বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ৩১

0
1219

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৩১

গ্রামে ১১ টা মানেই মধ্যরাত। কুকুর গুলোও ক্লান্ত হয়ে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। দূরে শুধু কতগুলো শেয়ালের ডাক কানে আসছে। আশেপাশে ঝি ঝি পোকার তীব্র শব্দে মাথা ঝিমঝিম করছে। সেলিম রুশা আর হিমেল অনেকটা সময় ধরে গল্প করছে। রাতের খাওয়া শেষ করে তারা গ্রামের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে। রুশা সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। রাতে আবার এসব নিয়ে তাকে স্টাডি করতে হবে। প্রতিটা পয়েন্ট মাথায় গেথে নিচ্ছে খুব ভালোভাবে। কোন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বিষয় যেন ছাড়া না পড়ে। কথা বলার এক পর্যায়ে সেলিম বলল
–আপনারা এখন শুয়ে পড়ুন। বাকি কথা কাল হবে।

সেলিম নিচ তলায় যাবে। সেখানেই সে থাকে। আর দো তলায় দুটো ঘর রুশা আর হিমেলকে দেয়া হয়েছে। দো তোলার বারান্দায় একটা ছোট্ট গোল টেবিল রাখা আছে। সেখানে বসেই চলছিলো তাদের আলাপন। রুশা ফোনটা তুলে বলল
–এখানে কি নেটওয়ার্ক নেই?

সেলিম উঠে দাঁড়িয়ে বলল
–আছে। তবে কিছু কিছু অপারেটর এখানে ঝামেলা করে মাঝে মাঝে। একটু অপেক্ষা করলেই পেয়ে যাবেন।

সেলিম যেতে যেতে বলল
–গুড নাইট। সকালে দেখা হচ্ছে।

–আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা হল না যে?

রুশার কথা শুনে সেলিম থেমে গেলো। পেছন ফিরে কিছুটা অসস্তি নিয়ে বলল
–অনেক আগেই ঘুমিয়েছে। সকালে দেখা করিয়ে দেবো।

বলেই চলে গেলো। রুশা কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। হিমেল কাঠের রেলিঙ্গ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। বেশ ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মধ্য আকাশে মস্ত চাঁদটা যেন কারো অপেক্ষায় ক্লান্ত। কাউকে দেখার প্রয়াশে নিরন্তর আলো ছড়িয়ে অপেক্ষা করছে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে জ্বালিয়ে নিলো। এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আবারো আকাশের দিকে তাকাল। শুভ্র মেঘ নীলের মাঝে নকশা একেছে যেন। অপার্থিব এক দৃশ্য। কিন্তু এসব কিছুই তার মনে ঠেকছে না। এক সময় এসব দৃশ্য দেখার জন্য মাঝরাতে সে ছাদে উঠত। চোখ জুড়িয়ে সেসব দৃশ্য দেখত। কিন্তু এখন এসব ফিকে মনে হয়। কিছুই আর আগের মতো মনে ধরেনা। ভেতরে এক রকম শুন্যতা জেঁকে বসেছে। কারো অপেক্ষায় কাতর হয়ে উঠেছে হৃদয়। কাউকে এক পলক দেখার আশায় ভেতরটা কেমন হাঁসফাঁস করে ওঠে। দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। রুশা হিমেলের পাশে রেলিঙ্গে হালকা ভর দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–এই চেয়ারম্যান কে একটু নজরে রাখতে হবে। কিছু কিছু আচরন সন্দিহান।

হিমেল সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে রুশার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–তোমার এই সন্দেহ বাতিক বন্ধ করো। লোকটা ভালো। আমার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি।

রুশা হিমেলের কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল
–আমি ক্রিমিনাল সাইকলজি নিয়ে পড়েছি। মানুষের আচরন দেখেই আন্দাজ করে ফেলতে পারি তার কথার সত্যতা কতটুকু।

হিমেল তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–কি বুঝলে? মিথ্যা কথা বলছে?

–সব কথা মিথ্যা না। তবে কিছু একটা লুকাতে চেষ্টা করছে। যেটা আমাদের কাছ থেকে লুকানোর ব্যাপারে তার মনের কাছ থেকেও ঠিকঠাক সিগনাল পাচ্ছে না। গোছানো কথাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

হিমেল হতাশ গলায় বলল
–তোমার এইসব অদ্ভুত কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

রুশা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। হিমেল একা থাকতে চাওয়া মানেই তার অতীতের স্মৃতি চারন করবে মনে মনে। নিজের কষ্ট কাউকে দেখায় না সে। একা একাই দুঃখ বিলাশ করে। তাকে আর না ঘাটিয়ে রুশা চলে গেলো ঘরে। সে এখন মনোযোগ দিয়ে স্টাডি করবে। কোন একটা ক্লু খুঁজে বের করবে। তারপর সকালে উঠে তার প্রথম কাজ হবে এই চেয়ারম্যান তার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা। হিমেল একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা সিগারেট জ্বালালো। বুকটা ভারী হয়ে আসছে। অনেকদিন গলায় সুর আসেনা। আজ কেন জানি মন খুলে গাইতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখল না। গলায় সেই পুরাতন আঙ্গিকে সুর তুলে ফেললো। গাইল গলা ছেড়ে।

আমার ক্লান্ত মন, ঘর খুজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন।
ঘর ভরা দুপুর, আমার একলা থাকার সুর
রোদ গাইত, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায় কতদুর?
আমার বেসুর গিটার সুর বেঁধেছে
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।
আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে
তোমার হাসি হেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।

গানটা থেমে যেতেই নিচের তলায় কেউ ছুটে বেরল ঘর থেকে। দরজায় দাঁড়াতেই দেখা হল সেলিমের সাথে। অস্থির ভাবে শ্বাস পড়ছে। ঘেমে উঠেছে মুখশ্রী। সেলিম ঘাবড়ে গেলো। বলল
–কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন তো?

রমণীটি শাড়ির আঁচলে নিজের মুখ মুছে হাঁসফাঁস করে উঠে বলল
–কে গান গাইছে?

সেলিম স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–শহর থেকে যারা এসেছেন। ওনারাই উপরে গান বাজনা করছেন। কেন? ডিস্টার্ব হচ্ছে আপনার?

অস্থিরতাটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলো না মেয়েটি। অস্থির শ্বাস ফেলে বলল
–ওনারা কোথা থেকে এসেছেন? ওনাদের পরিচয় কি?

সেলিম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–আপনি নিজেই মেইল করে ডেকেছেন তাদেরকে। আর এখন নাম পরিচয় আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? আপনি জানেন না? কাকে ডেকেছেন? আচ্ছা আদৌ এরা ঠিক মানুষ তো?

মেয়েটি হতবিহবল হয়ে তাকাল। মাথার ভেতরে যন্ত্রণাটা বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল
–আমি তো এন জি ওতে মেইল করেছিলাম। ওনারা কাকে পাঠিয়েছেন আমি নাম ঠিকানা এখনো জানিনা। ওনাদের ফিরতি মেইলটা চেক করা হয়নি। চেক করলেই জানতে পারবো।

–ঠিক আছে। চেক করে সিওর হয়ে নেবেন। আমাকেও জানিয়ে দেবেন। এখন শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে।

মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে গেলো। সেলিমও নিজের ঘরে চলে গেলো। ঘরে গেলেও মেয়েটি স্থির হয়ে থাকতে পারলো না। বুকটা ভারী হয়ে আসছে। চোখ গুলো জ্বালা করছে। কেমন ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে সবকিছু। ঘরে কিছুতেই থাকতে পারলো না। বের হয়ে চলে গেলো দো তলায়। পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এদিক সেদিক তাকাল। কাউকে দেখতে পেলো না। পুরোটা ফাঁকা। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করতেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো পানি। ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই রুশার কানে আওয়াজ আসলো। কান খাড়া করে ফেললো সে। তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কাঁদছে। কিছুটা সময় নিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলল। সামনেই একটা মেয়েকে আকাশের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনেকটা অবাক হল। হা করে থেকেই কেটে গেলো কিছু সময়। কৌতূহল মস্তিস্কে ভিড় করতেই চাপা সরে বলল
–কে?

চমকে তাকাল মেয়েটি। ভয়ে মুখখানা শুকিয়ে গেছে। চোখে পানি চিকচিক করছে। শুকনো ঢোক গিলে চোখের পানিটা মুছে নিতেই রুশা আবারো বলল
–কে আপনি?

–অনামিকা। অনামিকা হাওলাদার।

গলা অস্বাভাবিক কেঁপে উঠলো মেয়েটির। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে গেলো। রুশার জহুরি দৃষ্টির আগে টিকতে না পেরে অনামিকা মৃদু সরে বলল
–আমি আসছি।

রুশা বাধ সাধল। বলল
–আপনিই তো মেইল করেছিলেন? আপনার সাথে একটু পরিচিত হই। ঘরে আসুন।

অনামিকা ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে ঘরে গেলো। রুশা বিছানায় বসতে দিলো। অনামিকার আচরণে অস্থিরতা। রুশা পাশে বসে বলল
–আপনি সেলিম সাহেবের স্ত্রী তাই না?

অনামিকা চমকিত দৃষ্টিতে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–জি।

রুশা দুর্বোধ্য হাসল। তার চোখে মুখে অস্থির রহস্য খেলে গেলো। অনামিকা নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ তুলে তাকাল। বলল
–কে গান গাইছিল?

–আমার হাসবেন্ড। হিমেল। খুব ভালো গান গায়।

ভেতরটা কেঁপে উঠলো অনামিকার। তীব্র ব্যাথায় হৃদপিণ্ডটা ছটফট করে উঠলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘেমে একাকার হতেই রুশা বলল
–আপনার খারাপ লাগছে?

পানির গ্লাস সামনে ধরে বলল
–পানি খান।

চোখের পানি ফেলে মেয়েটি বলল
–আমি নিজের ঘরে যাবো।

বলেই চলে গেলো। রুশা অবাক হল। এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কি হতে পারে? কিছু সময় ভেবে বাঁকা হাসল। তার জহুরির চোখ যে কোন ভুল করেনি। তবে চেয়ারম্যানের রহস্য এতো তাড়াতাড়ি যে খোলাসা হয়ে যাবে সেটা ভাবতে পারেনি। সকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হল না তাকে।

———–
রাতে অনেক দেরিতে ঘুমানোর কারণে রুশার ঘুম ভাংতে দেরি হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই হিমেলকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো সে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য তাকে দেয়ার আছে। কিন্তু কোথাও হিমেলের কোন খবর না পেয়ে ছুটে গেলো বাইরে। এদিক সেদিক ঘুরতে গিয়ে চোখে পড়লো সেলিমকে। গাছের আড়ালে এক মেয়ের সাথে কথা বলছে। অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনকে জহুরি চোখে পরখ করে নিলো। দুজনের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে এতটুকু আন্দাজ করা সম্ভব যে তাদের মাঝে কোন সম্পর্ক আছে। আর মেয়েটা এই গ্রামেরই। সেলিম কথা শেষ করে চলে গেলো সেখান থেকে। রুশা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে ডাকল। পেছন ফিরে রুশাকে দেখে মেয়েটি বেশ অবাক হল। বুঝে গেলো চেয়ারম্যান বাড়ির অতিথি। এগিয়ে এসে রুশাকে সালাম দিলো। রুশা সালামের জবাব দিয়ে বলল
–তোমার নাম কি?

–ঝুম।

–বাহ! তোমার বাড়ি কোথায়?

–অইহানে।

আঙ্গুল তাক করে দেখায়ে দিলো ঝুম। রুশা আঙ্গুল তাক করে দেখে নিয়ে ঝুম কে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলল
–সেলিম সাহেবের স্ত্রীকে দেখেছো? ওনাকে খুঁজে পাচ্ছি না। একটু দরকার ছিল।

ঝুম হা করে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বলল
–কি কইতাছেন আপনে? হের তো বিয়াই হয়নি। বউ আসবো কেমনে?

রুশার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি। তার আন্দাজ মতো সমস্ত সমীকরণ মিলে গেলো। তবুও বলল
–বিয়ে হয়নি ওনার? কিন্তু…

ঝুম সম্পূর্ণ কথা শুনল না। তার আগেই গলার চেনটা তুলে ধরে বলল
–এইডা দেখেন। হের লগে আমার বিয়া ঠিক হইয়া আছে। রশিদ কাকা সারলেই আমাগো বিয়া।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here