব অনেক বছর পর আবার চোখের সামনে দেখে যেন পাগল পাগল লাগছে তোয়ার | এরা এরকম করছে কেন ?
তোয়াই উঠে যাবে ভেবেছিল সাগরনীল | দেখলো তোয়ার চোখ মুখ লাল হয়ে আসছে কিন্তু উঠে চলে যেতে হবে সেটা যেন ওর মাথাতেই আসেনি | ওখানে যেন পা গেঁথে গেছে তোয়ার | মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, খুব অপমানিত হয়েছে | সাগরনীল ওকে খুব মন দিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করলো, কি চলছে তোয়ার মনে ? হয়তো একটু সাহায্য চাই ওর, হয়তো ও ভাবছে যে সাগরনীলও ওর উপর বিরক্ত হয়েছে এই ডেকে এনে অপমান করানোর জন্যে | ভীষণ বিপর্যস্ত লাগছে তোয়াকে দেখে |
নাহ! আর বসে থেকে লাভ নেই, এই ভেবে সাগরনীল উনাদের বাকবিতণ্ডার মাঝেই ওয়েটারকে ইশারায় ওর আর তোয়ার খাবারগুলো সব প্যাক করে দিতে বললো | বিল যা হবে তার থেকে অনেক বেশি টাকা টেবিলে নামিয়ে দিয়ে, প্যাকেটগুলো আসতেই সেগুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো | তোয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে নিল নিজের হাতে | ওর বাবা, মাকে একদম অবাক করে সোজা বেরিয়ে গেল | তোয়া কিছুই বললো না, চুপচাপ ওর সাথে চলে এল |
তোয়ার হাত থেকে ওর গাড়ির চাবি নিয়ে আজ সাগরনীলই গাড়ি চালিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এল |
তোয়া যেন একদম ঘাবড়ে গেছে | যদি ও নিজের মধ্যে থাকতো দেখতে পেত ওর মুখ দেখে সাগরনীলের মুখে যেন হাজারটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে | ওকে ওরই বাবা, মায়ের থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতেই যেন পাঁচশো বার হর্ন দিল সামনের গাড়িদের | এমনিই এই জ্যামে ধৈর্য থাকে না সাগরনীলের, তার আবার আজ তোয়ার মন খারাপ !
এমনিতে শক্ত, বাস্তববাদী মেয়ে তোয়া, কিন্তু আজ যেন খুব ভেঙে পরেছে | তোয়াকে বিছানাতে বসিয়ে ওর পাশে বসলো সাগরনীল | আলতো করে জড়িয়ে ধরলো, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ভয় নেই তোয়া, এই তো আমি আছি তোমার কাছে “|
তোয়া কেঁদে ফেললো এইবার | কেন ওরা বাবা,মা এরকম করলেন ওর সাথে ? একদিন কি একটু ওর আনন্দের খাতিরে নিজেদের ঝামেলাগুলো সরিয়ে রাখা যায় না ? ওর জন্যে সাগরনীলকেও অপমানিত হতে হলো | সেটা মনে করেই তোয়া বললো, “সো সরি নীল, শুধু শুধু তোমাকে ইনসাল্টেড হতে হলো |”
“কিছু অসুবিধে নেই তাতে আমার, তুমি কেঁদো না তোয়া..প্লিজ”, না ভেবে সহজেই বললো সাগরনীল | ওর ভালো লাগছে না তোয়াকে কাঁদতে দেখে | এইটাই ওর সমস্যা, তোয়ার বাবা, মা কি বললো না বললো তাতে কিছু যায় আসে না ওর এই মহুর্তে |
বেশ খানিকক্ষণ ওর কাঁধেই মাথা রেখে কাঁদলো তোয়া | সাগরনীল কিন্তু আর কোনো কথা বললো না, চুপ করে ওর পাশে বসে থাকলো শুধু | যতক্ষণ তোয়া কাঁদলো ওকে ধরে থাকলো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল | যেন ও বুঝতে পেরেছে যে সান্ত্বনা চাই না তোয়ার, শুধু কেঁদে হালকা হতে চায় | তারপর তোয়া সামলে নিল , নিজের চোখ মুছে নিয়ে বললো, “থাঙ্কস নীল”| সাগরনীল এক গ্লাস জল নিয়ে এল আর চকলেট | আলমারি থেকে তোয়ার ঘরে পরার জামা বের করে এগিয়ে দিল | নিজেই ওর হাতের ওই ব্রেসলেট, কানের দুল এইসব অপটু হাতে খুলে এক জায়গায় রেখে দিল | তোয়া আপত্তি করলো না, এই যত্নটুকু একদম লুটেপুটে নিল, কেন নেবে না ?
তারপর তোয়া যখন জামা পালটাতে গেল, ওর ফোনটা অফ করে দিল সাগরনীল, ভাবলো “আজ রাতে আর অশান্তির কোনো প্রয়োজন নেই তোয়ার, অনেক হয়েছে “|
তোয়া বাথরুম থেকেই শুনতে পেল, গান চালিয়েছে সাগরনীল | তোয়ার খুব পছন্দের “সানশাইন অন মাই শোল্ডার্স মেকস মি হ্যাপি …” |
“সত্যি তো নীল তো আছে”, ভাবলো তোয়া | ও বেরিয়ে আসতেই সাগরনীল জিজ্ঞেস করলো, “শরীর ঠিক আছে তো তোমার ? খাবে কিছু ?”
খিদে নেই আর তোয়ার, বললো, “আই এম ওকে, খিদে পায় নি |”
“শুয়ে পড়ো তাহলে, এস “, বলে বালিশ ঠিক করে দিল, ও শুতেই চাদর গায়ে দিয়ে দিল |
তারপর ওর বিছানার পাশেই বসলো মেঝেতেই, ওর একটা হাত ধরে |
তোয়া আবারও বললো, “নীল আমি জানাতাম না এরকম হবে | জানলে আমি কখনো তোমাকে আজ ওখানে নিয়ে যেতাম না | আমার জন্যে তোমাকে এইভাবে অপমানিত হতে হলো, আমি ..”
সাগরনীল কিন্তু ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই বললো, “তুমি তো আর অপমান করোনি আমাকে, তাহলে তুমি কেন এইসব বলছো ? ছেড়ে দাও তোয়া | তোমার এত সুন্দর সন্ধ্যেটা মাটি হয়ে গেল ভেবে আমারই খারাপ লাগছে | শুধু আমরা দুজনে গেলেই ভালো হতো |”
ওর ওপর একটু রাগ করেনি ? ওকেই বরঞ্চ সান্ত্বনা দিচ্ছে !
এইটা তোয়া আশা করেনি | ভেবেছিল রাগ করবে, বলবে যে “তোমার বাবা, মা এরকম জানোই যখন তুমি আমাকে ডেকে নিয়ে গেলে কেন ?”
তোয়া তো রেস্টুরেন্টেই ভাবছিলো যে সাগরনীল রেগে উঠেই চলে যাবে | ওকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবে, একা ছেড়ে দিয়ে আসবে না, তখন ভাবতেই পারেনি | এখনো ভাবলো, “ভাগ্গিস !! নীল যদি আমাকে একা রেখে যদি চলে যেত কি করতাম আমি ?”
“শুধু আমরা দুজনে গেলেই ভালো হতো”, ও নিজেও অস্ফুটে বললো |
সাগরনীল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, আরামে আর কিছুটা ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল তোয়ার | কি করে বুঝতে পারে সাগরনীল ? এইযে এখন তোয়ার একা থাকতে একটুও ইচ্ছে করছে না, আবার কোনো কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না, ও জানলো কি করে ? এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো তোয়া|
যখন ঘুম ভাঙলো , সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে |
চোখ খুলে দেখলো ওই এক জায়গাতেই বসে ঘুমোচ্ছে সাগরনীল | মাথাটা নেমে এসেছে বিছানায়, তোয়ার পাশে | একটা হাতে এখনো আলগা করে ধরে আছে তোয়ার হাতটা | সেই কালকের জামা প্যান্টই পরে আছে, টাই আর জ্যাকেটটা খুলে মেঝেতেই রাখা | ওখানেই বসে খানিক খেয়েছে কালকের প্যাক করে আনা খাবার | তোয়া ভাবলো, “ আহা রে ! কাল ওকে জিজ্ঞেসই করিনি যে ও খাবে কিনা কিছু, দেখো খিদে পেয়েছিল তো | নিজের ঘরে গিয়ে ভালো করে শোয়নি কিছুনা, এখানেই বসে থেকেছে | আর আমি আরাম করে ঘুমোলাম!!”
তোয়া ডাকলো আসতে, “নীল …”
“উঃ”
“নীল …”, আবার ডাকলো তোয়া|
এইবার চোখ খুলে তাকালো ওর দিকে, জিজ্ঞেস করলো, “ঠিক আছো তো ? শরীর ঠিক আছে ?”
তোয়া হাসলো, বললো,”হ্যাঁ | ঠিক করে শোও বিছানায়, ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে যাবে তোমার |”
এই প্রস্তাবে, কোনো কথা না বলে উঠে তোয়ার পাশেই শুয়ে পড়লো আর মুহূর্তের মধ্যে একদম গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল | তোয়া জেগে থাকলো, বেশ অনেক্ষন | তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো | সাগরনীল ওর উঠে যাওয়াটা বুঝতে পারেনি | অনেক রাত অব্দি জেগে বসেছিল ওর পাশেই, তাই এখন একদম ঘুমিয়ে পড়েছে | তোয়া মুখ ধুয়ে এসে দেখলো যে ওর ফোনটা বন্ধ করা আছে, অন করতেই অনেক মেসেজ ঢুকলো, বাবা আর মায়ের দুজনেরই | ইচ্ছে করলো না ওর পড়ে দেখতে |
নিজের আঙ্গুলে সাগরনীলের দেয়া আংটিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো |
আংটিটাও যেন সাগরনীলের মতোই |
প্রথম দেখাতে মনে হয় সহজ, সরল, কিন্তু যতই দেখে তোয়া ততই যেন কিছু নতুন খুঁজে পায় |
প্রথমে তো খেয়ালই করেনি, সাগরনীলের কথার পিঠে ও হাসি মুখে “আই লাভ ইউ টু” বলতেই সাগরনীল ওর আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়েছিল আংটিটা | অনেকদিন পর তোয়া এমনিই আনমনে খুলে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি একটা ভাবতে গিয়ে খেয়াল করলো ভেতরে লেখা আছে, “নীল লাভস তোয়া”|
ও সেটা আগে দেখেনি আর সাগরনীলও ওকে বলেনি কিছুই |
পরে জিজ্ঞেস করেছিল তোয়া , “আগে বলোনি কেন আমাকে ?”
“একদিন নিজেই দেখতে পাবে জানতাম তো, বলার দরকার কি ? “, সাগরনীল ওর ওই দুস্টু হাসিটা হেসেছিল |
সত্যি!
এই যেমন কাল ও জানতে পারলো, এইভাবে ওকে আগলে রাখতেও পারে নীল | বলার দরকার কি ? কাজের সময় করে বেরিয়ে গেল তো | কি অনায়াসে কাল ওকে ওখান থেকে নিয়ে চলে এল সাগরনীল | এখন ভাবলে তোয়ার অদ্ভুত লাগছে | কথা কাটাকাটি করলো না, চেঁচালো না, রাগ করলো না | শুধু তোয়ার হাতটা ধরে উঠে চলে এল | ভাবখানা এমন যেন অন্যরা ঝামেলা করছে, চলো আমার এইখান থেকে নিজেদের বাড়ি চলে যাই, শান্তিতে থাকি |
“আবার খাবারও প্যাক করিয়ে এনেছে, পারেও বাবা !!!”, ভেবে জোরেই হেসে ফেললো তোয়া |
কাল খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, এখন মাথাটা পরিষ্কার, মনটাও হালকা তোয়ার |

সাগরনীলের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে বসে নিজের লাগানো গাছগুলো দেখছে তোয়া | দুপুর গড়িয়ে গেছে বেশ খানিকটা | সাগরনীল স্নানে গেছে | কিছুতেই আর ওকে মানুষ করতে পারেনি তোয়া, সেই দুপুরে আগে খাবে পড়ে স্নান ! “পাগল একটা !”, হাসলো তোয়া | ল্যাপটপ সামনে খোলা ওর, কিন্তু কাজে মনে নেই আজ |
তোয়ার মাঝেমাঝে মনে হয় যেন ও স্বপ্নে আছে | এইরকম ভাবে যে ওরা কাছাকাছি এসে পড়বে আর এইভাবেই পাশাপাশি থাকবে ওর যেন বিশ্বাস হতে চায় না | সাগরনীল যেভাবে ওকে সেদিন ওরই বাবা, মায়ের কাছ থেকে আড়াল করে নিয়ে এসেছিল, এমন ভাবে নিজের কাছে লুকিয়ে নিয়েছিল যে তোয়ার নিশ্চিন্ত আশ্রয় হয়ে গিয়েছিল সেই রাত থেকেই |
দেখে মনে হয় আপনভোলা | আবার মাঝেমাঝে ওর কথায় ঔদ্ধত্ব প্ৰকাশ পায়, কিন্তু সাগরনীলের মনটা খুব নরম | এত ভালোবাসতে পারে, যেন নিজের সবটা ঢেলে দিচ্ছে মনে হয় | পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারে সারারাত | সেই মায়ায় যেন কোনো বিরাম নেই, ক্লান্তি নেই | তোয়ারই অবাক লাগে, ভাবে “কি আছে আমার মধ্যে এত ভালোবাসার মতন ?”
এইসব ও ভাবছে এমন সময় সাগরনীল এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি ভাবিতেছেন দেবী ?”
সাগরনীলের ভিজে চুল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে, তোয়া রাগ করে বললো, “আবার ! যাও চুল মুছে এস ভালো করে !”
সাগরনীল মাথা ঝাঁকিয়ে খানিক জল ওর গায়েই দিয়ে মিচকে হাসলো, বললো, ” কুকুরের মতন ঝেড়ে ঝেড়ে শুকিয়ে নেব |”
তোয়া রাগ করে বললো, “এইরকম বদমাইশি করলে আমি চলে যাবো নীল “, তোয়া জানে ও চলে যাবে বললেই কাজ হয় | বলতেই সাগরনীল বললো, ” সরি সরি, আমি জল দেব না গায়ে | প্লিজ যেও না, মুছে নিচ্ছি বাবা !! ”
তোয়া ওর এই ভেসে ভেসে বেড়ানো জীবনে একটা নোঙ্গর যেন | ওকে স্থির থাকতে, এক জায়গায় শিকড় ফেলতে সাহায্য করেছে | এইরকম করে কেউ ভালোবাসে না সাগরনীলকে, এত মন থেকে আর কেউ আপন করে নেয় নি ওকে | ওর বাবা মারা যাবার পরে, তোয়াই প্রথম মানুষ যে ওকে বোঝে, ওর কথা মন দিয়ে শোনে | আবার কথায় কথায় বকে | বন্ধু, গুরুজন, প্রেমিকা, তোয়াই যেন ওর সব, সব | নিজের সৌভাগ্য দেখে অবাক হয় সাগরনীল, এত ভালোবাসাও ছিল ওর কপালে ?
চুল শুকিয়ে বেডরুম থেকেই ডাকলো, “এই তুমি কাজ করছো ? আমার পাশে বসে করো না, একটু ঘুমিয়ে নেব এইবার |”
এখন এইগুলো রোজকার আবদার, জলভাত হয়ে গেছে | “কাজ শেষ করেই আসছি, তুমি শোও”, বললো তোয়া | আর দশ মিনিটে নিজের কাজ গুটিয়ে, ওর পাশে গিয়ে বিছানাতেই বসলো একটা বই হাতে | দেখলো ঘুমিয়েই পড়েছে সাগরনীল | ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখে হাসলো হালকা, এখানেই থাকে এখন বেশিরভাগ সময় তোয়া, নিজের বাড়ি গেলে কেমন একা একা লাগে | আর তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে | আর আলাদা আলাদা না, এইবার সব সময় একসাথে থাকবে ওরা….

সামনের সপ্তাহে সাগরনীলের জন্মদিন পড়েছে | সেই অজুহাতে তোয়া ঠিক করেছে যে ওরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবে | সবাই বলতে, ওরা দুজন, নীলেশরা তিনজন আর তোয়ার খুব ভালো বন্ধু শেফালী আর ওর বর সুমিত | ওরা দিল্লি থেকে আসবে | সাগরনীল ছাড়া বাকিরা সবাই জানে আসল মতলব কি তোয়ার, ওই মানে সাগরনীল আর নৈঋত ছাড়া |
দেখতে দেখতে বেড়ানোর সময় এসে পড়েছে | কোচিন এসেছে ওরা সবাই | কেরালার ওই মনোরম পরিবেশ, সবুজ চারপাশ, সামনেই সমুদ্র, সবার ল্যাপটপে আটকে থাকা চোখে যেন আরামের পরশ বুলিয়ে দিয়েছে | আর নৈঋতের তো কথাই নেই, সে খুব খুশি | ওদের রিসোর্টটাও খুব সুন্দর, ওদের জন্যে তিনটে কটেজ বুক করেছে তোয়া তার সাথে একফালি সমুদ্র সৈকতও আলাদা করে ওদের ভাগে পড়েছে, ওই যাকে বলে প্রাইভেট বিচ |
ভোর বেলার ফ্লাইট ধরে এসেছে ওরা | সবাই হাত মুখ ধুয়ে, জলখাবার খেয়ে এইবার একটু ওই সমুদ্রের ধারে দিব্যি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে | নৈঋত বাবার কাছে সুবিধে করতে না পেরে সাগরনীলের কাছে বায়না জুড়েছে, “প্লিজ সাগরমামা …চলো না ..”
নীলেশ পাশ থেকে বকলো, “এই নৈঋত জ্বালাস না মামাকে!!”
সাগরনীল আরাম করে বালিতে আধ শোয়া হয়েছিল, জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবো রে ? এই তো এলাম এখানে |”
জলে নেমে খেলবে ও, ওর সাথে যেতে হবে | ওর সব বায়না এখানে চলবে, জানে নৈঋত |
“চল তাহলে..”, এই বলে ওর হাত ধরে সমুদ্রের জলে নামলো | “আরেকটু চলো ” এই বলে বলে অনেকটা এগিয়ে গেছে, থেকে থেকেই সাগরনীল সাবধান করছে, “এই হাত ধরে থাকবি কিন্তু …”
জলে নেমে নৈঋত খুব দুস্টুমি করছে দেখে ওকে কোলেই নিয়ে নিয়েছে সাগরনীল | দুহাতে ধরে একবার করে জলে নামছে আবার তুলে নিচ্ছে | খুব মজা পেয়েছে তাতে নৈঋত, খিলখিল করে হাসছে | এইসব আবদার ওর সাগরমামার কাছে, বাবার কাছে এইসব দুস্টুমি চলে না ওর | সাগরনীল যদিও নীলেশেরই কলেজের বন্ধু, তাও শ্রুতির ইচ্ছেয় ও বরাবরই নৈঋতের মামা, কাকা না |
শ্রুতি ওদের দেখে তোয়াকে বললো, “সাগরদার যেমন মাথা খারাপ, নৈঋতের কথা শুনে জলে নেমে গেলো | যা বলবে সব শুনবে সাগরদা, একটু বকো! তা না ! দেখো ওকে কোলে নিয়ে এইসব করছে, হাতে ব্যথা হবে তখন বুঝবে | ও কি আর সেই ছোট্ট আছে নাকি ? ওজন নেই ওর ? তোমাদের ছেলেমেয়ে বাবার কোনো কথা শুনবে না তোয়া, আঙুলে নাচাবে ওকে | তোমাকেই সবাইকে সামলাতে হবে |”
তোয়া হাসলো, সত্যি হয়তো তাই হবে | সাগরনীল শাসন করতে পারবে নিজের সন্তানকে ? নাকি শুধু আস্কারা দেবে ? দূর ! এখন সেসব অনেক দূরে, এই নিয়ে কোনো কথাই হয়নি ওদের |
দূর থেকে সাগরনীল তাকালো তোয়ার দিকে, ডাকলো ওকেও হাতের ইশারায় | তোয়া মাথা নাড়লো, না এখন জলে নামবে না ও |
খানিক্ষন জলে থেকে নৈঋত বালির দুর্গ বানাতে বসেছিল, একটু পরে আর ধৈয থাকেনি | “তুমিই বানাও সাগরমামা”, বলে উঠে মায়ের কাছে কি একটা বায়না করছে | এখন সাগরনীলই বালির দুর্গ বানাচ্ছে | জুসের গ্লাস, কফি কাপ, নৈঋতের একটা খেলনা বেলচা এইসব ব্যবহার করে বেশ বড়সর একটা বালির দুর্গ গড়ছে সাগরনীল | খুব মন দিয়ে বানাচ্ছে, ধৈর্য ধরে, আসতে আসতে | তাতে, দরজা, জানলাও আছে | ভিজে ভিজে বালির গায়ে নিজের লম্বা লম্বা আঙুল, পড়ে থাকা কাঠি এইসব দিয়ে কারুকার্য করছে | অন্য কোনোদিকে হুঁশ নেই | তোয়াও ওর পাশে এসে বসেছে, কি একটা ছেলেমানুষি আনন্দ খেলা করছে ওর মুখে সেটাই দেখছে | ওর হাতের গুনে জিনিসটা খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে | আসতে আসতে সবাই ওখানেই জড়ো হয়েছে |
শেষ করলো যেই, শেফালীই প্রথমে বললো, “লাভলী !! ইউ আর সো পেশেন্ট!!”
সাগরনীল যেন চমকে তাকালো, এতক্ষন খেয়াল করেনি বাকিদের | তারপর অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো অল্প, “থাঙ্কস” | বাকিরাও খুব প্রশাংসা করলো, অনেক ছবি তোলা হলো ওটার | তারপর আবার সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো |
তোয়া এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে, কাঁধে মাথা নামিয়ে রাখলো | নিচুস্বরে বললো, “খুব সুন্দর হয়েছে নীল | কারা থাকবে এইটাতে ?”
অমলিন হাসলো এইবার সাগরনীল, নির্দ্ধিধায় ওর কানে কানে বললো, “তুমি আর আমি” |

সেদিন সূর্যাস্তের আগেই সেই সৈকত ফুল আর বেলুন সাজানো হয়েছে সুন্দর করে | এইখানেই সাগরনীলের জন্মদিন উদযাপন করা হবে আজ |
তোয়া আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে, আকাশি রঙের একটা ড্রেস পরেছে, পা ছাড়িয়ে বালিতে লুটোচ্ছে সেটা, গয়না আজ সবই মুক্তর | কানে, গলায়, হাতে | চোখে ওর ঘন কাজল, ঠোঁট আজ গোলাপি | চুল খুলে রেখেছে তাতে দিয়েছে একটা নীল ফুল | কি মিষ্টি যে দেখতে লাগছে ওকে | সূর্যের পড়ন্ত আলো নিজের গায়ে মেখে মোহময়ী হয়ে উঠেছে ও |
সাগরনীল আর নৈঋত এতক্ষন এখানেই জলে খেলছিল, শ্রুতি ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আর সাগরনীলকে তাড়া দিয়ে জামা পালটে আসতে পাঠিয়েছে |
সাগরনীলের তোয়ার সাথে এখানে এসে সময় কাটাতে ওর বেশ ভালোই লাগছে | ল্যাপটপ আনতে দেয়নি তোয়া, কাজ করা নাকি বারণ ! নিখাদ ছুটি | বহুদিন, বহু বছর পরে | অন্যরকম লাগছে সাগরনীলের | এভাবে কারুর সাথে আগে বেড়াতে আসেনি | বেড়ায় ও, একা বা বন্ধুদের সাথে | তবে এই প্রথম ও আর তোয়া | এই প্রথম ওর সাথে কেউ এসেছে, যে শুধুই ওর |
সাগরনীলের উপর ভরসা নেই তোয়ার, তাই নিজেই বের করে রেখে গেছে ওর জন্যে জামা | নিজের সাথে রং মিলিয়ে নতুন আকাশি শার্ট আর সুতির সাদা কার্গো প্যান্টস | সেগুলোই গলিয়ে, চুল আঁচড়ে আবার সমুদ্রের ধারে ফিরে এল সাগরনীল |
তোয়াকে আজ অপরূপা লাগছে, সাগরনীলের চোখ সরছে না | ও এসে দাঁড়াতেই তোয়া ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো, “হ্যাপি বার্থডে নীল!”
সাগরনীল হাসলো, “থ্যাংক ইউ”, বাকিরাও “হ্যাপি বার্থডে”, “মেনি হ্যাপি রিটার্নস” বললো ওকে | তারপর কিন্তু কেকের কাছে না, তোয়া ওর হাত ধরে সমুদ্রের একদম ধারে নিয়ে গেল, যেখানে ঢেউ এসে ওদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে | বাকিরা দেখতে পাচ্ছে ওদের, তবে সব কথা শুনতে পাচ্ছে না |
বিয়ের কথা সাগরনীলকেই বলতে হবে কে বললো ? তোয়া ওকে বিয়ে করতে চায়, ও কেন জিজ্ঞেস করবে না ? সেই ব্যালকনিতে ওকে আংটি দিয়ে অবাক করে দিয়েছিল সাগরনীল, আজ তোয়ার পালা | আর বিয়ের প্রপোজাল কি আংটি ছাড়া হয় নাকি ?
তাই, সাগরনীলের সামনে জলেই এক হাঁটু মুড়ে বসলো তোয়া | দেখে মনে হচ্ছে যেন সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে কোনো মৎস্যকন্যা, সাগরনীলকে সঙ্গে করে নিজের জলের দেশে নিয়ে যাবে | ওর হাতে একটা সোনার আংটি, কোনো বিশেষত্ব নেই ওতে, কোনো পাথর বসানো নেই, নেই গায়ে কোনো কারুকাজ | শুধু ভেতরে লেখা আছে “তোয়া এন্ড নীল ফরেভার “|
ওর কান্ড দেখে সাগরনীল মিটিমিটি হাসছে, বুঝতে পেরেছে কি হতে চলেছে | ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কি একটু অপ্রস্তুত হতো ? কে জানে ? তবে, সাগরনীলের আত্মবিশ্বাসের কোনো অভাব নেই, এইরকম দেখে সে মোটেও ঘাবড়ালো না | কি প্ৰশ্ন আসছে ও জানে আর তার উত্তর ? সেও জানা | না কোনো দ্বিধা নেই |
তোয়া যেই ওর চোখে চোখ রেখে, ওর একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, “সাগরনীল রায়চৌধুরী উইল ইউ মারি মি ?”
দরাজ হেসে তোয়ার দিকে তাকিয়ে, বললো, “ইয়েস, ডেফিনিটলি !স্বচ্ছতোয়া চ্যাটার্জি |” ওর উত্তর সমুদ্রে ভেসে বেড়ালো, হাওয়ায় উড়ে গেল | সবাই জানলো যেন যে ও স্বচ্ছতোয়ার সাগরনীল |
তোয়া আংটি গলিয়ে দিল ওর আঙুলে, তারপর ওর দুহাত ধরে উঠে দাঁড়ালো | একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো | ওদের পিছনে সূর্য সমুদ্রে ডুব দিল, লাল আভা ছড়িয়ে | যেন ওদের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল | নীলেশ আর শেফালী প্রচুর ছবি তুলেছে ওদের | বাকিদের কাছে ফিরে আসতে আসতে, সাগরনীল চোখ নাচিয়ে, হেসে বললো,”আমি কবে থেকে অপেক্ষা করছি তোয়া!! যাক জিজ্ঞেস করলে তুমি ফাইনালি !!”
তোয়া এই শুনে ওর গাল দুটো ধরে নেড়ে দিয়ে বললো, “অমনি বাজে কথা !”
সৈকতে কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠলো, জন্মদিনের কেক কাটা হলো | জন্মদিনের উপহার ? শংকু সমগ্র, খুব পছন্দ হয়েছে সাগরনীলের | সেরার সেরা জন্মদিন আজ ওর |
তবে ওর থেকেও খুশি হলো মনে হয় নৈঋত, “সাগরমামার বিয়ে” এই বলে সে খুব উৎসাহ দেখালো | সাগরনীল ওর আনন্দে জল ঢেলে গম্ভীর মুখ করে বললো, ” নেচে লাভ নেই রে নৈঋত, আমাদের বাড়িতে থাকলেও তোকে পড়তে হবে | এই তোয়া আন্টিও খুব স্ট্রিক্ট | আমাকেই সারাদিন বকে, তোকেও বকবে |”
এই শুনে নৈঋত দমে গেল, সাগরনীলের কোলে উঠে খুব দুঃখ দুঃখ মুখ করে ওর গলা জড়িয়ে বললো, “এবাবা ! তোমাকে বকে যদি তাহলে ইয়েস বললে কেন ? নো বলতে হতো |”
সবাই তো এই শুনে খুব হাসলো |

রাত প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে |
সমুদ্রের ধারে বসে আছে সাগরনীল, রাতে সমুদ্র জোয়ারের টানে আরও অনেকটা এগিয়ে এসেছে | আজ বিকেলেই তোয়া যেখানে হাঁটু মুড়ে বসেছিল সেখানে এখন অনেক জল | ঢেউ ভাঙছে একের পর এক, আর কোনো আওয়াজ নেই চারপাশে | সুন্দর একটা হাওয়া চলছে |
আজ কিন্তু একা না সাগরনীল | ওর কাঁধে মাথা রেখে, চোখে, ঘুম মেখে বসে আছে তোয়া | “চলো | তোমার ঘুম এসে গেছে”, বলেছে দুতিন বার | তোয়াই বায়না করেছে, “আরেকটু বসি না …” | তাই বসেই আছে ওরা, সাগরনীলের তো ভালোই লাগছে, আজ মন খুব খুশি |
“নীল ..”
“হুঁ ?”
তোয়া একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা আমরা যদি ওই যজ্ঞ, সাতপাক এইসব না করি তোমার আপত্তি আছে ?”
“না | আমি তো শুধু রেজিস্ট্রি করে নেব ভাবছিলাম | তুমি কি ভাবছো ?”
তোয়া ওর আরও কাছে ঘেঁষে এসে বললো,” হ্যাঁ, রেজিস্ট্রি করে একটা পার্টি মতন করা যায় | আমার বাবা, মা তো আসবে মনে হয় না, ওই আমাদের বন্ধু বান্ধব আর তোমার ফ্যামিলি | আর কিছু কাজিন | তুমি কি বোলো ?”
সেদিনের অপমানটা ভোলেনি সাগরনীল, একটু ক্ষুন্ন হয়েই জিজ্ঞেস করলো, “তোমার বাবা, মাকে ডাকবে ?”
তোয়া কিন্তু দৃঢ় ভাবেই বললো,”হ্যাঁ | আমার ডাকা কর্তব্য, আমি ডাকবো | আমি আমার মনের দিক থেকে পরিষ্কার থাকতে চাই | পরে যেন আমার রিগ্রেট না হয় যে আমি আমার বিয়েতে বাবা, মাকে ডাকিনি | বাকি ওদের ব্যাপার | আসলে আসবে, না ইচ্ছে হয় তো আসবে না | আর এসে যদি আর একবারও তোমাকে বাজে কথা বলে আমি আর কোনোদিন ডাকবোও না, কথাও বলবো না | তাতে আমার আর কোনো আফসোস থাকবে না |”
হাসলো সাগরনীল, তোয়ার এইটা খুব ভালো লাগে ওর | ভাবনা, চিন্তা একদম স্বচ্ছ |
বললো, “বেশ তো তাহলে তাই করি আমরা | রেজিস্ট্রি আর পার্টি | আমিও আমার মাকে ডাকবো | না, আসলে আর কি করবো ? আর ফ্যামিলি বলতে আমার পিসি, পিসেমশাই আশা করি আসবেন আর বাকি ওই বন্ধুরা | আর …”
তোয়া ওর দিকে তাকালো, “আর ?”
সাগরনীল ওকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় নিজের মাথা ঠেকিয়ে বললো,”আর তুমি আর আমি | তোয়া এন্ড নীল ফরেভার ব্যাস !”
তারপর ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “জলকন্যে, এইবার চলো ঘরে | এইখানে ঘুমিয়ে পড়লে কেস ! আসল সাগরে নীল, লাল সব ধুয়ে যাবে | ওঠো ওঠো, জল বাড়ছে এখানে তোয়া |”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here