#বিধবা_বিবাহ (তৃতীয় পর্ব )
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কফিশপের এক কোণায় বসে অধৈর্য মত পা নাচাচ্ছে ঐশী। দেওয়ালের এককোণে ঝোলানো ঘড়িতে লেগে থাকা চঞ্চল কাঁটাদুটো জানাচ্ছে সময়টা দশটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। অতনুর কফিশপে আসার কথা ছিল সকাল দশটায়। কিন্তু সময় গড়াতে থাকলেও তার পাত্তা নেই। এদিকে ফোনেও কানেক্ট করা যাচ্ছেনা।
টানা পঞ্চান্ন মিনিট অপেক্ষা করিয়ে রাখলে যে কোনো মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে বাধ্য, ঐশীও তার ব্যতিক্রম নয় মোটেই।
“আর পাঁচ মিনিট দেখবো। কি অসহ্যকর লোক রে বাবা। নির্ঘাৎ বলবে বাস, ট্রেন ঝুলিয়ে দিয়েছে!” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী,”পিসিও এমন একজন ইরেস্পনসিবল লোকের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চাইছিলো!” ওর রাগের পারদ তরতরিয়ে বাড়ছে ততক্ষণে।
“ম্যাডাম অর্ডার?” ওয়েটার এসে হাসিমুখে অভিবাদন জানাতেই মেজাজটা এক্কেবারে সপ্তমে চড়ে গেল এবার। টানা পঞ্চান্ন মিনিট এরা সহ্য করেছে, আর কাহাতক মুখ বুজে থাকবে! এদিকে অফডে হলেও কফিশপে বসার জায়গা নেই।
“একটা চকো চিপস কুকি আর মাশরুম টার্ট,” মেনুকার্ডটা দেখতে দেখতে বলে উঠলো ঐশী।
“একটা করে?” পাশের ফাঁকা সিটের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ওয়েটার।
“হাই! দুটো করে অর্ডার করে দিন, আমি এসে গিয়েছি।” আচমকা পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে থতমত খেয়ে গেলো ঐশী। তারপর ওর জবাবের অপেক্ষা না করে ওয়েটরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,”দুটো কফিও নিয়ে আসবেন। একটায় এক্সট্রা ক্রিম দিয়ে…”
“আপনাকে যেটা আনতে বললাম সেটাই আনবেন, আর ওনার কোন দরকার হলে আলাদাভাবে অর্ডার করে নিতে বলুন।” বলে ঐশী চোখ রাখলো মেনুকার্ডে। ক্রিম দেওয়া কফি ওর ফেভারিট হলেও এই পরিস্থিতিতে অতনুর তালে তাল মিলাতে ইচ্ছে করছেনা একেবারেই। ভাবখানা এমন করছে যেন ঐশীর ভালো খারাপ লাগা সবকিছু জেনে বসে আছে!
“সেকি! আপনিতো ক্রিম কফি খেতে পছন্দ করেন বলেই জানতাম…” কণ্ঠস্বরটা শোনার পর ঐশী সরাসরি চোখ রাখলো অতনুর মুখে। তেলতেলে মুখে চারদিনের না-কামানো দাড়িতে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। অগোছালো ঘেঁটে যাওয়া চুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে দুই তিনটে ফুসকুড়ি।
ছোট দুই চোখে রাত্রি জাগরণের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।
সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফের মেনুকার্ডটা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলো ঐশী। ছোট্ট কপালে কুঁচকে যাওয়া ত্বকের অভিব্যক্তি জানান দিচ্ছে ওর মানসিক উত্তপ্ততার পরিমাপ। প্রত্যুত্তরে কিছু জবাব দেওয়ার ইচ্ছে জাগছেনা মোটেই, তা বলাই বাহুল্য।
“লাল কুর্তিতে দারুন মানিয়েছে আপনাকে।” ইচ্ছাকৃত খানিক উচ্চস্বরে বলে উঠলো অতনু।
“নাহ্, এবার কিছু বলতেই হবে দেখছি!” আপনমনে বলে ঐশী চোখ রাখলো সেদিকে।
“সরি এতটা দেরি করে আসার জন্য, আর আপনার অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য কথাগুলো উঁচুগলায় বললাম।” খানিক ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো অতনু। “নাহলে তো ফিরেই তাকাচ্ছিলেননা আমার দিকে।”
ওর কথা বলার ধরণেই হোক, বা খাবার এসে যাওয়ার কারণে…ঐশীর মুখে খানিক হাসি ফুটলো। সেদিকে তাকিয়ে অতনু বলে উঠলো,”ট্রেন বাসের দোহাই দিয়ে মিথ্যে কথা সাজাবনা। আমারই ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর সেই উবের ভরসা!”
চেনা ছন্দে ব্যতিক্রমী সুরের আলাপ লাগতেই ঐশীর মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। অতনুর সহজাত সততায় মুগ্ধ না হয়ে পারলোনা ও।
“আপনি ফোন করার পরই ঘুম ভাঙে আমার। তারপর তাড়াহুড়োতে রেডি হতে গিয়ে শেভিংও করতে পারিনি।” খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে ওঠে অতনু।”সাধারণত বেলা নয়টা অব্ধি ঘুমানোর অভ্যাস নেই, কিন্তু রাত্রি জাগলে যা হয় আরকি!”
“আর রাত্রি জাগার কারণ?” কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে ওঠে ঐশী।
“প্রায় তিনটে অব্ধি জেগে স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়েছে, উপরন্তু স্কুলের খাতা দেখাও পেন্ডিং ছিলো।” হাসিমুখে বলে ওঠে অতনু,”কিন্তু প্রমিজ করলাম নিজের কারণে অন্যের অসুবিধা ক্রিয়েট করবনা।”
“আপনি স্ক্রিপ্টও লেখেন নাকি!” ভাবি স্বামীর পেশা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও লেখালেখির অভ্যাস অজানাই ছিলো তার।
“কী করবো বলুন, যতদিন না পার্মানেন্ট সুরাহা হচ্ছে ততদিন এইভাবেই চালাতে হবে। পার্টটাইম এমপ্লয়ী হওয়ার হ্যাপা ভীষণ। পেটের জ্বালা মারাত্মক। এর মধ্যেই আবার সিভিল সার্ভিসের জন্যও খাটছি।” অতনুর কথা শুনে বিয়ের কিছুদিন পরের দৃশ্যটা ভেসে ওঠে ঐশির চোখে।
“তুমি এতটা মিথ্যেবাদী অবিনাশ! এতদিন পার্মানেন্ট চাকরির কথা বলে পার্টটাইমে জব করছিলে, আর এখন চাকরিতে মন না টেকায় ফের আমার গহনা দাবি করছো!” বিয়ের পরপরই অবিনাশের চরিত্রের এক বিষম রূপ আবিষ্কার করে ঐশী। শিক্ষিত বনেদি বাড়ির সন্তান হয়েও মিথ্যে কথা জিভের আগায় লেগে থাকতো ওর। এমনকি বিয়ের আগে বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করার কথা বড়াই করে বলতো, যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যে। মনে মনে ভীষন কষ্ট পেলেও নিজের পরিবারের কাছে খবরটা সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছিল ঐশী। মায়ের বাধানিষেধ অমান্য করে অবিবেচকের মতো বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা নিয়ে খেদও জমছিল একটু একটু করে। কিন্তু সমসাময়িক স্ত্রীদের মত গোটা ঘটনাটা দুঃস্বপ্নের মতো ভুলে স্বামীকে সাহায্যের আশায় পড়াশোনা শুরু করেছিল নতুন করে। বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া নিজের গহনাও বন্ধক দিচ্ছিলো একটা একটা করে। কিন্তু চাকরি ছেড়েও ব্যবসায়ে ঠিক উন্নতি করতে পারছিলনা অবিনাশ। পারফেক্ট বিজনেস emvironment, মূলধন থাকলেও লস হয়ে যাচ্ছিল ভীষণভাবে। ঠিক যেমন খোলামকুচি গড়িয়ে যায় হাতের ফাঁক দিয়ে।
“বাব্বাহ, আপনি তো বেশ গুণী মানুষ মশাই! স্কুলে পড়িয়ে এতো সময় পান কীকরে? আমি তো অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই ঘুমে ঢুলে পড়ি।” হাসতে হাসতে বলে উঠলো ঐশী।
“শিক্ষিত এবং বেকার হলে যা হয় আরকি। পায়ের মাটি শক্ত না হলে শেকড় ছড়িয়ে রাখতে হয়, যেমন আমি এদিকে সেদিকে নিজের শেকড় ছড়িয়ে আছি। টিকে থাকতে হবে তো ম্যাডাম!” হাসতে হাসতে বলে ওঠে অতনু,”কেন আমাকে কী বাউন্ডুলে মনে হয়েছিলো আপনার?”
সেই কথা শুনে লজ্জায় চোখটা নামিয়ে নেয় ঐশী।
উল্টোদিকে বসে থাকা মানুষটি একবিন্দু মিথ্যে বলেনি। প্রথম দেখাতেই অবিনাশের সাথে এক দাঁড়িপাল্লাতে মেপে নিয়েছিল। উচ্চতাটা অবিনাশের খানিক কম হলেও এমন অগোছালো বাউন্ডুলে মার্কা চেহারা ছিলনা। ক্লিনশেভড, যত্ন করে ছাঁটা চুলের কলি, ফুসকুড়িবিহীন ত্বকে সুপুরুষ, ঝকঝকে যুবক বলতে যা বোঝায়, অবিনাশ ছিলো ঠিক তাই। উপরন্তু অসাধারণ ড্রেসিং সেন্স, পুরুষালী পারফিউমের মেলবন্ধনে অবিনাশকে তখন চোখে হারাতো ঐশী। বাবার পরে এই যুবকটিই তখন হয়ে উঠেছিল ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ।
“আরে ম্যাডাম কোথায় হারিয়ে গেলেন?” ভরাট পুরুষালী কণ্ঠস্বরে ঐশী ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে। তারপর চোখ তুলে চাইল অতনুর দিকে। অগোছালো, পারিপট্যের অভাবেও এমন সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে সেটা অজানাই ছিল ওর। সজীব প্রাণবন্ত দুই চোখের অতলের হদিশ না পেলেও
সেখানে যে এক স্বচ্ছ, সৎ ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই। অবিনাশের মত প্রবঞ্চক নয় সে, বরং খাঁটি সোনার মত ঔজ্জ্বল্যে পরিপূর্ণ। তারপর অতনুর দিকে তাকিয়ে বলল “আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন…”
“নিজের ভুল ত্রুটিগুলো এমন অবলীলায় স্বীকার করতে পারে কয়জন?” আপনমনে বলে উঠল ঐশী।”কই কখনো তো অবিনাশ এত সহজ ভাবে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রাণভরে ঢেলে দেয় নি আমার কাছে? স্বামী হওয়া সত্ত্বেও সর্বক্ষণ আভিজাত্যের মুখোশের লুকিয়ে রেখেছিল নিজের খানাখন্দকে। কখনো বা লুকিয়ে রেখেছিল নিজের বিষাক্ত চরিত্রকে….”
“যথা আজ্ঞা!” নিজের ধবধবে রুমালটা এগিয়ে দিল ঐশির দিকে এগিয়ে বলে উঠলো অতনু,”আপনার, মানে তোমার মেকআপটা খানিক ঘেঁটে গিয়েছে। বোধ হয় ঘেমে নেয়ে এয়ারকন্ডিশন রুমে এসে বসার কারণেই হয়েছে। একটু ঠিক করে নাও।” উল্টোদিকে বসে থাকা পুরুষটির ব্যতিক্রমী ব্যবহারে ঐশী মহাবিষ্টের মত রুমালটা হাতে নিয়ে মুখে বলে উঠলো,”আমার মেকআপ করার অভ্যাস নেই বললেই চলে… কিন্তু আজ প্রথম দেখার কারণে…”
“ফাস্ট ইম্প্রেশন ইজ দা লাস্ট ইম্প্রেশন তাইতো?” মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল অতনু,”কিন্তু ইমপ্রেস করার জন্য নিজের কমফোর্ট জোন নাইবা ছাড়লেন।” হালকা হেসে বলে উঠলো অতনু,”আর আপনি কি কারনে ডেকেছিলেন সেটা তো বললেন না!”
“হুম,”খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলে উঠল ঐশী… কথাগুলো সাজিয়ে নিতে শুরু করলো নিজের মধ্যে,”তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি একজন বিধবা। বিয়ের এক বছরের মাথাতেই একটা অ্যাক্সিডেন্টে স্বামীকে হারিয়ে ফেলি।”
“আপনার স্বামীকে ব্যবসার কাজে বিয়ের পরপরই চলে যেতে হয় অন্য রাজ্যে। তারপর খানিক লাভের মুখ দেখায় পর হানিমুনে যাওয়ার প্ল্যান করেন আপনারা দুজনে মিলে,” ঐশীর কথা মাঝপথেই বলে ওঠে অতনু, “কিন্তু জার্নির মাঝপথে গাড়ির ব্রেকফেল হয়েছিল। আর ড্রাইভার সমেত গোটা গাড়িটা গিয়ে পড়েছিল খাদে।”
“ঠিক! কিন্তু আপনি এত কিছু জানলেন কি করে?” ঐশীর ছোট্ট কপালে চিন্তার আঁকিবুকি রেখা ফুটে উঠেছে ততক্ষনে।
“যিনি আপনার সম্বন্ধটা আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন, আই মিন আপনার পিসিমা…তিনিই সবকিছু জানিয়েছেন।” ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো অতনু,”আর এটাও জানিয়েছেন খাদের উল্টোদিকে থাকার সুবাদে আপনি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে যেতে পেরেছিলেন। ডানদিকে খাদ থাকায় আপনার স্বামী বা ড্রাইভার কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি বেঁচে ফেরা।”
“ঠিক” অতনুর কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ঐশীর বুক চিরে। সব অবহেলা, বঞ্চনা, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব ভুলতে পারলেও এই দিনটা যে কিছুতেই ভোলা সম্ভব নয়! শুধুমাত্র ঐশীর ইচ্ছেপূরণ করতে একবছর বাদে নিজের টাইট সিডিউল থেকে সময় বার করে অবিনাশ ফিরে এসেছিল বাড়িতে। হানিমুন কনসেপ্টে শ্বশুরবাড়ি খানিক নিমরাজি থাকলেও মোটেই পাত্তা দেয়নি তাদের আপত্তিকে। সেই মতো ঐশীকে নিয়ে সোজা চলে গেছিল পূর্বনির্ধারিত প্ল্যান অনুযায়ী। ব্যবসায় সবেমাত্র সুখের মুখ দেখেছিল লোকটা। সেইমতো ঐশীর ইচ্ছে অনুযায়ী এক্সপেন্সিভ লং ড্রাইভে গিয়েছিল ওরা দুজনে মিলে। বাসে ট্রেনে সময়, খরচ কম লাগলেও বউয়ের শখ পূরণে কোনো কার্পন্য করেনি অবিনাশ। কিন্তু কে জানত অবিনাশের ফার্স্ট লং ড্রাইভটাই লাস্ট লং ড্রাইভ হবে!
সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে দুই প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ-তরুণী যখন প্রাণভরে বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ডুব দিচ্ছে, তখনই দুর্ভাগ্যের করাল ছায়া নেমে আসে তাদের জীবনে। পাহাড়ের কোলে উঠতে গিয়ে ড্রাইভার আবিষ্কার করে গাড়ির ব্রেক কাজ করছেনা, আর তারপরেই…
“আমি যদি সেদিন লং ড্রাইভের জন্য আবদার না করতাম, তবে মানুষটা আজ বেঁচে থাকতো।” আপনমনেই বলে উঠে ঐশী,”কে জানত আমাদের যাত্রাটা অপয়া ছিল। মানুষ যে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়না!”
“ঠিকই শুনেছ তুমি,” মনের ভাবটা গোপন করতে ঐশী চোখ রাখলো মেঝেতে। পটলচেরা চোখে এসে জমা হয়েছে দু ফোঁটা জল।
“আর যেটা আমি শুনিনি?” বলে উঠল অতনু।
“অবিনাশের এক্সিডেন্টের পর নিজের দেওরের কুদৃষ্টি পড়েছে আমার উপর। ও মারা যাওয়ার পর ওবাড়ি ছাড়তে চাইনি আমি, কিন্তু অরিন্দমের হাত থেকে বাঁচতে একপ্রকার পালিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে।” চোয়াল শক্ত করে ভাবি স্বামীর কাছে নিজের অতীত, বর্তমান উগরে দিচ্ছিল ঐশী। এমন সময়ে কফিশপের অন্যপ্রান্তে চোখ রাখতেই বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো ওর।
ব্ল্যাক হোয়াইট কম্বিনেশনের টি শার্ট পরিহিত পেটানো চেহারার এক সুদর্শন যুবক তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
“অরিন্দম” অস্ফুটে বলে ওঠে ঐশী।
————
অতনুর সাথে ডেটিং সেরে ঐশী যখন উত্তর কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে, তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে গেছে। আজ গোটা দিনটা ওর স্মৃতিপটে লেগে আছে জলছবির মত। মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য নিজের জীবন্ত দুঃস্বপ্নের সাথে দেখা হওয়া, তারপর অতনুর হাত ধরে গটগট করে বেরিয়ে যাওয়া। এটুকুই যা ছন্দ বিরতি ঘটেছিল, কিন্তু তারপর কোনরকম অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয়নি ওকে।
“কিরে কেমন লাগলো ওকে? আর খাবারটা টেবিলে দিতে বলবো?”নিজের জন্য ফেনাভাত রাঁধতে রাঁধতে বলে ওঠে ঐশীর পিসি। বিয়ের পরপরই স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবার আচার-ব্যবহারকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন বিনা বাক্যব্যয়ে। সেই মত নিরামিষ খাবার খাওয়া, চুল ছোট করে রাখা, সাদা কাপড় পরা ইত্যাদি সংস্কারকে পালন করতেন সাধ্যমত…
“রোজ রোজ এই সিদ্ধসিদ্ধ খাবারে মন ভরে পিসি?”ভেজা চুলটা মুছতে মুছতে বলে উঠলো ঐশী। কোন জবাব না দিয়ে আগুনের তাপটা কমিয়ে দিলেন বাসন্তীলতাদেবী।
এমনসময় মুঠোফোনটা সশব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই ঐশী চোখ রাখে ডিজিটাল স্ক্রিনে।
“রেড কুর্তি, মুখে মেকাপ! চেনাই তো যাচ্ছিল না আজ তোকে। আবার হেসে হেসে গড়িয়েও পড়ছিলিস!” অচেনা নাম্বারটা যে কার, সেটা বুঝতে বিশেষ অসুবিধে হলোনা ঐশীর। চোয়ালটা শক্ত করে মেসেজ বক্স থেকে ব্লক করতে যাবে, এমন সময়ে ফের আরেকটা টেক্সট দেখে ভ্রূ জোড়া কুঁচকে উঠল ওর।
“নিজের মৃত স্বামীকে নিয়ে খুব বড়াই করতিস তুই, ব্যবসায় সুখের মুখ দেখার পর হঠাৎ এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায় কেঁদে-কেটেও ভাসিয়েছিস। কিন্তু জানিস কী তার স্বরূপ কেমন? কেনই বা তোকে নিয়ে হানিমুনে যেতে চাইছিলো?”
“মানে! কী বলতে চাইছে!” মেসেজটার বিন্দু-বিসর্গ না বুঝতে পেরে আপনমনে বলে উঠলো ঐশী। প্রত্যুত্তরে রিপ্লাই অপশনে প্রেস করতে যাবে এমন সময় চার্জের অভাবে ফোনটা সুইচ অফ হয়ে গেল।
মনের মধ্যে চিন্তাটা জিইয়ে রেখে চার্জার পিন ইনসার্ট করে দিল ঐশী, তারপর চোখ রাখলো বিছানাতে।
“এইটা আবার কে দিলো?” খাটের উপর পড়ে থাকা ভেলভেটের বড় বাক্সটা দেখতে পেয়ে পিসিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ঐশী।
“তোর দাদা দিয়ে গেছে, একটু আগেই।” বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“এই যে সেদিন সাতনরী হার দিল! আবার কি দিয়েছে!” আপনমনেই বলে ঐশী খুলতে শুরু করলো ভেলভেটের বাক্সটা…
জড়োয়ার ঝুমকো আর প্রমাণ সাইজের কান পাশাটা দেখে ওর চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। “এত উপহার! কিন্তু প্রথম বিয়ের গয়না তো এখন আমার কাছেই আছে পিসি…”
“তো কি হয়েছে? প্রথম হোক বা দ্বিতীয় বিয়ে, বিয়ের আবার রকমফের হয় নাকি!” বলতে না বলতেই ঘরে ঢুকে পড়েছে ঐশীর বৌদি। এই মহিলাটাকে সে সহ্য করতে পারেননা একদম। ফর্সা গোলগাল মুখে সবসময় হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও মেলামেশার কিছুদিন পরেই বোঝা যায় এর গাঁটে গাঁটে কালনাগের বিষ। বৈধব্যর পর বাপের বাড়ি ফিরে আসার পর ননদকে নাকাল করার পালা শুরু করে সুচতুর ভাবে। প্রত্যক্ষভাবে কিছু না বললেও আচার-ব্যবহারে সবসময় বুঝিয়ে দিত বাপের বাড়ির চৌকাঠ অনেক উঁচু হয়ে গিয়েছে ঐশির জন্য। মাছের ল্যাজা হোক, বা মুরগির পাজরা, খাবারের আছেদ্দা অংশগুলো অবলীলায় তুলে দিতে ঐশীর পাতে। কিন্তু ভাবখানা এমন করত রান্নার সেরা অংশটা তুলে দিতে চাইছে ঐশির কাছে।
“ঠিকই বলেছ বিয়ের আবার রকমভেদ কি! আমার বোনের বিয়ে যতবারই হোক না কেন! ততোবারই সাজিয়ে গুছিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো আমি…” বলতে না বলতেই ছোট্টঘরে ঐশীর দাদা কৃষানু ঢুকে পড়েছে।” মনি বললিনা তো কেমন লাগছে কানপাশাটা? তোর বৌদি নিজে পছন্দ করে কিনেছে। সবকিছু মিলিয়ে দশভরি সোনা লেগেছে।”
“দশ ভরি!” স্বামীর কথা বাধা দিয়ে বলে উঠলেন লাবনী,”কি যে বলো তুমি! সাতনরি হারেই তো সাতভরি সোনা লেগে গেলো! জড়োয়ার ঝুমকোয় পাঁচ ভরি, তাছাড়া সবকিছু কি টাকার পরিমাপে মাপা যায় না! ভুল কিছু বললাম পিসি?” ননদকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ উচ্চস্বরে বলে উঠলো লাবনী।
হ্যাঁ বাচক ভঙ্গিতে মাথাটা একদিকে হেলিয়ে দিলেও ঐশীর মনের মধ্যে ততক্ষনে জেগে উঠেছে আজকের সকালে দাদা বৌদির কথোপকথন। ভাইফোঁটা দিতে যাওয়ার সময় লাবনী বলছিল সাতনরির হারটা দুই ভরি।”তাহলে সোনার পরিমাণ বাড়িয়ে বলছে কেন!” আপনমনেই বলে উঠে ঐশী। দরজার আড়াল থেকে গহনার আসল পরিমাণ যে শুনে নিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।
“বোন তোর সাথে একটা আলোচনা আছে বুঝলি তো! সকালে যেটা বললাম। একঘন্টার মধ্যে বসার ঘরে চলে আয়।” কৃষানু বলে উঠলো এবার,”আর ডিজাইন পছন্দ না হলে বলিস, তোর বৌদি পাল্টে এনে দেবে…”
আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই।
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/166522311794867/
© সম্প্রীতি রায়
ক্রমশ
আগামী পর্ব কাল