বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ৩২.২

0
1171

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৩২ (বর্ধিতাংশ)

ভয়ংকর বজ্রপাতের শব্দে কেপে উঠলো ধরণী। আলো অন্ধকারের খেলা চলছে অবিন্যস্ত। অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে কুমু। বুকের ভেতরে তীব্র কাপন শুরু হয়েছে। হৃদপিন্ডটা বের হয়ে আসার উপক্রম। নিশ্বাস পড়ছে অস্থির ভাবে। শরীরটা হালকা লাগছে। অসাড় হয়ে আসছে হাত পা। হিমেল সামনে এসে দাড়াতেই আবারও তীব্র শব্দে কেপে উঠলো চারপাশ। এবার ভীষন শব্দ আর এলোমেলো অনুভূতির আঘাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো কুমু। ঢলে পড়ে যেতেই ধরে ফেললো হিমেল। দুর্বল চোখে তাকাল। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে ভীষন রকম। প্রচন্ড ভয়ে হিমেলের ভেতরটা ধক করে উঠলো। গালে হালকা আঘাত করে ডেকে উঠলো
— কুমু? এই কুমু? কি হয়েছে?

উত্তর দিতে পারলো না কুমু। এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটার মুখে নিজের নামটা শুনে ভেতরটা আরো অস্থির হয়ে উঠলো। হিমেল তার শারীরিক অবস্থা অস্থিতিশীল বুঝে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে গেলো। বিছানায় শুয়ে দিতেই কুমু ক্লান্ত চোখ জোড়া মেললো। হিমেল আলতো করে গালে হাত রেখে বলল
— পানি খাবে?

এবারও উত্তর দিতে পারলো না কুমু। হিমেল তার উত্তরের অপেক্ষাও করলো না। পানি এনে মাথাটা তুলে ধরে একটু খাইয়ে দিলো। পানি খেয়েই আবার শরীর ছেড়ে দিলো কুমু। এবার আর শুয়ে দিলো না হিমেল। বুকে জড়িয়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে বলল
— আমি তোমার কাছেই আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একদম ভয় পাবে না।

দুর্বলতার কারণে কোন কথা বলতে না পেরে কুমু আরো অস্থির হয়ে উঠলো। নিজেকে এই মুহূর্তে অসহায় লাগছে তার। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। হিমেল আরো শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল
— একদম কাদবে না। শান্ত হও।

কুমু থামলো না। কেঁদেই যাচ্ছে। হিমেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— তোমার সাথে ঠিক কি হয়েছে আমি এখনো জানিনা। যতটুকু শুনেছি তুমি এই বাড়িতে যখন এসেছো তখন তোমার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। এখন তুমি ঠিক আছো এটাই অনেক। আমি কিছু জানতে চাইনা। শুধু জানি এই ৪ মাস আমি তোমাকে পাগলের মতো খুঁজেছি। শুভ্রার কাছে শুনেছি তোমার নানা মারা গেছিল। তুমি গ্রামের বাড়িতে গেছো। তারপর আমি বিদেশে যাই ১ মাসের জন্য। ১ মাস পর ফিরে এসে শুনি তোমার চাচা এসে বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কারণটা কেউ জানে না। আমি অপেক্ষা করেছিলাম কুমু। ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ফোন দেবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। নিরাশ হয়ে শুভ্রার কাছে তোমার যত সম্ভাব্য ঠিকানা ছিলো সেগুলো নিয়ে খোঁজ করেছি। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। হতাশ হয়েছি। কষ্ট পেয়েছি। শেষ পর্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছিলাম আমি। তোমাকে প্রয়োজন ছিলো। খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো।

কথা শেষ করে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কুমু তখনো ফুপিয়ে কাদঁছে। হিমেল পেছনে মাথা এলিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল
— ঘুমাও কুমু। তুমি অনেক দুর্বল। সুস্থ হয়ে নাও তারপর আমরা কথা বলবো।

কুমুকে বুকে জড়িয়ে নিয়েই হিমেল পেছনে মাথা এলিয়ে দিলো। কুমুও আস্টে পৃষ্টে জড়িয়ে রইলো হিমেলের সাথে। এতো কিছু সহ্য করার পর এই প্রশান্তির প্রয়োজন ছিলো খুব করে। সমস্ত সংকোচ কাটিয়ে উঠে আজ সে হিমেলকে অনুভব করছে আলাদা ভাবে। এতদিন নিজেকে ভীষন অসহায় মনে হয়েছে কুমুর। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে পরিপূর্ণ। সস্তির নিশ্বাস ফেলে বাচ্চাদের মতো বুকের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ল কুমু। বাইরে বজ্রপাতের আওয়াজটা আরো বাড়লো। বাড়লো বৃষ্টির বেগ। অকারণে শুরু হলো এলোমেলো বাতাস। সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড হওয়ার উপক্রম। কিন্তু ঘরের ভেতরে প্রশান্তির আমেজ। বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া কোন প্রশান্তি ফিরে পাওয়ার সস্তি। হিমেল তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো। এই হাসি তার একাকীত্বের নিঃশেষ হওয়ার প্রমাণ।

———-
রাতভর বর্ষণের পর মিষ্টি রোদ্দুরের ছোঁয়ায় দিনের শুরু। চোখ মেলে নিজেকে এক ঘরে সম্পূর্ণ একা আবিষ্কার করলো কুমু। উঠে বসে চারিদিকে তাকাতেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। ভয়ে সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো এক রাতেই। যে ভয়ে এতদিন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল লোকচক্ষুর আড়ালে সেই ভয়েই নিজেকে প্রকাশ করে ফেললো? তাও আবার এমন একটা মানুষের সামনে যার কাছে সে সবথেকে দুর্বল। নিজের প্রতি করুণা জন্মালো কুমুর। কি করে পারলো আরেকজনের স্বামীকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভরসা করতে। কি করে মানুষটাকে নিজের প্রশান্তির প্রয়োজন ভেবে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেললো। হতাশ নিশ্বাস ছাড়তেই দরজায় শব্দ হলো। কুমু সচেতন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাল। হিমেলকে দেখেই নিজেকে গুটিয়ে নিল মানসিক ভাবে। কাপড় ঠিক করে ফেললো তৎক্ষণাৎ। হিমেল শীতল দৃষ্টিতে কুমুর দিকে তাকালো। এগিয়ে এসে কিছুটা দূরত্ব রেখে বিছানায় বসে নরম কণ্ঠে বলল
— এখন কেমন লাগছে?

কুমু এক প্রকার ছুটে বিছানা থেকে নেমে গেলো। অস্থির হয়ে কয়েকবার নিশ্বাস ফেলে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল
— আমি আমার ঘরে যাবো।

হিমেল অবাক হলো। কাল রাতেই তো সবকিছু ঠিক ছিলো। সকালে উঠেই সব এমন করে কেনো বদলে গেলো। হিমেল চুপচাপ তার আচরণ দেখছে। কুমু দ্বিতীয়বার কোন কথা না বলেই ঘর থেকে বের হতে দরজার কাছে গেলো। কিন্তু হিমেল তার হাত টেনে ধরলো। আরেক হাতে দরজা লক্ করে কুমুর দিকে তাকাল। ভয়ে শিউরে উঠলো কুমু। ঘেমে গেলো। কাপা কাপা গলায় বলল
— আমাকে যেতে দিন। কেনো এমন করছেন?

হিমেল ততক্ষণে কুমুর হাত ছেড়ে দিয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। কুমু পেছাতে পেছাতে দেয়ালের সাথে মিশে গেলো। হিমেল দূরত্বটা মিটিয়ে দাড়ালো। দুই পাশে হাত রেখে অনেকটা ঝুঁকে গেলো কুমুর দিকে। হিমেল এর উষ্ণ নিশ্বাস কুমুর মুখে আছড়ে পড়ছে। শরীর শিরশির করে উঠছে। নিজের অবাধ্য অনুভূতি গুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তেই হিমেল বলল
— ব্যাক্তিগত হিসেব আছে তোমার সাথে। সেগুলো মিটিয়ে নেই। তারপর যেখানে সখ সেখানে যাবে। আমি আটকাবো না।

হিমেল এর গা ছাড়া কথার ভাবটা কুমুর পূর্বের আত্মবিশ্বাস ফিরে নিয়ে এলো। ঠিক আগের মতো রূপ ধরে ফেললো মুহূর্তেই। কণ্ঠে সেই আগের জেদ নিয়ে বলল
— আমি আপনার কথা মানতে বাধ্য নয়। আমাকে ছেড়ে দিন।

— ধরে রেখেছি যে ছেড়ে দেবো?

কুমু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সত্যিই তো হিমেল ধরে রাখে নি। ছেড়ে দেয়ার কথাটা ভুল ছিলো। অন্যভাবে বলতে হতো। তাই নিজের কথা পরিবর্তন করে বলল
— সরে দাঁড়ান।

হিমেল এর ঠোটের সূক্ষ্ম হাসিটা মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর থমথমে একটা ভাব চেহারায় ফুটে উঠল। সেরকম ভাবেই বলল
— আমি কখনো অধিকার দেখাইনি। কারণ সেটা তোমার পছন্দ ছিলো না। কিন্তু যদি নিজের কোন অপছন্দনীয় কাজ করতে আমাকে দেখতে না চাও তো চুপচাপ আমার কথা শুনে সেটার ঠিক জবাব দেবে। আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না। আর যদি এর বিপরীত কিছু হয় তাহলে কিন্তু তোমার বিপদ। কারণ আমি এখন ঠিক ভুল কোনটাই ভাবার মতো অবস্থায় নাই। আর যদি এটা ভাবো যে আমি কিছুই করতে পারবো না তাহলে এটাই বলবো আমাকে এখনো চিনে উঠতে পারো নি। আমি এই মুহূর্তে তোমার সাথে অনেক কিছুই করতে পারি। যা তোমার ধারণার বাইরে।

হিমেল থেমে যেতেই কুমু অবাক হয়ে তাকাল। এরকম কথা হিমেলের মুখে আগে কখনো সে শোনেনি। তাই বিশ্বাস করতে কিছুটা কষ্ট হয়ে গেলো। তীব্র রাগ নিয়ে বলল
— লজ্জা করেনা আপনার। বিবাহিত হয়ে আরেকজনের সাথে ঘরের মধ্যে এভাবে নোংরা কথা বলছেন।

হিমেল এর কঠিন দৃষ্টি শীতল হয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
— আচ্ছা? এই লজ্জাটা কাল রাতে কোথায় ছিলো? বুকের মধ্যে সারারাত ঘুমানোর সময় মনে ছিলোনা যে একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে এরকম আচরণ শোভনীয় নয়। নাকি তখন লজ্জাটা বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলে। এখন বৃষ্টি শেষে আবার এসে পড়েছে।

কুমু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। হিমেল এর কথার জবাবে কি বলা উচিত বুঝতে পারলো না। কিছুটা থেমে থেমে বলল
— আপনার বউ জানতে পারলে ভুল বুঝবে।

— চান্স নেই। কারণ আমার বউ এখন তোমার বরের কাছে।

চোখ বড় বড় করে তাকাল কুমু। কথাটা ধরতে না পেরে বলল
— মানে?

হিমেল হেসে ফেললো। কুমুর অবাক দৃষ্টি দেখে বলল
— তুমি এতদিন যেমন ওই সেলিমের বিয়ে না হওয়া স্ত্রী ছিলে রুশাও আমার তেমনি বিয়ে না হওয়া বউ।

আরেকদফা অবাক হলো কুমু। ঘটনার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। মাথাটা ঘুরে উঠছে তার। এলোমেলো চিন্তা গুলোকে এক পাশে রেখে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
— আমি কিছু বুঝতে…

কথাটা শেষ করতে পারলো না। হিমেল এক আঙ্গুল ঠোঁটে রেখে থামিয়ে দিলো। কয়েক ইঞ্চি দূরত্বটা আর একটু ঘুচিয়ে নিলো। নাকটা কুমুর নাক একদম ছুঁইছুঁই অবস্থায়। কিন্তু ছুঁয়ে দিচ্ছে না। চোখের দিকে তাকিয়ে মাদক কণ্ঠে বলল
— অধিকার চাই আমার। আজই। এই মুহূর্তে।

কুমুর মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। সব কেমন গুলিয়ে গেলো। হিমেল এর এতটা কাছে আশায় আবারও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। অনুভূতি গুলো বাঁধন ছাড়া হয়ে ছুটতে লাগলো। কুমুর তির্যক প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি দেখে হিমেল বলল
— আর সম্ভব নয় তোমাকে ছাড়া থাকা। এই মুহুর্তেই প্রয়োজন তোমাকে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত একজন হিসেবে। বিয়ে করছি তোমাকে। আজ। এখনই।

সরে দাঁড়ালো হিমেল। দরজার লকটা খুলতেই কুমু পেছন থেকে বলে উঠলো
— আমার কিছু বলার আছে আপনাকে। দয়া করে সেটা শুনে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন আমাকে বিয়ে করবেন কি না।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here