#বিধবা_বিবাহ (অষ্টাদশ পর্ব)
“ওকি মনি! কি করছিস তুই। বিধবা মানুষটাকে মাছভাত খেতে বলছিস! এযে ম্লেচ্ছ খাবার, ছোঁয়াও নিষিদ্ধ।” মাছ ভাতের থালাটা সবেমাত্র পিসির দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলো ঐশী, এমন সময় মায়ের চিলচিৎকারে খাবার টেবিল থেকে ভরা ভাতের থালাটা মেঝেতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল প্রায়।
“মাছ ভাত ম্লেচ্ছ?” স্বভাবজাত ধীরস্বরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ঐশী,”তবে তুমি কেন মাছ ভাত খাও মা, কেন পিছুটান ছিঁড়ে গেলেও আমিষের মায়া ত্যাগ করতে পারোনি?”
“মানে! আমার খেলে কি দোষ!” মেয়ের কথায় বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে প্রায় রে রে করে তেড়ে উঠলেন সবিতাদেবী। “এই শেষবয়সে এসে বুড়ো মানুষটাকে দিয়ে এত বড় পাপ করাবি! তুই জানিস না মাছ ভাত খাওয়া তো দূর, বিধবাদের জীবনে বড় চুল রাখাও নিষিদ্ধ? ভুলে গিয়েছিলি তোর ঠাম্মাও নিজের চুল কেটে ফেলে ছিলেন স্বামী মারা যাওয়ার পর!”
“তবে তুমি কেন নিজের চুল কাটোনি মা? কেন মাছভাতে অভ্যস্ত ছিলে এতদিন? তুমি যে নিজেও বিধবা!” বিন্দুমাত্র গলা না উঁচিয়ে স্বভাবজাত শান্ত স্বরে বলে উঠলো ঐশী। কিন্তু দাবানলের মত জ্বলে ওঠা দুচোখের দৃষ্টি পড়ামাত্র যে কেউ বুঝে যাবে কতশত আগুন জ্বলছে ওর মনমধ্যে। নিজের স্বচ্ছ নিরপেক্ষ চেতনাকে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দিতে পারে সেই তপ্ত সুগভীর চাহনি। ঠিক যেমনটা বাতাসের বেগে দাবানল এগিয়ে চলে তরতরিয়ে।
“আমি বিধবা! এসব কি বলছিস তুই!” ক্রোধে হতাশায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এবার প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো সবিতাদেবী। ফর্সা ছোটো দুইহাতে শোভা পাওয়া শাখা, পলা ততক্ষনে উঁচিয়ে ধরেছেন মেয়ের মুখের সামনে। প্রবল বেগে হাতদুটো নাড়ানোর দাপটে সধবার ঝংকারে কানে তালা লেগে গেলো প্রায়। কয়েকমুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে মায়ের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকিয়ে রইল ঐশী। তারপর শান্তভাবে মায়ের কাঁধে হাত রেখে বসিয়ে দিল সামনে থাকা চেয়ারে।
আত্মজার স্পর্শই হোক বা মেয়ের ইস্পাতকঠিন দৃষ্টিতে চেয়ারে বসতে বাধ্য হলেন সবিতাদেবী। মায়ের জিজ্ঞাসু নজরটা পড়ে নিয়ে ঐশী বলে উঠল অস্ফুটে,”স্বামী মারা গেলেই আমরা তার বিবাহিতা স্ত্রীকে বিধবা বলে জানি, কিন্তু যখন স্বামী জীবিত থাকা সত্ত্বেও মৃতের মত আচরণ করেন তখন? বিধবা হওয়ার জন্য কি আদৌ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করা মুখ্য, নাকি স্বামী নামক অসুখের মায়া ত্যাগ করাই বিধবার পরিচয়?”
মেয়ের মুখে ফুটে ওঠা কথাগুলো শুনে সবিতা দেবী বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। মুহূর্তে মুহূর্তে চোখের তারায় বদলে যাচ্ছে তার মানসিক অভিব্যক্তির পরিচয়। যেন এক অজানা সত্যর সর্বসমক্ষে ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে ভীত হয়ে আছেন তিনি প্রবলভাবে।
“কি বলতে চাইছিস তুই…” অস্ফুটে কোনমতে বলে উঠলেও মৃদু সেই শব্দসমষ্টিই ঐশীর কর্ণপটহে পৌঁছে গিয়েছে ততক্ষনে। নিজের মায়ের এমন ভেঙেপড়া অবস্থা দেখে বুকটা যেন ভেঙেচুরে যাচ্ছিল ঐশীর, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠল সে,”যে মানুষটা বিগত পাঁচবছর কোনরকম যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেনি, টাকা পয়সা পাঠিয়ে বাবার কর্তব্যটুকুও পালনের চেষ্টা করেনি। সে সেকি আদৌ জীবিত মা? নাকি মারা গিয়েছে এই সংসার থেকে?”
গোটা ঘরে তখন বিরাজ করছে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। খাওয়ার টেবিলে এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা বাসন্তীলতাদেবীও হতভম্বের মতো চেয়ে আছেন নিজের ভাইঝির দিকে। ঐশীর কথা যে তিনিও কিছু বুঝতে পারছেন না, তা বলাই বাহুল্য।
এক অজানা কারণে নিজের মেয়ের কথা শুনে মুখ তুলে তাকাবার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন সবিতাদেবী। মনের প্রবল দোলাচলে তার শুকনো ঠোঁটদুটো কেঁপে চলেছে তিরতির করে। চোখের কোণে জমছে নোনতা দানা। মনের মধ্যে কতশত কথা এলোমেলোভাবে জমাট বাঁধলেও কিছুই উগরে আসতে পারছেনা। জল ভরে আসা চোখে ভিড় করে আসছে শুধু স্মৃতিগুলো।
“কিন্তু তুমি চলে গেলে সংসারটা যে ভেসে যাবে গো! কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে। কি হবে ওদের ভবিষ্যৎ।” নিজের বাক্স প্যাটরা বাঁধতে থাকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে আকুল আর্তিতে বলে উঠেছিলেন তখনকার সবিতাদেবী।
স্বামীর সোহাগ, ভালোবাসার চিন্তা ততক্ষনে উবে গিয়েছে একজন স্ত্রীয়ের ভাবনা থেকে বরং ছোট ছোট দুই ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে একটা মায়ের মন।
“বাড়িটা তোমাদের তিনজনের নামে রেখে গেলাম.. আর ব্যাংকে কিছু পয়সাকড়ি রইল। তিনজনে দিব্যি চালিয়ে নিতে পারবে তোমরা।” চেন আটকানো শেষে ভারী ব্যাগটা টেনে নামাতে নামাতে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে উঠেছিলেন ঐশীর বাবা। যদিও কর্তব্য দায়িত্বের বিচারে বাবা শব্দটা তার ব্যক্তিত্বের সাথে নেহাতই অর্থহীন, কিন্তু দুই ফুটফুটে সন্তানের জন্মদাতা হিসেবে তার ভূমিকা অস্বীকার করা চলেনা যে…
“বিয়েটা আমি নিজের ইচ্ছেতে করিনি সবিতা। আমার ধ্যানধারণা, শিক্ষা দীক্ষা কিছুই তোমার সাথে মেলে না। একতরফা ভালোবাসা কখনও পূর্ণতা পায় না। তাই স্ত্রীয়ের অধিকার তুমি দাবি করোনা। মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুদূর যাওয়া যায়, কিন্তু এইভাবে আর কতদিন!”
সেদিন চোখের জলে বুক ভাসিয়েও নিজের সংসারটার ভাঙন আটকাতে পারেননি সবিতাদেবী। যে যাওয়ার তাকে আটকানো কি অতই সহজ! কচুরিপানার জমাট কুণ্ডলী কবেই বা খরস্রোতা নদীকে আটকাতে পেরেছে। আগাছার দামকে ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে সে আপন লক্ষ্যে। ঠিক যেমন সবিতাদেবীকে ফেলে ঐশীর বাবা চলে গিয়েছিলেন প্রবাসে…
মনের মধ্যে ভিড় করে থাকা কথাগুলো কখনও প্রকাশ করতে পারেননি তিনি জনসমক্ষে। নিজের পেটের ছেলে মেয়েকেও বলতে পারেননি তার স্বামী আগের বার নিজের দেশে এসেছিলেন শুধুমাত্র নিজের পাওনা আদায় করতে, নিজের সোপানের আরেক ধাপ গড়ে তুলতে…নিজের দেশে ফেরার অজুহাতে ঐশী কৃষানুর ভরণপোষণের দায়িত্বের অঙ্গীকার সেখানে শুধুই ছিল বাহানা মাত্র।
ঐশীদের কাছে তিনি তখনও লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজের স্বামীর স্বরূপ। অন্যদিকে ঐশীর বাবা নিজের মন থেকে লুকিয়ে ফেলেছিলেন অস্থায়ী আবেগে সবিতাদেবীর সাথে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, ও তার ফলশ্রুতিতে জন্মানো দুই সন্তানের ভবিষ্যত। সাথে শুরু করেছিলেন প্রবাসে নিজের নতুন সংসার।
“মুখ নিচু করে থেকোনা মা। মুখ লুকিয়ে থাকার কিচ্ছু হয়নি। তুমি কোনো অন্যায় করোনি যে মুখ নিচু করে থাকবে। এদিকে তাকাও!” বলে ধীরে ধীরে মুখ নিচু করে বসে থাকা সবিতাদেবীর মুখটা উচিয়ে দিলো ঐশী। তারপর কালি ঠাসা চোখের কোলে জমে থাকা জলটা মুছে দিলো সযতনে। নোনতা সেই ধারায় ঐশী যেন দেখতে পেলো নিজের বাবার চরিত্রের সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি। বছরকয়েক আগে নেহাতই কৌতূহলবশত বাবার নাম সার্চবারে বসিয়ে নিজের জন্মদাতাকে খুঁজছিল ঐশী। দেশ ছেড়ে সমীরণবাবু তার কয়েকদিন আগেই ফিরে দিয়েছিলেন প্রবাসে। বাবার প্রতি নতুন করে জেগে ওঠা ভালোবাসার টানেই ঐশী খুঁজে চলেছিলো একের পর এক প্রোফাইল। কিন্তু তার পরিণতি এতটা নির্মম হবে সেটা কে জানত!
অ্যাংলো এক মহিলার কোমর পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাসিখুশি মানুষটাকে চিনতে পারলেও মনমধ্যে পুষে রাখা বাবার তকমা খসে গিয়েছিলো নিমেষেই। বাবার উপর প্রচন্ড রাগ জন্মানোর পাশাপাশি মায়ের উপর অভিমানের পরত বেড়ে গিয়েছিল অনেকটাই। কারণ ভিনদেশে স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা না জানলেও সবিতাদেবী জানতেন ওদেশ থেকে ভরণপোষণের খরচ আসবে না কোনদিনই। উপরন্তু নিজের মনের ক্ষত মনেই পুষে রেখেছিলেন সযতনে।
“বাবা তোমাকে প্রতিমাসে টাকা পাঠাত মা? আর কতখানি সত্যি লুকালে স্ত্রী হওয়া যায়?” বলে গহনার দোকানের রসিদটা মেলে ধরলো মায়ের মুখের সামনে। একের পর এক গহনা বেচে দেওয়ার তালিকা নথিভুক্ত আছে সেখানে।
দিনকয়েক আগে পাওয়া মায়ের ঘরে এই কাগজটি হঠাৎই আবিষ্কার করেছিলো ঐশী, সাথে আবিষ্কার করেছিলো সবিতাদেবীর মনে জমিয়ে রাখা কথাগুলোকে। প্রতিবাদ না করার কারণে মায়ের উপরে সেই সময়ে সুতীব্র অভিমান জন্মালেও গতকালের পর সেগুলো পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো নিখাদ ভালোবাসাতে। যার ফলশ্রুতিতে ঐশী অনুভব করেছে নিজের মায়ের সাথে মিলে যাওয়া তার সত্তাকে। বিধবার সত্তাকে।
একজন স্বামীর মৃত্যু হওয়ার কারণে বিধবা, আরেকজন জীবন্ত স্বামীর স্মৃতি সংসার থেকে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণে বিধবা। সমীরণবাবু যে এদেশে থাকা নিজের স্ত্রীকে আইনত বিচ্ছেদ দেননি তা বলাই বাহুল্য।
“আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে মা? আমি তুমি পিসি তো সকলেই সমগোত্রীয়। তবে কেন পিসির বেলায় নিয়ম আলাদা আর আমাদের….”
“আমি কি তোদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছি মনি?” মুখটা উঁচিয়ে মেয়ের দিকে চাইলেন সবিতাদেবি, তারপর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন ঐশীকে উদ্দেশ্য করে।
“অবশ্যই মা, তুমি পিসির উপর জোর করেই চাপিয়ে দিয়েছ। কিন্তু স্বল্পবয়স্কতার কারণে পিসি মুখ বুজে সহ্য করেছিল সেই সব অত্যাচার। তারপর পরিণতি পাওয়ার কালে নিজের সম্মান অটুট রাখতে মেনে চলতেন কুসংস্কারগুলোকে।” বলে পিসির নিমকাঠের চিরুনীটি বের করে আনলো সবার চোখের সামনে। সাথে ম্যাগের তেলচকচকে কাগজে দই কাতলার রেসিপি।
“মনি! তুই কখন এইসব…” বিস্ময়ে বাসন্তীলতাদেবী বলে উঠলেন এইবারে প্রায় চিল্লিয়ে উঠলেন। কিন্তু বৌদি কথা বলে ওঠায় চুপ করে গেলেন ফের,” সত্যিই তুমি এগুলো ব্যবহার করো ঠাকুরঝি?” চোখের তারার ফুটে উঠেছে অবিশ্বাসের ঘনঘটা। যেন তখনও তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ঘটনাক্রম। ভুলতে চাইছেন অন্যের উপর অন্যায়ভাবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মনিষ্ঠাকে।
“পিসি মিথ্যে কেন বলবে মা!” মায়ের কথার মাঝখানেই বলে ওঠে ঐশী। “কিন্তু তুমি যে কথার খেলাপ করছো…”
“খেলাপ? কিসের খেলাপ!” প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলে উঠলেন সবিতাদেবী।
“ভিন্ন ভাবনাচিন্তা থাকলেও অপরের দৃষ্টিভঙ্গিকে তো সম্মান দেওয়া যায়…” নিজের মায়ের কথাগুলো আউড়ে উঠলো ঐশী,”তবে তুমি কেন পিসির দৃষ্টিভঙ্গিকে মর্যাদা দিয়ে তাকে নিজের মতো বাঁচতে বাঁধা দিচ্ছ?”
মেয়ের আর্তি শুনে সবিতাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বড্ড ক্লান্ত লাগছিল এই সকালেও…
জীবকুলের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়াও যে অন্যায়..রাধামাধব যে আরও রুষ্ট হবেন তার এই আচরণে, নিজের সংস্কার অন্য আরেকজনের উপর অন্যায় ভাবে চাপিয়ে দিলে।
“তাছাড়া আমিও তো বিধবা। স্বামী বেঁচে থাকতেও বিধবা…তবে কেন স্বামী মৃত হওয়ার কারণে ঠাকুরঝিকে শেষবয়সে এসেও এত কষ্ট দেবো। এই কুসংস্কার যে অনেককে দূরে ঠেলেছে আমার কাছ থেকে।” আপনমনেই বলে উঠলেন সবিতাদেবী। তারপর মাছভাতের থালাটা ঠাকুরঝির দিকে এগিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন ধীরে ধীরে।
সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতে রাখা মুঠোফোনে সেভড সমীরণবাবুর পরিবারের ফটোটা মুছে দিলো ঐশী।
থাকুক কিছু গোপনে…
ক্রমশ
আগের পর্ব https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=180906573689774&id=114703953643370
সারাদিন ক্লাস চলার কারণে লেখার সময় পাইনি আজ। তাই পর্বটা ছোটো দেওয়ার কারণে দুঃখিত।