বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ৪

0
1642

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৪

নীলাম্বরে রঙ ধরেছে। গাড় কমলা রঙ। পশ্চিম দিগন্তে তেজ হীন ডুবু ডুবু সূর্যটা রাত নামার পূর্বাভাস। পশ্চিমের জানালায় ক্লান্ত চোখ মেলে লালচে রঙের ডুবন্ত সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছে কুমু। উদাসীন ভাবটা চেহারায় বেশ জোরালো ভাবে ফুটেছে। সেই বাড়ি ফিরে এই টেবিলে বসেছে আর ওঠেনি। স্থির দৃষ্টি তার জানালার বাইরে বিদ্যমান। চঞ্চল মন উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশের পানে। দিগন্ত পেরিয়ে। এতো কিছুর মাঝেও কোথায় যেন একটা কমতি মনে হচ্ছে। বারবার পিছুটান তার মনে ঝেঁকে বসছে। সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। হতাশ শ্বাস ছেড়ে টেবিলে পড়ে থাকা ডাইরিটার দিকে তাকাল। সাদা পাতাটা এখনো ফাঁকা। অনেক কিছুই লেখার আছে। কিন্তু শুরুটা করে উঠতে পারছে না। আজ বড্ড অগোছালো লাগছে নিজেকে। অনেক ভেবেও কারণ খুঁজে পেলো না। হিমেলের সাথে কথোপকথনের দৃশ্যটা মস্তিস্কে ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। তারপর থেকেই ভেতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। হিমেল যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আরও কিছু বলতে চায় কিনা সেই সময় কিছুই বলতে না পারার আক্ষেপটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। এই নিয়ে মানুষটার সাথে তার দ্বিতীয়বার দেখা। আর দুই বারেই অকল্পনীয় ব্যক্তিত্তের পরিচয় পেয়েছে সে। যা তাকে ঐ মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষকে নিয়ে এভাবে ভাবার বিষয়টা কুমুর কাছে বেশ অস্বাভাবিক ঠেকলেও সেটা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না। বারবার সেই অচেনা মানুষটাকেই দেখার প্রবল ইচ্ছা জেগে উঠছে। নিজেকে সামলান কঠিন হয়ে পড়ছে কুমুর জন্য। মন খারাপ নিয়েই লিখতে বসলো ডাইরিতে।

বগাব্দ ১৪২৮, ২০ শে ফাল্গুন

“কাউকে একবার দেখার আকুলতায় ভীষণভাবে জগতের সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করছে আজ। অচেনা মানুষটাকে দেখার তৃষ্ণায় এই মন আজ কাতর হয়ে উঠেছে। আর যদি কখনো সেই মানুষটার সাথে দেখা নাহয় সেটা ভাবতেই ভেতরটা কেমন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে আমি জানি না। তাহলে কি আমি প্রেমে পড়েছি? নাহ! এ তো প্রেম নয়। প্রেমে পড়তে এখনো ঢের বাকি। এ তো কেবল ভাললাগার শুরু। ভাললাগা থেকে ভালোবাসা হলেও দুটোর অনুভূতি একদম আলাদা। প্রথমটার অনুভূতি একদম সাধারণ। আর দ্বিতীয়টার বিশেষ। তবে এই সাধারণ অনুভূতি যে বিশেষে পরিণত হবে বা হবেই না এর কোনটাই আমি বলবো না। কারণ এই অজানা অচেনা অনুভূতি কখন, কোথায়, কিভাবে আসে কেউ জানে না।“

————–
–তুই নাকি প্রেম করছিস?

চায়ে ডুবানো বিস্কুটটা উপরে তুলতেই সেটা আবার চায়ের মধ্যে গলে পড়ে গেলো। শ্রাবণ শুকনো ঢোক গিলে হাতে ধরে থাকা সেই চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। হতাশ দৃষ্টি তার। বিস্কিট চায়ে পড়ে যাওয়ায় হতাশ নাকি সদ্য বলা কথার প্রভাব বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রাবণকে উদ্দেশ্যে করে সৌরভের বলা কথাটা কানে আসতেই হিমেল সচকিত দৃষ্টিতে একবার সৌরভের দিকে আবার শ্রাবণের দিকে তাকাল। দুজনেই তার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। শ্রাবণ পরিস্থিতির ভয়াবহতা আন্দাজ করেই অপ্রস্তুত হেসে বলল
–মা মনে হয় ডাকছে।

উঠতেই সৌরভ হাত ধরে ফেললো। গম্ভীর আওয়াজে বলল
–তোকে কেউ ডাকে নি। আর ডাকার সম্ভাবনা নেই। কারণ এই মুহূর্তে বাড়িতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই বাইরে।

শ্রাবণ কিছুটা সস্তি পেলো। কারণ তার মা যদি বাসায় থাকতো আর এই বিষয়ে কিছুই যদি আচ করতে পারতো তাহলে তাকে আজ বাড়ি ছাড়া করেই ছাড়ত। সৌরভ আবারো বলল
–আমি কি ঠিক শুনেছি?

শ্রাবণ তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিতে পারলো না। হিমেল সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই কার কাছ থেকে এসব শুনলি?

সৌরভ বিরক্ত নিয়ে তাকাল। বলল
–আমার বউয়ের একমাত্র বড় ভাই। তুই তো সন্যাস নেয়ার ছক কষেই ফেলেছিস। তাই বলে কি তোর ছোট ভাইও তোর পথেই হাঁটবে? তুই ওকে চিনিস না। পাক্কা ধুরন্ধর শালা আমার। আর তুই কেমন বড় ভাই? নিজের সন্যাস জীবন নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত যে ছোট ভাই কি করছে সেসবও জানার আগ্রহ নেই।

হিমেল সম্পূর্ণ বিষয়টা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল
–ও এখন আর ছোট নাই। যথেষ্ট বড় হয়েছে। এক দুইটা প্রেম করতেই পারে।

বড় ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে হৃদপিণ্ড গতি কমিয়ে দিলো। ভয়ে ঘেমে যাওয়া কপালটা এক আঙ্গুলে মুছে ফেলে বলল
–তুমি ভুল শুনেছ ভাইয়া। এখনো প্রেম করছি না। প্রসেসিং চলছে। তোমাদের দোয়া থাকলে তাড়াতাড়ি শুরু করবো।

শ্রাবণের কথা শুনে সৌরভ হিমেল দুজনেই পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। হিমেল কথা না বললেও সৌরভ বলে ফেললো
–কেমন নির্লজ্জ দেখেছিস? বলছে নাকি প্রসেসিং! এসব কথার মানে কি?

শ্রাবণ লাজুক ভঙ্গীতে হেসে বলল
–এখনো পুরোপুরি প্রেমটা হয়ে ওঠেনি। আমার দিক থেকে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ওপাশ থেকেও কিছুটা সাড়া মিলেছে। কিন্তু মুখে বলাটা বাকি আছে। ওটা বলে দিলেই প্রসেসিং লেভেল কমপ্লিট হয়ে যাবে।

এবার আর হিমেল চুপ করে থাকতে পারলো না। ভাইয়ের এমন ছন্নছাড়া কথা শুনে বলল
–যা করছ করো। এখন তো কিছুই বলবো না। আগে রেজাল্ট দেখে তারপর সোজা মাকে সব বলে দেবো।

শ্রাবণ শুকনো ঢোক গিলে অসহায়ের মতো বলল
–এতো বড় অন্যায় করো না ভাইয়া। তুমি প্রেম করছ না বলে কি আমিও করতে পারবো না। আমার তো একটা মন আছে তাই না? তোমার মতো পাষাণ তো আমি না। একটা মেয়ে চোখের সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করবে আর ভালো লাগলেও আমি বলতে পারবো না? তাছাড়া আর কিছুদিন পর তো আমার পড়ালেখাই শেষ। এখন থেকে বিয়ের প্রস্তুতি না নিলে কিভাবে হবে।

শ্রাবণের কথার উত্তরে হিমেল কড়া কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিতেই সদর দরজায় শব্দে সেদিকে তিনজনেই সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। শ্রাবণ চায়ের কাপটা সামনের টেবিলে রেখে বলল
–আমি দেখছি।

উঠে দরজা খুলতেই তার গম্ভীর কৌতূহলী চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো। ওপাশের মানুষটার চেহারা দেখার জন্য সৌরভ আর হিমেল উদগ্রীব হয়ে পড়লো। শ্রাবণ হেসে উঠে জড়িয়ে ধরে বলল
–স্নেহা! কতদিন পর আসলে।

নামটা কানে আসতেই হিমেলের ভেতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। সৌরভ স্নেহার চেহারা না দেখেই হিমেলের দিকে তাকাল। তার আহত দৃষ্টি দেখে বলল
–তুই স্বার্থপর!

হিমেল কঠিন চোখে তাকাতেই সে ফিসফিস করে বলে উঠলো
–এই মুহূর্তে নিজের কথা ভাবার চেয়ে তোর ভাইয়ের কথা ভাবা উচিৎ ছিল। দেখছিস না যেভাবে জড়িয়ে ধরছে। এই মেয়ের সাথে যদি প্রেম হয়ে থাকে তাহলে ভয়ংকর একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

সৌরভের কথা শুনে হিমেল কিছুটা সস্তি পেলো এটা ভেবে যে এরকম কিছু হলে অন্তত সে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। কারণ এই মেয়ে তার জীবনে একটা আপদ। পরক্ষনেই নিজের ভাইয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো। সৌরভের কথা যদি সত্যি হয়ে যায় তাহলে শ্রাবণের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। স্নেহার গায়ে পড়া স্বভাবের কারণে মাও স্নেহাকে তেমন পছন্দ করে না। নেহাত বোনের মেয়ে বলেই সহ্য করে নেয়। মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না। যদি জানতে পারে তার বাড়ির বউ এই মেয়ে হবে তাহলে শ্রাবণের কোন নিস্তার নেই। মুখটা ফ্যাকশে হয়ে উঠতেই সৌরভ বলল
–শোন ছোট ভাই হয়। এখনো সময় আছে। যদি আমার ধারনা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে প্রসেসিং লেভেলেই আটকে দে। ওকে বোঝা ছেলেদেরও ইজ্জত থাকে। আর সেটা অনেক দামী। একবার হারিয়ে গেলে ফেরত পাওয়া যায়না।

সৌরভের এমন কথা শুনে হিমেল বিরক্ত হল। তার বিরক্তিটা রাগে পরিণত হতেই কাপটা ঠক করে টেবিলে রেখে গম্ভীর আওয়াজে বলল
–আমি বাইরে যাচ্ছি। আজ আর বাসায় ফিরব না। মাকে বলে দিস।

সৌরভ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এ কেমন বড় ভাই? একটা মেয়ের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অথচ ছোট ভাইটার কথা একবারও ভাবছে না। শেম অন ইউ হিমেল। শেম অন ইউ।

চলবে……
(গল্পটা নিয়ে ছোট করে কিছু বলবেন কেমন লাগছে। রিচেক করা হয়নি। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরধ রইল।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here