#বিধবা_বিবাহ (দশম পর্ব)
একচিলতে ঘরে রোদের কণা প্রবেশ করতেই বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো ঐশী। চরম মানসিক উদ্বিগ্নতায় ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে রাত্রি পার করলেও ক্লান্তির ছিটেফোঁটা জেঁকে বসেনি ওর উপরে। গতকাল রাত্রে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে আজকের পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে মনে মনে। একদিনের সিকলিভ শেষে আজ অফিসে যেতেই হবে, তারপর বাড়ি ফেরার আগে অরিন্দমের কেসটা নিয়ে একবার থানায় যেতে হবে।পর্যাপ্ত এভিডেন্স না থাকায় পুলিশ যে ব্যাপারটা তেমনভাবে এলেম দিচ্ছেনা কেসটা, সেটা ওর মাথায় গেঁথে বসেছে ততক্ষনে।
তাছাড়া মায়ের কাছ থেকে অন্য ঘরের চাবিও নিতে হবে, এই ছোট্ট ঘরে দুটো মানুষ কাটানো যে কিরকম অসুবিধেজনক, সেটা ভালোমতই বুঝতে পারছে ঐশী। সেইমতো মুঠোফোনটা চার্জ থেকে খুলে স্নানঘরে পা বাড়াতেই চোখটা আটকে গেলো সেখানেই। অতনুর তরফ থেকে সাতটা মিসডকল জ্বলজ্বল করছে সেখানে। কিন্তু মনের মধ্যে চেপে বসা বিতৃষ্ণার দরুন আর কলব্যাক করার ইচ্ছে জাগলোনা ওর। অরিন্দমের কীর্তিকলাপ পিসির কানে ঢালার ফলে ওর মনটা যে এখনও সমে নেই, তা বলাই বাহুল্য। তাই ফোনটা ওইভাবেই রেখে ঐশী পা বাড়ালো স্নানঘরে।
স্নান সেরে পোশাক পরে খাবার টেবিলে বসতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে একঝটকা খেলো ঐশী। মা আর পিসি দুইজন মিলে রান্নাঘরের কাজ সামলাচ্ছে। লাবনীর চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। এমনকি টিয়া, তুতুনও নেই। অন্যান্য দিন এই সময় দুই ভাইবোন ঘরটা মাতিয়ে রাখে, প্রায় পিঠোপিঠি দুই ভাইবোন হাজার রকম শব্দের জাল বুনতে বুনতে প্রায় ব্যতিব্যস্ত করে রাখে তাদের আদরের পিসিকে।
অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়ার অলিখিত ছেদ পড়লে ছন্দপতন হয় বৈকি। ভাইঝি, ভাইপোকে না দেখে ঐশীর মনটাও তেমনটা খানিক কুডাক ডেকে উঠলো। গতরাতে দাদা বৌদির কর্ণার থেকে খানিক চিল্লামেলির আওয়াজ শুনেছিল বটে।
“কিন্তু তার জন্য ঘরের বাইরে বেরোবেনা?” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী,”নাকি টিয়া, তুতুনকে সাথে নিয়ে বৌদি ফের চলে গেলো বাপের বাড়িতে!” কৃষানুর সাথে ঝগড়া করে লাবনী যে আগেও এমন বাপের বাড়ি গিয়েছে, সেটা এখনও ঐশীর স্মৃতিকোটরে উজ্জ্বল।
“মনি, আরেকটা মাছ দেই? আর এইটুকুন ভাতে হয় নাকি!” বলে বাসন্তীলতাদেবী ওর পাতে আরেকটা মাছ তুলে দেওয়ার উপক্রম করতেই ঐশী ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে। তারপরই পিসির হাতে লেগে থাকা মাছের ঝোলটা দেখে প্রায় চমকে উঠলো ও। সাদাথানকে নিজের জীবন বানিয়ে নেওয়া বাসন্তীলতাদেবী বৈধব্যের পর মাছ, মাংস খাওয়া তো দূর! স্পর্শকেও এড়িয়ে গিয়েছেন সযত্নে। এমনকি পরিবেশন করতেও এগিয়ে আসেননি কোনোদিন।
“তবে আজ কি হলো!” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী। ননদের এমন কাজকর্ম ঐশীর মায়েরও নজর পড়েছে, কিন্তু লাবনী চলে যাওয়ার কারণেই হোক বা অন্য কোনো অজানা কারণে নিজের মুখ বন্ধ রাখলেন তিনি। মানসিক পরিশ্রান্ততা লেপ্টে থাকলে মানুষ যে আচার বিচারকেও হেলায় ভাসিয়ে দেয়, তা বলাই বাহুল্য।
———–
অফিসের কাজকর্ম সেরে ঐশী বাসে যখন শরীরটা এলিয়ে দিলো তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে গিয়েছে। বাইরের নিভু নিভু আলোর ঘাটতি মেটাতে শহর সেজে উঠেছে হরেকরকম আলোর রোশনাইতে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঐশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো ডিজিটাল খবরের পাতায় চোখ রাখতে।
“স্নানঘরে গোপন ক্যামেরা…গ্রেফতার স্বামী।” হেডলাইনে চোখটা আটকে যেতেই মন দিয়ে খবরটা পড়তে শুরু করলো ঐশী। পড়শী রাজ্যে এক গৃহবধূর সাথে ঘটেছে এই নিন্দনীয় ঘটনা, এমনকি অভিযুক্ত জানিয়েছে নিজের ধর্মপত্নীকে বিক্রি করে দেওয়ার ছকও কষে রেখেছিল মনে মনে।
রাজ্যের নামটা চোখে পড়তেই ভ্রূ দুটো কুঁচকে গেলো ওর। “অবিনাশও তো এই রাজ্যেই বিয়ের পর পর চলে গিয়েছিল।” বিষাক্ত স্মৃতিটা ফিরে আসতেই আগ্রহটা চেপে বসলো যেন।
“পয়সার লোভে নিজের পরিবারকে পণ্য করে তোলার চক্রান্তে স্বামীকে চোদ্দ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সন্দেহ করা হচ্ছে এই ‘নীল’ চক্রে অনেকেই যুক্ত। পুলিশ তাদের খোঁজে খবরি লাগিয়েছে।” সম্পূর্ণ খবরটা রুদ্ধশ্বাসে পড়ার পর থম মেরে বসে পড়লো ঐশী। নিজের জীবনের সাথে নিখুঁত সাদৃশ্য পেয়ে মনটা কেমন খারাপ লাগায় ভরে উঠলো। পার্থক্য এটাই এখানে অভিযুক্ত স্বামী, আর ওর নিজের জীবনে স্বামীর ভাই।
“কিন্তু, অরিন্দম তো কখনও আমাদের স্নানঘরে ঢোকেনি।” বাইরের শহর দেখতে দেখতে আপনমনেই বলে উঠলো। চোখের সামনে পিছিয়ে যেতে থাকা দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে অগুন্তি স্মৃতিকথন ভিড় করছে ওর মানসপটে। বিয়ের পর কালরাত্রির স্মৃতি, বৌভাতে ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান, অবিনাশের অকৃত্রিম অভিনয়, মায়ের উৎকণ্ঠা সব মনে পড়ে যাচ্ছে একে একে। বিয়ের পর একবছর বাইরে কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে ঘরের সজ্জায় কিছু অদলবদল করেছিল অবিনাশ। এনক্লোসার শাওয়ার রুম বসানো থেকে শুরু করে এককোণে মার্বেলের বাথটাবও অ্যাটাচ করেছিল অবিনাশ। আর সেই স্নানঘরটা ছিলো একেবারেই ব্যক্তিগত। ঐশী আর অবিনাশ মিলেই ব্যবহার করতো সেটা।
“তবে কি অবিনাশই সজ্জায় রদলবদলের অছিলায়…!” সদ্যসদ্য জেগে ওঠা চিন্তাটা মাথায় ভেসে আসতেই একঝটকা খেলো ও। নিজের মৃত স্বামীর প্রতি বিদ্বেষটা বেড়ে উঠলো সুতীব্রভাবে।
বস্তুত অবিনাশের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালো ধারণা বেঁচে নেই ওর মনমধ্যে। “তবে কি অবিনাশও এই গ্যাং এর সদস্য! যে মুখ লুকিয়ে নিজের ক্লিপস বেচে অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে নিজের বউকে পণ্য বানাতে চেয়েছিলো?” সন্দেহটা যে নেহাতই অমূলক নয় সেটা প্রতিবেদনের একটা অংশ পড়ার পর স্পষ্ট,”অভিযুক্তের কল ডিটেইল চেক করার পর অনুমান করা হচ্ছে এই চক্র পাশের রাজ্যেও বিন্যস্ত।”
“কিন্তু, ক্লিপটা অরিন্দমের হাতে পড়লো কীকরে! অরিন্দম তো কখনও রাজ্যের বাইরে যায়নি।” পরিষ্কার মাথায় চিন্তাটা ভেসে আসতেই এক ঝটকা খেয়ে চলন্ত বাসের সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ঐশী। স্টপেজ এসে গিয়েছে ততক্ষনে।
এমন সময় মুঠোফোনটা সশব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই পথরোধ হয়ে গেলো ওর। ডিজিটাল স্ক্রিনে ফুটে ওঠা আননোন নাম্বারটা দেখে ভয়ে ভয়ে রিসিভ করে বলে উঠলো,”হ্যালো।”
“নমস্কার ঐশী ম্যাডাম, আমি ভট্টাচার্য পরিবারের ফ্যামিলি ল ইয়ার বলছি। আপনার সাথে গতকাল রাস্তায় দেখা হয়েছিলো মনে আছে আশাকরি?” ওপ্রান্ত বলে উঠলো এবারে।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।” আচমকা এমন ফোন আসায় খানিকটা বিব্রত হলেও মনের ভাব চেপে রেখে বলে উঠলো ঐশী।
“অনন্ত ভট্টাচার্য, আই মিন আপনার শ্বশুরমশাই মাসতিনেক আগে উইল চেঞ্জ করেছিলেন। ছেলে মারা যাওয়ার আগেই ওনার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়। যদিও অবিনাশবাবু কোনোদিন চাননি এই চেঞ্জিং। কিন্তু অনন্তবাবু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন, আর উনি যেহেতু তখনও বেঁচে ছিলেন, তাই আপনাকে জানানোর প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আপনি ওবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর স্যারের মৃত্যু ঘটে, আর ভাগ বাটোয়ারা প্রসঙ্গ এসে পড়ে।” ওপ্রান্ত একদমে বলে গেলো এবার। “যদিও মিসেস অনন্ত ভট্টাচার্য এই ব্যাপারে আপনাকে জানাতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু বুঝতেই পারছেন পারসোনাল কনফ্লিক্ট বজায় রাখা আমাদের ডিউটির মধ্যে পড়েনা।”
“উইল! কিসের উইল?” ভদ্রলোকের কথা শুনে ঐশী মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন ততক্ষনে।
“মিস্টার অনন্ত ভট্টাচার্য ওনার গোটা সম্পত্তির একটা বড়ো অংশ আপনার নামে রেজিস্টার করে দিয়ে গিয়েছিলেন, বাদবাকি দুই ছেলের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন।” ওপ্রান্ত বলে উঠলো ঐশীকে উদ্দেশ্য করে,”আশা করি আগামীকাল আপনি ফাঁকা আছেন?”
“আমি এখন থানায় যাচ্ছি, আপনি কি একবার থানায় আসতে পারবেন? আমি উইলের কপিটা পুলিশের কাছে সাবমিট করতাম। কারণ আমার মনে হচ্ছে কোথাও না কোথাও এর একটা লিংক আছে।” বলে অরিন্দমের কার্যাবলী একনাগাড়ে বলে গেলো ঐশী।
“ঠিক আছে, আমি আসছি।” বলে লাইনটা ডিসকানেক্ট করে দিলেন তিনি।
——-++++——-
“কিন্তু একটা মানুষ কীকরে বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে অফিসার! ও যে আমাকে রীতিমত শোয়ার জন্য ব্ল্যাকমেইল করছে, হুমকি দিচ্ছে বিয়ে করবে। নিজের বউকে ডিভোর্স দেবে।” অফিসারের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে ক্লান্তস্বরে বলে চলেছে ঐশী। অরিন্দমকে যে পুলিশ এখনও খুঁজে পায়নি তা বলাই বাহুল্য।
“দেখুন ম্যাডাম, আপনার কথামত আমাদের নতুন স্যার অরিন্দমের বাড়িতে ফোর্স পাঠিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখানে নেই, এমনকি ওনার পার্সোনাল মোবাইলটা ট্র্যাক করেও কিছু হদিশ মেলেনি। এমনকি যে নাম্বারটা আপনি দিয়েছেন সেটাও পড়শী রাজ্যের, এই রাজ্যের নয়। তবে কিভাবে তদন্ত এগোবে বলুন!” অধৈর্যের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন লেডি অফিসার।
“কোন রাজ্য বললেন?” বলতে বলতে ঐশী সেই হেডলাইনের ছবিটা মেলে দিলো অফিসারের সামনে। নীল ছবি চক্রের খবরটা জ্বলজ্বল করছে সেখানে।
“দেখি,” বলে মুঠোফোনটা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন অফিসার, সেদিকে তাকিয়ে ঐশী বলে উঠলো এবারে,”আমার মৃত স্বামীও ওই রাজ্যেই এক বিশেষ কাজে যেতেন।” তারপর অরিন্দমের তরফ থেকে শোনা সমস্ত কথা উগরে দিলো অফিসারকে।”এমনকি ওই রাজ্যেই আমরা হানিমুন প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু রাস্তায় গাড়িটা ব্রেক ফেল করে আর খাদে গিয়ে পড়ে।” সেই কথা শুনে অফিসারের ভ্রূ জোড়া কুঁচকে গিয়েছে।
“আমার মনে হচ্ছে এই দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনার কোনো যোগসূত্র নিশ্চয় আছে, কারণ আমার কাছে সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকলেও অরিন্দম বলেছিলো নিজের দাদার স্বরূপ। তখন অবশ্যি একাউন্ট ডিলিট করা হয়নি, ইনফ্যাক্ট আমাকে ফোন করেও ডিস্টার্ব করতো।” কললগটা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো ঐশী।
“আর আপনি এতোদিন ধরে চুপ ছিলেন?” গোটা লিষ্টটা দেখার পর বলে উঠলেন অফিসার,”মানছি সমাজের একটা ভয় থাকে, মেয়ে হওয়ার সুবাদে একটা জড়তা বোধ কাজ করে, কিন্তু এইভাবে মুখ লুকিয়ে কতদিন?” অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলে উঠলেন অফিসার,”আর এতগুলো কানেকটর পাওয়ার পর তদন্তে অনেক অগ্রগতি হবে আশা রাখি। যদিও আমাদের নতুন স্যার আপনার কেসটা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছেন।”
“আর এই যে আমার প্রাক্তন শ্বশুরমশাইয়ের উইলের কপি। ওনার সম্পত্তির অন্যতম ভাগীদার আমি।” বলে কাগজটা এগিয়ে দিলো ঐশী।
“ধন্যবাদ।” অফিসার নমস্কার জানিয়ে উঠলেন এবার,”আই হোপ আপনার স্বামীর অ্যাক্সিডেন্ট কেস রিওপন করতে হবে।”
ক্রমশ..
© সম্প্রীতি রায়
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/173335981113500/
আশা করি ভালো লাগছে সবার সঙ্গে থাকবেন সবাই।