বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ৫

0
1755

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৫

রান্না ঘর থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ঠেকতেই নিলু হাঁচি দিয়েই মায়ের দিকে তাকাল। তার মা বেশ আয়েশ করে বসে সিরিয়াল দেখছে। তার মুখের ভাব ভঙ্গী বলে দিচ্ছে এই মুহূর্তে বাড়িতে কি হচ্ছে সেসব নিয়ে ওনার কোন টেনশন নেই। সমস্ত মনোযোগ ঐ সিরিয়ালে। নিলু একটু কাছে এসে কণ্ঠ একদম নামিয়ে নিয়ে বলল
–স্নেহা রান্না ঘরে কি করছে সেটা দেখছ না কেন? কে জানে কার সাথে কি মিলিয়ে দিচ্ছে?

কথাটা যেন কানেই নিলেন না শান্তি বেগম। টিভির রিমোটে আনমনে চাপ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন
–মেয়েটা ভালই রান্না করে। বাসায় আসলেই আমাকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেয়না।

নিলু মায়ের কথায় বিরক্ত হল। ঝাঁঝালো গলায় বলল
–ঐ মেয়ে আসার পর থেকে তোমার বড় ছেলে যে বাড়ি ছাড়া হয়েছে সেটা খেয়াল করেছো?

শান্তি বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন স্বাভাবিক ভাবে। তারপর সচেতন দৃষ্টিতে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন
–সে তো ভালো কথা। এটা থেকে বোঝা গেলো যে আমার ছেলের ঐ মেয়ের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। বেশ ভালো কথা।

শেষের কথাটা বেশ উতফুল্য কণ্ঠে বললেন তিনি। নিলু বিরক্ত হয়ে বলল
–কিন্তু মেয়ের তো তোমার ছেলের প্রতি ভরপুর আগ্রহ। আগুন আর ঘি একসাথে রাখলে আগুন কিন্তু জলবেই মা। আজ তোমার ছেলের আগ্রহ নেই এই মেয়ের প্রতি। কিন্তু অন্য মেয়ের প্রতিও তো আগ্রহ দেখা যায়না। তাই বলছি আগ্রহ জন্ম নিতে সময় লাগবে না। সাবধান করে দিলাম। মাথায় রেখো।

নিলু উঠে চলে যেতেই শান্তি বেগম একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। মেয়ের কথাগুলো তিনি কানে তুললেন না। ছেলের উপরে তার অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। যেমন তেমন মেয়েকে যে তার ছেলে পছন্দ করবে না সে নিয়ে তিনি একদম নিশ্চিন্ত। তার ছেলে যাকে পছন্দ করবে সে হবে একদম হিরা। যার পা এই বাড়িতে পড়লেই সংসার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। কথাটা ভাবতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তিনি মুচকি হেসে টিভি দেখায় মনোযোগ দিলেন।

————-
মাথার উপরে খটখট করে ফ্যানটা শব্দ করছে। বাইরে রোদের তেজ বেশ। ক্লান্ত কুমু ঘেমে নেয়ে বাইরে থেকে এলো। বিছানার উপরে চোখ পড়তেই গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। ঠিক মাঝখানটায় মৌ বসে আছে। ফ্যানের বাতাসে ঘাড় অব্দি পড়ে থাকা ফুরফুরে চূলগুলো উড়ছে। চোখ মুখ কুচকে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। এগিয়ে গিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বলল
–কি করছ তুমি?

মৌ চোখ তুলে তাকাল। রাগে মুখ লাল হয়ে আছে। আবারো নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলল
–দেখছ না পড়ছি।

কুমু অবাক হল। বইটা উল্টে পাল্টে দেখে বলল
–এটা তো রাফির বই? তুমি কেন এটা পড়ছ?

মৌ বইয়ের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর আওয়াজে বলল
–এই বই পড়েই তো রাফি ভাইয়া প্রতি পরিক্ষায় ভালো নাম্বার পায়। আর বাবা মা ওকে আদর করে। আমি এই বই পড়েই ভালো নাম্বার পাবো। তাহলে ওর থেকে আমাকে বেশী আদর করবে।

কুমু হেসে ফেললো। তার হাসি দেখেই রক্তিম চোখে তাকাল মৌ। অমন দৃষ্টি দেখে কুমু হাসি বন্ধ করে দিলো। কিন্তু লাভ হল না। তাই ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বইটা বন্ধ করে ফেললো। তারপর বলল
–আমিও তো ভালো নাম্বার পাই। তাই বলে কি আমি রাফির বই পড়ি?

মৌ বিচক্ষনের মতো ভেবে মাথা নাড়ল। কুমু হেসে আবারো বলল
–যেটা যার বই সে সেটা পড়ে ভালো নাম্বার পেলে তবেই বাবা মা তাকে আদর করবে। তুমি তো পড়তে চাও না। তাহলে কিভাবে ভালো নাম্বার পাবে। ভালো নাম্বার পেতে হলে প্রতিদিন আমার সাথে পড়তে বসতে হবে। কিন্তু তোমার বই পড়তে হবে। পুরোটা আত্মস্থ করে ফেলতে হবে। তবেই ভালো নাম্বার পাবে। আর বাবা মা তোমাকেও আদর করবে।

–আত্মস্থ কি আ[পা?

খুব কষ্ট করে উচ্চারন করলো কথাটা। এমন কঠিন শব্দ যে এর আগে কখনো শোনে নি। কুমু ভড়কে গেলো। এমন কঠিন শব্দ যে মৌ বুঝবে না সেটা তার ভাবা উচিৎ ছিল। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–মুখস্ত করাকে আত্মস্থ বলে।

মৌ আবারো প্রশ্ন করলো
–তবে তুমি যে বল মুখস্ত করবে না। বুঝে পড়বে। তাহলে আমি কিভাবে আত্মস্থ করবো?

ক্লান্ত কুমু ভীষণ বিরক্ত হল। চোখ বড় বড় করে তাকাল। এমন প্রশ্ন করা মৌয়ের স্বভাব। সুযোগ পেলে পেটের ভেতর থেকে সব প্রশ্ন হুড়হুড় করে বের করে দেবে। একটুও ভাববে না। তার এই মুহূর্তে প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–ভাইয়াকে বই দিয়ে আসো। ও পড়বে। যাও। নাহলে রাগ করলে কিন্তু মারবে।

মৌ বইটা নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো। চুপ করে রাফির টেবিলে বইটা রেখে কুমুর সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে শুয়ে কুমু চলন্ত ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে একটাই দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে। অচেনা মানুষটা তাকে কি জাদু করলো যার কারণে বারবার তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে নিজের চোখের সামনে। কিছুতেই ভুলতে পারছে না তাকে। খানিকবাদেই মন কেমন অস্থির হয়ে উঠছে তাকে এক পলক দেখার আশায়। মৌয়ের ঝাকিতে চমকে তাকাল। কোমরে দুই হাতে রেখে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল
–কখন থেকে ডাকছি তোমাকে। শুনতে পাচ্ছ না?

কুমু একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বল কি হয়েছে?

–আমাকে এখন পড়াও। আমিও ভালো নাম্বার পাবো।

কুমু অসহায়ের মতো বলল
–আপা এখন ক্লান্ত মৌ। পরে পড়াবে। এখন খেয়ে ঘুমাও। ঘুম থেকে উঠে পড়বে।

মৌ মন খারাপ করে বিছানায় উঠে এক পাশে শুয়ে পড়লো। তার ভালো নাম্বার পাওয়ার আশায় আপা এভাবে পানি ঢেলে দেবে সেটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে এলো। রাফি ভালো নাম্বার পাওয়ায় তাকে আজ বাবা একটা শার্ট কিনে দিয়েছে। সেই থেকে মৌয়ের মনে হয়েছে তাকেও ভালো নাম্বার পেতে হবে তাহলে বাবা তাকেও এমন অনেক কিছুই দেবে। কিন্তু আপা তো তাকে পড়াচ্ছে না। তাহলে কিভাবে ভালো নাম্বার পাবে। আর শুয়ে থাকতে পারলো না মৌ। উঠে বসে তার বইটা নিয়ে পড়তে বসলো। কুমুর মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেলো বাইরে।

———–
বঙ্গাব্দ ১৪২৮, ২২ শে ফাল্গুন

“চারদিকে গুমোট কালো মেঘ। মনের ভেতরে ভীষণ তোলপাড় করা ঝড়। ভীষণ এলোমেলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে কি আর কখনো দেখা পাবো না? তবে কি হবে না তার সাথে পরিচয়? নামটা কি অজানাই থেকে যাবে? কখনো কি বলা হবে না ভালো লেগেছিল আপনাকে; কিন্তু ভালবাসাটা এখনো বাকি।“

ক্লান্ত কুমু প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে ডাইরিটা বন্ধ করে ফেললো। ভেতরটা কেমন জ্বালা করছে। কাউকে দেখার তৃষ্ণা এতো ভয়ংকর হতে পারে তার জানা ছিল না। সেও যে এমন অনুভুতির স্বীকার হতে পারে সেটা ভেবেই কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। দমবন্ধ লাগছে। পরপর দুদিন সেই ফটোকপির দোকানের সামনে দাঁড়ানোর পরেও যখন কাঙ্ক্ষিত পুরুষটার দেখা মেলেনি তখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এসেছিলো কুমু। ভীষণ তোলপাড় হচ্ছিল নিজের মধ্যে। অন্তর্মুখী কুমু কাউকে সেই অস্থিরতার কথা জানাতে পারলো না। আধ ভাঙ্গা মন নিয়ে কাটিয়ে দিলো দুটো দিন। ভালো থাকার অভিনয়টা চালিয়ে গেলেও ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিল সে। সন্ধ্যা হতেই সেই অস্থিরতা বেড়ে গেলো। অস্থির হয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই মস্ত চাঁদটা চোখে পড়লো। মন খারাপটা আরও বেড়ে যেতেই ভীষণ সুন্দর জ্যোৎস্না দেখে মন ভালো করার প্রয়াশ নিয়েই ছুটে গেলো ছাদে। বেখেয়ালি ভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে সে। কিন্তু কয়েক কদম বাড়াতেই সিঁড়ির মাঝেই ঘটে গেলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যা কুমুর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here