বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ৩৩

0
1234

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৩৩

কুমুর তীক্ষ্ণ মেয়েলী আওয়াজটা কানে আসতেই হিমেল থেমে গেলো। ঘুরে তাকাল। চোখ জোড়ায় রাজ্যের ক্লান্তি। মেলে থাকতে হয়তো কষ্ট হচ্ছে। একটা নির্ঘুম রাত্রি পার করার ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। দরজাটা আবারো লক করে দিয়ে কুমুর সামনে এসে দাঁড়ালো। লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত গলায় বলল
–তুমি হয়তো আমার কথা ঠিকভাবে শোন নি। সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি। যা পরিবর্তন যোগ্য নয়। এই বিষয়ে কিছু বলতে চাইলে সেটা আমি শুনতে চাই না। তাছাড়া বাকি সবকিছু আমিও জানতে চাই। ইনফ্যাক্ট আমার জানার অধিকার আছে।

কুমুর দৃষ্টি অসহায় হয়ে উঠলো। তোলপাড় শুরু হল ভেতরে। সমস্ত গোছানো কথা ভেস্তে গেলো। কুমু বরাবর হিমেলের এই গভীর দৃষ্টি ভয় পায়। কিন্তু আজ ভয়টা অন্যরকম। ধরা পড়ে যাবার ভয়। যে ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা জায়গায় সেই ভয়টা সত্যি হয়ে গেলো? হাত পা কাঁপছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না কিছুতেই। হিমেল শীতল কণ্ঠে বলল
–বলো।

কুমু চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলল
–আমি বিয়ে করতে পারবো না। এই বিষয়টা এখান থেকেই শেষ হয়ে যাক এটাই ভালো হবে। আপনাকে বিয়ে করে সারাজীবন নিজের মাঝে অপরাধ বোধ বয়ে বেড়ানোর দুঃসাহস আমার নেই। আমার ভয়ংকর অতীত আপনার ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে যথেষ্ট।

কথা শেষ করেই হিমেলকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো কুমু। পেছন থেকে শীতল কণ্ঠে ডাকল হিমেল
–দাঁড়াও কুমু। আমার কথা শেষ হয়নি।

পা গুলো আপনা আপনি থেমে গেলো কুমুর। নিজের সম্পূর্ণ অবাধ্য ইচ্ছা গুলোকে এতক্ষন নিয়ন্ত্রণে রাখলেও এখন আর সম্ভব হল না। সেগুলো বাধন হারা হয়ে গেলো। এখানে দাঁড়ানোর কথাও ছিল না তার। চলে যাওয়ার জন্যই পা বাড়িয়েছিল। কিন্তু সেই শীতল কণ্ঠস্বরের কাছে হার মেনে দমে গেলো আরও একবার। নিজের সমস্ত আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে গুড়িয়ে নিস্তেজ হল যেন। কোনভাবেই ছুটে যেতে পারলো না সেই কণ্ঠস্বর উপেক্ষা করে। হৃদয় ভাঙ্গা হাহাকার ছড়িয়ে গেলো বাতাসে। হিমেল পাশে এসে দাঁড়িয়ে নীরবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখল। তারপর কঠিন গলায় বলল
–আমি আগেই বলেছি এই কথা ছাড়া আর সব কথা তোমার শুনবো। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমি এই বিষয়ে তোমার জন্য কোন অপশন রাখিনি। সেখানে তোমার কোন কথাই আমার উপরে প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে আমি জানতে চাই তুমি এতদিন কোথায় ছিলে। এখানে কিভাবে আসলে। সবকিছু।

কুমু কোন উত্তর না দিয়ে নিচের দিকে তাকাল। হিমেল তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখের দিকে শীতল দৃষ্টি স্থির করতেই কুমুর চোখ ভরে উঠলো। অশ্রুবিন্দু বাধ ভাঙ্গার আগেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। কিন্তু আটকাতে পারলো না। হিমেল শান্ত কণ্ঠে বলল
–৪ মাস আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুজেছি কোন ধারনা আছে তোমার? তোমার যত ঠিকানা আমার পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব ছিল সবটাই করেছি। সব জায়গায় নিজের মতো খুজেছি। আর তুমি এই জায়গায় পড়ে আছো অন্যের স্ত্রী পরিচয়ে। কেন কুমু? কি এমন হয়েছিলো?

হিমেলের শেষের কথাটা অন্যরকম ছিল। কিছুটা সন্দিহান। সেটাই কুমুর আত্মবিশ্বাস পুনরায় ফিরে আনার জন্য যথেষ্ট ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল
–কেন খুজেছেন আমাকে? আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানেই থাকি তাতে আপনার কি? আমার জীবন আমার ইচ্ছা। আমি যা ইচ্ছা করবো। তাতে কেউ নাক গলাক সেটা আমার একদম পছন্দ নয়। আপনি কোন অধিকারে আমাকে খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন?

কুমুর কথাটা বলতে দেরি হল কিন্তু হিমেলের তার গালে থাপ্পড় দিতে দেরি হলনা। এমন আচরণে কুমু হতবাক হয়ে তাকাল। অজস্র প্রশ্নের সমাহার তার দৃষ্টিতে। হিমেল শান্ত কণ্ঠে বলল
–যে অধিকার থেকে তুমি আমাকে স্পর্শ করেছো ঠিক সেই অধিকার থেকেই আমি তোমাকে থাপ্পড় মারলাম। এখন নিশ্চয় জানতে চাইবে না অধিকারটা কোথায় পেয়েছি। কারণ আমি জানি উত্তর টা তোমার নিজের কাছেই নেই।

নিস্তব্ধ হয়ে গেলো পরিবেশটা। কুমুর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো পানি। সে হিমেলের দিকে তাকিয়েই আছে। হিমেলের মুখে অধিকার কথাটা শুনে ভেতরটা কেমন হাঁসফাঁস করে উঠলো। এই কয়েক ইঞ্চি দূরত্বটা আর সহ্য হচ্ছে না যেন। হিমেল এক আঙ্গুলে কুমুর চোখের পানি মুছে ফেলে বলল
–কোথায় ছিলে কুমু?

কুমুর দম যেন দম বন্ধ হয়ে এলো। সেই আগের মতো করেই হিমেল ডাকছে। সে কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছে না। সুপ্ত অনুভূতি গুলো সজাগ হয়ে উঠতেই কুমু নিঃসংকোচে আঁচড়ে পড়লো হিমেলের বুকে। জাপটে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো। হিমেল কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো। পরক্ষনেই ভীষণ আদরে কুমুকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। আদর পেয়ে কুমু আরও অস্থির হয়ে উঠলো। নিজের সমস্ত আবেগ বেসামাল হয়ে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে পুরো শরীর ছেড়ে দিলো। হিমেল কুমুকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো
–কি এমন হয়েছিলো কুমু? আমাকে সবটা খুলে বলো।

কুমু কাঁদতে কাঁদতে হাপিয়ে উঠেছে। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলো। তারপর বলতে শুরু করলো
–নানা মারা যাওয়ার পর আমরা সেখানে ৪ দিন থাকি। তারপর বাবা বলল গ্রামে যখন চলে এসেছি তখন একবার দাদু বাড়ি থেকে ঘুরে তারপর যেতে। আমরা দাদু বাড়িতে যাই তার পরেরদিন। সেখানেও কয়েকদিন থাকি। তারপর বাবা সিদ্ধান্ত নেয় শহরে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু আগেরদিন রাতে জমি নিয়ে বড় চাচার সাথে কিছু কথা কাটাকাটি হয়। বেশ ভালো রকমের। সেই ঘটনার পর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি আমরা। কিন্তু মাঝরাতে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্রামে মধ্যরাতে ডাক্তারের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হওয়ায় বাবা…

ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো কুমু। কথাগুলো গলায় আটকে রইল। হিমেল কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–আঙ্কেলের কি হয়েছে?

কুমু চোখ তুলে তাকাল। বলল
–বাবা নেই। সেই রাতেই মারা গেছে।

হিমেল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কুমু ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। হিমেল কিছুক্ষন সময় নিয়ে বলল
–তারপর কি হয়েছিলো কুমু?

কুমু বড় শ্বাস টেনে আবার বলতে শুরু করলো।
–বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা অথই সাগরে পড়ে গেলাম। দোকান এখন কে চালাবে? শহরে থেকে তিনজনের পড়াশোনা করানোর মতো অবস্থা তখন ছিল না। চাচার কাছে মা জমিজমার ব্যপারে সব জানতে চাইলেন। যদি এতে কোনভাবে চালানো যায়। কারণ রাফি আর মৌয়ের তো ভবিষ্যৎ আছে। ওরা তো এখনো ছোট। কিন্তু কোনভাবেই কিছুই সম্ভব হল না। চাচা সিদ্ধান্ত নিলেন বাসা ছেড়ে দিয়ে আমরা দুই ভাইবোন মেসে থেকে পড়াশোনা শেষ করবো। আর মৌ গ্রামের একটা স্কুলে ভর্তি হবে। সবই চলছিলো পরিকল্পনা মতো। কিন্তু তারপরেই ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। একদিন রাতে বাড়িতে ডাকাত পড়লো। সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে যায়। তারা সবকিছু নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমি একজনকে দেখে ফেলি। আর ওরা সেটা বুঝে যায়। আমাকে রেখে গেলে আমি পুলিশকে তাদের কথা জানিয়ে দিতে পারি তাই তারা আমাকে তুলে নিয়ে আসলো।

হিমেল চোখ বন্ধ করে ফেললো। এতো কিছু হয়ে গেছে কুমুর সাথে অথচ সে কিছুই জানে না। মেয়েটা এতো কিছু সহ্য করেছে। কতোটা কষ্ট পেয়েছে। হিমেল কুমুকে বুকে আগলে নিলো যত্ন করে। আদুরে কণ্ঠে বলল
–তুমি এখানে কিভাবে এলে কুমু?

কুমু ফুপিয়ে উঠে বলল
–ওনারা আমাকে নিয়ে আসার পর পুরো একটা রাত তাদের কাছে রাখে। আমার ওপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। আর পরের দিন তারা আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়না। কারণ আমি কোন রকমে পালিয়ে আসি। তখনও জানতাম না কোথায় এসেছি। এই বাড়িতে এসে সেলিম সাহেবের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়ে যায়। উনি আমাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলে আমি সবটা বলে দেই। কারণ আমার ভরসা করার আর কোন জায়গা ছিল না ঐ মুহূর্তে। আমার আশ্রয় দরকার ছিল। উনি সব শুনে আমাকে সবার কাছ থেকে আড়ালে থাকতে বলেন। আর উনি সেই ডাকাতদের খুঁজে বের করে পুলিশে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে আমাকে সান্ত্বনা দেন। আমিও বিশ্বাস করে এখানে থেকে যাই। আমার আর কোন যাওয়ার জায়গা ছিল না। তাই এখানে থাকতে আমাকে বাধ্য হতে হয়। গ্রামে একটা মেয়েকে এভাবে বাড়িতে আশ্রয় দিলে মানুষ নানা রকম কথা বলবে। আর উনি এই গ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে ওনাদের যথেষ্ট সম্মান আছে। তাই উনি আমাকে বলে দেন অপরিচিত কারো সামনে ওনার স্ত্রী বলে নিজেকে পরিচয় দিতে।

হিমেল শান্তভাবে সবটা শুনে কুমুর চোখের পানি মুছে দিলো। আদুরে কণ্ঠে বলল
–এটাই বলবো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার আফসোস থাকবে তোমার প্রয়োজনের সময় আমি তোমার পাশে থাকতে পারিনি। আমি দুঃখিত কুমু। সত্যিই দুঃখিত। এই আফসোসটা আমাকে সারাজীবন আঘাত করবে। তাই আমি আর তোমাকে নিয়ে কোন আফসোস রাখতে চাইনা।

হিমেলের কথা শুনে কুমুর কান্না গুলো গলায় দলা পেকে গেলো। ফুপিয়ে উঠে বলল
–আমি যে এই বাড়িতে আসার আগে পুরো একদিন ওদের কাছে ছিলাম। জানতে চাইবেন না এই একদিনে কি হয়েছে আমার সাথে? আমি যে…

হিমেল তাকে কথা শেষ করতে দিলো না। মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে বলল
–আমি কিছুই শুনতে চাই না। তোমার কোন কিছু নিয়েই আমার কোন আক্ষেপ নেই কুমু। একটা দোয়াই থাকবে শুধু। এই জীবনে তোমাকে পাওয়াই আমার জন্য যথেষ্ট হোক।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here