#বিধবা_বিবাহ (দ্বিতীয় পর্ব)
“ছি! মানুষ এতটা নিচু হতে পারে!” কলটা ডিসকানেক্ট করামাত্র ঘৃণার অভিব্যক্তি লাভাস্রোতের মতো বেরিয়ে এলো ঐশীর মুখ থেকে। উত্তেজনায় ওর ভরাট ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। মাথার উপরে পূর্ণগতিতে ফ্যানটা ঘুরে চলা সত্ত্বেও পিঠে, হাতের চেটোতে ফুটে উঠেছে ঘামের দানার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা। হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে গিয়েছে পূর্ণগতিতে। তীব্রতা এতটাই বেশি যে, ফ্যানের একটানা একঘেয়ে শব্দ ছাপিয়ে নিজের বুকের ধুকপুকানি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ঐশী।
সমাজে বিধবা মেয়েদের প্রতি অদ্ভুত নাকউঁচু ভাব বিরাজ করে। স্বাভাবিক মানুষের মতো ভালোবাসা না পেয়ে অপরের করুণাকে নিয়ে বাঁচতে হয় তাদের জীবনভর। উপরন্তু সহ্য করতে হয় একদল মানুষের লালসার জ্বালাপোড়া। অপরিচিত স্বল্পপরিচিত মানুষের তরফ থেকে আসা কু-প্রস্তাব সহ্য করে নেওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে।
“কিন্তু যখন নিজের পরিবারের সদস্যই সদ্য বিধবাকে কুপ্রস্তাব দেয় তখন?” আপনমনেই বলে উঠে ঐশী, “অবিনাশ এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর অরিন্দমের উৎপাত আরও বেড়ে গিয়েছে! ভেবেছিলাম ওর বৌদি হওয়ার পর পুরনো কথা ভুলে সম্মান করবে আমাকে। কিন্তু দাদা মারা যাওয়ার পর নিজের আসল রূপ দেখাচ্ছে। কে বলবে ওর এক বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে আছে… ছি!”
“মনি আর কতক্ষণ লাগবে রেডি হতে? এখানেই সাড়ে নয়টা বাজিয়ে দিলি! দশটায় পৌঁছতে পারবি তো?” দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসা পিসির কণ্ঠস্বর শুনে ভাবনার এলোমেলো জালটা ছিঁড়ে ঐশী ফিরে আসে বাস্তবের মাটিতে। তারপর আনসেভড দেওরের নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে মুঠোফোনটা রেখে দেয় বিছানার উপরে।
“আর পাঁচ মিনিট পিসি, মাকে ভাত বাড়তে বলো। এক্ষুনি আসছি আমি।” কথাটুকু বলে ঐশী তড়িঘড়ি এগিয়ে যায় দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পারাখসা আয়নাটার দিকে। এই আয়নাটা ঐশির পিসীমার।
অবিনাশের মৃত্যুর পর বাপের বাড়ি ফিরে আসার সময় বিয়েতে দেওয়া গয়নাগাটি ছাড়া কিছুই আনতে পারিনি ঐশী। তাই খাট, আলমারি, দেরাজ সবকিছুই এখনও পড়ে আছে ওবাড়িতে।
সময়ের ছোপ লাগা, কিন্তু পরিষ্কার তকতকে সেই আয়নার দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল ঐশীর। কান্নাকাটি করার জন্য ওর তীক্ষ্ণ টিকলো নাকে আবেগের লাল ছাপ পড়েছে। চোখদুটোও ফোলা ফোলা লাগছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পাশে রাখা কনসিলার, ফাউন্ডেশনটা টেনে নিল ঐশী। চরাচর মেকআপ করার অভ্যাস না থাকলেও কালশিটে দাগ বা কান্নাভেজা লালচে মুখের আবেগ ঢাকতে এর জুড়ি নেই…তাই অনভ্যস্ত হাতে মেকআপ করতে শুরু করল সে।
“কী সুন্দর লাগছে রে মনি! কতদিন বাদে তোকে এইভাবে দেখলাম। কিন্তু কাজল কই? আর লিপস্টিকটা ঠোঁটে কে বুলোবে?” মেকআপ ছেড়ে বাইরে বের হতেই পিসি বলে উঠলেন ঐশীকে উদ্দেশ্য করে। যেন এতক্ষন ভাইঝির অপেক্ষাতেই বসে ছিলেন তিনি।
“অতসব পরতে ভালো লাগে না আমার, শিগগির খেয়ে বেরিয়ে যাবো আমি, খিদে পেয়েছে ভীষণ।” বলে ঐশী হাঁটা লাগালো ডাইনিং রুমের দিকে…
মন খারাপি ভাবনাগুলো আবার উঁকি মারছে মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারে। বছরতিনেক আগে ঐশীর গায়ে যখন অবিবাহিতদের তকমা আঁটা ছিলো, তখন ওর মাও এমনভাবে মেয়ের প্রতিটি পদক্ষেপে তীক্ষ্ণ নজর রাখতো। ড্রেসআপ, মেকআপ সবকিছুতেই মায়ের অতিরিক্ত খুঁতখুঁত ভাব দেখলে রীতিমতো রেগে যেত তখনকার ঐশী। কিন্তু আজ, বর্তমান সময়ে পিসির ভালোবাসার পরশমাখা কথাগুলো শুনে মায়ের অভাববোধটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল যেন।
কে বলে বাবা, মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কের বন্ধন চিরন্তন থাকে? ইগো নামক সূক্ষ্ম চিড় পড়লে যেকোনো সম্পর্ককাঁচ ভেঙে পড়তে বাধ্য। কোনো কিছুই যে চিরস্থায়ী নয়, তা বলাই বাহুল্য।
মা-বাবার সাথে যদিও ঐশী সম্পর্ক ভেঙে পড়েনি, তবুও অন্যপক্ষের দিক থেকে আসা একটা সূক্ষ্ম কাঁটা মাঝেমাঝেই ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় ওকে। অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারালেও বোধহয় এতটা খারাপ লাগত না ঐশির, কিন্তু যে মানুষটা পরিবারের অন্যান্যদের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার বজায় রাখছে, হাসিখুশি মেজাজে আছে, গল্পগুজব করছে। সেই মানুষটাই যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে নির্দিষ্ট কোনো মানুষের সাথে নির্লিপ্ত ব্যবহার করে… তবে মনখারাপি ভাবনা আসা স্বাভাবিক বৈকি। উপরন্তু সেই মানুষটি যদি নিজের মা হয়, তবে খারাপলাগার নিরাময় ওষুধ রয়ে যায় অধরাই। অস্তিত্বহীন সম্পর্কনামার বোঝা যে বড্ড ভারী হয়, তা বলাই বাহুল্য।
“ঠিক যেমনটা বাপের বাড়ি ফিরে এসে মায়ের কাছে আমার অস্তিত্বটা মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে।” আপন মনেই বলে উঠে ঐশী, তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলে রাখা খাবার থালাটা এগিয়ে নিলো নিজের দিকে। কড়কড়ে করে ভেজে রাখা আলু, সাদা ময়দার দুইখান রুটি, একটা ডিমের পোচ, আর দুটো বেগুন ভাজা উঁকি দিচ্ছে থালাটা থেকে। দৃশ্যটা দেখেই বিরক্তিতে ভ্রূ দুটো কুঁচকে গেলো ঐশীর। বেগুনে ওর জন্ম থেকে অ্যালার্জি। একটুকরো মুখে নিলেই ঠোঁট, মুখ ফুলে যায় বিচ্ছিরিভাবে।
“মা কী ভুলে গেছে বেগুন ভাজা খেলে এলার্জি হয় আমার?” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী। তারপর গলা ছেড়ে মায়ের উদ্দেশে ডেকে ওঠে সে,”আমাকে বেগুন ভাজা দিয়েছো কেন? তুমি কি জানোনা বেগুন খেলে আমার এলার্জি হয়।”
“খাবিনা তো ফেলে দে! সবকিছু আমার মনে রাখা সম্ভব নয়।” ডাইনিং রুমের অন্য প্রান্ত থেকে মায়ের উঁচু গলাটা শুনতে পেয়ে ফের খোলসের মধ্যে ঢুকে গেল ঐশী। চোয়ালটা শক্ত করে পাশে ঢেকে রাখা দাদার খাবারে প্লেটে বেগুন ভাজাটা চালান করে দিতেই ফের ঐশীর মা চিল্লিয়ে ওঠেন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে, “ছুঁয়ে ফেলা খাবার অন্যের পাতে দিয়ে দিলি? সহবতটাও কি ভুলতে বসেছিস? নাকী এখনও বাচ্চাদের মতো শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে আমাকে!”
ততক্ষণে পিসি এসে দাঁড়িয়েছেন ঐশীর পাশে। ভাইঝিকে সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন তিনি,”এতো বকাবকি করার কী আছে.. দুটো বেগুন ভাজাই তো,খেয়ে নিতে পারবে ঠিক।”
“তুমি ওকে আর মাথায় উঠিও না তো! তোমার আশকারাতেই মেয়েটা আমার গোল্লায় গিয়েছে। প্রথম থেকেই যদি শক্ত হাতে রাশ ধরতাম, তবে আজ এই দিন দেখতে হতনা আমাকে!” ফের ঝেঁজিয়ে বলে উঠলেন ঐশীর মা, সুপ্রভাদেবী।
“তোমার কথা শুনেই অবিনাশের সাথে ওর বিয়েটা দিলাম, কিন্তু কী হলো! শেষমেষ বিধবার তকমা জুটেই গেলো মেয়েটার কপালে।”
“আবার সেই ঘুরে ফিরে এক জায়গায় আসতেই হল!” বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে অস্ফুটে বিড়বিড় করে উঠলো ঐশী। “সব ঘটনার সাথে আমার বৈধব্য টেনে না আনলে কি শান্তি হয় না মায়ের!” আপনমনেই বলে উঠল ঐশী।
“পাড়া-প্রতিবেশী কাছে কথাগুলো তো আমাকে শুনতে হয়, তাই না? পই পই করে তখন বলেছিলাম মেয়েটা মাঙ্গলিক, উপরন্তু যোনিকুটে দুষ্ট…বিয়ে করার দরকার নেই ছেলেকে। তখন বললো চার বছরের সম্পর্ক এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি!” এঁটো বাসন মাজতে মাজতে বলে উঠলেন সুপ্রভাদেবী, “চার বছরের প্রেম টেকানোর জন্য সারা জীবনের জন্য হারিয়ে বসলি মানুষটাকে।”
কথার তীর যে ঐশীর দিকেই ঘোরানো, তা বলাই বাহুল্য।
জবাব না দিয়ে রুটির টুকরোটা মুখে পুরে
ঐশী, তারপর একমনে চিবোতে চিবোতে ডুব দিলো স্মৃতির মুকুরে।
ঐশী,অবিনাশ আর অরিন্দম একই কলেজে পড়তো। সমবয়সি হওয়ার সুবাদে অরিন্দম, ঐশী ছিল ব্যাচমেট। আর অবিনাশ ছিলো সিনিয়র।
বস্তুত অরিন্দমের মাধ্যমেই অবিনাশের সাথে আলাপ বাড়ে ঐশীর। কলেজের সিনিয়র হিসেবে দেখা মানুষটি একদিন মনের কথা জানায় ঐশীকে। কাকতালীয় ভাবে তার দুইদিন পরেই অবিনাশের ভাই অরিন্দম প্রপোজ করে ঐশীকে। কিন্তু বন্ধুত্বের বেড়াজাল পেরিয়ে অরিন্দমকে প্রেমিকের জায়গায় বসাতে পারেনি ঐশি।
কলেজের সিনিয়র হওয়ার সুবাদে অবিনাশ চাকরি পেয়ে যায় পাশ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই। জুনিয়র হওয়ার সুবাদে ঐশীর চাকরি পেতে সময় লাগে আরো বছরদুয়েক। তার মধ্যেই কেরিয়ারটা মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছিল অবিনাশ। দুই বাড়িতে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। কিন্তু ঐশীর মা এত সহজে সম্পর্কটাকে বিয়ে অব্দি টেনে আনতে দেননি। সুপুরুষ, সুউপায়ী হলেও নিজের সংস্কারবশত পরিচিত এক জ্যোতিষীর কাছে মেয়ে- ভাবি জামাই দুজনকে নিয়ে গেছিলেন তিনি। সেখানেই দেখা যায় অবিনাশ মাঙ্গলিক দোষে দুষ্ট।
সেইমতো অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে মেয়েকে বলেন বিয়েটা ভেঙে দিতে।
কিন্তু ভেঙে দিতে বললেই কি বিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়? চারবছরের মানসিক শারীরিক আদান-প্রদান ভুলে অন্য কারো সাথে সংসার শুরু করা বাস্তবে খুবই কঠিন। উপরন্তু অবিনাশের সাথে ঐশীর বোঝাপড়া ছিলো অতুলনীয়। তাই মায়ের কথা একপ্রকার অমান্য করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে ঐশী। এবং এই পদক্ষেপে পরিপূর্ণ সমর্থন করেছিলেন বাসন্তীলতাদেবী।
সমস্যার সূত্রপাত শুরু হয় তখনই, মনের ভাব চেপে রেখে ঐশীকে নিজের বৌদি হিসেবে মেনে নিলেও অরিন্দমের কামভাব কমেনি। সরাসরি কিছু না বললেও বৌদির প্রতি জেগে থাকা লোভের দাপট ঐশী টের পেয়েছিল কিছুদিন পরেই। সেইমতো…
“বোন তুই কোথাও বেরোচ্ছিস নাকি?” পাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর কানে আছড়ে পড়তেই ঐশী ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে। তারপর চোখ তুলে তাকালো দাদার থালার দিকে। ঠাণ্ডা বেগুন ভাজাদুটো তখন নিজের কাছে টেনে নিয়েছে ওর দাদা।
“আরে ওটা রেখে দে পাতের পাশে। ঐশী এঁটো করে দিয়েছে বেগুনদুটো।” বলতে না বলতেই সুপ্রভাদেবী এগিয়ে এসেছেন এই দিকে। ছেলের পাতে দুটো গরম গরম বেগুন ভাজা তুলে দিতে দিতে বলে উঠলেন তিনি।
“তো কি হয়েছে! নিজের বোনের এঁটো খেলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে নাকি?” মায়ের কথাটা অগ্রাহ্য করে কৃশানু ততক্ষনে একটা বেগুনভাজা খেয়ে ফেলেছে। দাদার পরিতৃপ্ত হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে ঐশীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো নিমেষেই। চক্রবর্তী বাড়িতে এঁটোকাঁটা নিয়ে বিধিনিষেধ চিরকাল থাকলেও ছেলেবেলাতে কৃশানু বোনের পাত থেকে খাবার তুলে নিত স্বতস্ফূর্তভাবে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে কিছুদিন ভাই বোনের সম্পর্কে চড়াই উতরাই এলেও ফের মসৃণ বাঁধন দেখে ঐশীর মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।
“যাক, কেউ তো আমার নিজের আছে…” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী।
“বোন, তোর সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আলোচনার আছে। বিকেলে ফাঁকা থাকছিস?” খাবারটুকু খেয়ে ঐশী চেয়ার ছেড়ে ওঠার উপক্রম করতেই তড়িঘড়ি বলে উঠল কৃশানু।
“হ্যাঁ, কিন্তু কেন?” টাওয়েলে হাতটা মুছে বলে উঠলো ঐশী।
“একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে আর কিছুই না। তাই সবাই মিলে আলোচনায় বসবো।” খেতে খেতে বলে উঠলো কৃষানু।
“আচ্ছা,” সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে ঐশী পা বাড়ালো বাড়ির বাইরে। এমন সময় বারান্দায় বসে থাকা লোকটাকে দেখে ভ্রূ জোড়া কুঁচকে গেল ওর।
“এই দালালটা আবার এখানে কেন?” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী।
আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই। পরবর্তী পর্বে অরিন্দমের ভূমিকা আরো স্পষ্ট হবে।
ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/165666871880411/