বিধবা বিবাহ’ পর্ব-১২

0
1166

#বিধবা_বিবাহ (দ্বাদশ পর্ব)
“মনি উঠে পড়। অতনু ফোন করে চলেছে তখন থেকে। কি ব্যাপার বলতো?তোরা কি আবার ঝগড়া বাঁধিয়েছিস নাকি?”
একটানা রিংটোন ধ্বনি বহুক্ষণ ধরে নাছোড়বান্দার মতো বেজে চলছিল ঐশীর কানের কাছে। কিন্তু দিনভর পরিশ্রম করে ক্লান্ত থাকার কারণে হাত বাড়িয়ে রিসিভ করতে পারছিলনা সে।
উপরন্তু রিংটোনের শব্দ মিলেমিশে অদ্ভুতুড়ে স্বপ্নও দেখছিল ঘুমের ঘোরে। এমন সময় কানের পিসির ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরটা শুনে প্রায় ধড়মড় করে উঠে বসলো বিছানার উপরে।
“কতক্ষন ধরে ডেকে চলেছি তোকে। নাকি আজ অফিস নেই তোর?” ফের পিসির আরেকটা ধমক খেতেই হাত বাড়িয়ে মুঠোফোনটা টেনে নিলো নিজের দিকে। তারপর ঘুম ঘুম চোখে ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অক্ষরসমষ্টি গুলো পড়ে নিলো সে। অতনুর তরফ থেকে কানেক্ট হওয়ার চেষ্টা তখনো চলছে পুরোদমে।
“হ্যাঁ বলো।” ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বরে ঐশী বলে উঠলো এবারে।
“এখনও ঘুমাচ্ছ তুমি? কি ব্যাপার?” অবাক হয়ে বলে উঠলো ওপ্রান্ত।
“হুমম ঘুমাচ্ছিলাম।বলো কি বলবে।” স্পষ্ট বিরক্তিভাব চুঁইয়ে পড়লো ঐশীর কণ্ঠস্বরে।
“কিছু নয়, দু-তিনদিন কথা হয়নি ঠিক মত। তাই ফোন করেছিলাম আর কি।” আমতা আমতা করে অতনু বলে উঠলো এবারে। ঐশীর তরফ থেকে এতটা ঠান্ডা ব্যবহার আশা করেনি সে, তা বলাই বাহুল্য।”তুমি চাইলে আমি পরে ফোন করে নিতে পারব…”
“আচ্ছা, যেমন তোমার ইচ্ছে।” সংক্ষেপে জবাব দিয়ে চুপ করে গেল ঐশী। আদতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল প্রসঙ্গটা দূরে সরাতে। সাতসকালে উঠে এই মানুষটার সাথে বকবক করতে একেবারেই মন চাইছিলনা ওর। প্রথম দিন কফিশপে দেখা হওয়ার সুখানুভূতিগুলো উড়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। পিসিকে জানানোর কারণে অতনুর প্রতি বিরূপভাব ঐশী তখনও পুষে রেখেছে মনমধ্যে।
“তোমার কোন অসুবিধা হয়েছে কি?কালকে ফোন করলাম রিসিভ করলেনা। আর আজ এমন ভাবে কথা বলছো… ইটস রিয়েলি কনফিউজিং।”খানিক দ্বিধামিশ্রিত কণ্ঠস্বরে অতনু বলে উঠলো ফের। বস্তুত ঐশীর তরফ থেকে এমন ব্যবহারের কারণটা তার বোধগম্য হচ্ছেনা কিছুতেই।
“সময় পাইনি, তাই কথা বলতে পারিনি।” নিস্পৃহভাবে প্রত্যুত্তরে বলে উঠলো ঐশী,”আমরা পরে কথা বলে নেব, ঠিক আছে? অফিসে যেতে হবে।”
“কেন জানিনা মনে হচ্ছে,তুমি আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছো। যোগাযোগ রাখতে চাইছনা আমার সাথে।” স্পষ্টবক্তা হওয়ার স্বভাবগুণে অতনু বলে ফেলল এবারে। ভাবি স্বামীর মুখে সেই কথা শুনে চুপ করে গেলো ঐশী।
অতনুর বক্তব্যে কোনরকম খাদ নেই। “কিভাবে বোঝাব যোগাযোগ কমে আসার সাথে সাথে মানুষটার উপরেও আকর্ষণ কমতে শুরু করেছে আমার।”নিজমনে বলে উঠলো সে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়াই হোক বা অতনুর পেটপাতলা স্বভাব অথবা দুইয়ের মেলবন্ধনে ঐশী
আদতে এড়িয়েই চলতে চাইছে আবেগের বশে গড়ে ওঠা সম্পর্কটাকে। পারিবারিক, অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত থাকলে বেশিরভাগ মানুষই অপরকে আঁকড়ে ধরে প্রবলভাবে। কিন্তু স্বভাবে ঐশী সম্পূর্ণ উল্টো। জীবনের বিষমপরিস্থিতি গুলো এতকাল নিজের হাতেই মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেছে সে, তাই স্বভাবজাত কারণে অতনুর অস্তিত্বটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে ওর কাছে।

“সেরকম কিছু নয়, ইদানিং আমি খুব ব্যস্ত আছি। নাথিং এলস…” মনের ভাবটা সম্পূর্ণ গোপন করে বলে উঠলো ঐশী তারপর কলটা ডিসকানেক্ট করে চলে গেলেন স্নানঘরের দিকে।
অতনুর তরফ থেকে আসা পূর্ববর্তী সতেরোটা মিসডকল জ্বলজ্বল করছে তখন মুঠোফোনের ডিজিটাল স্ক্রিনে।

——

“আপনি কি সিওর? আই মিন ভেবে বলছেন তো?” খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসে চেপেছিল ঐশী। এমন সময় ভট্টাচার্য্য বাড়ির ল ইয়ারের তরফ থেকে আসা ফোনকলে দিনের প্ল্যানটা চেঞ্জ করে ফেলল ও। শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি সম্পর্কিত আলোচনার জন্য উকিলবাবুকে প্রথমে নিজের বাড়িতে ডাকলেও সেই সিদ্ধান্ত বদলে দিলো ঐশী। প্রথমত নিজের মাকে এব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিতে চায়না সে, উপরন্তু সম্পত্তি সংক্রান্ত আলোচনার সময় শাশুড়িমায়ের গোলগাল মুখটা দেখতে বড্ড লোভ জাগছিলো ওর। শ্বাশুড়িমায়ের তরফ থেকে চেপে রাখা গুরুত্বপূর্ণ খবরটা ফাঁস হলে ওনার মানসিক স্থিতি টলে যেতে বাধ্য, তা বলাই বাহুল্য।
ঐশীর শ্বশুরমশাই অনন্ত চক্রবর্তী নিজের বাড়ির কানাকড়ি দেননি স্ত্রীকে। গড়িয়ে রাখা কিছু গয়নাগাটি, পেনশন বাবদ পয়সা কড়ি, আর শহরের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বল্পমূল্যের কিছু জমিজমা লিখে দিয়ে গেছেন নিজের স্ত্রীকে।
কিন্তু নিয়মের বাইরে পা ফেলে দুই ছেলেকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের প্রিয় বউমাকে অগাধ সম্পত্তির মালিকানায় বসিয়ে দিতে ভোলেননি।
“কে বলে মেয়েদের কোন ঘর হয়না? আমার যে একটা নয়, দুই দুটো বাড়ি হল!”আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী। তারপর চলতে থাকা বাসটা নির্দিষ্ট স্টপেজে থামতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়ে রাস্তাতে। এই রাস্তা পেরিয়ে আর মিনিটখানেক হাঁটলেই ওর শ্বশুরবাড়ি।

দ্রুতপায়ে এগোতে এগোতে টুকরো টুকরো স্মৃতি ধাক্কা মারছিল ওর মানসপটে। মেয়েবেলায় নিজের বাবার শান্ত শীতল ছায়াটা হারিয়ে বিয়ের পর অবিনাশের বাবাকেই নিজের বাবার জায়গায় বসিয়েছিল ঐশী। শয্যাশায়ী সেই বৃদ্ধ মানুষটির শারীরিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক কিস্তিতে আয়া থাকায় পারতপক্ষে সেই ঘরে কেউই যেতেন না। দুই ছেলে, ছোটো বৌমা, এমনকি নিজের স্ত্রীও পারতপক্ষে ঘেঁষতেন না অনন্ত ভট্টাচর্য্যের ঘরে।
আয়াকে মাসিক মাইনেটা দিয়েই স্বামীর প্রতি সকল কর্তব্য সারতেন ঐশী শাশুড়িমা। কিন্তু চেনা ছকের গণ্ডি পেরিয়ে ঐশী বিয়ের পর শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে গিয়ে বসে থাকতো। বৃদ্ধ মানুষটিকে মানসিক সাহচর্য দেওয়া থেকে শুরু করে বার্ধক্যকালীন নিঃসঙ্গতার কাটানোর ওষুধ হয়ে উঠেছিল সে। উপরন্তু অবিনাশ নিজের কাজে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরে সেই শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে সময় কাটানোর পরিমাণ বেড়ে যায় ভট্টাচার্য পরিবারের প্রাক্তন বড়োবৌমার। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনেই সেই ভালোবাসার টানে ভদ্রলোক যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন, সেটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ঐশীর। গোটা সম্পত্তির অর্ধেকের বেশি সম্পত্তি তার নামে রেজিস্টার করা হয়েছে। বাদবাকি যা পড়ে ছিলো, সেটুকু সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে দুই ছেলের মধ্যে। বড়ছেলের মৃত্যুর আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
“বোধকরি এই মানুষটাই একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন আমার ভালোবাসার মাপকাঠি।”রাস্তায় চলতে চলতে নিজমনেই বলে উঠে ঐশী তারপর সুনির্দিষ্ট বাড়িটার সামনে এসে কলিংবেলে চাপ দিলো সে।

“তুমি ফের আমার বাড়িতে এসেছো! তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! একদম ঢুকবেনা আমার বাড়িতে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্তু পুলিশ ডাকবো।” ফর্সা মুখখানা ফের হিংস্র বিষোদগার করতে শুরু করলো নিজের প্রাক্তন পুত্রবধূকে দেখে।
ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার অভাবে ইনিই ভট্টাচার্য্য বাড়ির ফ্যামিলি ল ইয়ারকে বারণ করেছিলেন উইলের ব্যাপারে না জানাতে।
“খুব অবাক হয়ে গিয়েছেন, তাই না?” শাশুড়ি মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে ঐশী.. ভেবেছিলেন আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর কিছুতেই জানতে পারবনা বাবার উইল চেঞ্জিং এর ব্যাপারে। কিন্তু সত্যি কি আদৌ চাপা থাকে বেশিদিন?”
“একদম মুখে মুখে তর্ক করবেনা বলে দিলাম!তোমার জন্য আমার ছোটছেলেটা বাড়িছাড়া হয়েছে। লজ্জা লাগেনা…”সম্পূর্ণ কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলেননা তিনি। কারণ উকিলবাবু ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে ঐশির পিছনে। তাকে দেখেই জ্বলে ওঠা মুখটায় খানিকটা প্রশমনের প্রলেপ পড়লো। অগত্যা মনের ভাবটা চাপা রেখে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি।

“এক গ্লাস জল হবে?” উকিলবাবুর মুখ থেকে খটোমটো কথাগুলো শুনতে শুনতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলো সে। তাই শাশুড়ি মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ঐশী। বাইরের লোকের সামনে এই মহিলা যে নিজের বিষদাঁত বার করবেনা, সেটা ও বুঝে গেছে ততক্ষনে।
“হবে,”বলে বাড়ির অন্য প্রান্তে তিনি হাঁটা লাগাতেই উকিলবাবুকে অবাক করে চটপট সিঁড়ির পথ ধরল ঐশী। উদ্দেশ্য নিজের গোটা বাথরুমটা পর্যবেক্ষণ করা। ” ভিডিও ক্লিপটার উৎস জানতেই হবে আমাকে, যে করেই হোক।” একের পর এক সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে বলে উঠলো ঐশী।”কোনোভাবে এভিডেন্স কালেক্ট করে পুলিশকে দেওয়া মাত্রই তদন্ত কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।”
বস্তুত উকিলবাবুকে এই বাড়িতে এনে ঘরখানা পর্যবেক্ষণ করার যে ঐশীর মূল উদ্দেশ্য, তা বলাই বাহুল্য।
একের পর এক সিঁড়ি টপকে ঐশী যখন তিনতলায় ওদের ঘরের সামনে আসলো, তখন যারপরনাই অবাক হয়ে গেল। ধুলোময়লা মাখা, অগুন্তি মাকড়সার চক্রান্তে ঘরখানা যেন আঁস্তাকুড়ের রূপ নিয়েছে। বহুদিন যে এই রুমটা ঝাড়াপোছা হয়নি, তা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। এমনকি ব্যবহৃত আসবাবগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। “ইস! কি অবস্থা করে ছেড়েছে ঘরটাকে। এই ধুলো-ময়লা পেরিয়ে যাওয়া যায়!” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী। কিন্তু তাড়াহুড়োর দরুন লক্ষ্য করলোনা ঘরের বেশিরভাগ মাকড়সার জালই ছেঁড়া।

ধুলোমাখা পথটা পেরিয়ে ঐশী চোখ রাখলো প্রমাণ সাইজের বাথরুমে। প্লাস্টার অফ প্যারিসের ছোঁয়া লাগানো সেই দেওয়ালে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। অব্যবহারের কারণে দেওয়ালের রংও চটে পড়েছে। এমন সময় কোণের একটা অংশে চোখ যেতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল ওর। খুব সুক্ষ্ম, নজরে পড়বেনা, এমন ক্যামেরার লেন্স উঁকি দিচ্ছে দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে।
“আমার অনুমানই মিলে গেলো। অবিনাশই ক্যামেরা বসিয়েছিল স্নানঘরে।” উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে অস্ফুটে বলে উঠলো ঐশী।”কিন্তু অরিন্দমের হাতে ক্লিপটা গেল কিভাবে, আর ক্লিপটা নিয়ে তো এতদিন ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ইন্টারনেটে। অরিন্দমের উদ্দেশ্য কি হতে পারে…
হিসেবটা কিছুতেই মিলছেনা যে। চিন্তার বুনোটটা পাক খেতে থাকলে ঐশী চোখ রাখলো বাথরুমের অন্য প্রান্তে… শাওয়ারের ভাঙ্গা হাতলটা এককোণে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেখানে.. এমনকি এনক্লোজার শাওয়ার রুমের একটা অংশ ভাঙ্গা!
“এগুলো কি আবার! আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তো ভাঙ্গাচোরা ছিলনা।” ক্যামেরায় পটাপট ফ্ল্যাশ মারতে মারতে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল ঐশী। এমন সময় ওর চোখ গেলো মেঝেতে ফুটে ওঠা পায়ের ছাপের দিকে। ভারি বুটজুতোর আড়াআড়ি দাগ ফুটে উঠেছে সেখানে।
“তার মানে কি আমার আগেও এখানে কেউ এসেছিল? কিন্তু কেন?” এমন সময় বাইরে থেকে শাশুড়িমার কন্ঠস্বর ভেসে এলো এই ঘরে,”তোমার সাহস দেখে তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি আমি… জল আনতে পাঠিয়ে সোজা ঘরে চলে এসেছো!

“বাড়িটা আমার নামে, তাই এত না চিল্লালেও চলবে।” এগিয়ে রাখা জলের গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড়িয়ে নামতে শুরু করলো ঐশী। নামতে নামতেই কানেক্ট করলো অফিসারকে। ধুলোমাখা ঘরে জেগে থাকা পায়ের ছাপের চিহ্ন জানতেই হবে ওকে।

আগামী পর্বে চমক আছে সঙ্গে থাকবেন সবাই।
ক্রমশ
© সম্প্রীতি রায

আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/175658510881247/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here