#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০২
#মিদহাদ_আহমদ
নতুন ঘরে বউ হয়ে এসে যখন দেখলাম দরজায় মাতাল হয়ে বসা আমার স্বামী আমার সাথে হওয়া তার বিয়েকে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, ঠিক তখনি আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। আমার দুনিয়া যেনো অন্ধকার হয়ে গেলো মুহূর্তে। বারবার ভেসে উঠছিলো আমার বাবার মুখ। আমার মায়ের জয়ের হাসির মতো হেসে উঠা মুখের ঝলকানি। আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের ভঙ্গুর দিন! দরজা থেকেই ননাস আমাকে টান মেরে ধরে এনে একটা রুমে বসালো। তারপর বললো,
‘শুনো, কোন কথাবার্তা বলার বা বুঝার দরকার তোমার নাই। সবকিছু তো তোমাকে আগেই জানানো হয়েছে। এখন যা হবার তা হবে। যা দেখার তা দেখবো৷ কোন টু শব্দ তুমি করতে পারবে না।’
বাইরে শুনতে পেলাম বাক বিতন্ডতা হচ্ছে আমার স্বামীর সাথে ঘরের লোকজনদের। আমার স্বামী চিৎকার করে বলছে,
‘তোমরা আমার এতো বছরের সম্পর্ককে ভেঙ্গে আমাকে নতুন করে জোর করে বিয়ে করিয়েছো আর আমি তোমাদের সম্পর্ক মেনে নিবো? এইটা আমার জীবন, এইটা আমার চয়েজ৷ আমার চিন্তার উপর কেউ ডোমিনেট করতে এসো না বলে দিলাম। নাহলে এর পরিণাম খুব একটা ভালো হবে না।’
আমি আরও আৎকে উঠলাম এই কথাগুলো শুনে৷ কী বলছে এসব লোকটা! তার আরেকটা সম্পর্ক! অনিচ্ছায় বিয়ে! আমার ছোট মস্তিষ্কের ভেতরে এসবের ঠাই হচ্ছিলো না যেন। কিছুক্ষণের মাথায় আমার ননদ একটা মোবাইল এনে আমার কানে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তোমার বাড়ি থেকে কল এসেছে। কথা বলো ‘
আমি কল ধরলাম। ওপাশ থেকে মা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছিস রে?’
আমি নিজেকে আটকে রেখে জবাব দিলাম শুধু,
‘ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?’
‘ভালো আছি রে মা। সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো সেখানে?’
আমি কোন দ্বিমত না করে আমার মাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বললাম,
‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে মা। কোন চিন্তা করো না তুমি।”
শাশুড়ি আসলেন এমন সময়ে রুমে। আমার কান থেকে মোবাইল টেনে নিয়ে আমার মাকে বললেন,
‘এতো যদি মন উতলা থাকে, তাহলে মেয়ে বিয়ে দেয়ালেন কেন? নিজের ঘরেই রেখে দিতে পারতেন। মেয়ের আসার হলো না আধা ঘন্টা এর মাঝেই জানতে শুরু করে দিয়েছেন কী কেন কোথায়? এসব এখানে করা চলবে না।’
আমি ভয়ে আৎকে উঠলাম তখনি। এসব কী বলছেন আমার শাশুড়ি! তাও এমন কড়া ভাষায় আমার মায়ের সাথে কথা বলছেন!
ননাস আমার রুমে ঢুকলো কিছুক্ষণ পর। আমার সাথে আনা লাগেজ খুলে দেখতে লাগলো আমার সাথে কী কী এনেছি কাপড়চোপড়। দেখতে গিয়ে সে শুরুতেই বললো,
‘এসব সুতি কাপড় এই ঘরে পরবা তুমি? এসব আমাদের চাকরাও পরে না। বুঝেছো?’
তারপর কাকে যেনো ডেকে এনে একে একে আমার লাগেজ থেকে চারটা সুতি শাড়ি বের করে দিয়ে দিলো আমার ননাস। তারপর তাকে বললো,
‘ওগুলা পরে নিস তুই। আর নাহলে কাওকে দিয়ে দিস। তোদের ওখানে তো এসব পরার লোকের অভাব হবে না ‘
সেই মেয়েটা আমার ননাসকে বললো,
‘আরে কী বলেন আফা? আইন্নেগো ঘরে আইজ তিন বৎসর ধইরা কাম করি। এমন বাজে ছাপার শাড়ি তো কখনো দেননাই। এই শাড়ি আমি পরতে পারুম না। আমি তারচেয়ে আমার গেরামে বাইটা দিমুনে।’
আমার ননাস সেই মেয়েটাকে বলল,
‘যা যা। হয়েছে। যাকে ইচ্ছা দিয়ে দিস।’
মেয়েটা রুম থেকে শাড়ি চারটা নিয়ে চলে গেলো। আমার চোখ দিয়ে সেই প্রথম জল আসলো এই বাড়িতে আসার পর৷ আমার মা এই চারটা শাড়ি তার ডিম, সবজি বিক্রি করে জমানো টাকায় কিনেছিলো আমার জন্য। আমি পরবো বলে কিনেছিলো এই শাড়িগুলো। আর আজ! আমার চোখের সামনে আমার মায়ের দেয়া শাড়িগুলো এভাবে!
আমার চোখের ঝাপসা হয়ে আসা জল টপকানোর আগেই ননাস আমার মুখে ধরে বললো,
‘এই শাড়িগুলো এনেছো বাপের বাড়ি থেকে? দেখেছো আমাদের কাজের মেয়েরাও এসব পরে না? এগুলো পরবা? ফকিন্নিমার্কা কাজ এই ঘরে চলবে না নুপুর। আর আমার ভাইর সম্পর্কে তো আগ থেকেই জানো। এখন এই বাহানা টাহানা ধরবা না বলে দিলাম। এই সম্পর্কের জন্য তোর মামা তো পুরোপুরি চার লাখ টাকা নিলো। শেষমেশ দিয়েছে তো! শুধু মুখটাই যা সুন্দর পেয়েছি। আচ্ছা এক কাজ করো নুপুর, সব গহনা খুলে দাও। আমি তুলে রাখি৷ ওসব শুধু পরার জন্য দিয়েছিলাম দুদিনের জন্য৷ আমার মায়ের গহনা আবার নিজের মনে করে বসে থেকো না যেনো!’
আমার ননাস এক এক করে আমার সব গহনা গা থেকে খুলে নিলো। তারপর আলমারি থেকে একটা সবুজ রঙের কাতান শাড়ি বের করে আমাকে পরতে বললো। যাওয়ার সময় চোখ রাঙিয়ে দিয়ে আমাকে বলে গেলো,
‘যে ঘরের মেয়ে, সেই ঘরের হিসাব মতো এখানে সম্মান পাবা। বেশি বাড়াবাড়ি করার কোন কারণ নাই। যেমন যা আছে, যেমন যা চলে, তেমন করেই চলতে হবে তোমাকে। কোন বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কোন অহেতুক চাওয়া যাবে না।’
আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। চোখে ভেঙ্গে জল গড়ালো আমার। আকাশ ফাটিয়ে শুধু শব্দ করতে পারছি না যেনো। আমার সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো, আমি যদি মাটি ফাক করতে পারতাম দুনিয়ার, তাহলে সেই মাটি ফাক করে আমি ঢুকে যেতাম সেখানে। আমার এই বাঁচার সাধ নেই, ইচ্ছা নেই।
শাড়ি বদলিয়ে বসে রইলাম এই রুমে চুপটি মেরে। শাশুড়ির সাথে আরও দুইজন মহিলা আসলেন রুমে। শাশুড়ি পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এই হলো আসিফের বড় খালা, এই হলো আসিফের ছোট খালা। তোমার দুই খালা শাশুড়ি।’
আমি সালাম করলাম পা ধরে। আসিফের বড় খালা যিনি, তিনি আমাকে দেখে বললেন,
‘বউমা তো সুন্দর। এখন মাতাল হওয়া নষ্ট হওয়া ছেলেকে লাইনে আনতে পারলেই হলো।’
আসিফের ছোট খালা বললেন,
‘এই রূপে না জানি কতো ছেলে নাচিয়েছো! এখন আমাদের আসিফকে বশে এনে রাখো দেখি।’
দুজনেই আমার হাতে পাঁচ হাজার, পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা সালামি দিলেন। তারা রুম থেকে বের হতে না হতেই আমার ননদ এসে হাজির রুমে। আমার হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিলো। তারপর বললো,
‘আমি যে নিয়েছি কাওকে বলবা না। বললে তোমার কপালে শনি আছে ভাবি বলে রাখলাম।’
মিনিট বিশেকের মধ্যে আমার শাশুড়ি এলেন রুমে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তার বোনদের দেয়া সালামি কোথায়। আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। সাথে সাথে আমার ননদ রুমে এলো। সে আমার কথা আটকিয়ে বললো,
‘মা আমি নিয়েছি। দুই দুই চার হাজার টাকা। ভাবির কাছেই ছিলো আমি নিয়ে রেখেছি।’
শাশুড়ি মা তার মেয়েকে সায় দিয়ে বললেন,
‘অহ আচ্ছা। ঠিক আছে।’
আমার ননদ তখন আবার বলে বসলো আমার শাশুড়িকে,
‘মা, ভাবির হাতের এই আংটিটা আমার দারুণ লেগেছে। আমি নিয়ে নেই?’
শাশুড়ি আমার হাতের আংটিটা খুলে তার মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন,
‘এইটাও তো আমাদের বাড়ি থেকে দেয়া। তোর বোন হয়তো খুলতে ভুলে গিয়েছে। নে এইটাও তুই রেখে দে।’
রাত এগারোটা নাগাদ আমাকে আমার রুমে দিয়ে আসলো আমার ননদ। বড় রুম। চারদিকে জানালা। জানালার উপর থেকে নিচ বরাবর দামি পর্দা। সবদিকেই যেনো আভিজাত্যপূর্ণ ছাপ দেখা যাচ্ছে। একটা এসি লাগানো রুমে। দেয়ালে সাটানো বড় মতোন একটা ফ্লাট টিভি। কত ইঞ্চি এইটা আমার জানা নেই। একপাশে একটা একুরিয়াম রাখা। আমি খাটের এক কোণে বসে রইলাম। মিনিট দশেকের মাথায় আমার রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো আসিফ। আমার স্বামী। এবার আমি তার দিকে তাকালাম। লম্বা মতোন করে। দেখতে যেনো ঠিক কোন এক রাজপুত্রের মতো। গালে চাপ দাড়ি। ধার নাক, ইষৎ কালো চোখ। পরনে একটা টু কোয়ার্টার প্যান্ট আর গেঞ্জি৷ রুমে ঢুকেই সে একটা সিগারেট ধরালো৷ ইজি চেয়ারে বসলো। পায়ে চুলকাতে চুলকাতে আমার দিকে ইশারা করে বললো,
‘আমি এই বিয়েতে রাজি নই। তার পরও যখন খাওয়ার সুযোগ পরিবার করে দিয়েছে, তখন আর না খেয়ে আমি থাকতে পারছি না। সরি। তার পরও মর্দ মানুষ। বুঝোই তো!’
আমার স্বামী নামক নরপশু আমাকে সেদিন রাতে পাষণ্ড জানোয়ারের মতো ভোগ করলো।
(চলবে)