বালিকা বউ 🥰পার্টঃ১৯

0
4204

#বালিকা_বউ 🥰

#পার্টঃ১৯
লেখিকা ঃ মারিয়া

রোশনি খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর আমি কলেজ থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আমি রোশনি সাথে রিত্তিক অমি মিলে বস্তির আশপাশে থাকা অসহায় এতিম বাচ্চাদের অনাথ আশ্রমে রেখে এসেছি। ওদের ভরন পোষনের যাবতীয় খরচের প্রায় ৭০% আমি দিতাম। ওদের মুখের স্নিগ্ধ হাসি দেখলেই মনটা শান্তি পেত। প্রতি সপ্তাহে ওদের সাথে দেখা করা, কেউ অসুস্থ হলে রোশনি নিজে গিয়ে তার যত্ন করতো। মা ও এসব জানার পর তেমন কিছুই বলেনি বরং খুশিই হয়েছে। রোশনি খুব সহজেই বাচ্চাদের সাথে মিশে গিয়েছিল। আর এরপর থেকে ওর মা হবার তীব্র ইচ্ছে হয়। সেটা আমাকেও বলেছে।

দেখতে দেখতে দেড় বছর কেটে গেলো। রোশনির এইচএসসি রেজাল্ট খুবই ভালো হয়েছে। পুরো কলেজের মধ্যে স্ট্যান্ড করেছে। মায়ের সেকি আনন্দ সবাইকে বলছে, মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। আমার খুব প্রাউড ফিল হচ্ছে। আবার একটা বিষয়ে ভীষণ টেনশন হচ্ছে। কারন এই দেড় বছরে অনেকভাবে ট্রাই করেছি কিন্তু রোশনি বেবি কনসিভ করতে পারছে না।

ওকেও বলিনি শুধু শুধু ভয় টেনশন করবে। এতে ওর পড়াশোনার ও ক্ষতি হতে পারে ভেবে চেপে গিয়েছি। কিন্তু ওর রেজাল্ট পাবার পর মা ভীষণ রকম জেদ করছে। এখন তো কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছে। বিকালে ছাদে বসে আছি একা একা। হঠাৎ রোশনি পিছন থেকে হাত দিয়ে বলল
কি লুকাচ্ছো তুমি আমার কাছ থেকে??

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম কই কিছু নাতো।

আমি বেশ বুঝতে পারছি। আচ্ছা আমাদের বেবি হচ্ছে না কেন??

হচ্ছে না কে বলেছে। অবশ্যই হবে।

আমি একজন সাইন্সের স্টুডেন্ট। তাই আমাকে ভুগোল পড়াতে এসো না। চলো আমরা কোনো ডক্টরের সাথে কথা বলি। উনি নিশ্চয় কোনো সমাধান দিতে পারবে।

আমিও তাই ভাবছিলাম। আচ্ছা আগামীকালই যাবো।

রোশনি খুশি হলেও সেভাবে হলো না। জাস্ট মাথা নাড়লো।

রাতে দুজনে শুয়ে আছি। রোশনি বলল আচ্ছা যদি কাল শোনো সমস্যা টা আমার। তাহলে কি আমাকে ছেড়ে যাবে।

আমি কাত হয়ে ওর হাত ধরে বললাম আমার প্রান থাকতে আমি তোমাকে কখনো আলাদা করবো না। আর আমি জানি সমস্যা টা আমার হলেও তুমি কখনো আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে না। এভাবে বুঝিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালাম।

সকালে উঠে দেখি রোশনি রুমে নেই। তার মানে কিচেনে আছে। আমিও ফ্রেশ হয়ে একবারে রেডি হয়ে নিচে নামলাম। নিচে গিয়ে দেখলাম রোশনি আর শ্যামলি মিলে টেবিলে খাবার রাখছে। রোশনিকে বললাম আমার খাবার দাও খুব খুদা লাগছে।
আচ্ছা বসো তুমি।
এর মধ্যে মা ও নিচে নামল। সেই আগের মতই মুখ ভার করে রেখেছে। আমি বললাম আজ আমরা ডক্টরের কাছে যাচ্ছি।
ডক্টরের কাছে গিয়ে আর কি হবে। আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।
মায়ের এমন কথা শুনে খুব কষ্ট লাগলো। রোশনির মুখটাও কালো হয়ে গেলো। আমি আর কিছু না বলে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলাম।
রোশনি কিছু বলবে তার আগেই বললাম আমি গাড়িতে আছি। খেয়ে রেডি হয়ে বাইরে এসো। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলাম।

প্রায় ১০ মিনিট পর রোশনি একটা সাদাকালো শাড়ি পড়ে বাইরে আসলো। মেয়েটার মুখ শুকনো দেখে আমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে মনে বললাম আজ যাই হোক যদি কোনো সমস্যা থাকে সেটা যেন আমারই হয়। নাহলে রোশনি খুব ভেঙে পড়বে ভেতর থেকে। রোশনি সামনে দাড়িয়ে বলল
কি হলো যাবে না??
হু,,হুম। চলো।
তারপর গাড়িতে বসলাম। রোশনিকে জিজ্ঞেস করলাম খেয়েছো তুমি??
নাহ। খাবার গলা দিয়ে নামবে না।

তারপর ক্লিনিকের সামনে গাড়ি ব্রেক করলাম। আগে থেকেই এপোয়েনমেন্ট করা ছিল। তারপর ড. শীলার কাছে সবটা খুলে বললাম। উনি বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন কিছু এর সাথে কানেক্টেড আবার কিছু পারসোনাল। সবকিছু জেনে বলল আপনাদের কিছু টেস্ট করতে হবে।
প্রথমে আমাকে নিয়ে গেলেন। তারপরে রোশনিকে। আর বললেন কাল যে একবার এসে রিপোর্ট জেনে যাই। ওখান থেকে বেরিয়ে রোশনিকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালাম। রোশনি বলল এখানে কেন আবার??
কাজ আছে তাই ভিতরে চলো।
ভিতরে গিয়ে বসে রোশনির সব পছন্দের খাবার অর্ডার দিলাম। বেশ জোর করার পরেই খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে সোজা বাসায় আসলাম।

এসে মাকে কোথাও না দেখতে পেয়ে শ্যামলিকে জিজ্ঞেস করলাম মা কোথায়??
উনি একটু বের হচ্ছিলেন। কিন্তু কোথায় যাবে তা কিছু বলেনি।
তারপর মায়ের ফোনে কয়েকবার ফোন করলাম। কিন্তু রিসিভ করে নি। মায়ের সব রিলেটিভ ফ্রেন্ডস্ দের ফোন করলাম। কিন্তু কারো বাসায় যায়নি৷ এদিকে রোশনি চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ছে। কোনোরকমে ওকে বুঝিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শহরের এদিক ওদিক তন্নতন্ন করে খুজছি আর ফোনে ট্রাই করেই যাচ্ছি।

বিকালে রোশনি ফোন করে বাসায় যেতে বলল মা নাকি বাড়ি ফিরেছে। কথাটা শুনে বুকটা শান্ত হয়ে গেলো। গাড়ি ঘুরিয়ে প্রায় ১ কিমি পথ থেকে বাসায় আসলাম। তারপর সোজা মায়ের রুমে গিয়ে বললাম
কোথায় গিয়েছিলে কাউকে কিছু না বলে??
গিয়েছিলাম মন্দিরে। আর আমি তো ছোট বাচ্চা না যে হারিয়ে যাবো।
এরপর থেকে আর এমন কোরো না মা। তুমি ছাড়া আমাদের কে আছে বলো,, বলে মায়ের কোলে লুটিয়ে পড়লাম।
রাতে রোশনি সব মায়ের পছন্দের খাবার রান্না করেছে। মা টু শব্দ না করে চুপচাপ খাচ্ছে। তারপর বলল ডক্টর কি বললো।
আমি বললাম কাল রিপোর্ট দেবে।
ওও আর আমি মানত রেখেছি। আমার বংশধর এলে আমি হাজার মানুষ খাওয়াবো।
মায়ের এমন আশা দেখে ভালো ও লাগছে আবার ভয়ও করছে। জানিনা কাল কি হবে??

খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে ইশুকে কল করে বললাম মা ফিরে এসেছে। ও ও একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।

সকালে খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম ক্লিনিকের উদ্দেশ্য। হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে আমার। ড. শীলা আমাদের দেখে বললেন আপনারা এসে পড়েছেন। তারপর একটা নার্সকে বলে ওনার কেবিনে নিয়ে গেলেন। আমরা মুখোমুখি হয়ে চেয়ারে বসে আছি। রোশনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। আমিও আরেক হাত ওর হাতের উপরে রেখেছি৷ ড. শীলা খুব সিরিয়াস মুখ করে কিছু রিপোর্ট আর কিছু পেপার দেখে রোশনির দিকে তাকিয়ে বললেন

আপনার কি এর আগে কোনো ক্রিটিকাল অপারেশন হয়েছিল।
রোশনি মাথা নাড়ল।
উনি বললেন কি হয়েছিল??
একজন আমার পেটে ছুড়ি ঢুকিয়ে ছিল।

এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এসব বলে ওকে মনে করানোর কি দরকার। ও বিষয়টা নিয়ে এমনিতেই ভয় পেয়ে থাকে। বেশ উত্তেজিত হয়ে বললাম এগুলো কি বলছেন আপনি।

আহ মিস্টার দেবরায় উত্তেজিত হবেন না। এর সাথে কানেকশন আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি। যে পেটে ছুড়ি ঢুকিয়ে ছিল সে হয়তো ওই প্রথম কাউকে ছুড়ি মেরেছে। তাই অসাবধানতার জন্য ছুড়ির আঘাত ওনার জরায়ুতে লাগে। এতে জরায়ুর লিগামেন্ট গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেজন্য মিসেস দেবরায় কনসিভ করতে পারছেন না।

কথাটা শোনার সাথে আমার মস্তিষ্কে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। আর রোশনি আমার হাত ছেড়ে দিলো। দুজনে একে অপরের দিকে তাকালাম। রোশনি অশ্রুসিক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ডক্টর কে বললাম এর কি কোনো ট্রিটমেন্ট নেই।

দেখুন এগুলো ভীষণ সংবেদনশীল অঙ্গ। ট্রিটমেন্ট হলেও রেজাল্ট কেমন হবে সেটা সিওর বলা যাচ্ছে না। এখন একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই কোনো মিরাক্কেল করতে পারেন। বাচ্চা কনসিভ হবে হয়তো কিন্তু তার জন্য অনেক সময় লাগবে। আমি আপনাদের সিওর কোনো আশা দিতে পারছি না। সরি। বলে উঠে চলে গেলেন।

রোশনি নিশব্দে কেঁদেই চলেছে। ওকে স্বান্তনা দেবার মতও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। বারবার মায়ের কথাগুলো মনে পড়ছে৷ জানিনা বাড়ি গিয়ে মায়ের মুখোমুখি কিভাবে হবো।

তারপর রোশনিকে নিয়ে গাড়িতে বসালাম। রোশনি বলছে আমাকে মায়ের সামনে নিও না প্লিজ। আমি একটা অপয়া। এই অপয়া মুখ দেখাতে চাই না। শুভ্র আমার অস্তিত্বই মুছে দিলো। আমার মা হবার ক্ষমতাই কেঁড়ে নিলো। রোশনির এমন আর্তনাদ আমার আর সহ্য হচ্ছিল না।

বাড়ি পৌঁছে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি মা এদিকেই চেয়ে আছে। হয়তো আমাদের আসার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বলল
ডক্টর কি বলল। সব ঠিক আছে তো।
দুজনেই চুপ করে রইলাম।
কি হলো কিছু তো বল।
শ্যামলি এসে বলল হ্যা দাদাবাবু ডাক্তার আপা কি বললো। বৌদিমনির বাচ্চা হবে তো।
এসব শুনে রোশনি মুখ চেপে দৌড়ে উপরে গেলো।
মা ওর যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল কি হলো কিছু বলছিস না কেন??

আমি নিজেকে সামলে রিপোর্ট গুলো মার সামনে ধরলাম। মা ওগুলো পড়ে একবার আমার দিকে তাকালো আরেকবার রিপোর্টের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে করে সোফার কাছে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো।
আর আমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে বললাম মা এতে রোশনির কোনো দোষ নেই। আসলে,,,

মা হাত উঁচু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল থাক বউয়ের হয়ে আর সাফাই গাইতে হবে না। যার মা হবার ক্ষমতা থাকে না সে আবার কারো বউ হয় কিভাবে বলে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলেন।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ইনি কি আমার মা। শুধুমাত্র বংশ রক্ষার জন্য নিজের মেয়ের থেকে বেশি ভালোবাসে সেই রোশনি বিপক্ষে কথা বলছে।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here