বিধবা বিবাহ’ পর্ব-১৩

0
1160

#বিধবা_বিবাহ (ত্রয়োদশ পর্ব)
ভট্টাচার্য বাড়ির আঙিনা থেকে ঐশী যখন বেরিয়ে আসলো, সূর্য তখন প্রায় মধ্যগগনে। উত্তেজনার দরুন মাথাটা টিপটিপ করে ব্যথা করছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত আজ ছাতাটাও আনেনি।
“এত বেলায় অফিসে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।” আপনমনেই কথাটুকু বলে ঐশী এসে দাঁড়াল বাসস্ট্যান্ডে। উদ্দেশ্য নিজের বাড়িতে গিয়ে নতুন ঘরে শিফট করা। এমন সময় বাসটা স্টপেজে এসে দাঁড়াতেই ঝট করে উঠে পড়লো ও।
অফিসটাইম না হওয়ায় ভিড় সেরকম নেই, তাই দরজার কাছে একটা সিট পেয়ে গেল সহজেই।
প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ি থেকে গুটিকয়েক এভিডেন্স কালেকশনের পর ভালোমন্দের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়
মনটার আজগুবি বুনোটে নিজেকে কেমন ছন্নছাড়া লাগছিল ওর।
একদিকে এভিডেন্স মুঠোফোন বন্দি থাকায় খুশি উপচে পড়ছিল ওর মনমধ্যে, অন্যদিকে অবিনাশের চরিত্ররূপ নির্ধারণের ইমারতে আরেকটি নোনাইঁট ধরা পড়ার দরুন আত্মবিশ্বাসের বাঁধটা একটু একটু করে ধসে পড়ছিল যেন। হাজার হোক, মায়ের অমতে গিয়ে নিজের পছন্দেই ঐশী বিয়েটা সেরেছে।

ক্রিং ক্রিং

মুঠোফোনের কর্কশ রিংটনে ভাবনার জালটা কেটে ঐশী ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে। ডিজিটাল স্ক্রিনে ফুটেওঠা অতনুর নামটা দেখেই চোরা বিরক্তিতে ছেয়ে গেল মনটা আনাচ-কানাচ। “উফফ, কি অদ্ভুত ছেলে মাইরি!” আপনমনেই কথাটা বলে পাওয়ার বাটনে হালকা চাপ দিল ঐশী। মুহূর্তের মধ্যেই ঘ্যানঘ্যানে শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর দ্রুত হাতে সাইলেন্ট মোডে ফোনটাকে ফেলে দিয়ে ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে দিল সে… অতনুর নামটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে ওর জীবনে। মানসিক টানাপোড়েন ডুবে থাকতে থাকতে বিয়েটা করতেও মন টানছেনা আর। নিজের একাকিত্বেই ঐশী এখন ডুবে থাকে সর্বক্ষণ। অবিনাশের আকস্মিক মৃত্যুর পরপরই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ইতি এনেছিল সে, কেবলমাত্র অফিশিয়াল কাজের সুবিধার্থে চ্যাটবক্সটা অ্যাক্টিভ রাখতে হয়েছিল ওকে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরে সরা, ফ্রেন্ডসার্কেল কমতে কমতে শূন্যতে নামিয়ে আনা, গেট টুগেদার পার্টিগুলোকে অভয়েড করার পালা শুরু হয় তখন থেকেই। এমনকি আত্মীয়স্বজনদের নানা রকম পারিবারিক অনুষ্ঠানেও যাওয়া বন্ধ করেছিল ঐশী। বিধবা হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনদের করুনার ফোঁটাগুলো নুনের দানার মত বিঁধতো ওর ক্ষতস্থানে। যদিও সেই করুনাতে পাশে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা বিন্দুমাত্র লেগে থাকতনা, বরং একরাশ বিদ্রুপই ঠেলে দিতো ঐশীর ভাগ্যদোষকে কেন্দ্র করে।
“বিপদে পড়লেই বোঝা যায় মানুষ কিরকম। আত্মীয়-স্বজনের মুখোশ খুলে যাওয়ার পাশাপাশি নিজেকে চিনে নেওয়ার পালা শুরু হয় তখনই।” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী। বস্তুত, একের পর এক টানাপোড়নে অন্যকে বিশ্বাস করার গুনটিও হারিয়ে যেতে বসেছে ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে। অতনুর থেকে দূরত্ব রাখার কারণ যে এইটাই, তা বলাই বাহুল্য। এমনকি পুলিশি তদন্তেও বিশ্বাস না রাখতে পেরে এখানে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছে সে।
সেইমতো এভিডেন্স কালেক্ট করার পর আজ বিকেলে থানায় যেতে হবে ওকে। অফিসারের সাথে কানেক্ট করার পর সেইমতোই নির্দেশ পেয়েছে ঐশী।
“ম্যাডাম টিকিট কেটেছেন তো?” বাস থেকে নামার সময় কন্ডাক্টরের আওয়াজ ভেসে আসতেই মুঠোয় রাখা কাগজের টুকরোটা তার দিকে এগিয়ে দিল ঐশী, তারপর পা বাড়ালো বাসের বাইরে।

“কি ব্যাপার?আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি? শরীর টরির খারাপ নাকি তোর?” পায়ে পায়ে নিজের বাড়ি ঢুকে পিসির ঘরের দিকে এগুতেই কৃশানু বলে উঠলো বোনকে উদ্দেশ্য করে।
“আজকে অফিসে যাসনি?” জবাবটা সরাসরি না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল ঐশী।
“নাহ্, তোর বৌদিকে আনতে যেতে হবে। টিয়া, তুতুনের স্কুল কন্টিনিউ হচ্ছে না, কয়েকদিন বাদেই ওদের পরীক্ষা…এইভাবে বেশিদিন চলা যায়না যে।” ধুলোমাখা হাতদুটো জলের তোড়ে ধুতে ধুতে বলে উঠলো কৃশানু। “আর হ্যাঁ, তোর ঘর কিন্তু রেডি করে দিয়েছি, ঝাড়াপোছাও কমপ্লিট। আর ফার্নিচারগুলোও শিফট করে দিয়েছি। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল!” ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসি টেনে বলে উঠলো কৃশানু।
দাদার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা যেন ভিরমি খেলো ঐশী,”কি বলছে কি লোকটা! ফার্নিচার সেট করে দিয়ে, ঘরদোরও পরিষ্কার করে রেখে দিয়েছে!” দাদার কথাটা কিছুতেই যেন বিশ্বাসযোগ্য হলো না ওর। খানিক কিন্তু কিন্তু ভাব মনের মধ্যে জেগে থাকলেও বাইরে প্রকাশ করল না ও। স্বভাবদোষে কথাগুলো মনের মধ্যে চেপে রেখে ঐশী বলে উঠলো ফের,”মা কোথায়? দেখছি না যে?”
“মন্দিরে গিয়েছে, আজ সোমবার যে। শিবের মাথায় জল ঢালতে হবে।” ভিজে হাতটা
টাওয়েলে মুছতে মুছতে বলে উঠলো কৃশানু।
“ওহ্,আচ্ছা।” অস্ফুটে বলে ঐশী পা বাড়ালো পিসির ঘরের দিকে। “সারাজীবন এত দুঃখ পেয়েও
শিবভক্তি ছাড়তে পারলনা মা। আমি হলে তো কবেই…” বস্তুত পূজাঅর্চা, কীর্তন মানত কোনোকালেই ঐশির যুক্তিসর্বস্ব মন গ্রাহ্য করেনি। নিজের চিন্তা ধারা বজায় রাখতে কোন কালে ঠাকুর ঘরে গিয়ে পুজো দেয়নি সে। অন্যদিকে ঐশীর মা সবিতাদেবী নেহাতই ধর্মভীরু, আস্তিক মানুষ। একমাত্র মেয়ের সাথে বনিবনা না হওয়ায় আরেকটি কারণ ঈশ্বরবিশ্বাসে মতান্তরের জন্যও বটে।
“মনি তাড়াতাড়ি চলে এলি?” কোণের ঘরটাতে ঢুকতেই বাসন্তীলতাদেবী বলে উঠলেন ভাইঝিকে উদ্দেশ্য করে। ফাঁকা আসবাববিহীন ঘরের মেঝেতে তিনি তখন ঝাঁটা বুলোচ্ছেন।
“ওই আরকি। তেমন কিছু নয়।” নিজের প্রাক্তন শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার কথা পিসিমার কাছেও চেপে গেল ঐশী। তারপর ফের বলে উঠলো,”আসবাব তো শিফট করে দিয়েছে শুনলাম। তাহলে আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম, কেমন?শরীরটা টায়ার্ড লাগছে বেশ।”
“দাঁড়া, দাঁড়া, একসাথে যাই।” ঝাট দেওয়ার শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলেন তিনি।”দুজনের তো একটাই ঘর…”
“একটা! কিন্তু কেন?” পিসির কথা শুনে প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল ঐশী।”একটা ঘর কেন? আমি যে মাকে বললাম দুটো ঘরের চাবি দিতে!”
“বৌদি তো সেই কোন সকালে মন্দির চলে গিয়েছে। তাই কৃশানুই চাবি খুলে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিলো। আর বললো টিয়ার সামনেই পরীক্ষা। তাই তোর দক্ষিণ খোলা নিরিবিলি ঘরটাই মেয়ের জন্য রাখছে। আর নিচতলাটা বললো ভাড়া বসাবে। কোণের পুবদিকের ঘরটাই আমাদের জন্য
খুলে দিয়েছে বললো। বাক্স প্যাটরা নেওয়ার জন্য লোকও রেডি করলো। তুই আসার কিছুক্ষণ আগেই লোকগুলো শিফট করে চলে গেলো।” ঐশী প্রশ্নের জবাবে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“মানে! এরকম তো কথা হয়নি!” ঐশীর মনে হিসেবটা মিলছেনা কিছুতেই।”আমি তো দক্ষিণ খোলা ঘরটায় বিয়ের আগে থেকেই থাকতাম!”
“হ্যাঁ, কিন্তু কৃশানু বলল ওই ঘরে টিয়ার জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই একা হাতে ফার্নিচারগুলো এদিক-ওদিক করা কষ্টকর হয়ে যাবে ওর পক্ষে। তাই পুবের ঘরটা খুলে দিল আরকি!” নিজের একচিলতে ঘরটার জানলার পাল্লা আটকাতে আটকাতে বলে উঠলেন বাসন্তিলতাদেবী।
পিসির কথা শুনে ঐশীর কাছে সমস্ত ব্যাপারটা জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল, কিছুক্ষণ আগেই দাদা বলেছে বৌদিকে ফিরিয়ে আনতে যাবে…সাথে টিয়া আর তুতুনও আসবে। সেইমতো নিজের মেয়ের পড়াশোনার সুবিধার জন্য ঐশীর পুরনো ঘরটা এখনও নিজের দখলে রাখতে চাইছে কৃশানু। আসবাব সরানোর অজুহাতটা যে নেহাতই মিথ্যে, সেটা একটা স্বল্পবুদ্ধির বাচ্চাও বুঝবে।

“এই ঘরের জিনিসপত্র লোক ডাকিয়ে দিব্যি সরাতে পারল! কিন্তু ওই ঘরের জিনিসপত্র সরাতে গেলেই একহাতে সরাতে কষ্ট হয়ে গেল! বাহ রে বাহ।” নিজের মনের ভাবটা আর গোপন করে রাখতে পারলনা ঐশী। পিসির সামনেই বিতৃষ্ণা উগরে বেরিয়ে এলো এবার।
এমনকি পিসির কথা শুনে এটাও পরিষ্কার যে একতলাটা ভাড়াটে বসিয়ে সম্পূর্ণ ভাড়ার টাকা নিজের পকেটে ঢোকাতে চাইছে কৃষানু। বস্তুত গোটা বাড়ি তিনজনের নামে থাকলেও আলাদা করে ঘরগুলো ভাগাভাগি করা নেই, তা বলাই বাহুল্য। “জমি জবরদখল শুনেছিলাম, কিন্তু ঘর জবরদখল প্রথম শুনলাম!” আপনমনেই বলে উঠে ঐশী। বাড়িতে মা, বোন না থাকার সুযোগ যে এমনভাবে নিতে পারে নিজের দাদা, সেটা ভাবতেই
মনটা রাগে, হতাশায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো ওর। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ঐশীর বুক চিরে, তারপর দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে এগিয়ে গেলো পুবের ঘরটার দিকে। বাড়ির দুইজন বিধবার জন্য বন্দোবস্ত করে রাখা সেই ঘরের দিকে…
পায়ে পায়ে সেই ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পর মাথাটা ফের গরম হয়ে উঠলো ওর। ছোট্ট ছোট্ট দুটো জানলা, রংচটা দেয়ালের খাবলানো স্থাপত্যে পরিপূর্ণ সেই ঘরে প্রাণখোলা ভাবের চিহ্ন নেই একেবারেই। আগের ঘরের চেয়ে খানিক ভালো হলেও এই ঘরটা যে ঐশীর মনঃপূত নয়, তা বলাই বাহুল্য।
“এর চেয়ে শতগুণ ভালো ছিল আমার দক্ষিণ খোলা ঘরটা।” অস্ফুটে বিড়বিড় করে বলে ওঠে ঐশী। ভাইঝির পিছুপিছু পিসিও এসে দাঁড়িয়েছেন ততক্ষনে সেই ঘরে। নিজের বৃদ্ধা পিসিমণির জন্য কৃশানু যে অন্য ঘরের অ্যারেঞ্জমেন্ট রাখেনি, তা বলাই বাহুল্য।

“পিসি, দরকার নেই আমার, অনেক হয়েছে এই নোংরামি!” কেটে কেটে বাসন্তীলতাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ঐশী।”আমি এই বাড়িটা বিক্রি করে দেব। যেখানে কথা দিয়েও কথা রাখার বালাই নেই, সেখানে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা নেহাতই বোকামি!”
“সেকি! কিছুদিন আগেও যে বাড়িটা বিক্রি করতে চাইছিলিস না তুই!” হতভম্ব হয়ে বলে উঠলেন ঐশীর পিসিমা।
“বিক্রি করতে চাইছিলাম না, কারণ আমাকে আমার প্রাপ্য দাবীদাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল। বাড়ির আসল দামের টেন পার্সেন্টেরও কম আমার ঘাড়ে গছিয়ে ভূজুংভাজুং বুঝিয়ে বাড়িটাকে বিক্রি করার চেষ্টা করা হচ্ছিল!” কণ্ঠস্বরে শ্লেষ মিশিয়ে বলে উঠলো ঐশী।
দাদার এহেন কর্মকান্ডে সে রেগে গিয়েছে প্রচন্ডভাবে। উপরন্তু এই বাড়িতে একমুহূর্ত থাকতেও মন চাইছেনা ওর। ঝগড়া-বিবাদের চোরাবালিতে ডুবতে ডুবতে একমুঠো শান্তির খোঁজে যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা…
“এইবার আমি নিজেই প্রোমোটার কাকুর সাথে কথা বলবো, বিক্রির টাকাটা বুঝে শুনে নিয়ে চলে যাবো অন্য কোথাও!”বলে নড়বড়ে খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লো ঐশী। ওর ভারী ওজনটা সামলাতে না পেরে ঘুণধরা পুরনো আসবাবটা ক্যাচ শব্দ করে আর্তনাদ করে উঠলো এবারে।
সেই শব্দ শুনে ঐশী বলে উঠলো এবারে, “অবিনাশের বাড়ি থেকেও আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে দেওয়া আসবাবগুলো নিয়ে যাবো নতুন বাড়িতে। ভাঙুক বাড়িটা! হোক ফ্ল্যাট! নিজের পাওনা আদায় না করে নড়বো না আমি!”
“বিয়ের জন্য নিয়ে আসবি ফার্নিচারগুলো? শুনলাম বৌদি তোর বিয়ের জন্য নতুন করে কোন আসবাব গড়িয়ে দেবেনা বলেছে…” ভাইঝির দিকে তাকিয়ে খানিক চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী। বাড়ি বিক্রির প্রসঙ্গ তার মধ্যেও ভাবনা বাড়াচ্ছে বৈকি।

“আমি করবো না বিয়েটা! নিজের বাড়িতেই শান্তি পেলাম না। অন্যের বাড়িতে শান্তির আশা করি কিভাবে…বেকার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।” পিসিমার থেকে চোখটা ফিরিয়ে বলে উঠলো ঐশী। “এই বাড়ি বেচে দিয়ে শহরের অন্য কোথাও চলে যাব আমি আর তুমি। কাউকে দরকার পড়বে না বেঁচে থাকার জন্য। কোনো অবলম্বন, ভরসার কাঁধের দরকার নেই আমার!”
“কিন্তু অতনুর মাকে কী জবাব দেবো আমি!” ভাইঝির সিদ্ধান্ত শুনে চমকে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।”ওকে যে অনেক বড়মুখে কথা দিয়েছিলাম মনি।”
“বিশ্বাস করো পিসি আমার মন টানছেনা বিয়েটা করতে। এক্কেবারে ইচ্ছে করছেনা নিজের এই ভাঙাচোরা জীবনের সাথে কাউকে জুড়ে নিতে।” পিসির কুঁচকে যাওয়া হাতদুটো নিজের হাতে ভরে নিয়ে বলে উঠলো ঐশী,”জীবনটাকে এবার নিজের মত করে বাঁচতে চাই পিসি। আর কারোর জীবনের সাথে জুড়তে ইচ্ছে করেনা গো। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই আমি। কারোর করুণা, দয়া পেতে ইচ্ছে করেনা আর। একের পর এক টানাপোড়নে ক্লান্ত আমি।”কণ্ঠস্বরে অসহায়ত্ব চুঁইয়ে পড়ছে এবারে।”দরকার নেই পিসি কোনো বন্ধনের। অবিনাশ, অরিন্দম, দাদা সব্বাই সমান। সব্বাই…”

“অতনুও?” ভাইঝির কথার মাঝেই বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী। “ওই মানুষটা তো তোর কোনো ক্ষতি করেনি..” সেই কথা শুনে ফের চুপ করে গেল ঐশী। কীকরে বোঝাবে ভাবি স্বামীর প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস জন্মায়নি ওর। বিশ্বাস ছাড়া কি স্বামী স্ত্রীর বন্ধন আদৌ সম্ভব..?
“মানছি তুই ছেলেটাকে এখনও বিশ্বাস করতে পারিসনি। কিন্তু…” ভাইঝিকে ফের বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“প্লিজ আমাকে জোর করোনা পিসি, মানছি অতনুর মা তোমার খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু জোর করে মনের বিরুদ্ধে বিয়ের পিঁড়িতে বসা যায় কি?”
খানিক জোর দিয়েই ঐশী বলে উঠলো এবারে।
ভাইঝির কথা শুনে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন বাসন্তীলতাদেবী। তারপর অস্ফুটে বলে উঠলেন,”যেটা তুই ভালো মনে করিস। বড় হয়েছিস। নিজেরটাও বুঝতে শিখেছিস…”

——–

বিকেল সন্ধের সন্ধিক্ষণে গোটা আকাশটা ছোপ ছোপ আলতা রঙে ভরে উঠেছে। একমনে সেই সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই ঐশী এগিয়ে যাচ্ছিল থানার দিকে। পরনে জিন্স প্যান্ট, স্নিকারে কলেজপাশ যুবতী মেয়ে লাগছে ওকে। হাঁটতে হাঁটতেই প্যান্টের একটা পকেটের মধ্যে থাকা মুঠোফোনটা ধরে রেখেছে দৃঢ়মুষ্ঠিতে। সাথে ধরে রেখেছে নিজেকে জিতিয়ে দেওয়ার সমস্ত তথ্য প্রমাণকে।
“বসুন, বসুন।” থানায় ঢুকতেই লেডি অফিসার ঐশীর দিকে তাকিয়ে উল্টোদিকের চেয়ারে ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিলেন।
“ম্যাডাম, এই দেখুন সমস্ত এভিডেন্স… অবিনাশই ঘরদোর রিপেয়ার করার অছিলায় স্নানঘরে ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিল।” বলে চেয়ারে বসতে না বসতেই মুঠোফোনটা তাড়াহুড়ো করে বার করলো ঐশী… তারপর সুনির্দিষ্ট ফটোটা খুলে মুঠোফোনটা বাড়িয়ে দিল অফিসারের দিকে।”এই দেখুন,আমি আসার আগে অজানা কেউ ওই ঘরে কেউ এসেছিল, ধুলো-ময়লা ভরা মেঝেতে পায়ের ছাপ পেয়েছি আমি।” বলে আরেকটা ফটো এগিয়ে দিলো অফিসারের দিকে।কোন জবাব না দিয়ে মহিলা পুলিশটি একমনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো ফটোগুলো।
“আর হ্যাঁ, আমি এটাও বলে রাখি শাওয়ার এনক্লোজার রুমের একটা কোণা ভাঙা ছিলো। সাথে শাওয়ারের হ্যান্ডেলও।” তড়িঘড়ি এক নিশ্বাসে বলে উঠলো ঐশী,”আমার মনে হয় আপনাদের খুব তাড়াতাড়ি ওই বাড়িতে ফোর্স পাঠানো উচিত। আই থিঙ্ক এভিডেন্স নিয়ে রীতিমত কাটাছেড়া করা হয়েছে সেখানে।”
সেইকথা শুনে উল্টোদিকের চেয়ারে উপবিষ্ট ফর্সা সুন্দরী মহিলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অফিসার, তারপর মুখটা গম্ভীর করে ঐশীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,”আপনি পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেননা, তাইনা?”
এমন সপাট জবাব ঐশী যে আশা করেনি, তা বলাই বাহুল্য। “নানা, সেরকম কিছু নয়, আসলে আমি ঐবাড়ি গিয়ে দেখতে চাইছিলাম যে ব্যাপারটা আদতে কি। আপনাদেরও তদন্ত এগিয়ে যেত, আর…” আমতা আমতা করে জবাব দিল ঐশী।
“আর?” ঐশীর কথার খেই খানিকটা উঁচিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন অফিসার,”আর আপনার এখনও মনে হচ্ছে আমরা কেসটাকে হালকাভাবে নিচ্ছি, তাই তো? ঠিক যেমনটা অবিনাশের মিস্ট্রিয়াস এক্সিডেন্ট ইনসিডেন্টটা পড়শী রাজ্যের পুলিশ হালকাভাবে নিয়েছিল?”
“আমি সেটা বলতে চাইনি আপনাকে।” মনের ভাবটা সম্পূর্ণ গোপন করে বলে উঠল ঐশী… আদতে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের উপর ভরসা উঠে যেতে বসেছিল ওর। অবিনাশের মৃত্যুর পর যে কম হ্যারাস করা হয়নি ওকে নিয়ে, তা বলাই বাহুল্য। এমনকি সাসপেক্টেট লিষ্টে অবিনাশের বউ তথা সহযাত্রী হওয়ার সুবাদে ঐশির নামটাই এনলিস্টেড ছিল।

“আপনি সেটাই বলতে চেয়েছেন…” হাসিমুখে বলে উঠলেন অফিসার,”কিন্তু একজনকে দেখে বাদবাকি সবাইকে বিচার করাটা কী উচিত ম্যাডাম?” বলে ড্রয়ারে রাখা প্লাস্টিকের মোরকগুলো এগিয়ে দিলেন তিনি ঐশীর দিকে। প্লাস্টিকের আবরণ ভেদ করে গুটিকয়েক ছোট ছোট ক্যামেরা সেখানে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট ভাবে।
“এগুলো কি?” ভুরু কুঁচকে ঐশী জিজ্ঞেস করে উঠল অফিসারকে উদ্দেশ্য করে।
“ওই যে, আপনি বললেন কারা নাকি এভিডেন্স কাটাছেঁড়া করতে গিয়েছিলো। তারাই আমাদের কাছে পৌঁছে দিল এই ক্যামেরাগুলো।” খানিক কৌতুক ভঙ্গিতে বলে উঠলেন লেডি অফিসারটি।
“মানে?” ওনার কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে বলে উঠলো ঐশী,”এভিডেন্স নিয়ে কাটাছেড়া করলে আপনার কাছে দিয়ে যাবে কেন?”
“ভারী বুট জুতো কিনতে অনেক পয়সা লাগে ম্যাডাম। এভিডেন্স কালেক্ট করে আমাদের কাছে দিয়ে গেলে অনেক পয়সা পাওয়া যায় তো! তাই আরকি।” পিছন থেকে ভেসে আসা অতিচেনা পুরুষালী কণ্ঠস্বরটা শুনে চমকে উঠলো ঐশী।
“তুমি? মানে আপনি!” খাকি রঙের ইউনিফর্ম পরে যে মানুষটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সে অতিচেনা হলেও আজ বড্ড অচেনা ঠেকলো ঐশীর কাছে। ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্যে মোড়া অবয়বটাকে তুমি সম্মোধনে অভ্যস্ত থাকলেও নিজের অজান্তেই আপনি সম্বোধন করে উঠলো ঐশী।
“হ্যাঁ আমি, আর যারা এভিডেন্স চুরি করতে গিয়েছিল তারা এটাও বলেছে পড়শী রাজ্যের নীলচক্রের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু চিন্তার বিষয় ব্যবসাটা এখনও রমরমিয়ে চলছে।”
একগাল হেসে ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো অতনু,”আই থিঙ্ক, ওই চক্রের মাথা এখনো ধরা পড়েনি পড়শী রাজ্যের পুলিশের হাতে।”

ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/176434327470332/
© সম্প্রীতি রায়
আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here