বিধবা বিবাহ’ পর্ব-৯

0
1430

#বিধবা_বিবাহ(নবম পর্ব)
থানা থেকে ঐশী যখন ফিরে এলো, তখন সময়টা সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত্রি নেমে গিয়েছে। গোটা ঘটনার আকস্মিকতায় ওর শরীরটা তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফর্সা দুই গালে কান্নার ছোপ স্পষ্ট ভাবে বোঝা না গেলেও একপ্রকার বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে ওকে। এলোমেলো না আঁচড়ানো চুল, আলুথালু বেশবাসে থাকা ঐশীকে দেখলেই বোঝা যাবে বিশাল বড়ো ঝড় বয়ে গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। অরিন্দমের তরফ থেকে পাঠানো অশ্লীল ক্লিপটা আপাতত মুঠোফোনেই বন্দি। পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের তথা তথ্যপ্রমাণের অংশস্বরূপ ক্লিপসটার কপি জমা দিলেও মনের দুর্ভাবনা যে কাটছেনা ওর, তা বলাই বাহুল্য।
“পুলিশ তো সেরকম ভাবে মাথাই ঘামালোনা! অরিন্দমকে তখনই গ্রেফতার করা উচিত ছিলো। যদি ক্লিপসটা মার্কেটে ছড়িয়ে দেয় তখন?” প্রচণ্ড উদ্বিগ্নতা ঝরে পড়লো ঐশীর গলা বেয়ে। “আমি ভাবতে পারছিনা এমন দাগী অপরাধীকে ওরা ছেড়ে দিচ্ছে!”
“ছেড়ে কই দিলো! অভিযোগ জমা নিলো তো!” ঐশিকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো অতনু। অরিন্দমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে থানা পুলিশ করা থেকে শুরু করে অতনু ভাবি স্ত্রীকে ছাড়তে শোভাবাজারের বাড়ি অব্ধি চলে এসেছে। “তাছাড়া তুমি ভুলে যাচ্ছ, নম্বরটা মোটেই অরিন্দম ভট্টাচার্যের নামে রেজিস্টারড নয়। সেক্ষেত্রে কিভাবে গ্রেফতার করতো ওকে? গোটা কনভারসেশনে অরিন্দম নামটার ছিটেফোঁটা উল্লেখ নেই। এদিকে তোমার কাছে এভিডেন্স বলতে সম্বল ছিলো শুধুমাত্র চ্যাটবক্সটা। ভুয়ো সিম তোলা আজকাল কিন্তু খুবই সহজ।” চিন্তিত মুখে বলে উঠলো অতনু, “আমি ভাবছি ক্লিপটা পেলো কীকরে…তবে রক্ষে এটাই ছবিতে কারোর মুখ বোঝা যাচ্ছেনা।”
সেকথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঐশী। সত্যিই কি নিখুঁত প্ল্যান বটে। ঐশীর সাথে কথোপকথনের সময়ে আনসেভড নম্বরে অরিন্দমের ছবি ডিসপ্লে পিকচারে সাটা থাকলেও কাজ মেটার সাথে সাথে ডিপি তো বটেই, গোটা একাউন্টটাই উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অপরপক্ষ থেকে।
“নেহাত অরিন্দম বুঝতে পারেনি তুমি সিধে ওর বাড়ি চলে যাবে, নাহলে তখনই একাউন্ট ডিলিট করে দিতো” হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলো অতনু,
” নাহলে ওর মাও ফের অবিশ্বাস করে বসতো তোমাকে। প্রচণ্ড শার্প, ক্রিমিনাল মাইন্ডেড লোকটা। মারাত্বক ডেঞ্জারাস!”
অতনুর কথা শুনেও কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো ঐশী।
ওর মাথায় তখন হাজার রকম জটিল চিন্তাভাবনা জট পাকিয়ে উঠছে অবিন্যস্তভাবে। অরিন্দমের শেষ কথাগুলোও ভেসে উঠেছে ক্রমাগত,”এবার বোঝ প্রতিবাদ করার ঠ্যালা। খুব সখ জেগেছিল ঘেউ ঘেউ করতে। ভালোয় ভালোয় বিছানায় এলে মিটে যেত। কিন্তু তুই তো এক্কেবারে আমার দাদার মতো একরোখা জেদীই রোয়ে গেলি। দুটোর পরিণতিই এক হবে!”

“তুমি বাড়ি চলে যাও, আমি বাড়ি পৌঁছে জানিয়ে দেবো।” হাঁটতে হাঁটতে মাঝরাস্তায় থেমে বলে উঠলো ঐশী। এই সময়টুকু ওর একলা থাকা বিশেষ প্রয়োজন।
“যেটা তুমি ভালো বোঝো,” বলে ফিরতি পথ ধরলো অতনু।
বাড়ি ফিরে শাওয়ারের অবিশ্রান্ত ধারায় শরীরটা ছেড়ে দিলো ঐশী। স্বাদু জলের সাথে মিলেমিশে যেতে লাগলো ওর শরীর নিঃসৃত নোনতা তরল। দেওয়ালজোড়া আয়নায় মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে যেন সপে দিতে চাইলো সেই স্রোতে।
খানিকক্ষণ পর নিজেকে খানিকটা সামলে আয়নায় নিজের প্রতবিম্ব এর দিকে নজর দিলো ও। ছাব্বিশটি বসন্ত পার করে ফেলা ভরাট শরীরের ক্লেদ ময়লা ধুয়ে মুছে গিয়েছে জলের তোড়ে। খানিকক্ষণ নিজের বিবস্ত্র সিক্ত শরীরটার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলে উঠলো সে,”দিয়েই দেবো না হয়, কীই বা আছে এই শরীরে। আমি তো কুমারীত্ব খোয়াচ্ছিনা। নিজের সম্মান জনসমক্ষে বাঁচাতে কতজনই তো এই উপায় অবলম্বন করেছে।”
বস্তুত পুলিশ প্রশাসন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা মোটেই সুখদায়ক নয় ঐশীর। অবিনাশের মৃত্যুর পর স্থানীয় আইনরক্ষকেরা কম হেনস্থা করেনি ওকে। এমনকি ইনভেস্টিগেশনের নামে ঐশী অরিন্দমের সাথে শারীরিক সম্পর্কে কতটা তৃপ্ত ছিলো, সেকথা জিজ্ঞেস করতেও আটকায়নি তাদের। ইনভেস্টিগেটরের দলের অনেকাংশের ধারণা ছিল পরকীয়া তথা দাম্পত্য জীবনে অসুখী থাকার কারণেই নিজের স্বামীকে খুন করেছে ঐশী। গাড়ির ব্রেক ফেল হওয়াটা যে নিছক দুর্ঘটনা, সেটাতেও সন্দেহ প্রকাশ করেছে কেউ কেউ। ঐশীর শাশুড়িমাও যে তাদের দলেই ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। সরাসরি মন্তব্য না করলেও ইনভেস্টিগেটরের দলটাকে নিজের সন্দেহ জানিয়ে আসতে দুইমুহূর্ত সময় ব্যয় করেননি তিনি।
“কোন কুক্ষণে যে অবিনাশকে ভালোবেসে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম আমি!” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী। তারপর ভেজা গা মুছে পা রাখে স্নানঘরের বাইরে।
“মনি!” পিসির ভেসে আসা কণ্ঠস্বর শুনতেই চমকে ওঠে ঐশী। যেন এতক্ষন তিনি ভাইঝির অপেক্ষাতেই বসে ছিলেন।
“বলো,” সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে মাথাটা নামিয়ে নিলো ঐশী।
“পুলিশ কি বললো?” কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই সরাসরি প্রসঙ্গে উপস্থিত হয়ে বলে উঠলেন তিনি,”আর কিন্তু পিছিয়ে আসার কোনো রাস্তা নেই। যে করেই হোক বদমাইশটাকে শাস্তি দিতেই হবে!”
“তুমি কীকরে জানতে পারলে!” পিসির কথা শুনে আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী। তারপর মনে পড়ে গেলো গোটা ঘটনায় অতনু ওর সাথে সর্বক্ষণ লেপ্টে ছিলো।
নিমেষে একটা চোরাক্রোধ বয়ে গেলো ঐশীর মানসপটে। গুরুজনস্থানীয় একজন মানুষের সাথে এমন স্পর্শকাতর ব্যাপার আলোচনা করতে মোটেই ইচ্ছে ছিলনা ওর। বরং ক্ষতবিক্ষত মনটা ভেবে চলেছিলো,”এরপর যদি আমাকে পিসিই খারাপ ভাবে! উপরন্তু পিসির মারফতে কথাটা মায়ের কানে গেলে সর্বনাশ হতে আর বাকি নেই। লোকেমুখে কথাটা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে নিজের আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে তখন। রাস্তাঘাটে বেরোতেই পারবোনা লোকজনের আঙ্গুল তোলার হিড়িকে। অতনুর পেটে কি কোনো কথাই পচেনা!”
প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব না দিয়ে ভিজে গামছাটা দড়িতে মেলে দিলো ঐশী। “এর থেকে বরং অরিন্দমের কথা মতো চললে এত বড় বিপদে পড়তাম না আমি!”

“মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জবাব দে।” ভাইঝিকে চুপ দেখে এবার প্রায় চিল্লিয়ে উঠলেন ঐশীর পিসিমা। “নাকি তুই আবার আপোষের পথেই হাঁটতে চাইছিস? ঠিক আগের মতো?”
সেই কথা শুনে চমকে উঠলো ঐশী। কোন জাদুমন্ত্রবলে এই মহিলা মনের ভাব পড়ে নেয় কে জানে!
“ঠিক আগের মত?” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী,”তার মানে কি অতনু পিসিকে সব বলে দিয়েছে! ইনফ্যাক্ট ওবাড়ি থেকে এইবাড়ি চলে আসার কারণটাও!”
লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে চাইছে ও।
“তুই নাকি আমাকে নিজের বেস্টফ্রেন্ড ভাবিস মনি? তবে এত গুরুত্বপূর্ণ কথাটা কোন আক্কেলে আমার থেকে লুকালি?” বাসন্তীলতাদেবী ফের বলে উঠলেন ঐশীকে উদ্দেশ্য করে। “নাকি মনে করিস ওই লম্পটটার সাথে ফের আপোষে জড়াবি?”
পিসির কথা শুনে ঐশী কেঁদে ফেলেছে ততক্ষনে। বহুক্ষণ ব্যাপী আটকে রাখা কান্নার জমাট দলাটা অশ্রু হিসেবে ঝড়ে পড়ছে সর্পিলাকারে।
ভাইঝির এমন ভেঙেপড়া রূপ দেখে বাসন্তিদেবী কাছে টেনে নিয়েছেন ততক্ষনে। ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন তিনি,” আর কত আপোষ করবি মনি? এইবার তো ফোঁস করে ওঠ। মানছি একবার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অরিন্দম নিজের বিষাক্ত রূপটা দেখিয়েছে। কিন্তু তাই বলে তুই হাল ছেড়ে দিবি? কত জায়গা থেকে পালাবি তুই? ওইবাড়ি থেকে ফিরে এসেও কি তোকে ছেড়ে দিলো?”
“কিন্তু আমি কি করবো পিসি! আমি যে আর পারছিনা। একে বিধবা তায় আবার..” ডুকরে কেঁদে ওঠে ঐশী। “এখন মনে হচ্ছে ওর শর্তে রাজি হলে আমার এত বড়ো সর্বনাশ হতনা…”
ভাইঝির কথা শুনে ততক্ষনে চুপ করে গিয়েছেন বাসন্তীলতাদেবী। বোধহয় কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন নিজের মধ্যে। “একসময় বিধবাকে স্বামী মারা যাওয়ার পরপরই সহমরণে বাধ্য করা হতো। তাদের আর্তনাদকে মিশিয়ে দিতো ঢাক ঢোল উৎসবে। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যেত তাদের স্বাধীনতা, স্বপ্ন। তোর অবস্থা কি তাদের থেকেও খারাপ? নাকি স্বেচ্ছায় ভেঙে পড়াটা অভ্যাস?”
পিসির কথা শুনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত তাকিয়ে রইলো ঐশী। সত্যিই তো কতশত বিধবা এর থেকে বেশি কষ্ট ভোগ করে নিজের সম্মান ফিরিয়ে এনেছে।”আর আমি এতো সহজে হাল ছেড়ে দিচ্ছি!”
“মনে রাখিস, ওর শর্তে রাজি হলেও ওর লোভ কমতো না। যে মানুষটা বিয়ের পরও তোর দিকে কুদৃষ্টি দিচ্ছে, সে এত সহজে ছেড়ে দেবে ভাবলি কীকরে! তোর আরো আগে শক্ত হাতে রাশ টানা উচিত ছিলো।” মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“আমি ভাবতে পারিনি অরিন্দমের কাছে আমার এরকম ক্লিপস থাকতে পারে পিসি, আমি তো নতুন জীবন শুরুর আশায় গোটা চ্যাপ্টারটা ভুলতে চাইছিলাম জাস্ট। অতীতের পিছুটান ছেড়ে আগামীর দিকে এগোচ্ছিলাম।” পিসির কথা শুনে ঐশী ততক্ষনে খানিকটা সামলে নিয়েছে নিজেকে।
“ভুল! অতীতকে ফেলে কখনো বর্তমানে বাঁচা যায়না মনি। আমি তোর খাবার নিয়ে আসি এই ঘরে। এমন অবস্থায় দাদা বৌদির সামনে না যাওয়াই ভালো।” বলে বাসন্তীলতাদেবী চলে গেলেন ঘরের বাইরে।
পিসি চলে যাওয়ার পর একরাশ হতাশা ঘিরে ধরলো ওকে। মনটা বড্ড ছট্ফট্ করে উঠছিলো সাথে সাথে, পুলিশের কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে।

“হ্যালো ইন্সপেক্টর! আপনারা অরিন্দমকে অ্যারেস্ট করেছেন?” মরিয়া হয়ে কলটা কানেক্ট হওয়া মাত্র বলে উঠলো ঐশী।
“হি ইজ আউট অফ্ দ্যা টাউন ম্যাডাম, আমাদের ফোর্স আপনার কথামত ওর বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু উনি নিজের বাড়ি ফেরেননি। আমরা আইপি এড্রেস ট্র্যাক করে লোকেশন আক্সেস করার চেষ্টা করছি। আপনি খামোখা টেনশন নেবেন না।” ওপ্রান্ত ক্যাজুয়ালি বলে উঠতেই রাগে হতাশায় নিচের ঠোটটা কামড়ে ধরলো ও।
“কিন্তু নম্বরটা অরিন্দমের নামে রেজিস্টার্ড নয়, তবে পুলিশ ওর বাড়ি ফোর্স পাঠালো কেন…” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী।

ক্রমশ
© সম্প্রীতি রায়
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/172581741188924/
আগামী পর্বে চমক আছে, সঙ্গে থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here