বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ১৯

0
1280

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ১৯

কুমুর শরীরটা ভালো লাগছে না। তাই আজ ভার্সিটি যায় নি। সারা সকাল বিছানায় এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি দিয়েই পার করেছে। ঘড়িতে ১১ টা বাজতেই টনক নড়ল। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। মৌকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। তাই দেরি না করে যেমন ছিলো তেমনি ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে বের হয়ে গেলো। বাসা থেকে স্কুল খুব বেশি দূরে না তাই হাঁটার জন্য মনস্থির করে ফেললো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পরই। অপ্রত্যাশিত ভাবে হিমেলের সাথে দেখা হয়ে গেলো। হিমেলকে দেখা মাত্রই কুমুর বুকের ভেতরে কেপে উঠলো। নিজেকে যথেষ্ট সাভাবিক প্রমাণ করতেই চোখ নামিয়ে জোরে হাটা শুরু করলো। কিন্তু লাভ হলো না। হিমেল সামনে এসে দাড়ালো। ভীষন শান্ত ভাবে বলল
— কোথায় যাচ্ছো?

কুমু কিছুটা বিরক্ত হলো। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— যাচ্ছি কোথাও। আপনাকে কেনো জানতে হবে?

হিমেল অবাক হলো না। মুচকি হেসে বলল
— জানলে কি কোন ক্ষতি হবে? যদি ক্ষতি নাহয় তাহলে তো জানতে বাধা নেই।

কুমু কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সাভাবিক ভাবেই বলল
— মৌকে আনতে যাচ্ছি।

হিমেল মুচকি হেসে বললো
— ওহ! তাহলে তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। মৌ অপেক্ষা করছে নিশ্চয়। চলো তাহলে যাওয়া যাক।

— যাওয়া যাক মানে? আপনি কোথায় যাবেন?

হিমেল ভাবলেশহীন ভাবে বলল
— মৌকে আনতে।

কুমুর চেহারা রক্তিম হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল
— আপনাকে যেতে হবে না। আমি যেতে একাই যেতে পারবো। আর আপনার কি কোন কাজ নেই? এভাবে সময় নষ্ট করছেন কেনো?

হিমেল গম্ভীর কণ্ঠে বলল
— আপাতত আমার কোন কাজ নেই। এই মুহূর্তে তোমাকে সঙ্গ দেয়াটাই বড়ো কাজ। এভাবে কথার পৃষ্টে কথা বলে কিন্তু লাভ নেই। শুধু শুধু সময়টাই নষ্ট হচ্ছে। আমি তো যাবই। তুমি জত দেরি করবে সেটার দায়ভার তোমার।

কুমু কোন কথা বলতে পারলো না। প্রচন্ড রেগে গেলো। বুঝতে পারলো হিমেল কথা শুনবে না। তাই আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। হিমেল মুচকি হেসে তার সাথে চলে গেলো। অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই তারা স্কুলে পৌঁছল। ক্লান্ত মৌ দরজায় দাড়িয়ে এদিক সেদিক দেখছিল অস্থিরভাবে। পরিচিত চেহারা চোখে পড়তেই অভিমানী কণ্ঠে কিছুটা গলা তুলে বলল
— তুমি এত দেরি করলে কেনো আপা? কখন থেকে দাড়ায় আছি।

কুমু হিমেলের দিকে তাকাল। তার জন্য যে দেরি হয়েছে সেটাই বোঝাতে চাইলো। হিমেল বুঝেও না বোঝার ভান করে মৌয়ের হাত ধরে বলল
— আমি তো আগেই আসতে চেয়েছিলাম। অযথা তোমার আপা সময় নষ্ট করেছে। আমার কিন্তু কোন দোষ নেই।

মৌ সরু চোখে তাকাল কুমুর দিকে। কিছু না বলে হিমেলের হাত ধরে বলল
— চলো ভাইয়া।

মৌয়ের এমন আচরনে কুমুর রাগ হলো। সমস্ত রাগ হিমেলের উপরে ঢেলে দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো। হিমেল বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। কিছুদূর হেঁটে যেতেই ক্লান্ত মৌ মুখের ঘাম মুছে বলল
— আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে। আর হাঁটতে পারবো না।

কুমু পলক ফেলে তাকাল। কিছুটা কঠিন গলায় বলল
— এইটুকু হাঁটতেই পা ব্যথা হয়ে গেলো? আর একটু হাঁটলেই চলে যাবো তো।

চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল মৌ। ভ্রু জোড়ায় গভীর ভাঁজ ফেলে কঠিন গলায় বলল
— এইটুকু বলছো? কতদূর হাঁটলাম। পারবনা বলছি মানে আর পারবো না। তুমি বোঝনা কেন আপা?

পিচ্চি মৌয়ের এমন রাগ দেখে দুজনেই বেশ অবাক হলো। হিমেল ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হাত নাড়িয়ে একটা রিক্সা থামিয়ে মৌকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কুমু ভাষা হারিয়ে বোকার মতো চেয়ে থাকলো। অনেকক্ষণ পর মৌ বিরক্ত হয়েই বললো
— আপা উঠে আসো। দেরি হচ্ছে।

কুমু কি করবে বুঝতে না পেরে বলল
— আর একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাবো। রিক্সায় উঠতে হবে না।

হিমেল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— রিক্সায় উঠতে অসুবিধা না আমার সাথে রিক্সায় উঠতে অসুবিধা?

কুমু কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। অগত্যা রিক্সায় উঠে বসলো। বসন্তের সহনীয় রোদ্দুর আর মাতাল করা ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে আসছে বিদেশী সুগন্ধির ঘ্রাণ। মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠতেই আনমনেই বলে উঠলো
— আপনি অযথাই রিক্সাটা নিলেন। আমরা হেঁটে গেলেই পারতাম।

হিমেল সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোলে মৌ বেশ আরাম করে বসেছে। সে সামনে তাকিয়েই বলল
— দুলাভাই হতে চেয়েছি দায়িত্ব নিতে আমি বাধ্য।

কুমু বিস্ময় মাখা দৃষ্টি ফেললো তার দিকে। গাল লজ্জায় ভারী হয়ে আসছে। বাড়ির কাছাকাছি রিক্সা যেতেই সদর দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে সদ্য দাড়িয়ে যাওয়া নিলুর চোখে পড়ে গেলো। বিস্ময়ে অভিভূত নিলুর মুখ হা হয়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে সৌরভকে বলল
— আমাকে একটা চিমটি কাটো তো।

সৌরভ তার দিকে তাকিয়ে আবেগে টলমল হয়ে বলল
— এতো সুন্দর করে তো কখনো আদর করতেও বলোনা জান। আজ যে চিমটি কাটতে বলছো?

নিলু বিস্ময় কাটিয়ে কটমট চোখে তার দিকে তাকাতেই সে অপ্রস্তুত হেসে সামনে তাকাল। সাথে সাথেই আর্তনাদ করে বলে উঠলো
— আমি কি এখনো ঘুমিয়ে আছি নাকি নিলু? সামনের দৃশ্যটা কি সত্যি? সন্যাসব্রত গ্রহণ করতে চাওয়া ছেলেটা তবে কি মেয়ে ঠিক করে ফেললো নিজের জন্য!

নিলু অবাক হয়ে বলল
— এই মেয়েটা ওই দো তলার মেয়েটা না?

সৌরভ ভাল করে খেয়াল করলো। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— হ্যা তো। ওই মেয়েটাই। যাহ ব্যাটা! আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্তু তোমার ধুরন্ধর ভাই আমার কাছে স্বীকার করেনি। কিন্তু দেখো গোপনে প্রেমলীলা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। আজ আমিও দেখে নেবো।

তাদের কথোপকথনের মাঝেই যোগ হলো আরেক ব্যাক্তি। শ্রাবণ তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে দাড়ালো। দুজনকে এভাবে সামনে তাকাতে দেখেই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল
— তোমরা এভাবে কি দেখছো?

সৌরভ এলোমেলো হয়ে বলল
— প্রেমলীলা দেখছি।

সৌরভের কথার অর্থ বুঝতেই তার দৃষ্টি তাক করে সামনে তাকাল। সামনের দৃশ্যটা চোখে পড়তেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সন্দেহটা এবার সত্যি হয়ে গেলো। রিক্সাটা এসে থামলো বাড়ির সামনে। এতক্ষণ হিমেল সেদিকে খেয়াল করেনি। রিক্সা থেকে নামতেই সবাইকে এভাবে তাকায় থাকতে দেখে হিমেল অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কুমু বেখেয়ালি ভাবে তাকাতেই সবার সন্দিহান দৃষ্টি দেখে অবাক হয়ে গেলো। শ্রাবণের চোখে চোখ পড়তেই দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জায় হাত পা অসাড় হয়ে আসতেই মৌয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে ভেতরে ঢুকে গেলো। হিমেল অসহায় হয়ে দাড়িয়ে থাকলো। নিলু আর সৌরভ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও শ্রাবণের অমন সরু চোখের চাহুনি তাকে ভাবিয়ে তুলছে। শ্রাবণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে থমথমে কণ্ঠে বললো
— সৌরভ ভাইয়া তোমার সাথে আমার কথা আছে।

সৌরভ সামনে তাকিয়ে বলল
— বলে ফেল।

শ্রাবণ হিমেলের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর গলায় বলল
— গোপন কথা। এভাবে বলা যাবে না।

হিমেল বুঝতে পেরে অসহায়ের মতো তাকাল শ্রাবণের দিকে। কিন্তু সেই দৃষ্টি তার উপরে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারলো না। সে ঠিক করে ফেলেছে সেদিনের ঘটনা সৌরভকে জানাবেই। হিমেল এর আচরণ তার কাছে মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। হিমেল কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এবার আর কোন রক্ষা নেই। শ্রাবণ যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখন এই খবর তার মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাবেই। তারপর ঠিক কি হতে পারে। সেটা ভেবেই শিউরে উঠলো সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here