#বিদায়_বরণ
২১ পর্ব
#মেহরুন্নেছা_সুরভী
.
– বিভার মেয়ে তো মাশাল্লাহ ভালো বড় হয়েছে। তা মেয়ের বিয়ে হয়েছে নাকী বিভা? বয়স তো আহামরি কম নয়, সেই ছোট বয়সে দেখেছিলাম।সেরকমই মোটাতাজা আছে দেখছি। তা মেয়ে, তোমার নামটা যেন কী?
বিভাবরী বেগমের গ্রামের এক প্রবীণ চাচি কথাগুলো বলল। বিভাবরী বেগম এসেছে শুনে সারা গ্রামের মানুষজন জেনে গিয়েছে। মহিলারা সকাল, দুপুর, সন্ধ্যের সময় এসে ভিড় জমাচ্ছে। হাজারো কথা, হাজারো প্রশ্ন, তার সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখা।
মনে হচ্ছে, বাড়িতে বিশাল এক আয়োজন বসেছে। লোকজন সব সে আয়োজনে সামিল হয়েছে।
গ্রামে এই এক বিষয়। বিয়ে আর মৃত্যু বাড়িতে লোকজনের অভাব পরে না। আর যদি গ্রাম ছাড়া একটি মেয়ে পুনরায় ফিরে আসে, তাহলে তো কথাই নেই। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসবে, আর এমন ভাবে দেখবে, যেন এরা চিরিয়াখানার কোনো প্রাণী!
শিখিনীরা এসেছে মাত্র একদিন হলো। এর মাঝেই সারা গ্রামের মহিলারা এসে ভিড় জমিয়েছে। যারা বিভাবরী বেগমের বড় বা বয়সে সমান, তারা এসে বিভাবরী বেগমকে আসটে ধরেছেন। কথার যেন শেষ নেই।
আর যামিনীর বয়সী কিছু মেয়ে এসেছে শিখিনীর প্রতি উৎসুক হয়ে। শিখিনীর বয়স কত, শহরে মেয়ে, দেখতে যেমন মাশাল্লাহ। কতদিন থাকবে? এমন কী এরা বিয়ে নিয়েও বলতে দ্বিধা করছে না।
চারপাশের এই কোলাহল শিখিনীর বেশ ভালোই লাগছে। নানা জনের মুখে নানান কথা শুনতে আর এত ভালো লাগছে।
গতদিন যখন তারা বাসায় পৌঁছাল। তখন থেকেই একজন একজন করে আসতে লাগল মহিলারা। কারো দু’একটা কথায় শিখিনীর অসহ্য বোধ লাগছিল। মানুষের চিন্তা ভাবনা সম্পর্কে ওর ধারনাই বা কতটুকু? রুম থেকে বাহিরে বের হতেই ইচ্ছে করছিল না। তখনি যামিনী এসে বলল,
– শুনো শিখিপু, তুমি তো কখনো গ্রাম, মফস্বলের মানুষ সম্পর্কে জানো না। এরা একেকটা অভিজ্ঞ প্রাণীর মত জ্ঞান দিয়ে থাকে, কিন্তু এদের জ্ঞানের ভাড় একেবারে শূন্য। তুমি একদম অসহ্য হবে না। শুধু এদের কথা শুনবে আর মজা নিবে, বুঝলে। এরা যে কত রুপের, কত ধরনের কথা বলতে পারে, তোমার ধারণা র বাইরে। কেউ ভালো বলবে, কেউ খারাপ। তুমি শুধু দেখতে থাকো, এদের রুপ। এরা শুধু অন্যের জীবনকে খুঁচা মারতেই জানে, একবেলা খাওয়ানোর সময় দেখবে, এরা তোমার তৃ সীমানায় পা রাখবে না। দেখো শুধু।
সেই থেকে শিখিনী শুধু মানুষের কথা শুনে, আর মনে মনে হাসে। কখন কাকে কীভাবে ঠেস দিয়ে কথা বলতে হয়, উচিত কথার জবাব দিতে হয়। সেটাও নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।
সন্ধ্যার পর মানুষ কমে এলে শিখিনীর বেশ আরাম লাগে। চারপাশের পরিবেশটা বেশ ঠান্ডা। কোনো যানবাহনের টু শব্দ নেই। কেমন নিঃস্তব্ধ, কোমল পরিবেশ।
এশার আজানের সময় বিভাবরী বেগম উঠোন ছেড়ে উঠতেই পারেননি। তার পাশে অবশ্য বাহার সাহেব বসে ছিলেন। যেন গ্রামের মানুষজন তার বোনকে কোনো কটু খারাপ কথা না বলতে পারে। মহিলারা বিভাবরী বেগমের চারপাশ ঘিরে বসে ছিলেন। হাজারো কথাবার্তা চলছিলই। শিখিনীরা অবশ্য বাসার ভিতরেরই বসে ছিল।
সকালে ফেরার পর থেকে কিংশুককে সারাদিন আর দেখা যায়নি। শুধু দুপুরে একবার খেতে এসেছিল। দুপুর পর্যন্ত সাখাওয়াত ঘুমেই ছিল সকালের নাস্তা শেষে। এরপর কিংশুকের সাথে বেরিয়ে গিয়েছিল। দু’জনে যে কোথায় গিয়েছিল। কে জানে?
রাত বাড়লে মানুষজন চলে যেতে থাকে। বিভাবরী বেগম ভিতরে এসে শিখিনীর সাথে কথা বলার একটু সময় পায়।
-কেমন লাগছে তোমার কাছে?
-ভালো মা, খারাপ নয়। তোমার কেমন লাগছে?
– উফ, মানুষের এত কথা।
– আমরা ঢাকা কবে ফিরছি মা?
বিভাবরী বেগম উত্তর না দিয়েই চলে গেলেন। মাথা যন্ত্রণা করছে তার। রাতের খাবার সবাই একসাথে খেয়ে যার যার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। সাখাওয়াত সারাক্ষণ কিংশুকের সাথেই রইল।
ইয়ামিনি বিভাবরী বেগমকে ছাড় ছিলই না। বাচ্চা মেয়েটা। ভারী আদর পেয়েছে বিভাবরী বেগমের থেকে।
যামিনী আর শিখিনী এক রুমে ঘুমাল। রাতের ঘুমাতে গিয়ে শিখিনীর বেশ আরাম লাগল। এত শান্ত পরিবেশ, শিখিনীর মনের ভিতর অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে।
-যামিনী, তোমাদের গ্রামের পরিবেশ কত সুন্দর। এত শান্ত। কোথাও যানবাহনের শব্দ নেই। চারপাশটা এত নিস্তব্ধ।
যামিনী সাগ্রহে বলে, “হ্যাঁ, জানো ঢাকায় প্রথম দিকে এই নিয়ে আমার খুব কষ্ট হতো। সারাক্ষণ চারপাশ থেকে এত শব্দ ভেসে আসত। রাতে তো মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যেত। অথচ, গ্রামের পরিবেশ কত শান্ত।
– আমার ভীষণ ভালো লাগছে জানো যামিনী। মনে হচ্ছে আমি যেন প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছি।
শিখিনীকে জড়িয়ে ধরে যামিনী বলে, ” কিছুদিন থাকো, দেখবে আরো ভালো লাগবে। ”
সকালে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে শিখিনীর ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে পাশে যামিনী নেই। বিছানা ছেড়ে রুমের বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। একতলা বিল্ডিংয়ের চারপাশে চারটা রুমের সাথেই বেলকনি লাগোয়া।
শিখিনী এখন দক্ষিণ পাশের বেলকনিতে। বারান্দার গ্রিল ধরে বাহিরে থাকায়।
সকালের ঠান্ডা হাওয়া। বাড়ির চারপাশে যথেষ্ট জায়গা আর গাছ লাগানো।
বাহিরের পরিবেশ দেখে শিখিনী আনন্দে লাফিয়ে উঠে। তার সামনে ঘাটলা বাধানো দিঘি। এতদিন সে শুনেই এসেছে, আজ প্রথম দেখল। সিঁড়ি বাধানো ঘাট। কী সুন্দর সচ্ছ জল। বেলকনি থেকে সামনের পাশটাই দেখা যায়। দিঘিতে কেউ গোছল করছে।
শিখিনী আনন্দে ওয়াও বলে চেঁচিয়ে উঠে।
শিখিনীর আওয়াজ শুনেই সিঁড়ির আড়াল থেকে সাখাওয়াত বেরিয়ে আসে।
-সাখাওয়াত!
-আরে শিখিপু, দিঘিতে গোছল করবে নাকী!
-তুই করেছিস?
– ইয়াহ্, করব, হাহাহা।
– আমিও করব তবে। ইয়েহ্!
কিংশুক গোছল করছিল। ডুব দিয়ে উঠেই শিখিনীর আওয়াজ পায়। ফিরে তাকিয়ে সিঁড়ি তে উঠে দাঁড়ায়।কিংশুককে দেখেই শিখিনী অপ্রস্তুত দাঁড়িয়ে থাকে।
কিংশুক একদম খোলা শরীরে। শুধু লুঙ্গি পরে আছে। গায়ের কালো পশম গুলো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
শিখিনীকে হঠাৎ এক নজর দেখতে গিয়ে দু’জনেই অপ্রস্তুত হয়ে পরল। শিখিনী এমনিতে টপস আর গেঞ্জি পরে। তবে, গ্রামে এসে এটা তার রাতে না পরলেই ভালো হতো।
আরেক নজর কিংশুককে দেখেই শিখিনী ভিতরে চলে গেল। ছি, ছি, সকাল সকাল কী একটা ঘটনা ঘটে গেল তার সাথে!
যামিনীকে বলে ভিতরের বাথরুম থেকেই ফ্রেশ হয়ে একটি থ্রিপিস পরে নিলো শিখিনী।
এরপর শুরু হলো আরেকদফা মহিলাদের আনাগোনা। যারা গতকাল আসেনি, তারা আজ আসতে শুরু করেছে।
মানুষের ভিড়েই কোনো ভাবে খাওয়া শেষে বিভাবরী বেগমের সাথে বসে ছিল শিখিনী। তখন থেকেই এসব কথাবার্তা চলছে। কেউ এসে জিগ্যেস করছে, মেয়ের বিয়ে দিতেই দেশে এসে নাকী বিভা? কেউ বা এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে, যাক, শেষমেশ ফিরলে দেশে, বেশ করেছ। আর কতকাল অভিমান করে থাকা যায়। তোমার ভারী অন্যায় হয়েছে বিভা। মহিলা মানুষের এত জেদ করা ভালো না। তবুও ভালো, তোমাদের সাথে খারাপ কিছু হয়নি। শহরে তো কত কী ঘটে, কত কী শুনি।
মানুষের এহেম কথাবার্তা শুনে শিখিনী মনে মনে শুধু হাসে। কত ধরনের কথা, কত রুপের কথা মানুষের।
তবে, এতকিছুর মাঝেও কয়েকজন তাদের জন্য ফলমূল, বিভিন্ন খাবার, পিঠে এনে দিচ্ছে। বিষয়টা শিখিনীর বেশ লাগছে। কত রকমের ফল, পিঠে। এক একজনের হাতের রান্না। এসে থেকে শুধু সে খেয়েই যাচ্ছে। সময়টা যেন তাদের দ্রুত চলে যাচ্ছে।
ভালো সময় অবশ্য দ্রুতই চলে যায়। শিখিনী এত আনন্দের মাঝে প্রেমের দেওয়া কষ্টটা ভুলেই গেল। এক একটা মুহূর্তের কথা সে প্রেমকে সানন্দে গিয়ে বলবে, সেটা ভাবতেই তার হৃদয়ে আরো আনন্দ বয়ে গেল।
চলবে…