বিদায়_বরণ পার্ট ১০

বিদায়_বরণ
পার্ট ১০
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

শিখিনীকে ঘুমন্ত দেখে কিছু না বলে ডেসিন টেবিলে রাখা ফুলদানিটা ফ্লোরে বেশ জোড়ে-ই ছুড়ে মারল প্রেম। কাঁচের ফুলদানিটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল!
খুব কাছে বেশ জোড়ালো শব্দ হলে ঘুমটা ভেঙে যাবে স্বাভাবিক। শিখিনীর ঘুমটাও ভেঙে গেল।চেয়ে দেখল প্রেম পাশে দাঁড়িয়ে। পরিবেশ বুঝতে শিখিনীর কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল। উঠে বসল। ঘুম কাতরে হয়েই বলল, প্রেম! এখানে কী করছ!

শিখিনীর কণ্ঠস্বর বেশ দূর্বল লাগছে। মাথা তুলে আবার খাটের সাথে ঠেকাল। জ্বরটা কমেছে, তবে দূর্বলতা ছাড়েনি! চোখ-মুখ ফোলা ফলো। শিখিনীর এহেম অবস্থা দেখে প্রেমের বেশ অনুশোচনা হলো। ঘুমটা ভাঙানো ঠিক হয়নি হয়ত। প্রেম কিছুক্ষণ পায়চারি করে শিখিনীর পাশে গিয়ে বসল। শিখিনী অবাক নয়নে প্রেমের দিকে চেয়ে রইল। হঠাৎ প্রেমের আগমনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না! তখনি বাহির থেকে বিভাবরী বেগমের ডাক আসে।

বিভাবরী বেগম কিচেন রুমে কাজ করছিলেন। ভারী কিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দে ছুটে৷ আসেন। মেয়ের দরজাটা বন্ধ পেয়ে তিনি ডাকতে লাগলেন।
” শিখি, উঠেছ তুমি?কীসের শব্দ হলো, কিছু ভেঙেছে!

শিখিনী হতবিহ্বল বসে রইল। একবার দরজা ধাক্কা দেওয়ার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ফ্লোরের দিকে। প্রেম মাথা নীচু করে বসে আছে।
প্রেমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল শিখিনী। এই অকাজটা যে প্রেম ছাড়া কেউ করেনি, সেটা বুঝাই যাচ্ছে! এদিকে তার এত দূর্বল লাগছে, উঠে দাঁড়িয়ে এসব পরিস্কার করাও তার পক্ষে অসম্ভব। প্রেমের হাতটা শিখিনী নিজের হাতের তালুতে নিলো। এরপর বিভাবরী বেগমের উদ্দেশ্য বললেন, “কিছু না মা, আমি উঠেছি মাত্র। আর কিছু ভাঙেনি!
” আচ্ছা, তুমি ঠিক আছো?
“হ্যাঁ,মা, আমি ঠিক আছি।

বিভাবরী বেগম আরো কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। কিছু একটা আঁচ করলেন। তিনি স্পষ্ট শুনেছেন, বেশ ভারী কিছু পরেছে ফ্লোরে! আপন মনে বিরবির করতে করতে কিচেন রুমে গেলেন।
যামিনী এসেছে। যামিনীর হাতে পালং শাক আর চিংড়ি মাছ। যামিনীর কাণ্ডে বিভাবরী বেগমের কপালে চলে গেল।
” এসব কী করেছ তুমি! এতটুকু মেয়ে, বাজারে গিয়েছ কেন!ছি ছি, এসব না আনলেও পারতে।

যামিনী মুচকি হেসে বাজারের ব্যাগটা রেখে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে নিলো। বিভাবরী বেগমকে জড়িয়ে ধরল।বিভাবরী বেগম বেশ চমকে উঠলেন যামিনীর ব্যবহারে। যামিনী আদুরে কণ্ঠে বলল,
“আন্টি, আন্টি, একটু দম নিন। এতগুলো দিন যখন আপনার পছন্দের রান্না খেয়ে এসেছি, আজ না হয় আমার পছন্দের রান্না করে আপনাদের খাওয়াই।
বিভাবরী বেগম তটস্থ হয়ে বললেন, ” ওহ, এসব তোমার পছন্দের খাবার। আমি এখনি রান্না করে দিচ্ছি। ”
” ছাড়ুন আন্টি, আমি আজ রান্না করব। আমি কিন্তু বেশ ভালো রান্না পারি।”
” যাই বলো, তুমি এতটুকুন একলা মেয়ে, অচেনা শহরের বাজার ঘাটে যাওয়া একদম উচিত হয়নি! কেমন দাম রাখল বলো তো!

যামিনী বিভাবরী বেগমের কথায় উচ্চস্বরে হেসে বলল,
” আন্টি, মেয়ে বলে বাজার করা যাবে না, এসআ আমি ধরিই না! আর এখন অনেক জায়গা চিনে যাচ্ছি। আর আমার ছোট সাখাওয়াত পারলে, আমি কেন পারব না হুম!

যামিনীরকথায় বিভাবরী বেগম মাথা ঝুলিয়ে হাসলেন। তিনিও তো একলা মেয়ে মানুষ, এত গুলো বছর সংগ্রাম করেই পার করে দিলেন। তবে, এখন আট তিনি একা নন। তার সাথে শিখিনী আছে,সাখাওয়াত আছে।গ্রাম থেকে আসা মিষ্টি মেয়ে যামিনী আছে।
“সাখাওয়াত! এসেছে?”
” হ্যাঁ, আসছে। ওর সাথে আমার রাস্তায় দেখা হয়েছিলো।
“হ্যাঁ,বলো না, বাজার এনেছে, দেখি দুধ নেই।তাই আবার পাঠিয়েছি।
” এই তো, এখনি চলে আসবে। ”

বিভাবরী বেগম সাখাওয়াতের আনা বাজারের ব্যাগটা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র বের করতে লাগলেন। যামিনী চিংড়ি মাছ গুলো একটি বাটিতে নিয়ে নিলো। বেছে নেওয়ার জন্য। বিভাবরী বেগম থামিয়ে বললেন,
“আগে ফ্রেশ হয়ে আসো। এরপর করা যাবে। আমি দেখছি।
যামিনী ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে বলল, আন্টি, আজ এতকিছু রান্না করবেন। স্পেশাল কিছু!আপনি আর স্কুলেও যাননি!
বিভাবরী বেগম মুচকি হাসলেন। তিনি উত্তর দেওয়ার আগেই যামিনী বলতে লাগল, ” আরো আমি ভেবেছি, আপনি স্কুল থেকে ফিরে আসার আগেই রান্না করে চমকে দিবো!

“আসলে, আজ সাখাওয়াত এর জন্মদিন।এই দিনটায় আমি ছুটি নিয়ে রাখি।”

সাখাওয়াতের জন্মদিন শুনে যামিনী খুশিতে লাফিয়ে উঠল, ” ওয়াও, আজ তাহলে দারুণ একটি দিন। আমি আজ ভীষণ মজা করে রান্না করব। খুব ভালো হলো, আমি যাওয়ার আগে সুন্দর একটি দিন সেলিব্রেশন করা হবে।
“তুমি কোথায় যাবে?”
” আমার ছোট বোনের জন্মদিন সামনে। ও খুব মন খারাপ করে বলেছে, আমাকে যেতেই হবে। ঐ দিনটায় ওর পছন্দের খাবার রান্না না করলে চলেই না! খুব দুষ্টু হয়েছে। আমার কাছেই এতএত আবদার তার! আর আমার হাতের পায়েস তো চাই চাই।

বিভাবরী বেগম চাল ধুয়ে বাটিটা রেখে যামিনীর কথার তালে হাসলেন। তিনিও সাখাওয়াতের জন্য পায়েস রাঁধবেম এখন।
তিনি পাতিল বসাতে বসাতে বললেন, কেন! তোমার মা?

যামিনী মন খারাপ করে বলল, “আসলে আন্টি, আমার মা নেই! আমার ছোট বোনের জন্মের সময় মারা গিয়েছেন।
বিভাবরী বেগম ব্যথিত হলেন।যামিনীর কাঁধে হাত রাখলেন।লজ্জিত হলেন এভাবে বলার জন্য।
” কষ্ট পেয়ো না, আমি দুঃখিত! এভাবে বললাম।
যামিনী হেসে বলল, ইট’স ওকে আন্টি।অনেকবছর হয়ে গেছে, এখন আর কষ্ট হয় না। জানো, আমি তো এখানে আসতেই চাইনি! কিন্তু আমার ভাই জোর করে পাঠিয়েছে। আমাদের সে বেশ আদর দিয়ে মানুষ করেছে। সব সময় বলে, তোদের অনেক বড়মানুষ হতে হবে।
বিভাবরী বেগম হেসে বললেন, ” তোমার ভাই আসলেই একজন অমায়িক মানুষ। অনেক বড় হও তোমরা। ”
“আচ্ছা, আন্টি, আমি বরং চেন্স করে আসি।”
“আচ্ছা, এসো।”

যামিনী চলে গেল। বিভাবরী বেগম বিমর্ষ চেহারায় যামিনীর দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটাকে দেখলে মনেই হয় না, ভিতরে কত দুঃখ! মা মরা মেয়েটা! ইশ্, কত কষ্টে একা একা বড় হয়েছে মেয়েটা!

বিভাবরী বেগমের মনটা খারাপ হয়ে গেল। যামিনীকে তার বেশ ভালো লেগেছিল প্রথম দিন থেকে। এই একমাসে যামিনী তাদের পরিবারে বেশ জায়গা দখল করে নিয়েছে। এতে অবশ্য যামিনীর অবদানই বেশি। শিখিনীকে একটা এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচিয়েছিল। সেই থেকেই মেয়েটা এখানে থাকে। চেহারায় বেশ মায়া মায়া ভাব। এক নজর তাকালেই হৃদয় জুড়ে যায়।
আর যামিনী নামটা তার খুব পছন্দের। পুরোনো এক অতীত তাকে যামিনী নামটার মেয়েটাকে আগলে নিয়েছেন। তার ভাইয়ের মেয়ের নাম সে রেখেছিল যামিনী। কারণ, বিভাবরী আর যামিনী নামের অর্থ একই!
বিভাবরী বেগম মনে মনে ভাবলেন, আহা অতীত! পিছুটান। সেই যে এসেছেন, আর কোনো খোঁজ রাখেননি! সেই ছোট যামিনী মেয়েটাও হয়ত এই মেয়েটার মত বড় হয়েছে। সখ্যতা থাকলে হয়ত, ফুফি আম্মা বলে ডাকত। ভালো থাকুক ওরা!

একরাশ অভিমান নিয়ে তিনি দীর্ঘস্বাস ছাড়লেন। এরপর কাজে মন দিলেন। ব্যস্ততার মাঝেই তার চোখ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরল!

প্রেম ফুলদানির কাঁচের টুকরো গুলো পরিস্কার করে শিখিনীর পাশে বসে। শিখিনীর শরীরে এখনো বর! প্রেম উশখুশ করতে থাকে কীভাবে জিগ্যেস করবে, আদৌও তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে কিনা!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here