#বিধবা_বিবাহ (একাদশ পর্ব)
“এতক্ষণ কোথায় ছিলিস তুই? মা কতটা চিন্তায় ছিলো জানিস? এদিকে তোর ফোনও সুইচ অফ!”
বাড়ি ফিরে সবেমাত্র স্নান সেরে চুল মুছছিলো ঐশী। এমন সময় দরজার কাছ থেকে ভেসে আসা দাদা কৃষানুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ভ্রূ দুটো কুঁচকে গেল ওর। বাপের বাড়ি ফিরে আসার পর কোনোদিন মনের ভুলেও অফিসফেরতা বোনের খোঁজ খবর নেয়নি কৃশানু। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়তো বেডরুমে। তাই অলিখিতভাবে ছন্দপতন হলে খটকা লাগা স্বাভাবিক বৈকি।
“কাজ ছিলো অফিসে, তাই দেরি হয়ে গিয়েছে। মাকে খাবারটা টেবিলে সার্ভ করতে বল। এক্ষুনি আসছি।” বলে আধভিজে চুলের গোছাটা ক্লিপ দিয়ে এঁটে নিলো সে। উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে থানা পুলিশের ব্যাপারটা কৃশানুর থেকে চেপেই রাখলো আপাতত। বোনের দুরাবস্থার কথা জানলে দাদা হিসেবে কতটুকু সাহায্য করবে কৃষানু, সেটাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ঐশীর।
“বেগুন ভাজাটা ফের আমার পাতে দিয়েছো?” বলতে গিয়েও চুপ করে গেলো ঐশী। একই রকম দেখতে দুটো থালার একটায় আলুভাজা উঁকি দিচ্ছে, অন্যটায় বেগুন আলুভাজা। বেগুন আলুভাজার থালাটা ঐশীর মা ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন ততক্ষনে।
“বস, আজ এত দেরি করে ফিরলি?” বলতে বলতে চেয়ারটা টেনে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন সবিতা চক্রবর্তী, সম্পর্কে ঐশীর মা।
“তুমি এখনও খাওনি?” ডালের বাটিটা থালায় উপুড় করে বলে উঠলো ঐশী। আজ রাতের খাবারে ওর প্রিয় পদ উঁকি দিচ্ছে থালার পাশে, ঝুরি ঝুরি করে ভাজা আলু আর ডিম বেরেস্তার মাখো মাখো ভুনা…
“খাবো, আগে তুই খা।” বলে অন্য পদের বাটিটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি,”আর বললিনা যে এতো দেরী কেন হলো?”
“অফিসে খানিক কাজ পড়ে গিয়েছিলো।” এক গ্রাস খাবার মুখে পুরে বলে উঠলো ঐশী। সুস্বাদু খাবারের দলাটার স্বাদ নিতে নিতে মনটা ফিরে গেলো কুমারী বেলাতে। বিয়ের আগে প্রায়শয়ই সবিতা চক্রবর্তী মেয়ের পছন্দমতো রাঁধতেন।
মাছভাতে রুচি না থাকায় ঐশীর পাতে বেশির ভাগদিন ডিমের নানাবিধ পদ উঁকি দিতো। অন্যদিকে কৃষানুর পছন্দমতো মাছের পদও রাঁধতে ভুলতেন না সবিতা চক্রবর্তী। বাড়ির অন্যান্য কাজে মাসকাবারি বন্দোবস্ত থাকলেও দুই ছেলে মেয়েকে নিজের হাতে রেঁধে না খাওয়ালে তৃপ্তি পেতেননা তিনি। সেইমতো সপ্তাহান্তে হোক বা অন্যান্য দিনে, শাকসবজির পাশাপাশি দুই ভাইবোনের প্রিয় পদও তিনি রাঁধতেন সযত্নে।
কিন্তু মায়ের অমতে অবিনাশকে বিয়ে করার পর সেই স্নেহ, যত্নে খামতি পড়েছিল অনিবার্যভাবে।
আজ, প্রায় বছরখানেক পর, ফিরে পাওয়া মায়ের যত্নে চোখের কোণটা ভিজে এলো ঐশীর।
কিন্তু মনের ভুলেও বাড়িতে দেরি করে ফেরার আসল কারণটা মায়ের কাছে উপুড় করে দিলোনা ও। “অবিনাশের স্বরূপসমেত গোটা ঘটনাটা বলে দিলে প্রচণ্ড কষ্ট পাবে মা, তখন আগের মতো দূরে ঠেলে দিলে!” আপনমনে কথাটুকু বলে ঐশী খেতে লাগলো ফের। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জেরে ঐশী যে আবার নতুন করে মায়ের যত্ন ভালোবাসা হারাতে চায় না, তা বলাই বাহুল্য।
“মা, আমি আর পিসি কিন্তু কালকেই অন্য ঘরে শিফট করবো। ওই ঘুপচি ঘরে দুজন মিলে থাকা যায়না। বিয়ের আগে যে ঘরে থাকতাম, সেখানে আমি উঠবো। আর পিসির জন্য অন্য কোনো বড়মাপের ঘর অ্যারেঞ্জ করলেই হবে।”
খাওয়া দাওয়া সেরে হাত ধুতে ধুতে বলে উঠলো ঐশী,”আজকেই শিফট করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এত দেরি হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে!”
“কিন্তু পিসি কেন? আই মিন পিসির ঘর তো রয়েছেই। আবার নতুন ঘর কেন?” আমতা আমতা করে বলে উঠলো কৃশানু। দুইতলা বাড়িতে একাধিক ঘর অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকলেও ঐশীর দাদা যে একখানা ঘর দিতেও রাজি নয়, তা সহজেই অনুমেয়।
“কারণ কোণের স্যাঁতসেতে ঘরটা মানুষ তো দূর, একটা বেড়াল বা কুকুর কাটানোর জন্যও উপযুক্ত নয়।” টাওয়েলে ভিজে হাত মুছতে মুছতে বলে ঐশী,”নেহাত মানুষটা সহ্য করতে জানে, তাই নিজের অসুবিধের কথা না বলে এতদিন মুখ বুজে পরেছিলো ওই ঘরে। কিন্তু আমি আসার পরেই বুঝতে পারলাম এতদিন কি পরিমান কষ্ট সহ্য করেছে মানুষটা। ভাগ্যিস এই বাড়ি বিধবা হয়ে এসেছিলাম আমি।” দাদার দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলে ওঠে ঐশী। “তাছাড়া সবটুকু বুঝেও না বোঝার ভান করা থাকার অসুখের কোনো ওষুধ নেই। স্বার্থপরতাও আজকাল ভীষণভাবে সংক্রমিত হচ্ছে যে!”
ঐশীর সূক্ষ্ম খোঁচাটা ততক্ষণে গেঁথে গিয়েছে কৃশানুর অহংবোধে। একমনে মাছের কাঁটা বাছতে থাকা হাতটা স্থির হয়ে যাওয়াই আপাতভাবে জানান দিচ্ছে কৃষানুর মানসিক উত্তপ্ততা। ছেলের এমন অভিব্যক্তি ধরা পড়েছে সবিতাদেবীর চোখেও। পরিস্থিতিটা রাশ টানতে তড়িঘড়ি বলে উঠলেন তিনি,”আরেকটা মাছ দেবো বাবু?”
“নাহ্, খিদে নেই।” বলে আধখাওয়া ভাতের থালাটা ফেলে রেখে কৃশানু ওঠার উপক্রম করতেই বলে উঠলো ঐশী,”আমার কথাটা শুনে তোর খুব খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটা ভুলিস না এই বাড়ির মালিকানায় আমিও অংশীদার। সুতরাং, নিজের ভাগ থেকে পিসিকে একটা ঘর দেওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই আছে আমার।”
“আচ্ছা সে হবে পরে, কিন্তু এই কথাগুলো কি খাওয়ার সময় না বললেই চলছিলনা?” বোনের উপর রেগে থাকার অভিব্যক্তি স্পষ্ট ঝরে পড়ছে কৃশানুর কণ্ঠস্বরে।
“আর কতরকম ভাবে সমস্যাগুলো থেকে মুখ লুকিয়ে চুপ থাকবো দাদা?” বিন্দুমাত্র নমনীয় না হয়ে বলে উঠলো ঐশী,”তাছাড়া অফিস কাছারিতে ব্যস্ত থাকার সুবাদে খাবার টেবিলেই দেখা হয় আমাদের। সেইমতো এই সময়টাই আমার কাছে বেস্ট বলে মনে হলো।” কথাটুকু বলে ঐশী পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।
“কিরে এত তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে গেলো?” ভাইঝি ঘরে ঢুকতেই কোলে রাখা মাসিক ম্যাগাজিনটা তাড়াতাড়ি সরিয়ে দিলেন বাসন্তীলতাদেবী। আধখোলা ম্যাগাজিনের তেলতেলে কাগজ থেকে দই কাতলার রেসিপি উঁকি দিচ্ছে সেখানে। জনপ্রিয় ম্যাগটা প্রতিমাসেই কেনার অভ্যাস ঐশির। হরেকরকম রান্নার সাথে নানাস্বাদের গল্প, জীবনশৈলীর কাহিনীগাঁথাও সযত্নে কালির ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে সেখানে। সেইমত অভ্যাসবশত এই মাসেও ম্যাগাজিনটা কিনে রেখেছিল ঐশী। সময়ের অভাবে উল্টেপাল্টে না দেখায় ম্যাগটা পড়েই ছিলো ঘরের এক কোণে। কিন্তু আজ, পিসির কোলে দই কাতলার রেসিপিটা দেখে ভ্রূ-দুটো কুঁচকে উঠল ওর। এর আগেও দুই তিনবার রেসিপি দেখার ঘটনা চোখে পড়েছিল বটে। কিন্তু আমল দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি ততটাও। কিন্তু ইদানিং চোখ কান খুলে রাখার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে ঐশীর। সকালে মাছের ঝোল পরিবেশন করা, এখন আবার লুকিয়ে চুরিয়ে দই কাতলার রেসিপি দেখা অস্বাভাবিক বৈকি। একাদশীর উপবাস তথা নিরামিষ খাবারে অভ্যস্ত বিধবা পিসির এহেন কর্মকাণ্ডে যারপরনাই অবাক হয়ে গেলো ঐশী।
“পিসি, তুমি হঠাৎ মাছের রেসিপি দেখছো?” মনমধ্যে ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেললো ঐশী।
“বেশ ভালো লাগছিলো রান্নাটা, তাই উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম আরকি। আমার শ্বাশুড়িমা, মানে তোর পিসের মাও এমন বাহারি রান্না রাঁধতে পারতো, ওনার কাছ থেকে আমিও বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই শিখেপড়ে নিয়েছিলাম। আজ পুরোনো কথা মনে পরে গেলো চোখ বুলোতে বুলোতে।”পিসির কাছ থেকে উত্তর পেয়েও জবাবটা ঠিক মনঃপূত হলোনা ওর। বিধবা রমণীর নিজের শ্বশুরবাড়ির কথা মনে পড়া স্বাভাবিক, কিন্তু তাই বলে দই কাতলার রেসিপির মধ্যে স্মৃতি হাতড়ে বেরানো? “নাহ্, কথাটা ঠিক হজম হলোনা আমার।”আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী।
উপরন্তু পিসি আজ মাছের ঝোলও পরিবেশন করছিলো আমাকে, কাকতালীয় নাকি স্রেফ…?”
“বিছানা পেতে দিয়েছি, শুয়ে পড়। নাকি আকাশপাতাল চিন্তাই করতে থাকবি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে?” ভাইঝি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে জিজ্ঞেস করে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“তোমার মাছভাত খেতে ইচ্ছে করে তাইনা পিসি?” মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা বে’লাগাম প্রশ্নটা ঠিকরে বেরিয়ে এলো ঐশীর মুখ চিরে, খানিকটা ওর অজান্তেই।
বিছানাপাতি গুছিয়ে দিয়ে নিজের এঁটো থালাবাটি মাজতে যাচ্ছিলেন বাসন্তীলতাদেবী। কিন্তু ভাইঝির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে পা দুটো যেন গেঁথে গেলো শক্ত কঠোর মেঝেতে। মনমধ্যে তখন ফুটে উঠেছে নিজের বিষাক্ত অতীত। স্বামী হারানোর পর মিথ্যে অপবাদ নিয়ে এই বাড়ি ফেরা, বৌদির কটূক্তি, পছন্দের খাবারদাবারে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ, কোমর ছাপানো চকচকে সোজা চুলের বিলুপ্তি… আরো কতকিছু। মাথা প্রায় মুড়িয়ে দেওয়ার সেই স্মৃতিতে সময়স্রোতের পলি পড়েনি আজও।
তখন কৃষানু ঐশী খুবই ছোট। বোঝার বয়স থেকে কয়েক পা দূরে। কিন্তু সেই বয়সেই বাচ্চাটা কি বুঝেছিলো কে জানে! মাথানিচু করে বসে থাকা পিসির মনের ভাব বুঝতে পেরেছিল কিনা সেটা বাসন্তীলতাদেবীর কাছে আজও স্পষ্ট নয়। কিন্তু মেরুদণ্ডে গিট্টু পাকিয়ে বসে থাকা কিছু মানুষের মধ্যে বসে থাকা একটা বাচ্চা মেয়ে যুবতী বাসন্তীলতাদেবীর কাছে ছুটে এসেছিলো অবুঝের মতো। ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নাড়িয়ে নাপিতমশাইকে সাধ্যমতো চেষ্টা করছিল বাঁধা দিতে। নিজের মায়ের তত্ত্বাবধানে পিসির চুল কাটছে দেখে ছোট্ট ঐশী মায়ের সাথে ঝগড়াও জুড়ে দিয়েছিলো সেই সময়ে। কিন্তু বালির বাঁধের মতো ধসে গিয়েছিলো সেই চেষ্টা। অন্যদিকে সমাজ সংস্কারের ভয়ে ভীত যুবতী বিধবা মানুষটি টু শব্দটি করেননি। মুখ বুজে সহ্য করে থাকার পালা শুরু হয় তখনই। নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেই পালা চলছে এখনও…
“পিসি বলোনা আমাকে, আমি নাকি তোমার বেস্ট ফ্রেণ্ড। তবে কেন লুকোচ্ছ আমার থেকে?” ভাইঝির প্রশ্ন শুনে অতীতের স্মৃতি পিছনে ফেলে বাসন্তীলতাদেবী ফিরে এলেন বাস্তবের মাটিতে।
খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর ভাইঝির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন তিনি,”ইচ্ছে আর অনিচ্ছের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ফারাক আছে মনি। যতটা থাকে বাস্তবের সাথে কল্পনার। বাস্তবের ইচ্ছেগুলো আমি বয়ে নিয়ে যাই কল্পনায়। তখন মনের গভীরে বাসা বাঁধতে বাঁধতে অনিচ্ছেগুলোই বড্ড প্রিয় হয়ে ওঠে।” পিসির উত্তরটা ঠিক মনঃপূত হলোনা ঐশীর। ফের কিছু বলার উপক্রম করতেই বাসন্তিলতাদেবী ফের বলে উঠলেন,”আমাদের সময়ে স্বনির্ভরতা শব্দটা বইয়ের পাতাতেই শোভা পেত, তাই ইচ্ছে আছে কি নেই খোলসা করতে চাইনা আর। তবে এটাও বলে রাখি বিধবাদের বড়ো জ্বালা। স্বামী হারানোর বেদনার সহমর্মী জোটেনা এদের, জুটলেও ভালোবাসা জোটেনা স্বাভাবিক মানুষের মতো। করুনাকে আঁকড়েই ভালোবাসার নাম দিতে চায়। আর বিধিনিষেধ নিজের গায়ে চাপিয়ে আশা করে সম্মানের। বুঝলি মনি?” ভাইঝির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন তিনি,”হয়তো এই নিয়মের জালে জড়িয়েই এই শ্রেণীটা সম্মানের আশা রাখে চাতক পাখির মতো। বিনিময়ে ইচ্ছেগুলো বেঁচে থাকে কল্পনাতে।
“দরকার নেই এমন সম্মানের যেখানে…” বলতে গিয়েও চুপ করে গেলো ঐশী। শৈশবের সেই অবুঝ মেয়েটার গলা ফের চাপা পরে গেলো। কারণ দরজার আগল ঠেলে ঐশীর মা ঢুকে পড়েছেন ততক্ষনে।
“বৌদি আসো আসো। বলে মশারির একটা কোনা খুলে এগিয়ে দিলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“মনি তুই দাদার সাথে এইভাবে কথা বললি?” বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। কারণ পায়ে পায়ে এগোতে গিয়ে পাশে থাকা আসবাবের কোণে আঘাত লেগেছে তার। ” উফফ মাগো। এত ছোট্ট ঘর, তায় আসবাবে ঠাসা। মানুষ হাঁটা চলা করবে কীকরে!” বলতে না বলতেই পায়ের বুড়ো আঙুলটা চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়েছেন তিনি।
“এবার বুঝলে তো দাদার সাথে অমন ভাবে কেন কথা বললাম? এই যন্ত্রণা আমাদের নিত্যসঙ্গী।” বলে হাতের কাছে থাকা মলমটা এগিয়ে দিলো মায়ের হাতে। সবিতা দেবী তখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বস্তুত ঐশী ততক্ষনে বুঝে গিয়েছে রাতে খাবার টেবিলে ডাকতে আসা কৃষানুর তরফ থেকে আরেকটি সূক্ষ্ম চাল। “চোখ কান খোলা রাখলে অনেক আগেই ভাড়া বসানোর মিথ্যে কথাটা ধরে ফেলতাম আমি।” ঘরের অবস্থার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী।
তারপর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,”তাছাড়া আমি তো তোমাদের ভাগ থেকে পিসির জন্য ঘর নিচ্ছিনা। এই বাড়িতে আমারও অধিকার আছে।”
“আহ্ মনি, ছাড়না। আমার এই ঘরে দিব্যি কেটে যাচ্ছে, আর কয়দিনই বা বাঁচবো।” ঐশীর কথাতে বাঁধা দিয়ে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“যে কয়দিনই বাঁচো, ভালোভাবে বাঁচবে। তাছাড়া বিয়ের আগে এই ঘরটা কি আদৌ তোমার ছিলো? নাকি বিধবা হওয়ার শাস্তি হিসেবে তোমাকে এই ঘুপচিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনটা?” মেয়ের কথা শুনে সবিতাদেবী বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে নিজের ননদ এই বাড়ি ওঠার পর আত্মীয় কুটুম্ব কম কাঁটাছেঁড়া করেনি বাসন্তীলতাদেবীর চরিত্র নিয়ে। তাদের কথা শুনে সবিতাদেবীও গিয়েছিলেন রেগে। ফলত নিজের ননদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল এই ঘরখানিই।
“বুঝতে পারছি তোদের অসুবিধে হচ্ছে, কিন্তু দাদার সাথে ঐভাবে কথা বলাটা কি উচিৎ হলো? লাবনী তো নাতি নাতনিকে নিয়ে বাপের বাড়ি উঠেছে। তেজের চোটে ফোনও করেনি তোর দাদাকে। এই অবস্থায় অফিস কাছারি সামলিয়ে মানুষের মানুষের মনটা এত কথা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকেনা মনি।”
“সঙ্গী হারানোর বেদনা তো আমিও ভোগ করেছি মা। মানসিক পরিস্থিতি কেমন ছিলো সেটা না হয় আবার নাই বললাম, কিন্তু কথা শোনাতে দাদা, তুমি কেউ ছাড়োনি তখন। তোমার ইচ্ছে বিরুদ্ধে বিয়ে করার জন্য এটাও বলে ফেলেছিলে অবিনাশের মৃত্যুর কারণ নাকি একমাত্র আমি।” কঠোর বাস্তব কথাটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলো ঐশী। উল্টোদিকে বসে থাকা অবুঝ মহিলার সাথে আর বিন্দুমাত্র বাক্যালাপে মন টানছে না আর। “যে বোঝার সে এমনিই বুঝবে।” আপনমনেই কথাটুকু বলে বিছানার মধ্যে ঢুকে গেলো ঐশী।
তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,”কাল বাড়ি ফিরে অন্য রুমে শিফট করবো। সকালে চাবিটা দিয়ে দিও।”
ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/174087684371663/
© সম্প্রীতি রায়
আশা করি ভালো লাগছে সবার সঙ্গে থাকবেন সবাই।