বিদায়_বরণ পর্ব- ১৯

#বিদায়_বরণ
পর্ব- ১৯
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

.
“আমি তোমার সাথে তোমাদের বাসায় যাবো কিংশুক, কিন্তু আমার বিশেষ কিছু শর্ত আছে। ”

বিভাবরী বেগমের কথায় উপস্থিত সবার ঠোঁটে হাসির রেখা প্রসস্থ হলো। কিংশুক সহসা সোফা থেকে উঠে বিভাবরী বেগমের পা জড়িয়ে ধরলেন। যামিনী খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে সাখাওয়াতকে জড়িয়ে ধরল। শিখিনী শুধু মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ হাসল।

কিংশুক একপ্রকার কান্না করে দিলো বিভাবরী বেগমের পা জড়িয়ে ধরে। বিভাবরী বেগম অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। কিংশুকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, ” কী করছ কী কিংশুক। উঠো, আমি বলছি তো যাবো।
কিংশুক মাথা তুলে হতাশ কণ্ঠে বলল, ” তুমি জানো না ফুফি আম্মা, তুমি আমার জীবনে কতটা জুড়ে আছো, এতগুলো দিন, বছর পরে তোমাকে পেয়েও হারাবো, সেটা আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। তুমি আমাকে আজ কতটা আনন্দিত করলে, তুমি নিজেও জানো না। আমি কত অপেক্ষা করেছি, এই দিনটার জন্য। আবার কবে, ফুফি আম্মার আদর পাবো। আবার কবে আমার ফুফি আম্মা আদরে গলায়, আমার সাহসী কিং বাবা, আমার বুকে আয় বলে ডাকবে। ”

কিংশুকের কথায় বিভাবরী বেগমের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আহা, তার মা হারা বাচ্চারা! কত আদর, যত্ন ভালোবাসা দিয়েছিল ছোট সময়ে। সময়ের পরিক্রমায় আজ এতগুলো বছর তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন। তার হৃদয়টা কেঁপে উঠল। চোখে জল এলো। পুরোনো দিনগুলো মনে পরতেই হৃদয়টা হাহাকারে ভরে উঠল। তার আদরের ভাইপো কিংশুক, আদর দিয়ে কিং বাবা বলে ডাকত। নামটা বিভাবরী বেগমেরই রাখা। নিজের অজান্তেই তিনি ওদের কতটা কষ্ট দিয়ে বসে আছেন। কিংশুকের মাথাটা বুকের ভিতর আগলে রেখে বিভাবরী বেগম কেঁদে দিলেন,
” কিং, আমার বাবা কিং, আমি যে বুকের মাঝে কতটা কষ্ট জমিয়ে ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কীভাবে বুঝাই তাকে। কত ছোট তোরা তখন! দুনিয়া সম্পর্কে তোদের ধারনা আর কতটুকু! এক একটা মুহূর্ত বিষের মত কাটিয়েছি আমি। কী দূর্বিষহ দিনগুলো! জীবন যে বড় কঠিন রে বাবা!

কিংশুক অভিমানী সুরে বলল, ” কেন ফুফি আম্মা, এমনটা না করলে হতো না? সব কী অন্যভাবে ঠিক করা যেত না? এমনটা কেন করলেন? জানো, তোমার উপর কত রাগ, অভিমান হয়েছিল আমার। কেন সেদিন তোমার সাথে আমাকেও নিয়ে আসলে না, বলো তো?

– বারে, সেদিন তোমাকে ফুফি আম্মা নিয়ে আসলে, আমাদের কী হতো শুনি!

যামিনীর কথায় শিখিনী হেসে দিলো। কিংশুকও আর কিছু বলতে পারল না। বিভাবরী বেগম হাত বাড়িয়ে যামিনীকে বুকে আগলে নিলেন।
যামিনীর কথাটা মজার ছলে না হলেও, যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ছিলো।
শিখিনী ছোট, সাথে তিনিও প্রেগন্যান্ট। এমতাবস্থায় তিনি কোন যুক্তিতে কিংশুককে সাথে আনবেন? তারউপর যামিনী, ইয়ামিনি হওয়ার পর ওদের দায়িত্ব তো কিংশুকের উপরে এসেই পরেছে। কিংশুক ও বাড়ির বড় ছেলে। কত দায়িত্ব তার!

তাছাড়া, বিভাবরী বেগম তখন গাঢ় অভিমান নিয়ে বাসা ছেড়ে ছিলেন। কিংশুকের মত শিখিনীও ছোট বাচ্চা। তার উপর তিনি নতুন কর প্রেগন্যান্ট। তখন তারই পরিবার সেই বাচ্চা নষ্ট করে নতুন করে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছিল। হ্যাঁ, দুঃভাগ্য বশত তার স্বামী মারা গেলেও, নিজেদের বাচ্চাদের ভরনপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার অযোগ্য ছিলেন না তিনি। সেখানে তাকে আবার কারো সাথে বিয়ের প্রশ্ন কেন আসবে?

কারণ, সমাজব্যবস্থা। বিভাবরী বেগমের মা বাবা অল্প শিক্ষিত। গ্রামের মানুষ। মেয়ের জামাই মরেছে, সেখানে সাথে দু’বাচ্চা। তাদের কাঁধে একপ্রকার বোঝার মতই। সাথে ছেলের সংসার। তারা চেয়েছিল, মেয়েকে নতুন কারো সাথে বিয়ে দিতে। যেন দায়িত্ব নেওয়ার কেউ থাকে। কিছু মেয়েরা এসব মেনেও নেয়, সবাই তো বিভাবরী বেগম নয়! এমনটা হলে দেখা যেত, শিখিনী অনাথ হতো, সাখাওয়াতের হয়ত পৃথিবীতে আসাই হতো না। বিভাবরী বেগম হয়ত বা ভালো খারাপ একটা স্বামীর সংসার পেয়ে যেতেন। শিখিনীর হয়ত মামার সংসারে হেলাফেলা করেই জীবনটা পার হতো।

কিন্তু এমনটা হয়নি! বিভাবরী বেগম তার ভবিষ্যৎ দেখতে পারছিলেন। তাই নিজেই নিজের জীবনের মূল পথ প্রদর্শক হয়েছিলেন। তার স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য একজন আর্মির অফিসার। জীবনকে কীভাবে পরিচালনা করে বেঁচে থাকতে হয়, সেটা বিভাবরী বেগম খুব সুন্দর ভাবে শিখে নিয়েছিল। হার না মানা এক অদম্য মনোবলের একজন স্বামীর আদর্শ স্ত্রী হয়েছিলেন বিভাবরী বেগম।
লড়াই করতে সাহস পেয়েছিলেন। লড়তে চেয়েছিলেন। তাই সেদিন গাঢ় অভিমান, রাগ, ইচ্ছে শক্তি নিয়ে সকল পিছুটান ভুলে নিজের পরিচয় গড়তে বেরিয়ে এসেছিলেন বাসা থেকে। যার ফলাফল, তিনি পেয়েছেন। দুইটি সন্তানকেই তিনি সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দিতে পেরেছেন। যদিও বা বাবার অভাব থাকেই। কিন্তু মানুষটা পরলোকগমন করেছে, তার জন্য শুধু বুকভরা দোয়া রেখেছেন।

তার প্রতি মৃত্যু বার্ষিকীতে তিনি শহরের এক একটা অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের খাওয়ার ব্যবস্থা, পোশাক, আরো জিনিসদ্রব্য দিয়ে থাকেন। নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করেন, অনাথ, পথশিশুদের জন্য। নিজের ইনকামের একভাগ ওদের জন্য রাখেন, একভাগ সঞ্চয় করেন, বাকীটা তিনি খরচ করেন। ছেলে-মেয়েদের অতিরিক্ত আহ্লাদ যেমন দেননি, তেমনি অভাবও অনুভব করতে দেননি।
শিখিনী অবশ্য তার মাকে এখন সাহায্য করতে পারে। বিভাবরী বেগম এভাবেই এক একটা বছর পার করতে করতে কঠিন মনের একজন মানুষ হয়ে গিয়েছেন।
জীবনটা কতটা কষ্টের, দূর্বিষহ, সেটা তিনি নিজ চোখে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন। কঠিন ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ হয়ে দাড়িয়েছেন। তিনি একজন দায়িত্বশীল সমাজসেবী হতেও কখনো হেলাফেলা করেননি।

সেই আদর্শেই তিনি সন্তানদের মানুষ করেছেন। যেন, জীবনের একটা পথ বন্ধ হয়ে গেলে, অন্য আরেকটা পথ অনায়াসে খোলা থাকে। কিছু একটা কর জীবন চালিয়ে নিতে যেন অসম্ভব হয়ে না পরে।

তিনি এক সময় আশা করেছিলেন, পরিবার থেকে হয়তবা খোঁজ আসবে। কিন্তু সে আশা একসম নিরাশায় পরিনত হয়। তিনিও আর পারেননি, খোঁজ নিতে। অভিমান নিয়েই দূরে দূরে থেকেছেন। সেখানে হঠাৎ আজ এতগুলো বছর বাদে তার আপন রক্তের সাথে দেখা হলো। পরিচয় হলো। পরিবারের দুঃসময়ের কথা জানতে পারল। তাই তিনি না কঠিন হয়ে থাকতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, একবার হলেও সে বাড়িটা ঘুরে আসবে, যারা আছে তাদের সামনে অন্তত একবার তার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সময় হয়ে এসেছে।

বিভাবরী বেগমের কিংশুকের সাথে বিশেষ শর্ত সকলের গোপনেই মিটে গেল।
সবাই প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলো। যাওয়ার জন্য সবাই এখন প্রস্তুত।

বিকেলের বাস ধরবে কিংশুকরা। তাই সারাদিন গুছিয়ে, ঘুরে ফিরে, বিভাবরী বেগমরা প্রেমের মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন।

এতকিছুর মাঝে প্রেমের সাথে শিখিনীর একনজরও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। ভীষণ এক হৃদয় বিষদায়ক যন্ত্রণা নিয়ে প্রেমের থেকে প্রত্যাক্ষান হয়ে বাসে বসে রইল শিখিনী। বাস ছুটে চলল নতুন এক উদ্যমে, নতুন এক যাত্রা পথের, নতুন এক বরণের।

পিছনে রেখে গেল অসমাপ্ত কয়েকটা গল্পের ঠিকানা…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here