বিদায়_বরণ পার্ট ৩

#বিদায়_বরণ
পার্ট ৩
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

কোনো এক ভোরে একজন স্বামী যখন তার লাল শাড়ি পরা শুভ্রতায় ভরা নির্মল, নিষ্পাপ চাহনি, স্ত্রীর মুখটা দেখতে পায়, তখন পুরুষটির পৃথিবীর বেশ সুখী মানুষ মনে হয়।
ক’জন পুরুষ মানুষের এমন সৌভাগ্য হয়। রুপকথার গল্পের মত সবার ভাগ্যে রাজকন্যা থাকে না! তবে স্বপ্ন সবাই থাকে।

কিংশুকের কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগছে। ভীষণ ইচ্ছে করছে সেই শুভ্রতার মুখটা আবার দেখতে। এই এখনি সে দেখতে পেল, টকটকে লাল শাড়ি পরিহিত এক নারী। ভেজা চুলের টপাটপ পানি পরছে, নির্মল চাহনি। ইশ্, কী সুন্দর!
এই অচেনা শহরে, অচেনা এক মেয়ে তার হৃদয়ে জায়গা বানিয়ে নেলো।
সেই থেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই রইল কিংশুক। মনের চোখে মুখটা এখনো ভাসছে, এমন অনুভূতি তো কখনো তার হয়নি! কত মেয়েই তো দেখল সে! এমন ভালো লাগেনি তো কখনো!
হে ব্যস্ত শহরের অচেনা পরী, মনটা যে আমার তোমার তাড়নায় কেমন যেন জ্বলছে, পুড়ছে। তুমি কী দেখতে পারবে কখনো!

হঠাৎ ফোনের রিংটোনে কিংশুকের হুশ ফিরে, বাসা থেকে তার বাবা ফোন দিয়েছে। সে ঢাকার পৌঁছে গেছে জানিয়ে রেখে দিলো। এরপর কারো নাম্বারে ম্যাসেজ করল। বাসার কলিংবেল বাজালো।
ভীষণ অস্থির লাগছে কিংশুকের, এই দরজা দিয়েই তো মেয়েটি ঢুকেছে। খুব ভুল না হলে, এই বাসায় তার বোন থাকে, সম্পূর্ণ ঠিকানা ডিটেলইসে বলেছিল। আর সেটা বেশ মনেই আছে তার। দরজা খোলার অধীর আগ্রহে সে দাঁড়িয়ে রইল।
এক মধ্য বয়স্ক মহিলা দরজা খুলে দিলো। মহিলাটিকে এক পলক দেখে কিংশুক চমকে উঠল ক্ষানিকটা। মনে মনে এই দেখবে বলেও কী সে কখনো আশা করেছিল!

কলিং বেল পেয়ে বিভাবরী বেগম দরজা খুলে দিলেন। সামনে একজন তরুণ ছেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। লম্বা, চওড়া, উজ্জ্বল শ্যামলা, চাপদাড়ি, পোশাক আশাকে ভদ্র ছেলের মতই লাগছে। কিছ ক্ষণ দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, “কী চাই?”

“জি, আমি কিংশুক। আমার বোন যামিনী। ওর কাছেই এসেছি।”

মাত্র সকাল হলো। এভাবে অচেনা একটি ছেলেকে ভিতরে ঢুকতে দিবেন কিনা তিনি বেশ চিন্তায় পরে গেলেন। কারণ, বাসায় তারা শুধুই তিনজন মেয়ে মানুষ। ছেলেটিকে অবিশ্বাস না করলেও, ভয়টা হয়ই। মায়ের মন, সন্তানের চিন্তা সবার আগে। তিনি দরজা আধো খোলায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন। কিংশুক কিছুটা অসস্থিতে দাঁড়িয়ে রইল। কী বলবে আর, ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে!

বিভাবরী বেগমের ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক আনোয়ার চৌধুরীর। সব এপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়ে দুই ছেলে সন্তানসহ সস্ত্রীক এখানেই থাকেন। তবে, তিনি বর্তৃানে বিদেশে আছেন। ছেলেরা যথেষ্ট বড় হয়েছে, দায়িত্ব সামলাতে পারে। তাই তিনি নিশ্চিন্তে বিদেশে ছেলেদের ভালো ভবিষ্যতের আশায় টাকা রোজগার করছেন।

আনোয়ার চৌধুরীর ছোট ছেলে প্রিয়ম চৌধুরী। ভার্সিটিতে পড়ে। যেমন সুদর্শন ছেলে, তেমনি তার গানের গলা। এত সুন্দর সুর তুলতে পারে, সবাই মুগ্ধ না হয়ে পারে না! ভার্সিটি ব্র্যান্ডের সাথেও যুক্ত। প্রতিদিন সকালে সবাই মিলে রেওয়াজ করে। এমনিতে ভদ্র স্বভাবের, তবে স্থানীয় ছেলেরা ঝগড়া, ঝঞ্জাট, সমস্যায় সব সময় ক্ষমতা দেখিয়ে থাকে। এলাকার ছেলে মেয়েদের শহরে একটা গুমোট ভাব নিয়ে চলাফেরা না করলে যে আবার আধুনিক প্রমান হয় না , সেরকমই।

সে সময়ে প্রিয়মের সাথে তার মাও বাহিরে এসেছিল, সামনের দরজায় একটা অচেনা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকতে আর বিভাবরী বেগমের আধ খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুজনেই এগিয়ে এলেন।
প্রিয়মের সাথে মিসেস আনোয়ার চৌধুরীও বললেন,
” কী হয়েছে আপা, কোনো সমস্যা? ”
” কী হয়েছে আন্টি, এই ছেলেটি কে? ”

কিংশুক একটু অসহায়বোধ করল, কিন্তু বেশী ঘাবড়ালো না, তার বোন তো এখনো বেরিয়ে এলো না। হয়ত, এভাবে একটা অচেনা ছেলেকে ঢুকতে দিতেও পারছেন না, সেটা কিংশুক বুঝতে পারছে!
বেশি ঝামেলা না হলেই হয়!
প্রিয়মকে দেখে বিভাবরী বেগমের একটু সাহস এলো। এখন ভালো মত পরিচয় নিয়ে বাসায় রাখা যাবে। মিসেস আনোয়ারকে দেখে স্মিথ হেসে বলল,
“ছেলেটি বলছে, আমাদের বাসার ভাড়াটিয়া যামিনীর ভাই।”

প্রিয়ম গম্ভীর ভাব নিয়ে কিংশুককে প্রশ্ন করল, আপনার নাম কী? বাসা কোথায়?
কিংশুক সহজ স্বাভাবিক উত্তর দিলো, ” জি, আমার নাম কিংশুক, আমাদের বাসা ফরিদপুর।
“কখন এসেছেন?”
” কিছুক্ষণ হলো এসেছি।”
” এর আগে তো কখনো দেখিনি।”
” জি, আজ প্রথম এলাম। ”
“ওহ, তা কী কাজে এসেছেন?”

মিসেস আনোয়ার প্রিয়মকে থামিয়ে বলল, আহ্, প্রিয়ম, থামো তুমি। এত প্রশ্ন করছ কেন! আপা আপনি বরং যামিনীকে ঢেকে দিন।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

বিভাবরী বেগম ভিতরে চলে গেল যামিনীকে ডাকতে। প্রিয়ম তার মা আর কিংশুককে শুনিয়ে বলল, আহা মম, অচেনা লোকটা কোথা থেকে এলো, কী কাজে এলো। সবটা জানা প্রয়োজন। এখানে একটা সেফটি আছে না। যেন, কোনো বিপদ না হয়। হঠাৎ কেউ এলেই তো বাসায় ঢুকতে দেওয়া যায় না! পরবর্তীতে বিপদ হলে জবাবদিহি তো আমাদরেই করতে হবে। লোকটা সত্যি বলছে কিনা, যাচাই করে নিতে হবে।

ছেলের বাড়তি কথায় মিসেস আনোয়ার গম্ভীর চেহারায় কিংশুকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। কে জানে, কী ভাবছে! এভাবে জেরা করতে হয়।
” বাবা, তুমি কিছু মনে করো না। ও এরমকই বলে। আসলে, এই বিল্ডিংয়ের সবার জন্য কিছু রুলস রেগুলেশন আছে তো।

কিংশুক জবাবে মৃদু হাসল। প্রিয়মের ব্যবহারে সামান্য বিরক্ত হলেও, এসব কথা শুনে খুশিই হলো। এত সুন্দর কথাগুলো বলল, আসলেই, এতটা সাবধান না থাকতে হঠাৎ বিপদ হলে, তখব ক্ষতী দেখা ছাড়া কী বা করার থাকে।

” ইট’স ওকে আন্টি। আমার ভীষণ ভালো লাগছে যে, আমার বোন এখানে অনেক ভালো আছে, সেইফ আছে। আমার সকল তথ্য জানা আপনাদের নায্য অধিকার। হঠাৎ কেউ আসলেই তাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।

প্রিয়ম একটু দমে গেল। মনে মনে ভাবল, ছেলেটার কথা শুনে বেশ ব্যক্তিত্ববান মনে হলো। সব কিছুতেই বেশ যুক্তি দেখিয়ে সুন্দর জবাব দিতে পারছে দেখছি। এ নিশ্চয় কোনো ছ্যাছড়া ছেলে হবে না।
কিংশুকের জবাবে মিসেস আনোয়ার চৌধুরীও বেশ সন্তুষ্ট হলেন।

” দা’ভাই! এসে গিয়েছ তুমি।”
কিংশুককে দেখে যামিনী দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। বিভাবরী, মিসেস আনোয়ার ভাই বোনের মিলন দেখে উজ্জ্বল হাসলেন। শুধু প্রিয়ম মুখটা বেঁকালো। যতসব আদিখ্যেতা!
“মম, আমি আসছি।”
“আচ্ছা, যাও, সাবধানে যেও।”
প্রিয়ম আর অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে।

যামিনী বলে,
“আন্টি, এই আমার দা’ভাই। যার কথা আমি সব সময় আপনাদরে বলেছি। আপনাদের কোনো সংশয় নেই, আমার দা’ভাই ভীষণ ভালো। আমাদের সাথে দেখা করতে গ্রাম করতে এসেছে, আজই হয়ত চলে যাবে।
প্রিয়ম যেতে যেতে কথাগুলো শুনছিল, আর ভেংচি কাটছিল, ভালো না ছাই, গাইয়া ভূত একটা হাহ্!
মিসেস আনোয়ার বিনয়ী স্বরে বললেন, আচ্ছা, যাও তোমার ভাইকে ভিতরে নিয়ে যাও। আপা, আমি বরং বাসায় যাই, নাস্তা শেষে আসব।

বিভাবরী বেগম মাথা দুলিয়ে হেসে কিংশুককে ভিতরে ডাকলেন, এসো বাবা এলো। নারাজ হইও না, আমরা একা থাকি। পুরুষ মানুষকে হঠাৎ বাসায় ঢুকতে দিতে পারি না বলো।

প্রেম নিচে নামতে নামতে দেখলে, শিখিনীর বাসায় একটি ছেলে ঢুকল। কপাল কুঁচকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। মিসেস আনোয়ার চৌধুরী ছেলেকে দেখতে পেয়ে বললেন, প্রেম, আজও তুমি সারারাত চিলেকোঠার রুমে ছিলে!
প্রেম গজগজ করে নেমে বাসায় ভিতরে গিয়ে শুধু বলল, খাবার দাও, খিদে পেয়েছে!
ছেলের এহেম ব্যবহারে মিসেস আনোয়ার বরবরাই অসন্তুষ্ট হোন।

দুপুর হতে চলল, কিংশুক বাসাটা ঘুরে ফিরে দেখল। সকালের চা জল খাবার খেল। আর যামিনীর এতদিনের ঢাকায় থাকার বকবক শুনতে শুনতেই সময় কেটে গেল।
এরমাঝে একবারও সেই শুভ্র, নির্মল মুখের মানুষটার দেখা মিলল না। এই বাসাতেই তো ঢুকল, তাহলে!
যদিও সে দেখেছে, একটা রুম বন্ধ! হয়ত সেখানেই আছে!
চলে যাওয়ার আগে কী একবার সে মানুষটার সাথে এক নজর দেখা হবে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here