বিদায়_বরণ ২০ পর্ব

#বিদায়_বরণ
২০ পর্ব
#মেহরুন্নেছা_সুরভী
.
এতকিছুর মাঝে এ কয়দিনে প্রেমের সাথে শিখিনীর একনজরও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। প্রেম অনেকটা আড়ালেই থেকেছে। শিখিনী দু’বার প্রেমের বাসায় গিয়েও এক পলক দেখতে পায়নি।
ভীষণ এক হৃদয় বিদায়ক যন্ত্রণা নিয়ে প্রেমের থেকে প্রত্যাক্ষান পেয়ে চেনা-অচেনার উদ্যেশে বাসে বসে রইল শিখিনী। বাস ছুটে চলল নতুন এক উদ্যমে, নতুন এক যাত্রা পথের, নতুন এক বরণের।

সেই সাথে শিখিনী রেখে গেল চেনা শহরের সেই অসমাপ্ত কয়েকটা গল্পের ঠিকানা!

ঠিক ভোর ছ’টায় ভাঙা বাস স্টেশনে এসে শিখিনীদের বাস এসে থামল। সারাটা পথ শিখিনী ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। যদিও, রাতের বাস জার্নিতে বেশির ভাগ যাত্রি ঘুমিয়েই কাটায়। যামিনীর ডাকে শিখিনী চোখ মেলে তাকায়। উঠে বসে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। বাহিরে ভোরের আলোয় বাসের ভিতর আলোরণ সৃষ্টি করে। মাথা নাড়াতে গিয়ে কাঁধের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে শিখিনী।

বিভাবরী বেগম ততক্ষণে বাস থেকে নেমে গিয়েছে। যামিনী এমন অবস্থা থেকে শিখিনীকে বলল, ” শিখিপু, সর্বনাশ করেছে, তুমি কী একদিকে কাঁধ হয়ে ঘুমিয়েছিলে, ব্যাথা বেশি করছে? বাসায় চলো তেল মালিশ করলে আরাম পাবে। তোমার ঘাড় যে বেঁকে নেই সেই আলহামদুলিল্লাহ। একবার দা’ভাইয়ের যা অবস্থা হয়েছিল, তোমারি মত ঘুম কাতুরে, হাহাহা!

যামিনী একবার কথা শুরু করলে হিস্ট্রি টেনে আনতে ভুলে না। চারপাশে যে অচেনা মানুষজন ওর কথা শুনতে পাচ্ছে, সেদিকে ওর খেয়ালই নেই।

বাসের কয়েকজন যাত্রী এখনো নামেনি। যামিনী কথায় দু’একজন কেমন ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে রইল। শিখিনী ভীষণ অস্বস্তিতে পরে গেল। যামিনীকে থামিয়ে বাস থেকে নেমে বিভাবরী বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কোমড়টাও শেষ! সেই ঢাকা থেকে আরিচা ঘাট দিয়ে ফরিদপুর পার করে ভাঙা এসে বাস থামল। এর মাঝে শুধু ফেরিতে নামা হয়েছিল, সামান্য হাঁটতে পেরেছিল। তাছাড়া সম্পূর্ণ পথ বসে এসেছে।
বিভাবরী বেগম পায়ের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে শিখিনীর হাত চেপে ধরল। এতক্ষণ বসে এসেছে, যার ফলাফল পা ফুলে ঢোল। এতদূর জার্নি কারোর শরীরে আরামের ছিটেফোঁটার চিহ্ন রইল না।

কিংশুক শীঘ্রই একটি ভ্যান গাড়িতে মালপত্র উঠিয়ে অন্যটায় সবাইকে বসতে বলল, শিখিনী ভ্যান গাড়িতে উঠা তো দূর, দেখেই চক্ষু চড়কগাছ! ঢাকা শহরে এসব ভ্যান গাড়িতে সে বিভিন্ন দ্রব্য, সবজি সাজিয়ে বিক্রি করতে দেখেছে। কিন্তু এতে যে মানুষ চড়ে তার জানা ছিল না। তাই আকস্মিক বলে উঠল, ” এদিকে রিকশা নেই?

রিকশার কথা শুনতেই যামিনী বাসের ভিতরের মত আরেক দফা হেসে বলল, শিখিপু, এখানের সাত গ্রাম খুঁজেও তুমি একটা রিকশা পাবে না। হাহা।
-তাহলে, এখানে লোকজন চলাচল করে কীসে?
– কেন! এই ভ্যানে, অটোতে, বাস আছে।

ভোরের সময়। তাই চারপাশে বেশি লোকজন দেখা যাচ্ছে না। যানবাহনও অল্প। চারপাশের পরিবেশটা যদিও সুন্দর, কিন্তু শিখিনী আহত চোখে বিভাবরী বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা ভ্যানে শিখিনী আর কিংশুক সামনে উঠে বসল। অপরটায় বিভাবরী বেগম, যামিনী ও সাখাওয়াত।

ভ্যান চলার সময় ধরে রাখার মত শিখিনী কিছু পেল না। চারপাশটা শুধু খোলা, উপরে আস্ত আকাশ। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে শিখিনীর হাত চলে গেল কিংশুকের বাহুতে।
কিংশুক হেসে বলল, “ভয় নেই, পরবে না। রাস্তা পিচঢালা, আরো উপরে উঠে পা ঝুলিয়ে বসো। এই তো পৌঁছে গিয়েছি।

শিখিনী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। তবুও, কিংশুকের হাত চেপে ধরে বসল। যাত্রা পথ থেকে কিংশুকের সাথে তার সম্পর্ক বন্ধুর মত হচ্ছে। এখন আর প্রথম দিকের মত দ্বিধা নেই।

পাঁচ মিনিটের আগেই শিখিনীরা পৌঁছে গেল। রাস্তার সাথে বাসার গেট। যদিও এটা গ্রামের দিকে, তবে পাকা রাস্তা, আর আশেপাশের বাড়িও বেশ উন্নত।
বাসার ভিতর থেকে দু’জন লোক এসে মালপত্র নিয়ে ভিতরে চলে গেল। কিংশুক বিভাবরী বেগমের হাত ধরে গেট ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল!যামিনী এসেই বাবা বলে উচ্চস্বরে ডাক দিলো।

বাহার সাহেব সকালে নামাজ পরে বাহিরে কাজের তদারকি করছিলেন। কিংশুক নেই বাসায়। তাই এসব দায়িত্ব ভার এখন তার কাঁধে। একতলা একটি বিল্ডিং বাড়ি, তার পাশেই টিনের দো’তলা বাড়ি, দু’টো বাড়ির মাঝে টিনের বেড়া দেওয়া, মাঝে গেট। ওপাশের বাসায় ভৃত্যরা থাকে। পাশে জমি আছে, বড় বড় পুকুর আছে। গরু আছে গোয়ালে, সাথে ফসল রাখা হয় সেই টিনের ঘরে। সেখানে মানুষ থাকার ব্যবস্থাও আছে। যারা এসব দেখাশোনা করে তারা এখানে থাকে। রান্নার মানুষও রাখা। দু’বেলা রেঁধে দিয়ে যায়।

বাসায় ইয়ামিনিকে দেখাশোনা করার জন্য দুঃসম্পর্কের একজন খালা আছে কিংশুকের। তার নাম জয়া বেগম। নিসন্তান। শ্বশর বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন। ভাইয়ের বাসায় জায়গা না হলেও, মায়ের আত্মিয়ের ভাইয়ের বাসায় এসে জায়গা করে নিলেন। তিনি কিংশুকের মা মারা যাবার পর থেকেই থাকেন। তার সম্পর্কে বলতে গেলে, ভীষণ ভালো মানুষ। কিংশুক, ইয়ামিনি, যামিনীকে নিয়েই নিয়ে জীবনটা পার করে দিলেন।
এদিকে বাহার সাহেবের জীবন বলতেই তো এখন উইলচেয়ার। বাড়ির সম্পূর্ণ দায়িত্ব কিংশুকের কাঁধেই। সবদিক দেখাশোনা কিংশুক নিজেই করে।

বিভাবরী বেগমের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরছিল। কতদিন বাদে চেনা-পরিচিত সেই বাবার বাড়ি এলো সে। নিজের জন্মস্থান। পিতৃ পরিচয়।
যদিও জন্ম নেওয়া সেই পুরাতন বাড়িটা আর নেই ভিটেয়। চারপাশের সবই পরিবর্তন হয়েছে। সব নতুন। রাস্তাঘাট, বাড়ি, ভাঙা শহর, সবই নতুন রুপ দেখতেছেন তিনি।
কয়েকটা পরিচিত গাছ দেখে তিনি চিনতে পারলেন, এসব তার, তার বাবার হাতে লাগানো ছিল। বাড়ির চারপাশে বড় বড় গাছগুলো এখনো আছে। আগের থেকে আরো বড় হয়েছে। বাড়ির পরিবেশ এখন বেশ উন্নত। তিনি তো ভাবতেই পারেননি, বাড়িটা বিল্ডিং বাড়ি হবে। কারণ, এত টাকা রোজকার করার সাধ্যে ছিলো না বিভাবরী বেগমের বাবা-ভাইয়ের। সবটাই হয়ত কিংশুকের হাতে গড়া।

কত বড় হয়ে গিয়েছে তার ভাইপোটা, কত দায়িত্বশীল ছেলে হয়েছে এতটুকু বয়সেই। হয়ত একসময় কষ্টও করেছে। সেসব ভাবতেই বিভাবরী বেগমের ভিতরটা হাহাকারে ভরে উঠল।

ভিতর থেকে ইয়ামিনি দৌড়ে এসে তার বোনকে দেখেই চেঁচিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। কেঁদেই এলো মেয়েটা। যামিনী বোনের সাথে শিখিনী আর সাখাওয়াতকে পরিচয় করিয়ে দিলো। কিংশুক আর বিভাবরী বেগমকে রেখে সবাই ভিতরে চলে গেল।

বাহার সাহেব অপরপাশের বাড়িতে ছিলেন। মেয়ের ডাক শুনে তিনি সবাই তাড়া দিয়ে এই পাশে চলে এলেন। বিভাবরী বেগম উঠোন দিয়ে হেঁটে হেঁটে চারপাশটা দেখছিলেন।

এতগুলো বছর বাদে বাহার সাহেব নিজের সামনে আদরের সেই ছোটবোনকে দেখতে উইলচেয়ার ধরে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। বিভাবরী বেগম তার সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না।
কিংশুক এগিয়ে এসে তার বাবাকে কিছু কথা বলল। বিভাবরী বেগম এগিয়ে এসে ভাইকে সালাম করলেন। হাঁটু ধরে বসতেই বাহার সাহেব চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন। ভাইয়ের কান্নায় বিভাবরী বেগম নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ঝর্ণার ধারার মত চোখের জল গড়িয়ে পরতে লাগল।
– বোনরে, আমার বোন। তুই কোথায় ছিলি এতদিন, তোর ভাইটা যে ভীষণ পাপি। শেষমেশ এলি কবর দেখতে, আমি যে লাশ হয়ে আছি রে বিভা।
– ওভাবে বলো না দাদা, ওভাবে বলো না।

ততক্ষণে জয়া বেগমও ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।কিংশুকের কথা মত তিনি সকলের জন্য খাবার রান্না করে রেখেছিলেন। এসেই যেন সবাই কিছু মুখে দিতে পারে।
তিনি বিভাবরী বেগমের যথেষ্ট বড়। তার বিয়ের সময় দেখেছিলো কয়েকবার।

ভাই-বোনের কান্নার আওয়াজ শুনে ভিতর থেকে শিখিনী দৌড়ে বাহিরে এলো। এভাবে কাঁদতে তার মাকে সে কোনোদিন দেখেনি।
কিংশুক একটু দূরে সরে গিয়ে চোখের জল মুছল। ভীষণ আবেগের মুহূর্ত চলছে যে। চোখে জল না এসে পারে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here