বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ২১
প্রকৃতি নিজের খেয়াল খুশি মতো চলে। কখনো বা মাথা পঁচা গরম আবার কখনো বা হিম শীতল হাওয়া। কিছুক্ষণ আগেই গরমের যে তীব্রতা ছিলো তার ছিটেফোঁটাও এখন নেই। হুট করেই কালো মেঘের আড়ালে ডুবে গেলো রোদ্দুর। শুরু হলো বাতাস। শীতলতা ছেয়ে গেল চারিদিকে। হিমেল আকাশের দিকে তাকাল। মনে হয় বৃষ্টি হবে। এতক্ষণ গরমের তেজে শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খুলে রেখেছিল। এখন সেগুলো লাগিয়ে দিলেও খারাপ লাগবে না। অতিষ্ট পরিবেশটা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। এমন একটা পরিবেশ রিক্সায় ঘোরার জন্য উপযোগী। আর সাথে যদি ভালোলাগার মানুষ থাকে তাহলে তো কথাই নাই। বাতাসে কুমুর ওড়না এলোমেলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে। সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যাগটা ধরবে নাকি ওড়না সামলাবে। আবার নিজেকেও ঠিকঠাক বসে থাকতে হচ্ছে। এভাবে একই রিক্সায় হিমেলের সাথে যেতে তার ভারী অসস্তি হচ্ছে তার। কিন্তু কোন উপায় নেই। হিমেল আজ পাগলামির সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে। হাজার বার বুঝিয়েও কোন লাভ হয়নি। সে কুমুর সাথে যাবে তো যাবেই। কে কি ভাবলো তার যায় আসেনা। অদ্ভুত মানুষ! এভাবে জেদ করার কোন কারণ নেই। অথচ হিমেল নাছোড়বান্দা। অবশ্য বাড়ির সামনে থেকে আজ আর রিক্সা নেয়নি। কিছুটা দুর হেঁটে গিয়ে তারপর রিক্সায় উঠেছে। হিমেল এর কোন সমস্যা ছিল না। কুমুর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত। রিক্সায় ওঠার পর কিছুদূর যেতে না যেতেই কুমুর অসস্তি শুরু হয়। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তার সাথে রিক্সায় উঠলেও সেদিন মৌ ছিলো বলেই হয়তো তেমন কিছু মনে হয় নি। কিন্তু আজ ভীষন অসস্তি হচ্ছে। চেষ্টা করছে হিমেলের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসার। কিন্তু খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কুমুর বিষয়টা হিমেল খেয়াল করলো। আড় চোখে একবার তাকিয়ে বলল
— আর একটু হলে তো পড়েই যাবে। ঠিক হয়ে বসো।
মস্তিষ্ক নানা রকম চিন্তায় ব্যস্ত থাকায় কুমু কথাটা ধরতে পারলো না। সেও আড় চোখে তাকাল। মিনমিনে সরে বলল
— কি বললেন?
— বললাম যে এর আগেও আমার সাথে রিক্সায় উঠেছো। কিন্তু আজ এমন আচরণ করছো যেনো আমি অপরিচিত কেউ। আর আমার সাথে রিক্সায় গেলে সাংঘাতিক রকমের দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
হিমেল এর কথা শুনে কুমু থতমত খেয়ে গেল। একে তো তার অসস্তি হচ্ছে আর এই লোকটা তাকে আজ অসস্তির সাগরে ডুবিয়ে মারার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। রিক্সায় উঠলেও পরিস্থিতি তো আর একরকম ছিলো না। আর সে তো ছেলে। মেয়েদের মনের অবস্থা কিভাবে বুঝবে। হিমেল গম্ভীর গলায় বলল
— ঠিক হয়ে বসো। পড়ে যাবে।
কুমু ওড়নাটা টেনে গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলো। ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে স্থির হয়ে বসলো। হিমেল বিরক্ত হলো তার উপরে। সে ঠিক হয়ে বসতে বলেছে মানে এভাবে নয়। তাদের মাঝের জায়গাটায় অনেকটা দূরত্ব। ছোটো বাচ্চা একজন বসতে পারবে অনায়াসে। মেয়েটা কি তার কথা বুঝতে পারে না নাকি ইচ্ছা করে এমন করে। এখন কিভাবে তাকে বোঝাবে সে ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছে। হতাশ শ্বাস ছাড়তেই মেঘের গর্জন শোনা গেলো। হিমেল আকাশের দিকে তাকাল। অবস্থা খুব একটা ভালো না। এখনি বৃষ্টি নামতে পারে। তার ধারণা সত্যি করে দিতেই বুঝি প্রকৃতি প্রস্তুত ছিলো। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নামলো ধরণীতে। কুমু উদাসীন চোখে তাকাল আকাশের দিকে। এখন কি হবে? ভাবতে ভাবতেই হিমেল রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল
— মামা হুড উঠিয়ে দেন। বৃষ্টি পড়ছে।
— না না। হুড উঠাতে হবে না। এভাবেই ঠিক আছে।
কুমু অস্থিরভাবে কথাটা বলতেই হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এমন কথা এই মুহূর্তে সে কোনভাবেই শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। রিক্সাওয়ালা ইতিমধ্যে রিক্সা থামিয়ে অপেক্ষা করছে শেষ পর্যন্ত ঠিক কি সিদ্ধান্ত আসতে পারে সেটা জানার। হিমেল পা থেকে মাথা পর্যন্ত অদ্ভুত ভাবে কুমুকে দেখে নিলো। অসস্তি আরো বেড়ে যেতেই কুমু ওড়নাটা আরো জড়িয়ে নিলো। হিমেল কিছুটা বিরক্তিকর সরে বলল
— এভাবে থাকলে ভিজে যাবে। আর ভেজা কাপড়ে সবাই তাকিয়ে থাকবে। ভালো লাগবে?
কুমু কথাটা বুঝতে পেরেই আর কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না। রিক্সাওয়ালা হুড উঠিয়ে দিয়ে তাদেরকে একটা পলিথিন দিলো কোলের উপরে বিছিয়ে রাখার জন্য। সেটা দিয়ে দুজন নিজেদেরকে বৃষ্টি থেকে আড়াল করে নিতেই যেনো কুমু কেপে উঠলো। এতক্ষণ তো শুধু অসস্তি হচ্ছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত পা কাপছে। হিমেল বিষয়টা কিছুটা সময় নিয়েই খেয়াল করলো। বুঝে যেতেই ভীষন বিরক্ত হলো। কুমুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল
— মেয়েরা কি সবাই এরকম নাকি তুমিই আলাদা? এমন আচরণ করছো যেনো মনে হচ্ছে আমি তোমার সুযোগ নিচ্ছি। তুমি কিন্তু আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছো কুমু। একটু স্থির হও। বিষয়টা আমার জন্য সত্যিই অন্যরকম।
হিমেল এর কথা কুমু বুঝতে পারলেও নিজেকে কিছুতেই স্থির করতে পারলো না। অনেকটা সময় নিয়েও সম্ভব হলো না। বৃষ্টির ছাঁট বাতাসের তোড়ে গায়ে এসে পড়তেই আরেকদফা কেপে উঠলো কুমু। এবার হিমেল বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। এতক্ষণ কুমুকে নিজের মতো সহজ করার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। কুমুর আচরনে এখন তার নিজেরই অসস্তি হচ্ছে। এতক্ষণের রিক্সা ভ্রমণটা কেমন বিরক্তিকর হয়ে উঠলো। হিমেল বিরক্ত হয়ে বলল
— তুমি কোথায় যাবে?
কুমু চমকে উঠলো। হিমেল এর এবার রাগ হলো খুব। চোখ বন্ধ করে নিজের রাগটা দমন করার চেষ্টা করলো। কুমু মিনমিনে কণ্ঠে উত্তর দিলো
— ঐতো সামনের গলিতে।
হিমেল দাতে দাঁত চেপে বলল
— আমি নেমে যাচ্ছি। তুমি যাও।
কুমু অবাক হলো। এতক্ষণের সমস্ত অসস্তি ভাবটা কেটে গেলো নিমেষেই। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। এই অবস্থায় মানুষটা নেমে কোথায় যাবে? বাড়ি থেকেও অনেকটা দূরে চলে এসেছে। এখানে রিক্সা পাওয়া এখন অসম্ভব। হিমেল কাগজটা ভাঁজ করে নিতেই কুমু বলল
— আপনি এখানে কোথায় নেমে যাবেন? রিক্সা পাবেন না তো। আমাকে সামনের গলিতে নামিয়ে দিয়ে এই রিক্সাতেই যেতে পারেন।
হিমেল উত্তর দিলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কুমুর দিকে তাক করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নেমে গেলো। কুমু এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল
— আপনি খামাখা আমার সাথে এলেন। না এলেই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতোনা। এখন এই বৃষ্টিতে বাসায় যাবেন কিভাবে?
হিমেল ততক্ষণে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। কুমু আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল
— আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন। উঠে আসুন। ঠান্ডা লেগে যাবে।
হিমেল শক্ত হয়েই দাড়িয়ে থাকলো। কঠিন গলায় বলল
— আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। তুমি নিজের কথা ভাবো। নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করো। আশেপাশের মানুষের যা হয় হোক। সেটা নিয়ে তোমার ভেবে মাথা ব্যাথা বাড়ানোর কোন দরকার নেই।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই থেমে গেলো হিমেল। কুমু নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই মানুষটা এমন রেগে গেলো কেনো? সে তো কোন উল্টা পাল্টা কথা বলে নি। ভালো কথাই বলেছে। তাহলে এভাবে রেগে যাওয়ার কি আছে। হিমেল এর অমন হিম শীতল দৃষ্টি দেখে বলল
— আমি রাগ করার মতো কিছু বলিনি। আপনি খামাখা আমার উপরে রাগ করছেন। আপনার জন্য চিন্তা হচ্ছে বলেই বললাম। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে বলতাম না।
হিমেল কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে থাকলো। তারপর খুবই শান্ত গলায় বলল
— আমার জন্য এতো চিন্তা হলে এতো কিছু না ভেবে একটা উপকার করো তাহলেই আমি খুশি হবো।
কুমু সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। কৌতূহলী কণ্ঠে বললো
— কি উপকার?
হিমেল হতাশ শ্বাস ছাড়লো। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
— নিজেকে একটু সময় দাও। মনের কথাটা চেপে না রেখে খোলাসা করে বলতে শেখো। আমার জন্য খুব উপকার হয়। এভাবে আর সম্ভব হচ্ছে না কুমু। আমি ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। আর সেটা তোমার চোখেই পড়ছে না। কিভাবে মেনে নেই আমি?
চলবে…